Alapon

আল-বিরুনীঃ মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ মুসলিম বিজ্ঞানী

আজকের আধুনিক যুগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আমাদের জীবনে যে বিস্ময়কর পরিবর্তনের সূচনা করেছে, তা একদিনে উদ্ভাবন হয়নি। বহু বিজ্ঞানসাধকের বহুবছরের পরিশ্রম ও সাধনার মধ্য দিয়েই আজকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই অবস্থান। মুসলিম বিজ্ঞান সাধকরাও এক্ষেত্রে কারো চেয়ে পিছিয়ে নেই। এরূপ একজন বিজ্ঞান সাধক পারসিক মুসলিম বিজ্ঞানী আবু রায়হান আল-বিরুনী।  

তিনি ছিলেন ইসলামী সভ্যতার গৌরবময় যুগের একজন বিজ্ঞানী। ৭৫০ থেকে ১২৫৮ ঈসায়ী সমকালীন এই সময়ের মুসলিম সভ্যতা শিক্ষা, সংস্কৃতি, বাণিজ্যের পাশাপাশি বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রেও বিশ্বের সকল সভ্যতার উপর প্রাধান্য বিস্তার করেছিল।   

বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণায়ও আল-বিরুনীর প্রভাব অনস্বীকার্য। তথাপি তার গবেষণাকর্ম পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ভাষাতে অনূদিত হওয়ার জন্য বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।

৯৭৩ ঈসায়ীর ৪ঠা সেপ্টেম্বর এই মহামনীষী তৎকালীন খোরাসানের খাওয়ারেজমে জন্মগ্রহণ করেন। ১০৫২ ঈসায়ীতে মৃত্যুর পূর্বমূহুর্ত পর্যন্ত তিনি বিজ্ঞানের সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।

বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানা যায়, আল-বিরুনী ছিলেন মধ্যযুগের অন্যতম সফল বৈজ্ঞানিক। তার বুদ্ধিমত্তা ও বৈপ্লবিক উদ্ভাবন কৌশলের কারণে তিনি ছিলেন সমকালীন বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে কিংবদন্তীতুল্য।  বিজ্ঞানের এমন কোন শাখা নেই, যা তার অবদান থেকে বঞ্চিত হয়েছে। নৃতত্ত্ব থেকে জ্যোর্তিবিজ্ঞান, রসায়ন থেকে সমাজবিজ্ঞান, গণিত থেকে পদার্থবিজ্ঞানের পাশাপাশি দর্শন ও মনোবিজ্ঞানে প্রভৃতি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার অবদান অনস্বীকার্য।

তার নিজের ভাষ্যানুসারে, 

‘আমি সর্বোপ্রথম জ্যামিতির মাধ্যমে আমার সাধনা শুরু করি এবং এরপর অঙ্কশাস্ত্র ও সংখ্যাবিজ্ঞানের দিকে অগ্রসর হই। এর পরবর্তীতে পৃথিবীর গঠন আমার মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং এর মাধ্যমে আমি জ্যোর্তিবিজ্ঞানের জগতে প্রবেশ করি। জ্যোর্তিবিজ্ঞানের জ্ঞানে কেউই সমৃদ্ধ হতে পারেনা যদিনা তার এই চারটি বিষয়ে সম্পূর্ণ জ্ঞান না থাকে।’

ইংরেজ জ্যোর্তিবিজ্ঞানী উইলিয়াম লিলি তার গ্রন্থে উল্লেখ করেন, মধ্যযুগে বিজ্ঞান সাধনায় আল-বিরুনী ছিলেন শ্রেষ্ঠতম প্রতিভা। আল-বিরুনী সম্পর্কে তিনি তার গ্রন্থ ‘কৃশ্চিয়ান এ্যাস্ট্রোলজি’তে তিনি লিখেন

‘তিনি ছিলেন অসাধারণ বিতার্কিক, ‍যিনি বিতর্ক করতেন যথেষ্ট জ্ঞান ও  বিচক্ষণতার নিয়ে উৎকৃষ্টতম শৈলীর ভাষায়। সকল বিষয়ের শিক্ষা ও রহস্য সমাধানে তিনি ছিলেন অক্লান্ত সন্ধানী। নিজের তীক্ষ্ম মেধা ও বুদ্ধিমত্তার জোরে কোন শিক্ষকের সাহায্য ছাড়াই তিনি সক্ষম ছিলেন একটি সম্পূর্ণ অপরিচিত বিষয়ে নিজে নিজে পাঠগ্রহণ করার। তিনি উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন সকল প্রকার জ্ঞান-বিজ্ঞানে পান্ডিত্য অর্জনের জন্য। দেশে বিদেশের অদেখা স্থান ভ্রমণে তিনি ছিলেন প্রকৃতিগতভাবে আগ্রহী। অপরিসীম কল্পনাশক্তির সাথে সাথে তিনি ছিলেন যেকোন অতিপ্রাকৃত জ্ঞানের ব্যাপারে কৌতূহলী। নিজের প্রতিভার সাহায্যে সফল ভবিষ্যদ্বাণী করতে তিনি সক্ষম ছিলেন।’

আল-বিরুনী হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি তার মহাজাগতিক বিভিন্ন তত্ত্ব সম্পর্কে নিজে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে মতপ্রকাশ করেছেন। তিনি ব্যবহারিকভাবে ১০১৯ সালের ৮ই এপ্রিলের সূর্যগ্রহণ এবং একই বছরের ১৭ই সেপ্টেম্বরের চন্দ্রগ্রহণ নিরীক্ষণ করেন এবং তা বর্ণনা করেন।

১০৩১ ঈসায়ীতে তিনি তার জ্যোর্তিবিজ্ঞানের উপর রচিত বিশ্বকোষ কিতাব আল-কানুন আল-মাস’উদী সমাপ্ত করেন। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিকার মতে, বইটির প্রতিটি অধ্যায়ের আলোচনাতেই জ্যোর্তিবিজ্ঞানে আল-বিরুনীর মৌলিক জ্ঞানের চিহ্ন ছিল স্পষ্ট।

স্কটল্যান্ডের সেন্ট অ্যান্ড্রুস বিশ্ববিদ্যালয়েরে অধ্যাপক জন ও’কনের এবং এডমন্ড রবার্টসনের বরাত দিয়ে ম্যাকটিউটর হিস্টরি অব ম্যাথমেটিকাল আর্কাইভে বলা হয়েছে, মাত্র সতেরো বছর বয়সে আল-বিরুনী সূর্যের সর্বোচ্চ উচ্চতা ব্যবহার করে তিনি তার নিজের শহরের অক্ষাংশ নির্ধারণ করেন। ওয়েবসাইটটিতে আরও বলা হয়, তিনি পৃথিবীর ব্যাসার্ধ নির্ণয় করেন ৬,৩৩৯.৬ কিমি। পশ্চিমা বিশ্বে ষোড়শ শতাব্দীর পূর্বে এতো কাছাকাছি হিসাব বের করা সম্ভব হয়নি।  

খনিজবিজ্ঞান সম্পর্কেও আল-বিরুনী ছিলেন প্রখর জ্ঞানের অধিকারী। তিনি প্রায় একশত প্রকার খনিজ পদার্থ, এদের প্রকারভেদ এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করেন।

নৃতত্ত্বের ক্ষেত্রে তিনি তার সমকালীন ভারত ও ভারতীয় সমাজ সম্পর্কে জ্ঞানারোহণ ও আলোচনা করেন। ভারতীয় ইতিহাস, দর্শন, চিকিৎসাবিদ্যা প্রর্ভতি সম্পর্কে আলোচনার মধ্য দিয়ে তিনিই প্রথম ‘ভারততত্ত্ব’ (Indology) সংক্রান্ত আলোচনার জন্ম দেন। তার এই অবদানের মাধ্যমে তিনি প্রথম ‘নৃতত্ত্ববিদ’ হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেন।  

আল-বিরুনী সারাজীবনে বিভিন্ন বিষয়ের উপর ১৪৬টি গ্রন্থ রচনা করেন। এরমধ্যে ৩৫টি জ্যোর্তিবিজ্ঞানের উপর, ৪টি অ্যাস্ট্রোলোব, ২৩টি জ্যোতিষশাস্ত্র, ৫টি কালপঞ্জি, ২টি সময়ের গণনা (time measurement), ৯টি ভূগোল, ১০টি ভূগোলকীয় হিসাব এবং মানচিত্রতত্ত্ব (geodesy and mapping theory), ১৫টি গণিতশাস্ত্র, ২টি প্রযুক্তিবিদ্যা, ২টি চিকিৎসাশাস্ত্র, ১টি আবহাওয়াবিদ্যা, ২টি খনিজবিদ্যা, ৪টি ইতিহাস, ২টি ভারততত্ত্ব, ৩টি ধর্ম ও দর্শন, ১৬টি সাহিত্যকর্ম, ২টি জাদুবিদ্যা এবং অন্যান্য বিভিন্ন বিষয়ের উপর আরও ৯টি গ্রন্থ রচনা করেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিশাল রচনাভান্ডারের মধ্য থেকে মাত্র ২২টি গ্রন্থ কালের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পেয়েছে। বাকী সমস্ত গ্রন্থই হারিয়ে গেছে। ২২টি গ্রন্থের মধ্যে বর্তমানে মাত্র ১৩টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

পঠিত : ১৯১৯ বার

মন্তব্য: ০