Alapon

ভগ্নকন্ঠ

শীতের সকাল,তিব্র শীত পড়ছে। ঘুম থেকে উঠতেই মন চায় না। মনে চায় এই কম্বলের নিচেই সারা দিন শুয়ে থাকি। জানালাটা খুলে দেখি বাহিরে ঘন কুয়াশা।দূর থেকে বড় গাছগুল দানবের মতো দেখাচ্ছে। কি সুন্দর প্রকৃতি।তিব্র শীতে কম্বলের নিচে শুয়ে থাকতে কিযে ভালো লাগে। মাঝে মাঝে মনেহয় সর্গে আছে। ভাবছি আজ বারোটার আগে ঘুম থেকে উঠব না।মনের মতো করে একটা ঘুম দিব আজ। 
হঠাত্ মনে পরলো আজতো টেষ্ট পরিক্ষার রেজাল্ট দিবে। এসএসসি পরিক্ষার চেয়ে টেষ্ট পরিক্ষা ভয়ংকর পাশ না করলে এসএসসি দেওয়া যাবে না। সকাল নয়টা বেজে গেছে দশটায় রেজাল্ট দিবে সবাই বোধহয় চলেও গেছে। আমি দ্রুত ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে রওনা দিলাম। সাইকেলটা নামিয়ে দেখি তার আবার চেইনটা ছেড়া। গতকাল ফেরার পথে চেইনটা ছিড়েছিল। কম্বলের নিচে ঘুমাতে ঘুমাতে তা ভুলে গেছি। হাটতে হাটতেই স্কুলে গেলাম। গিয়ে দেখি সবাই আসছে। সাহসি রাহাতের মুখেও আজ ভীতুর  ছাপ পরেছে । সবাই তো আসছে কিন্ত তন্ময়কে দেখছি না।

তন্ময় আমার বন্ধু। আমাদের ক্লাশের সবচেয়ে মেধাবি এবং সবচেয়ে গরিব এই তন্ময়।  ওর বাবার মোটামুটি টাকা আছে। কিন্তু সে টাকা থেকে একটি টাকাও তন্ময় পায় না।তন্ময়ের অপরাধ সে লেখা-পড়া করে। স্কুলে ওর বেতন নেয়া হয় না। ওর পকেট খরচা ও মানুষের কাজ করে  যোগায়। ওরে আমি আজও দেখিনি পান্তা ভাত ছাড়া অন্য কিছু টিফিন আনতে। ওর ঘরের কাজও সব ও আর ওর মা করে।ওর বাবা সকাল হলে সেই চলে যায় রাত হলে আসে।কোথায় যায় কি করে তার কোন খেজ কেউ জানেনা।কিভাবে সে টাকা উর্জন করে তাও কেউ জানেনা। কেমনেই বা জানবে সে তো এ বিষয় কেওরে কখনও বলে না।তন্ময়ের মা যে তাঁর স্ত্রী এটা দেখলে মনে হয় না মনে হয় সে ঐ ঘরের দাশী।আর তন্ময় সেই দাশীর ছেলে।

আমি রেজাল্ট শুনে দ্রুত তন্ময়ের বাড়ি চলে গেলাম।ওদের বাড়ি যেতেনঅনেক পথ হাটতে হয় প্রায় ৪৫ মিনিট।আমি হাটতে হাটতেই ওদের বাড়ি গেলাম।রাস্তার মাঝে বার বার ভাবনা একটাই আসে ছেলেটা এত পথ কেমন করে হাটে তাও আবার প্রতিদিন দুইবার।কিন্তু আমার হাটতে খুব ভালো লাগছিল।চারদিকে হালকা কুয়াশা।রাস্তার উপর দুরবা ঘাসগুল উপর পড়প থাকা শিশিরে ফোটাগুল হিরার মতো দেখাচ্ছিল।শিশিরের জলে আমার দু'পা ভিজে গেছে।হালকা ঠান্ডা অনুভব করলাম।

এই তিব্র শীতেও আমি ঘামে ভিজে গেছি।শীতপর পোষাকটা খুলে হাতে নিয়েছি।আমি তন্ময়কে ডাকতে ডাকতে ওদের পুকুরে পা ধুইলাম।এতগুলা ডাক দিলাম তন্ময় একটি ডাকেরও সারা দিল না।আমি ওদের ঘরের সামনে গেলাম।ওর মা উঠানে বসে আছে।ওদের বাড়ির পাশের তাল গাছটার দিকে চেয়ে কিযেন ভাবছে ওর মা।হয়তো ছেলেকে নিয়েই ভাবছে আর কাকে নিয়ে ভাববে তাঁর তো শুধু ওই ছেলেটা ছাড়া আর কেও নেই।স্বামি তো আর স্বামি না।

আমি ওদের ঘরে ডুকাল, দেখি তন্ময় পড়ার টেবিলে মাথা নিচু করে বসে আছে।গায়ে একটা ছেড়া জামা পড়নে একটা ছেড়া লুঙ্গি।মাথার চুলগুল এলোমেলো। আমি ওর মাথায় হাত রাখলাম।ও মাথা জাগালো।ওর চোখ জলে ভেজা।আমি বিস্মিত হলাম না তন্ময়ের চোখে জল এটা নতুন কোন বিষয় নয়।এটা প্রায়ই দেখা যায়।ও কোন কথা বলছে না।নিচের দিকে চেয়ে আছে।আর ওর দু'চোখ দিয়ে জল ঝড়ছে কিন্তু কান্নার কোন শব্দ আসছে না। ওর কান্নার শব্দ সেই কবে হাড়িয়ে গেছে।হাসি মুখে কাথা বলার দিনগুল অন্ধকারে ডুবে গেছে।

ওর মা ঘরে আসলো এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো
"কেমন আছো বাবা"(শান্ত কন্ঠে)
"আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো, আপনি কেমন আছেন"?
"আমি কেমন থাকি তা তো তুমি ভালো করেই জানো।আমার নিয়তি এমন কেন হলো?কি অপরাধ যে করেছিলাম"?(দীর্ঘ নিঃশ্বাস)
আমি আর কিছু বললাম না।অনেকক্ষুন দাড়ি থেকে জিজ্ঞেস করলাম "আন্টি তন্ময়ের কি হয়েছে?আজ রেজাল্ট শুনতেও গেলনা,এখন আমার সাথে কোন কাথাও বলছে না"
"কি আর হবে বাবা।সকালে ঘুম থেকে উঠে ও স্কুললর জন্য রওনা দিছিল।কিন্তু ওর বাপ বললো পূর্বপারার জমিতে হালচাষ করতে।ও রাজি হয়নি তাই ওরে পিটাইছে"।

নিঃশব্দে ওর মায়ের চোখ দিয়েও জল পড়তে শুরু করলো।আমি সেদিন আর কিছু বললাম না।বাড়ি ফিরে এসেছি। ওর রেজাল্টের কাথা বলতেও ভুলে গেছি।আমার মনও খারাপ হয়ে গেছে।কাল স্যার জানাবে ফর্মফিলাপে কত টাকা লাগবে।আমার মাথায় আরেকটা ভাবনা ডুকে গেল ফর্মফিলাপের জন্য তো কিছু টাকা দিতেই হবে।কিছু টাকা না কম হলেও ২৫০০-৩০০০।কিন্তু ওর আব্বা তো এক টাকাও দিবে না তাহলে কি তন্ময়ের ফর্মফিলাপ হবে না,তন্ময় কি পরিক্ষা দিতে পারবে না।তন্ময়ের জীবন কি এখানেই থেমে যাবে?

পরের দিন স্কুলে গেলাম।আমার যাইতেবএকটু দেরি হইছিল।তারপর জানলাম ফর্মফিলাপের জন্য ৪০০০ টাকা নির্ধারন করা হয়েছে।আমি শুনে তন্ময়দের বাড়ি গেলাম।গিয়ে দেখি তন্ময় ওর বাড়ির সামনের মাঠে কাজ করছে।আমাকে দেখে ও আমার কাছে আসলো।হাসি মুখে বললো "দোস্ত আমার রেজাল্ট কি"?
আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম তন্ময়ের মুখে হাসি।কতো দিন পর ওর মুখে হাসি দেখেছি আমি নিজেও জানি না।কিন্তু ওর রেজাল্টের সাথে যে আরেকটা খবর আছে সেটা শুনলে তো ওর হাসি মুখটা কালো হয়ে যাবে।কিন্তু করার কি বলতে তো হবেই।
"দোস্ত তুই জিপিএ ৫ পেয়ে প্রথম হইছ"
"ফর্ম ফিলাপের জন্য কতো টাকা ধরা হয়েছে"?
শান্ত কন্ঠে বললাম "৪০০০ টাকা"
যা ভেবেছিলাম তাই হয়েছে।ওর হাসি মাখা মুখটা আবার কালো হয়ে গেল।আবার জানো কত দিনের জন্য হাড়ালাম ওর হাসি মুখ।

আমি আর কিছু বললাম না।তন্ময় আমার কাঁধে হাত রেখে বললো "আমার আর পরিক্ষা দেওয়া সম্ভব হলো না"।ওর মা ওপাশে দাড়ানো।হঠাত্ ওর বাবাও এসে পরলো।ভয়ে আমার কলিজার জল শুকিয়ে মরুভুমি হয়ে গেছে।ওর বাবা মুখ থেকে সিগারেটটা ফেলে বললো-"কি হয়েছে এখানে?শুটিং চলছে নাকি?কাজ-কাম রেখে গল্প করা হচ্ছে।এই ছোকরা ফয়সাল আহমেদ তোমার কি আর কোন কাজ নেই।তুমি গিয়া তোমার লেখা পড়া করো।ও লেখা পড়া করবে না।লেখা পড়ায় খরচ হয় ইনকাম না।ও কাজ করলে আমার ইনকাম হবে।তুমি আর এবাড়ি জ্ঞান দিতে আসবে না"।(উচ্চ স্বরে)

আমি আর কিছু বললাম না।বাড়ি চলে আসলাম।পর দিন স্কুলে গিয়ে স্যারদের সাথে আলোচনা করলাম।তাঁরা বললো ৩০০০ টাকার কম ফর্মফিলাপ করা যাবে না।আমি অনেক বলেছি স্যারকে কিন্তু কোন কাজ হলো না।

আমি অনেক কষ্ট করে ৫০০ টাকা যোগার করছিলাম।পরদিন আবার ওদের বাড়ি গেলাম।গিয়ে দেখি তন্ময় পড়ে।ওর মা বাসায় নেই।আমি বললাম
"আন্টি কই?তাকে দেখছি না যে।"
"সকালে আব্বা যাওয়ার পর মা কোথায় যেন গেল বললো তুই পড় আমি দুপুরে বাড়ি আসবো এক জায়গায় যাই"।
"ওহ্"
আমি আর কথা না বাড়িয়ে টাকাটা তন্ময়কে দিলাম।তন্ময় নিতে চায়নি তবুও জোড় করে দিছি।আব্বা আবার আমাকে এক জায়গায় যেতে বলেছেন।তাই আমি দেড়ি না করে তন্ময়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলাম।

আজ এখনও রোদ উঠে নায়।বাহিরে প্রচুর কুয়াশা।আমি কুয়াশার মধ্যে হাটতে হাটতে ভিজে গেছি।চুলগুল ভিজে এমন হয়েছে যে দেখতে পাকা চুলের মতো লাগে।বেশ ভালোই লাগছিলো কুয়াশার ভিতরে হাটতে।হাটতে হাটতে দেখা হয়েগেল ফয়েজ চাচার সাথে।ফয়েজ চাচার মেয়েও আমাদের সাথে পড়ে।ফয়েজ চাচা শিক্ষিত না হলেও  বাল্যবিবাহ ও শিক্ষা এ দু'টায় খুব সচেতন।চাচা আমাকেনদেখেই বললো-
"বাবা ফয়সাল কেমন আছো?"
"আলহামদুলিল্লাহ্‌ চাচা ভালো, আপনি কেমন আছেন?"
"আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় ভালোই আছি, তো তোমার লেখা পড়া কেমন চলে? আর এদিকে কোথায় গেছিলা?"
"আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো।এই একটু তন্ময়দের বাড়ি গেছিলাম।ওর ব্যাপারে তো জানেনই"।
"আল্লাহ্‌ ওর বাপরে কেন  যে এমন বানালো"
চাচা কথা বলতে বলতে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন। তারপর চলে গেলেন। আমিও আবার হাটতে শুরু করলাম। 

হাটতে হাটতে ভাবতে থাকলাম তন্ময়ের কথা ও কতটা কষ্টে আছে তা কি কেও বুঝতে পারবে। কেমনেই বা বুঝবে এরকম কষ্ট কেও পায়না। সুযোগ থাকতেও লেখা-পড়া করতে পারছেনা তন্ময়। অথচ ওর চেয়ে গরিব ঘরের হাজারো শিশু স্কুলে যাচ্ছে। আমাদের পায়ের তলায় পরা দুরবা ঘাসগুলও এর চেয়ে সুখি। 

আমি হাটতে হাটতে কুয়াশায় ভিজে ক্লান্ত শরিরে পৌছালাম আমার গন্তব্যস্থানে। যেখানে আব্বা আমাকে পাঠিয়েছিল। যে লোকটার কাছে এসেছি তাকে আমি ভালো করে চিনিনা। নাম মফজ্জল মিয়া। আমাদের বাড়ি যায় মাঝে মাঝে আব্বার কাছে। আব্বা বলছে তার নাকি একসাথে ব্যবস্া করে। আমাকে পাঠিয়ে তার কাছ থেকে কিছু টাকা আনার জন্য। লোকটাকে দেখেই আমার যেন কেমন লাগলো। মাথায় চুল নেই, মোটা, গালে হালকা হলকা দাড়ি, চোখ দু'টো বড় বড় লাল রঙের। চোখ দেখে মনে হলো নেশা-টেশা করে। হাতে একটা ব্রেচলেট পরা। মুখে একটা সিগারেট। দেখে আমার কথাই বলতে ইচ্ছে হলো না। 

তবুও করার কিছু নেই টাকা নিতে হলে কথা তো বলতেই হবে। আমি গিয়ে সালাম দিলাম,

'আসসালামুআলাইকুম কাকা'
'ওলাইকুমআসসালাম। তুমি ফরিদের ছেলে না'?
'হ্যা, কাকা'
'কেমন আছো বাবা'?
'আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো কাকা, আপনি কেমন আছেন'?
'ভালা আছি'
'ভালা আছি। তো বাবা কি খবরে আইলা'?
'কাকা আব্বা নাকি টাকার কথা বলছিল'?
'ও হ্যা, তোমার আব্বা আমার কাছে কিছু টাকা পাবে। তো বাবা বাহিরে কেন ঘরের ভিতর চলো'
'না কাকা আমার বাড়ি যেতে হবে'
'দুপুর ১২টা বাজে, এখন দুপরের ভাত না খেয়ে তুমি যেতে পারবে না। আর কোন কথা হবে না। এখন ঘরে উঠো'।

কাকা আমাকে আর কোন কথাই বলতে দিল না। হাত ধরে ঘরে উঠালো। আমি ঘরে উঠলাম। আন্টি এসে আমার পাশে বসলো। আন্টির সাথে বসে অনেকক্ষণ গল্প করলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম 'আন্টি আপনি এখানে রন্না-বান্না করে কে'?
'আমার মেয়ে রিতা, স্কুল ছুটি থাকলে সেদিন রন্না-বান্না ওই করে। এটা ওর শখ'।
'ওহ্, সে কোন ক্লাশে পড়ে'
'ক্লাশ নাইনে পড়ে, খুব ভালো ছাত্রী আমার মেয়ে। ওর পড়া-লেখার জন্য ওর বাপ অনেক কষ্ট করে। ওর বাপের ইচ্ছা ও বড়ো হয়ে অনেক বড়ো ডাক্তার হবে'।

আমি আর কোন কথা বললাম না। চুপ করে বসে রইলাম। ভাবতে লাগলাম তন্ময়ের কথা। ওর কপালটা এমন হলো কেন? সবার বাপ মায়ের ইচ্ছা তাদের সন্তান শিক্ষিত হবে। ওর বাপের ইচ্ছাটা এমন কেন? আমার মনে একটা সন্দেহ জাগল। যে সন্দেহটা জাগছে কেন জানি মনেহলো এ সন্দেহ সত্যে রূপ নিবে। আর সেটা না হলে ওর বাপ এরকম করার কথা না। তন্ময় যখন প্রাথমিক লেভেলে পড়তো তখন তো এরকম ছিল না ওর বাপ। আজ থেকে ওর বাপকে আমার ফলো করতে হবে। এখান থেকে বিকালে গিয়েই কাজ শুরু করতে হবে। সত্যটা আমাকে সামনে নিয়ে আসতে হবে।

খাওয়া-দাওয়া করে কাজ শেষ করে আমি রওনা দিলাম। শীতের বিকেলে মাঠের পাশের রাস্তা দিয়ে হাটতে খুব ভালো লাগে। খেজুর গাছ কাটার টক টক শব্দ। খোলা মাঠে পাখিদের সমাবেশ,  ফসলের মাঝে কৃষক রেখেছে কাকতাড়ুয়া,  অনেক পাখি মাঠে কিচির-মিচির শব্দ করে পোকা খাওয়ার সমাবেশ করছে, মাঠকে তাঁরা যেন বানিয়েছে ভজনালয়। গাছগুল পত্রহীন, প্রকৃতি যেন এক নতুন রূপে সাজিয়েছে।

বাসায় যেতে যেতে রাত হয়েগেল। ক্লান্ত শরির প্রচন্ড এই শীতেও আমি ঘামিয়েগেছি তন্ময়ের বাপের কথা ভেবে। কপন জানি বারবার মনে হয় আমার ভাবনাটাই সত্যি। এটা তো তন্ময়ের মা সহ্য করতে পারবে না। তন্ময়ের বাপ ওর মারে যতই কষ্ট দিক না কেন ওর মা ওর বাপকে খুব ভালোবাসে। আমি মাথায় থেকে চিন্তাটা দূর করার চেষ্টা করলাম। ঘুমাতে হবে অনেক ক্লন্ত লাগছে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে পরলো সাইকেলটার কথা। সাইকেলটা আজ সারতে হবে। খুব সকাল এখনও কুয়াশা কাটেনি। আমি ভাবলাম বাজারে যেতে তো এক-দেড় ঘন্টা হাটতে হবে তো সকাল সকালই যাই। আজ থেকে আবার প্রাইভেট শুরু হবে। আমি সাইকেল নিয়ে হাটতে শুরু করলাম। তখন সকাল ৭টা বাজে। বাজারে যেতে যেতে, ৮টা  বেজে গেছে। কোন দোকান খোলেনি শুধু একটা হোটেল খোলা। আমি হোটেলে গিয়ে নাস্তা করলাম। নাস্তা করার পর ভাবলাম একটু হেটে আসি দোকান খুলতে এখনও অনেক সময়। হাটতে হাটতে প্রায় মিনিট ১৫ হাটলাম। এ রাস্তায় আমি খুব কম এসেছি। এদিকে আসার দরকার পরে না তাই আসি না। আর কিছুক্ষণ হাটার পর দেখি রাস্তার পাশে একটা ঘর। এ সারা রাস্তায় চোখে এই একটা ঘর পরল। আমি আবার বাজারের দিকে রওনা দিলাম। কিছু দূর যাওয়ার পর পিছনে তাকালাম।  দেখালাম ঘুটার ভিতর থেকে একটা লোক বের হচ্ছেন। লোকটা বেশ চেনা-চেনা মনে হলো। আমি রাস্তার এক পাশে চুপ করে দারিয়ে রইলাম। লোকটা কাছে আসাতেই আমি একটু কেঁপে উঠলাম। এ তো তন্ময়ের বাবা। এখানে এতো দূর কি করে সে? যেদিন সে রাতে বাড়ি না যায় সেদিন কি সে এখানেই থাকে? তাহলে আমার ভাবনাই সত্য? কাকা সামনে যাওয়ার পর আমি ঘরটার দিকে গেলাম। ঘরের সামনের দরজা খোলা। একটা মেয়ে খাট থেকে নামতে নামতপ বললো 'মা ও মা বাপজান কি চইলা গ্যাছে'? একজন উত্তর দিল 'হ্যা চলে গেছে, অই টেবিলের উপর তোর জন্য টাকা রেখে গেছে'।

আমি বাজার থেকে সাইকেল ঠিক করে বাড়িতে গেলাম। বিকালে প্রাইভেট শেষ করে তন্ময়দের বাড়ি গেলাম। তন্ময় বাড়ির সামনে বসে আছে। আমি গিয়ে তন্ময়ের পাশে বসলাম। আান্টির কথা জিজ্ঞেস করলাম বললো, সে এই কয়েক দিন ধরে সকালে যায় বিকেলে আসে। তন্ময়ের সাথে কথা বলতে বলতে সন্ধা হয়ে গেল। হঠাত্ কিছু লোক আসলো সাথে একটা ভ্যান। ভ্যানে আন্টিকে শোয়ানো।  একটা লোক বললো, 'সে আমার সাথে ইট ভাঙা মেশিনে কাজ করতো। কয়েকদিন যাবৎ সে জড় নিয়ে কাজ করছে। আজ কাজ শেষে অজ্ঞান হয়ে পরে। এখন জ্ঞান ফিরেছে।' লোকটা কথা শেষ করলো এরপর তন্ময়ের সাথে তিন হাজার টাকা দিল বললো, তার কাজের টাকা। এটাকা দিয়ে নাকি তোমাকে সে পরিক্ষা দেওয়াবে। আমরা আন্টিকে ঘরে নিয়ে শোয়ালাম। একবার ভাবলাম ওর বাপের ব্যাপারটা বলে দেই আবার ভাবলাম থাক তন্ময় আগে পরিক্ষাটা দিক তারপর বলবো। কিছুক্ষণ পর তন্ময়ের বাপ এসে বললো 'তন্ময়ের মা কিছু টাকা দাও টাকা লাগবো'। আন্টি এক কথায় উত্তর দিল 'না, এ টাকা দিয়ে তন্ময় পরিক্ষা দিবে'। আন্টির কথা শেষ হতে না হতেই শুরু হলো মার-ধর অনেক চেষ্টা করেও থামাতে পারিনি। মারার পর কাকা চলে গেল। আমিও কিছু না বলে মাথা নিচু করে নিঃশব্দে চলে আসলাম। রাতে আন্টি অসুস্থ হয়ে পরেছে। প্রচুর জর উঠেছে। শীতে কাপতে কাপতে তন্ময়ের হাত ধরে মধ্যরাতেই  মারা গেলো আন্টি। তন্ময় কাঁদতে পারেনি শুধু চোখের জলে গাল ভিজেছে। নিজের হাতে সে রাতেই মাটি চাপা দিয়ে দেয় মায়ের মরা দেহ। সেই কুয়াশা ভেজা আঁধার রাতেই তন্ময় হারিয়ে গেছে। আর ফিরেনি পরিক্ষাও দেওয়া হয়নি। হয়তো কষ্টকে পাথার চাপা দিয়ে কোন এক রাস্তায় হেটে বেড়াচ্ছে মেধাবি সেই তন্ময়।♦



"সেরা ব্লগ প্রতিযোগিতা জুলাই-১৮"




পঠিত : ১৩৩৫ বার

মন্তব্য: ০