Alapon

মনু।আলোক মাঝি


শীতের রাত।গভীর কুয়াশায় ঘেরা চারদিক। গাছেরা হীমবুড়ির রূপ ধারন করে চুপ মেরে বসে আছে। ঝিরি ঝিরি হাওয়ায় পাতারা সুণিপুনভাবে সাইরেন বাজাচ্ছে। কি মধুর সুর।কনকনে ঠান্ডায় এ সুর এক স্বর্গীয় আবহ তৈরী করেছে।এ শীতের রাতে মনু বসে আছে গ্রামের দক্ষিণের বিলের পাড়ে।নীল চাদরে শরীর আবরীত করে জলের ঘাপটি মারা রূপ দেখছে সে।

পেছনে অবারীত সবুজ প্রান্তর,সামনে বিশাল জলরাশি,মাথার উপরে পাতাদের সাইরেন।মাঝে মাঝে মাছদের খেলার শব্দ কানে ভেসে আসছে।নিশ্চুপ নিথর সে।হঠাৎ আকাশের দিকে মুখ ফেরালো মনু,কি যেনো দেখে হু হু করে কেঁদে উঠলো সে।

আমি রানা, মনুর বন্ধু।বলতে পারেন সেই ছোটবেলা থেকে একসাথে বড় হয়েছি আমরা।স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ে এক-ই-ব্যাচে ছিলাম।মনুর যখন তিন বছর তখন তাকে একটি এতিমখানা থেকে দত্তক আনেন আমার ছোট চাচা।ছোট চাচার কোন সন্তান ছিলোনা।এরপর থেকে তার নিবাস হয়ে যায় আমাদের বাড়ী।সেই সুবাদে সে আমার যেমন চাচাতো ভাই তেমনি প্রাণের বন্ধুও।
এখন শীতকাল,প্রচুর কুয়াশা পড়েছে ধরনীতে।সমস্ত গ্রাম নিরব,সবাই গভীর ঘুমের রাজ্যে।আমিও ঘুমাচ্ছিলাম।হঠাৎ দেখি সেই সোনার ছেলেবেলা।বয়স সাত কিংবা আট হবে।আমার আর মনুর পরনে ছোটচাচার দেয়া জামা জুতো।আমি মনুকে বললাম আয় লুকোচুরি খেলি?সেও বললো আয়।চোখ বন্ধ করলাম,মনু লুকাচ্ছে।আমার চোখ বন্ধ-ই-আছে।চোখ খুললাম মনুকে খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে।কোথায় মনু?খুঁজে পাচ্ছিনা তো,মনু তুমি কোথায়? মনু?মনু?

টিনের ছালে পাতার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো।কিছুটা ভয় পাচ্ছি,লাইট অন করে এক গ্লাস পানি পান করলাম।আর ঘুম আসছেনা,মনুকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। হাতে টর্চ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

শীতের রাত,কুুয়াশামাখা ঘাসের উপর বসে আছে মনু।সামনে বিশাল জলরাশি,পেছনে অবারীত সবুজ প্রান্তর,মাথার উপর মন পাগল করা পাতাদের গান, দু-চোখে নিশ্চুপ জলধারা এক করুণ আবহ সৃষ্টি করেছে।

রানা ঘর থেকে মনুর ঘরে যেতে প্রায় এক মিনিট সময় লাগে।সামনে পুকুর, আর পুকুরের উত্তর দিকে পারিবারীক কবর স্থান।এখানেই শায়িত করা হয়েছে মনুর বাবা-মা কে।আজ থেকে একমাস পুর্বে মৃত্যু হয়েছে মনুর বাবার।আর তার মা'র মৃত্যু হয়েছে আরো আগে।মনুর ঘরে মনুকে না পেয়ে কবর স্থানের দিকে গেলাম।না,মনু সেখানেও নেই।

তখন প্রায় শেষরাত।মনু প্রতি শেষরাতে তার বাবার কবর যিয়ারত করে।রানা সেখানেই দাড়িয়ে রইলো মনুর খুঁজে।

মনু একদিন তার বাবার পুরনো ড্রয়ারে একটি ডায়েরী পেয়ে পড়তে লাগলো।

১ম পাতায় লেখা___________
আজ আমি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলাম।জীবনের নতুন এ পথচলা যেনো সুখের হয়।

পাতা উল্টাতে লাগলো মনু।আরেক পাতায় লেখা আজ আমার বিবাহের তিন বছর পুর্ণ হলো,কিন্তু তারপরও আমাদের কোন সন্তান হলোনা।

আরেক পাতায় লেখায় আজ দশ বছর পরও আমাদের কোন সন্তান নেই।ভাগ্যে আছে কি না তাও জানা নেই,তবে এবার আমরা আর অপেক্ষা করবোনা।কোথাও থেকে একটি সন্তান নিয়ে আসবো।তাকে ভরণপোষন করবো,মানুষের মতো মানুষ করবো।আমার স্ত্রীও মত দিয়ছে।

যতো পাতা উল্টাচ্ছে ততো পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে মনুর।এভাবে পাতা উল্টাতে উল্টাতে মনু যা দেখলো তাতে হাই ভোল্টেজের শক খেলো সে।বসে পরলো মাটির উপর________________

যে এতিমখানা থেকে মনুকে আনা হয়েছিলো তার সম্পুর্ণ এড্রেস লেখা আছে ডায়রীর ভেতর।শিশুর মতো কাঁদতে লাগলো মনু।একদিন কাউকে না জানিয়ে মনু চলে যায় শহরের সেই এতিম খানায়।সে এতিম খানা আজও বাচ্চাদের কলকোলাহলে মুখরিত।আস্তে আস্তে এগিয়ে চলছে মনু,কিছুই পরিচিত মনে হচ্ছেনা।

অফিসে বসে আছেন মধ্যবয়সী এক নারী।খাতায় কি যেনো লিখছেন।অনুমতি নিয়ে অফিসে ঢুকলো সে।মহিলা বললেন
কে তুমি বাবা
?মনু।
কাউকে খুঁজতে এসেছো?
হ্যা।
বলো?
আচ্ছা ম্যাম আজ থেকে চব্বিশ বছর পুর্বে এখানের দায়িত্বে কে ছিলেন?
ছিলেন একজন,উনার তিন দিন আগে মৃত্যু হয়েছে।আবারো শক খেলো মনু,ভাবতে লাগলো এখন কি হবে?
মনুকে ভাবতে দেখে মহিলা বললেন কি ভাবছো তুমি?
আচ্ছা ম্যাম এখান থেকে যাদের দত্তক নেয়া হয় তাদের লিষ্ট কি আপনারা রাখেন?
হা রাখি।
আজ থেকে চব্বিশ বছর আগের বাচ্চাদের লিষ্ট আপনাদের কাছে আছে?
হা আছে,এখানে প্রথম থেকেই বাচ্চাদের লিষ্ট রাখা আছে।
আচ্ছা আপনি কি আমাকে দেখাবেন ওটা?
তুমি বসো আমি খুঁজছি সেটা।

অনেক খোঁজার পর পাওয়া গেলো সেটা।ঝাঁড়তে ঝাঁড়তে নিয়ে আসছেন উনি।অনেক খুঁজার পর একটি নামে চোখ আটকে গেলো মনুর।সম্পুর্ণ লিষ্টে এই একটি মনু ই আছে,সাথে একটি ছোট্র বায়োডাটা।বায়োডাটায় মনু সম্পর্কে যা লেখা আছেতা দেখে মাথা ঘুরে পরে গেলো সে।মহিলা দারোয়ানকে ডেকে এনে মনুর মুখে পানি দিলেন।ফ্যানের পাশে কিছুক্ষণ বসে চলে আসলো মনু।

শীতের রাত।কুয়াশামাখা ঘাসের উপর বসে আছে মনু।সামনে বিশাল জলরাশি।পেছনে অবারীত সবুজ প্রান্তর।মাথার উপর পাতাদের সাইরেন।মাঝে মাঝে মাছেদের খেলার শব্দ কানে ভেসে আসছে।আর আকাশের দিকে মুখ করে হু হু করে কাঁদছে মনু।

বিঃদ্র:-মনু এতিম খানার লেখা বায়োডাটায় দেখতে পেলো তাকে একটি নর্দমায় পেছানো অবস্থায় পাওয়া যায়।পরে হসপিটাল হয়ে এই এতিমখানায় স্থান হয় তার।ধারনা করা হয় কোন অবৈধ গর্ভাপাত করে কেউ ফেলে দিয়ে যায় শিশুটিকে।


সেরা ব্লগ প্রতিযোগীতা-জুলাই ২০১৮ ইং

পঠিত : ৮৬১ বার

মন্তব্য: ০