Alapon

আল-বাত্তানীঃ যে মুসলিম বিজ্ঞানী ভুল প্রমাণ করেন টলেমির দেয়া তত্ত্ব

মুহাম্মদ ইবনে জাবির ইবনে সিনান আল রাক্কি আল হারানী আস সাবী আল-বাত্তানী  (আরবি: محمد بن جابر بن سنان البتاني) (ল্যাটিন আল বাতেজনিয়াজ,আল বাতেজনি বা আল বাতেনিয়াজ) (৮৫৮ – ৯২৯) ছিলেন একজন আরব জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ। তিনি অনেকগুলি ত্রিকোণমিতির সম্পর্কেরও উদ্ভাবক। তার রচিত কিতাবুল আয-জিজ থেকে কোপারনিকাস সহ অনেক মধ্যযুগীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা উদ্ধৃতি প্রদান করতেন।

আল বাত্তানীর জীবন সম্পর্কে যতদূর জানা যায় তিনি মেসোপটেমিয়ার উচ্চভূমির অন্তর্গত হাররান নগরীতে জন্মগ্রহন করেন যেটি এখন তুরস্কতে অবস্থিত। তার বাবা ছিলেন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির বিখ্যাত একজন নির্মাতা। তার উপাধি 'আস সাবী' হওয়ায় অনেকে ধারণা করেন যে তার পূর্বপুরুষ সাবেয়িন গোত্রভুক্ত হতে পারে, তবে তার পুরো নাম পড়ে বুঝা যায় তিনি ছিলেন একজন মুসলিম। অনেক পশ্চিমা ঐতিহাসিকদের মতে তার পূর্বপুরুষ ছিল আরব রাজাদের মতই উচ্চবংশের। তিনি উত্তর সিরিয়ায় অন্তর্গত আর-রাক্কা শহরে বসবাস করতেন।

জ্যোতির্বিদ্যায় আল বাত্তানীর সর্বাধিক পরিচিত অর্জন হল সৌরবর্ষ নির্ণয়। আল বাত্তানীই প্রথম নির্ভুল পরিমাপ করে দেখিয়েছিলেন যে, এক সৌর বৎসরে ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৬ মিনিট ২৪ সেকেন্ড হয়। যার সাথে আধুনিক পরিমাপের পার্থক্য মাত্র ২ মিনিট ২২ সেকেন্ড কম।

জ্যোতির্বিজ্ঞানে টলেমির আগের কিছু বৈজ্ঞানিকের ভুলও তিনি সংশোধন করে দেন। সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণ সম্পর্কিত টলেমি যে মতবাদ ব্যক্ত করেছিলেন, আল বাত্তানি তা ভুল প্রমান করে নতুন প্রামাণিক তথ্য প্রদান করেন। নিকোলাস কোপার্নিকাস কর্তৃক আবিষ্কৃত বিভিন্ন পরিমাপের চাইতে আল বাত্তানীর পরিমাপ অনেক বেশী নিখুঁত ছিল।

পণ্ডিতবর আল-বাত্তানী একজন দরবেশতুল্য মানুষ ছিলেন। হারান রাজ্যে তাঁর জন্ম। জন্মেছেন ৮৬৮ খৃষ্টাব্দে। কারও কারও মতে, হারান রাজ্যের বাত্তান নামের এক স্থান তার জন্ম। তাঁর বাবা ছিলেন একজন বিশিষ্টজন। বাত্তানী তাঁর প্ৰাথমিক শিক্ষা নেন তাঁর বাবার কাছে। তার বাবার নাম ছিল জাবির ইবনে সানান আল-বাত্তানী। তিনিও তার সময়ের একজন বড় বিজ্ঞানী ছিলেন। আবু আব্দুল্লাহ রাক্কাতে যান মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণের জন্যে।

ইউফ্রেটিস নদীর তীরে রাক্কা ছিল জ্ঞানার্থীদের জন্যে এক তীর্থস্থান। জ্ঞানান্বেষণে সাগ্রহীরা রাক্কায় যেতেন। এটা ছিল পণ্ডিতদের এক নগরী। জ্ঞানী-গুণী আর প্রাজ্ঞ জনেরা সেখানে বসবাস করতেন। আব্দুল্লাহ নিজের জন্যে সেখানে একটা স্থান করে নিতে সক্ষম হন। তিনি সেখানে একজন সর্বজনগ্রাহ্য পণ্ডিতরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

নবম শতাব্দীর শুরুতে তিনি চলে যান সামারাহতে। সেখানে তিনি বাকি জীবন বসবাস করেন। তিনি বিজ্ঞান ও প্রজ্ঞার বিভিন্ন রাজ্যে প্রবেশ করতে সক্ষম হন। তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ জ্যোতির্বিদ। তখন তাঁর সমতুল্য জ্যোতির্বিদ কেউ ছিলেন না। সেই সাথে তিনি ছিলেন বড় মাপের গণিতবিদ। তিনি একটানা ৪২ বছর এক্ষেত্রে নানা গবেষণা চালিয়ে যান। তিনি গবেষণা চালান গণিত আর জ্যোতির্বিদ্যার নানা শাখায়।

এসব গবেষণার মাধ্যমে তিনি মানব জাতির সামনে অসাধারণ সত্য উদঘাটন করে গেছেন। তিনি টলেমীর অনেক তত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করেন। সূর্য ও পৃথিবীর সর্বোচ্চ অবস্থান সম্পর্কিত টলেমীর একটি তত্ত্ব ভুল প্রমাণ করে আমাদের কাছে তিনি প্রকৃত সত্য উদঘাটন করেন। সঠিকভাবে পরিমাপ করে দেখান, এটা হচ্ছে ১৬ দশমিক ৬৭ ডিগ্রি।

এ আবিষ্কার সূর্যের গতি ও সময়ের সমীকরণে সামান্য পরিবর্তন আনে। কোপারনিকাস সূর্যের ইকুইটারিয়েল গতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু আল-বাত্তানী তা কখনও বিশ্বাস করতেন না। আল-বাত্তানী সূর্যের ও চাঁদের গ্রহণের সময়ের সঠিক পরিমাপ নির্ণয় করেন। তিনি ঋতুর সময়-পরিধিও নির্ণয় করেন। সঠিকভাবে সূর্যের কক্ষপথে পরিভ্রমণ পরিস্থিতি তুলে ধরতে সক্ষম হন। তিনি এর সবচেয়ে কম গড়ও নির্ধারণ করেন।

আল-বাত্তানী সম্পূর্ণভাবে সূৰ্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কিত টলেমীর ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করেন। তিনি উল্লেখ করেন, সূর্যের কৌণিক অবস্থান পরিবর্তনীয়। তিনি বার্ষিক সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্ৰগ্ৰহণ সম্পর্কিত তথ্য আমাদের জানান। আসলে তিনি তৎকালীন সময়ের চন্দ্ৰ-সূৰ্য-গ্ৰহ সম্পর্কিত সকল বৈজ্ঞানিক বিশ্বাসে পরিবর্তন আনেন।

বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেন প্রকৃত সত্য। সত্য ধারণার প্রতিফলন ঘটান। তিনি ১৭৩৯ খৃষ্টাব্দে নতুন চাঁদ দেখার সঠিক পদ্ধতির সূচনা করেন। জ্যোতিষী দানত্রোনে সফলতার সাথে আল-বাত্তানীর পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে গেছেন। গ্লোবোলার ত্রিকোণোমিতির নানা সমস্যার সমাধান দিয়ে গেছেন আল-বাত্তানী।

গণিতের বিষয়েও তিনি ছিলেন একজন অগ্রদূত। তিনি গ্ৰীকদের সিম্ফোনি সিস্টেমের বিনাশ সাধন করেন। এর পরিবর্তে সূচনা করেন বিশুদ্ধ বানান বিদ্যা বা অর্থে গ্রাফি। তাঁর এ পদ্ধতি আরও উন্নততর বলে প্রমাণিত হয়।

আব্দুল্লাহ আল-বাত্তানী জ্যোতির্বিদ্যা ও ত্রিকোণোমিতি বিষয়ে অনেক বই লিখে গেছেন। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত বই হচ্ছে: Geej। এটি লাতিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। রোমের ভ্যাটিকানে এর মূল কপি পাওয়া যায়। রেনেসাঁ-পূর্ব ইউরোপকে তাঁর আবিষ্কার ও ধারণা ব্যাপকভাবে প্রভাবান্বিত করতে পেরেছিল। তাঁর বইগুলো বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। জ্যোতিবির্দ্যা ও ত্ৰিকোণোমিতি সম্পর্কিত তার আবিষ্কার-উদ্ভাবন ছিল শিক্ষণীয়। বিজ্ঞানের এই দু’টি শাখার উন্নয়নে তাঁর অবদান আমাদের জন্যে প্রেরণার উৎস।

পঠিত : ৯৬৪ বার

মন্তব্য: ০