Alapon

চাকরিটা যেন সোনার হরিণ!

অধিকাংশ মেয়েদের ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক ভাবেই চাকরীটা প্রয়োজন নয় বরং নিজেকে সাবলম্বী করার উৎস হিসেবে মনে করা হয়। অনার্স পাস করা একটি মেয়ে যখন মনে মনে ভাবে ফার্স্ট ক্লাশ সার্কুলার না পেলে আবেদন করবো না, অনেকেতো ভাবে চাকরী করে কি হবে? সেখানে একটি ছেলের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায় চাকরীর চিন্তায়। ছাব্বিশ বছর ধরে বাবার টাকায় বেড়ে উঠা ছেলেটিকে বাবা মাঝে মাঝেই বুঝিয়ে দেয় "তুমি বড় হয়েছো, বাবার টাকায় আর কতো?"

আদর করে বাজার থেকে দামী খেলনা কিনে আনা বড় ভাইয়ের কথা মাঝে মাঝেই চাবুকের মত শাপাং শাপাং করে বাড়ি দিয়ে পিঠে ঘা বানিয়ে দেয়। ইচ্ছে হয় মরে যাই, ইচ্ছে হয় ঘর দুয়ার ছেরে এক্ষুণি চলে যাই। কিন্তু বেকার যুবক, পেটের ভাবনায় রাগটাও প্রয়োগ করতে পারেনা। যে বয়সে মেয়েরা ঘর সংসার নিয়ে স্বপ্ন দেখে সে বয়সে ছেলেরা সাইফুরস, এমপিথ্রি মুখস্ত করতে ব্যস্ত। নারী এগিয়েছে সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি চাকরীটা তার জীবনে আবশ্যিক নয় ঐচ্ছিক।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভাইকে দেখেছিলাম, যিনি নিজ বিভাগে প্রথম হবার সাথে সাথে অনুষদে তৃতীয় হবার সম্মান কুড়িয়েছেন। ভার্সিটি টিচার হবার স্বপ্ন ছিল। রাজনৈতিক ঝামেলার কারণে তিন তিনবার ভাইবা দিলেও শিক্ষক আর হয়ে উঠতে পারেননি। আবেদন করা সকল জাগায় তিনি ভাইভা দিয়েছেন কিন্তু সোনার হরিণের দেখা পাননি। ভেবেছিলেন, হয়তো রিটেনে ভাল নাম্বার আসে না। পেটের দায়ে প্রাইভেট ফার্মের চাকরীটা ছেড়ে দিয়ে পরিবারের কাছ থেকে এক বছর সময় নিলেন তার খরচ চালানোর। ভালো চাকরী পেলে সুদে আসলে সব টাকা ফিরিয়ে দেবে। সেবার শিল্পমন্ত্রণালয়ে আবেদন করার জন্য ভাই বলেছিলেন, "রোমানা, একটা মডেম ম্যনেজ করে দাও"। মডেম নিয়ে তার বাসায় গেলাম।

সব কিছু পুরণ করে বয়সের ঘরে হিসাব কষে দেখলেন মাত্র একদিন আগে তার ত্রিশ বছর...আমি পাশ থেকে উঠে দাড়ালাম। তাকিয়ে দেখলাম ল্যাপটপের উপর ফোঁটা ফোঁটা পানি। না, ফুটো টিনের চাল দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে নি। হৃদয়ে সাইক্লোন হয়ে ততক্ষণে উনার বুকের পাঁজর হয়তো ভেংগে গেছে। আমি রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম। কিচ্ছুক্ষণ পর শব্দ পেয়ে সবাই দৌড়ে গেলাম। উনি চেয়ার থেকে পড়ে গেছেন। হাসপাতালে নিয়ে জানা গেলো স্ট্রোক করেছেন। সে যাত্রায় উনি বেঁচে গেলেন। কিন্তু হতাশায়, অপমানে, প্রিয়তমার বিয়ে আটকাতে না পেরে দ্বিতীয় স্ট্রোকে আর বাঁচানো যায় নি তাকে।

আচ্ছা, উনার প্রিয়তমাওতো গ্রাজুয়েট ছিলেন। তিনি কি ভাইয়াকে বলতে পারতেননা, "এত ভাবনা কিসের? তোমার ওই ছোটখাটো চাকরীতেই হবে, বাকি যা ঘাটতি তা নাহয় আমিই পুরণ করবো"। ওই ভাইয়ের মৃত্যুর পর সেই মেয়ের দিকে ঘুরেও তাকাইনি দ্বিতীয়বার। দুষ্টুমি করে ডাকা ভাবীকেই একদিন ভ্যম্পায়ার বলে হন হন করে হেটে এসেছি।

শিক্ষার হার বাড়ছে, বাড়ছে সার্টিফিকেট ধারি শিক্ষিতের সংখ্যা। অলিতে গলিতে গড়ে উঠছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কর্মস্থল কেন গড়ে উঠে না?? পাশের হার বাড়ছে কিন্তু বেকারত্বের হার কেন কমছে না?? একজন শিক্ষিত মানুষ যখন চারপাশে অশিক্ষিত মানুষের পেশা নিজ পেশা হিসেবে খুঁজে পায় তখন তার হাত পা অবশ হয়ে যায়। লজ্জায় পরে যায়। অশিক্ষিত ওই মানুষটা ব্যঙ্গ করে বলে "টাকা খুয়াইয়া পইড়া লাভ হইছে কি?? ঠেলাই যদি টানতে হইবো?"

মাঝে মাঝে মনে হয় বড় ভাগ্য গুণে মেয়ে হয়ে জন্মিয়েছি। অপবাদ আছে, বাধা বিপত্তি আছে কিন্তু একটা সংসারের অতগুলো মুখের খাবার যোগানোর চিন্তায় নির্ঘুম রাত নেই। আজকাল আশি ভাগ মেয়েরা অল্প বয়সে স্মার্ট ছেলেকে দেখে প্রেমে পড়লেও মন যখন বলে বিয়ে করো তখন ডেজিগনেশনহীন ওই স্মার্ট ছেলেটা আর তার চোখে স্মার্ট থাকে না। খুব কম মেয়ের মুখ থেকেই বের হয় "দু'জনে মিলে চালিয়ে নিব সুখের সংসার"।

বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাক সকল শিক্ষিত যুবক। দেখা পাক সেই মানুষের যে ডেজিগনেশনের পেছনে নয় ছুটবে মানুষটার পেছনে। পড়ার কোন বিকল্প নাই...প্রেম নিয়ে ভাবার সময় নাই...।

পঠিত : ১০৯৫ বার

মন্তব্য: ০