Alapon

বাস স্টপেজ

ভোর ৬ টা নাগাদ উঠে ফ্রেশ হয়ে দৌড়াতে হয়। ঠিক যখনি এর্লাম বাজে, সেই থেকে দৌড়। পড়নে লুঙ্গি আছে কিনা তার খেয়াল কখনো থাকে কখনো থাকে না। প্রথম প্রথম খেয়াল করতাম, পরে ছুটির দিনগুলাতে দেখতাম পাশে শুয়ে থাকা ছোট ভাই কখনো ৮টার আগে উঠতো না।

সেই দৌড় শেষ হয় বাস স্টপে ৬টা ৩৫ এ। বাস আসবে ঠিক ৬টা ৪০ এ। ভাবছেন এই মাঝখানের ৫ মিনিট আমি যাত্রী ছাউনিতে বসে হাঁপাই। মোটেই না।

হাঁপাই আর দেখি, দেখি আর হাঁপাই। দিনের বাকি ১৪৩৫ মিনিট শুধু ভাবি আর ভাবি। ঘুমও মনে হয়  ভাবি, স্বপ্ন দেখি।

বন্ধের দিনগুলা খুবই হতাশার। ওই ৫ মিনিট আর আসে না। আসে না সেদিকার দৌড়। ঘুম ভেঙ্গে যায় রোজকার নিয়মে ভোর ৬টায়। ৬টা ৩৫ এসে যায়, হাঁপানি আর সেই ৫ মিনিট আসে না।

আমি চাই সপ্তাহের সাতটা দিনই স্কুল, কলেজ খোলা থাকুক। কারণ, আমার চোখ যে আঠার মতো লেগে আছে অন্য কারো চোখে। 

পাঁচ মিনিট সেই দুজোড়া চোখের মাঝে আটকে যাই। চশমার মাঝেও বিধাতা কি মায়া দিয়ে রেখেছেন কে জানে। শুধু একটানা তাকিয়ে থাকার ভয়েই আমি তাহার মতো দুজোড়া চোখ লাগাই। কালো দুজোড়া চোখ বসিয়ে দি নাকের ডগায়।কার সাধ্য বোঝার, কার দিকে তাকাই। 

কখনোই ৩০০ সেকেন্ডের একটা সেকেন্ডও অন্যদিকে তাকিয়ে নষ্ট হতো না। সাদা এপ্রোন, পকেটে হাত, তাকিয়ে থাকতো দূরে, বাস আসার অপেক্ষায় তার চোখ।

এভাবে তাকে দেখতে দেখতে মায়া জমে উঠলো মনে। দিনের ওই ৫ মিনিট আমার লাগবেই। সে চলে যেতো ৭টা ৪০ এর বাসে, আমি ঠাঁয় দাড়িয়ে তার বাসের চলে যাওয়া দেখতাম। কখনোই কি সে খেয়াল করেছে আমাকে ? আমার মনে হতো, আমি প্রতিদিন এই স্টপেজ থেকে বাসে উঠি, এটা সে জানুক, তাহলে আমার জীবনটাই হয়ে যেতো ধন্য। আমার হুঁশ ফিরতো নাদিমের গলায় ৭টা ১০ এর বাস থেকে সে প্রতিদিন হাঁক ছাড়তো, কিরে হাবলা বাসে উঠবি না?

একদিন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। আমি ঠিক সময় এসে পৌছালাম স্টপেজে। দেখি সেও আসছে ছাতা মাথায়। বিধাতার কাছে এমন একটি দিনই আশা করেছিলাম। কে জানতো, বৃষ্টির পানি রাস্তায় উঠে টুইটুম্বুর। ভাগ্যিস সেদিন স্টপেজে আমি আর সে ছিলাম, এটাও মনে হয় বিধাতার পক্ষ থেকে আমার জন্য একটা উপহার।

হঠাৎ অনুভব করলাম, সে শীতে কাঁপছে। বৃষ্টিও পড়ছে অঝোরে। আমার মনটাও তার কাঁপুনির সাথে কেঁপে উঠছে। নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলাম না, ব্যাগে ছিলো বন্ধুর জন্মদিনের উপহার একটা শাল। শালা আজকে উপহার না পেলে ঠিকই আমাকে খাওয়াবে না ! যাই হোক, বুক কাঁপছে, কথা বলতে যাবো এই ভয়ে। আজ ভয় টয় নেই, চলেই গেলাম তার সামনে। 

আজকে এলেন কেনো,খুব ঝড় হচ্ছে, রাস্তায় পানিও উঠে গেছে। না এলেই পারতেন। কাঁপছেনও দেখি।

আপনিও তো এলেন । আমি সেদিন বলতে পারি নি, আমি তোমার জন্যই আসি প্রিয়তমা।
বললাম একটা মিথ্যা কথা।  আজকে আমার ফাইনাল এক্সাম, তাই আসতে হলো।

সেও বললো, আমার এক্সাম না থাকলে, কেউ কি ঝড় বাদলে বের হয় ! 

সেটাই, দুজনে একই পথের পথিক। কিছু মনে না করলে, শালটা নিন। কাঁপছেন আপনি।

শাল কি নিবে। দেখি তার মুখে হাসি। সে হাসি একমাত্র বিধাতাই দিতে পারে একজনকে। হাসির কারণ আমি না। পাশ ফিরে দেখি তার বাস চলে এলো।এই হাসি কাকে দিলো  আমাকে নাকি বাসকে! 

উফ, যাক বাঁচা গেলো! গতকাল রাতের প্রিপারেশন বৃথা যাবে ভেবেছিলাম।

আমি শাল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সে ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেলো। এই যে চলে গেলো, বৃষ্টির দিনে। ছাতা ফেলে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কখন ভিজে চুপসে গেলাম, নিজেও জানি না।

বাসের জানালায় গিয়ে, সে বলে, আরে ভিজে গেলেন তো। ছাতা মাথায় দিন। এক চিলতে হাসি উপহার দিয়েছিলাম তাকে। বাস ছেড়ে দিলো..  

ওই দিনই সরকারী চাকুরীর কারণে বাবার চট্টগ্রাম থেকে রংপুর বদলী। মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। কি করবো, করবো, ভাবতে ভাবতে, চলে গেলাম বাস স্টপেজে। একটা কাগজে নিজের নাম আর বাবার মোবাইল নাম্বারটা টাঙ্গিয়ে দিলাম। লিখলাম নিচে তোমার অপেক্ষায়। বাবা ফোন পেয়ে নিশ্চয় ঠেঙ্গাবে !

পরদিন রওনা দিলাম, আমি বাবার পাশের সিটে। মা আর ছোটভাই পিছনে।
একটা কল এলো,কি মশাই কার অপেক্ষায় ! ভাগ্যিস লোকটা আমার নাম বলার আগেই, বাবা ফোন কেটে দিলো। 

নিশ্চিত বুঝে গেলাম, কাগজটি দুষ্টু লোকের পাল্লায় পড়েছে। তাকে আমি হারিয়ে ফেললাম চিরতরে। 

বিধাতা তার সাথে কথা বলার সুযোগ যেহেতু দিলা আরেকটু সুযোগ দিতা, তার নামটাও তো জানা হলো ! নামটা নিয়ে না হয়, আরেকটু বড় হলে, স্বাধীনতা পেলে, তাকে খুঁজে বেড়াতাম সেই বাস স্টপেজ থেকে সারা পৃথিবীর আনাচে কানাচে ! 



" সেরা ব্লগ প্রতিযোগিতা-জুলাই '১৮ "



পঠিত : ৬৮০ বার

মন্তব্য: ০