Alapon

শৈশব

পুকুর পারের জাম গাছটার জাম পেকেছে।জাম পেকে পুরো গাছটার রং বানিয়েছে কালো।সবুজ পাতাগুলো কালো জামে ডেকে গেছে।কি সুন্দর লাগে দেখতে।পুকুর পারে বসে যখম গাছটার দিকে তাকাই তখনই মনেপরে যায় সেই স্মৃতির শৈশব।কত আনন্দের দিন ছিল তখন।এমন সময় আরো বেশি মজার দিন কাটাতাম।গাছে কাঠাল পাকে, জাম পাকে, আম পাকে।শৈশবের এই সময় গাছে গাছেই থাকতাম।গাছের ডাল ভেঙে কতো পড়েছি।হাত-পা দাগে ভরা থাকত তখন।যতই কষ্ট হোক গাছে উঠতামই।গাছে বসে ফল পেরে খেতে অনেক মজা।আর ডাল ভেঙে গাছে বসে বসে জাম খেতে আরো স্বাদ।আলাদা একটা স্বাদ।


স্কুল ছুটি হলেই দৌড় শুরু কে আগে গিয়ে পুকুরপাড়ের ঐ জাম গাছটায় উঠতে পারে।খালি হাতে কেউ উঠত না সবার হাতেই একটা বোতল থাকত।বোতলের মধ্যে থাকত পোড়া মরিচ, সরিষা তৈল, লবণ, চিনি অথবা খেজুরের গুড়।এগুলো বোতলে ডুকিয়ে ঝাকাতে ঝাকাতে দৌড় দিতাম গাছের দিকে।গাছে উঠতে উঠতে সব গুলে এক হয়ে যেতে।প্যান্টের কোন এক পকেটে রাখতাম।তারপর একেবারে পাঁকা দেখে জাম পারতাম।যখন একবতল পরিমাণ জাম পারা হয়ে যেত তখন শক্ত দেখে কোন একটা ডালে বসতাম।যে আগে উঠতে পারতো তার জন্যই শক্ত ডালটা। শক্ত ডালটা ছিল পুকুরের ভিতরে। ডালটার উপরে বসলে মনেহতো পানি আমাকে উপরে  জাগিয়ে রেখেছে।ডালটার উপরে বসে জামগুলো বোতলের ভিতরে ডুকিয়ে ঝাকাতাম। একবার আমি ঝাকাতে ঝাকাতে ডাল থেকে পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম পুকুরে। অকেক্ষুণ ঝাকানোর পর সবুজ বোতলটি হয়ে যেতো কালো। তারপর ডালটার উপর শুয়ে শুয়ে খেতাম। জামের কালো রস খেয়ে মাতালের ভান ধরতাম কখনও। জিহ্বার রং হয়ে যেত নীল। কিযে আনন্দ। জাম খাওয়া শেষ হলে আমরা সবাই গাছ থেকে একত্রে পুকুরে ঝাপ দিতাম। এজনের গায়ের উপর পরতাম আরেকজন। ডুবিয়ে চোখ হলুদ করে ফেকতাম। নীল জিহ্বা আর হলুদ চোখ নিয়ে ঘরে ফিরতাম সবাই। এ সময় প্রায়ই আমাদের জর হতো কিন্তু জর আমাদের ধামাতে পারতো না।

এই জাম আছে আগে উঠা নিয়ে আমার সাথে প্রতিদিন ফয়সালের সাথে ঝগড়া লাগতো। কতো মারা-মারি করতাম ওর সাথে। ও কখনও আমার সাথে পারত না। কিন্তু ওর ছিল প্রচুর বুদ্ধি। পড়া-লেখায়ও বেশ ভালো ছাত্র ছিল ফয়সাল। দেখতেও ছিল অপূর্ব! কিন্তু আজ কোথায় সেই ফয়সাল? জাম গাছটা তো আগের জায়গাই আছে-

সেদিন ছিল মঙ্গলবার আমাদের স্কুল বন্ধ ছিল।কিসের বন্ধ তা ঠিক মনে নেই।আমি একা একা জাম গাছে বসে আছি।জলেু ভিতরে নিজের ছবি দেখছি আর নিজের সাথে খেলা করছি। জল যখন তরঙ্গিত হয় তখন জলের ভিতরের আমিটাও দোলতে শুরু করি। ঢেউ মুখ হয়ে যায় আমার। আমি ওর দিকে হাত বাড়ালে ও আমার দিকে হাত বাড়ায়, আমি হাসলে ও হাসে আমি কাঁদলে ও কাঁদে, আমি গাইলে ও গায়, আমি যা করি তাই ও করে।আমার আমিটাই আমার ভালো বন্ধু। শুধু আমার নয় সবারই। নিজেই নিজের ভালো বন্ধু আর কেও না।

হঠাৎ ফয়সাল এলো। ওর বাপ নাকি ওরে কোথায় যেতে বলছে।ও এসে বললো "বন্ধু চল না একটু আমার সাথে অই রাস্তায় একা হাটতে আমার ভয় লাগে কি জঙ্গল রাস্তাটার দু'পাশ জুড়ে,  তারউপর এখন দুপর একা একা কেমনে যাবো চলনা বন্ধু"। আমি একথায় উত্তর দিলাম "না পারব না আমার সময় নাই তুই যা কিছু হবে না"। ও তারপরও আমাকে অনেকবার বলেছে যেতে আমি যাইনি। জলের ভিতরের আমিকে নিয়ে আমি ব্যস্ত ছিলাম। ও একা একাই চলে গেল খুব রাগ করেছে আমার উপর। আমি দুপুরে গোসল করে ঘরে গেলাম। আজকের গোসলটা তেমন মজার হয়নি একা একা গোসলে মজা বা কেমনেই হবে। ফয়সাল সেই কখন গেল এখনও আসলো না তাই অপেক্ষা না করে একা একাই গোসল করলাম আনদহীন গোসল। ঘরে গিয়ে খেতে বসেছে মা বললো "ফয়সাল কইরে ওরে ওর মা খুজে, ওর বাপ নাকি অই পারায় পাঠাইছিল এখনও ফিরেনি"। আমি বললাম "যেদিকে গেছে আরো দুপুর দেখ গিয়া ভুতে খাইয়া ফালাইছে"। মা আমার সাথে রাগা-রাগি করলো অমঙ্গলে কথা বলেছি তাই। সময় তো অনেক হলো কিন্তু ফয়সাল এখনও আসছে না। ওর বাপ আমারে বললো "চলতো যাইয়া দেইখা আসি কোথায় গেল"। আমি ওর বাপ হাটতে শুরু করলাম। আমার খুব ভয় ভয় লাগছে কি জন্য লাগছে কিছুই বুঝতে পারছি না। হঠাত্ আমার পায়ে একটা খেজুরের কাটা ডুকলো। এক টান মেরে বের করে ফেলেছি। উঠে দেখি ফয়সালের বাপ সামনে নেই সে আমাকে ফেলে দ্রুত হেটে গেছেন। আমি হাটতে শিরু করলাম। অনেকক্ষণ হাটার পর একটা চিৎকারের শব্দ শুনতে পেলাম ক্লান্ত গলার কান্নার চিৎকার। আমি ভয়ে কাপতে শুরু করেছি তবুও সামনে হেটেই যাচ্ছি। হঠাত্ থমকে দারালাম আমার শরির কাপতে কাপতে চোখের জল গাল বেয়ে পড়ছে। আমি কিছু বলতে পারছি না চিৎকার দিয়ে কাঁদতেও পারছি না, চোখের জলও থামাতে পারছিনা। ফয়সালের বাবার কোলে ফয়সালের মৃত লাশ। সাপের কামড়ে মারা গেছে ফয়সাল। খুব চিৎকার করে কাঁদে ইচ্ছে করে। ওর মৃত্যুর জন্য আমি দ্বায়ি আমি যদি ওর সাথে আসতাম তবে বোধহয় এমনটা হতো না। এখন প্রতিদিন আনন্দহীন গোসল করতে হবে, স্কুলে যেতে হবে। এখন আর ফয়সাল আমার সাথে জাম খেতে গাছে উঠবে না ঝগড়াও হবে না। জাম গাছ থেকে আমার গায়ের উপর কেউ ঝাপও দিবে না।চিরদিনের মতো বাশের ছাউনির মাটির ঘরে রেখে এসেছিলাম ফয়সালকে।

আজ থেকে সেই ১০ বছর আগের কথা পুকুর পারে বসলেই মনেপরে।বিশাল সেই  জামগাছটার দিকে তাকালেই ফয়সালের মুখ জলের ভিতরে দেখতে পাই। আজ আর জাম খাওয়া হয় না। এখন আর শৈশব নেই, ফয়সাল নেই।



"সেরা ব্লগ প্রতিযোগিতা জুলাই-১৮"

পঠিত : ২৩১৪ বার

মন্তব্য: ০