Alapon

সুদানের ইসলামপন্থী নেতা হাসান তুরাবি ও তার রাষ্ট্রভাবনা

হাসান তুরাবি। তিনি ছিলেন ইসলামের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন আল্লাহর জমিনে আল্লাহ দ্বীন কায়েম করার জন্য।
১৯৩২ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি সুদানের কাসালা গ্রামে ড. তুরাবি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ব্রিটিশ সরকারের শরীয়াহ আদালতের বিচারক ছিলেন। শিক্ষাজীবন শুরু করেন গ্রামের একটি মাদ্রাসায়। সেখানে তিনি ইসলামী শিক্ষা অর্জনের পর সুদানের রাজধানী খারতুমে আসেন আইন বিষয়ে পড়ার জন্য। সুদানের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ খারতুম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে লন্ডনে যান এবং আইন বিষয়ের উপর উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন।

অতপর প্যারিসে অবস্থিত বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রাচীন সারবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি একই বিষয়ের উপর ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল- ‘উদার নৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জরুরি অবস্থায় ক্ষমতা প্রয়োগ কতটা গ্রহণযোগ্য? এরপর তিনি সুদানে প্রত্যাবর্তন করেন এবং দেশে নেতৃস্থানীয় ইসলামিক আইন বিশারদ হিসেবে সুখ্যাতি লাভ করেন। তিনি কিছুদিন সুদানের খারতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে অধ্যাপনা করেন।

বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী হাসান তুরাবি ছিলেন একাধারে সুদানের ইসলামী রাজনৈতিক রূপকার ও আধ্যাত্মিক নেতা। সুদানের আধুনিক রাজনৈতিক অঙ্গনে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন হাসান তুরাবি। তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে বিভিন্ন সময় কারাবরণও করতে হয়েছে। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত সুদানের এটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন ইসলামী আন্দোলনের এই প্রাণপুরুষ। ১৯৮৯ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সুদানের ন্যাশনাল এসেম্বলির স্পিকার ছিলেন। 

ড. হাসান আল তুরাবি পপুলার কংগ্রেস পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এবং মৃত্যু পর্যন্ত তিনি সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন। ইসলাম প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে বহুবার জেল, জুলুম ও অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। ইসলামের সঠিক সহজ সরল ব্যাখ্যা ও সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যে তিনি প্রচুর কাজ ও লেখালেখি করেছেন। ‘তাফসীর আত-তাওহীদ’ নামে তিনি একটি তাফসীর লিখেছেন। ড. তুরাবি মনে করেন, ইসলামী জ্ঞানের সাথে আধুনিক জ্ঞানের সমন্বয় করা এখন খুবই প্রয়োজন। 

এই মহান নায়ক জাতির কল্যাণে অসংখ্য বই ও প্রবন্ধ লিখেছেন। বিশেষ করে তার লিখনীর মাধ্যমে সুদানের দারিদ্র্যতা, গোত্রীয় সংকীর্ণতা, মাজহাব নিয়ে ঝগড়া ফ্যাসাদের বিষয়গুলোর সমস্যার সমাধান পাওয়া যেত। তার উদার ও আধুনিক সমস্যার সমাধান সুদানের মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করেছে বলেই বিশ্ববাসীর কাছে তার সম্মান ও মর্যাদা আজো আকাশচুম্বী। সুদানের প্রেসিডেন্ট বশিরের সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ১৯৮৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন বশির। 

আদর্শের কারণে বশিরের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কের ছেদ করেন। প্রেসিডেন্ট বশিরের অবৈধ শাসনামলের প্রধান সমালোচক ছিলেন ড. তুরাবি। এই মহানায়ক তিউনিশিয়ার আদলে দেশে একটি রাজনৈতিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলেন। নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগে ২০১০ সালের মে মাসে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ড. তুরাবির দীর্ঘ চল্লিশ বছরের রাজনৈতিক জীবনে আরো বেশ কয়েকবার কারাবন্দী হতে হয়েছিল। 

ইসলামী আন্দোলনের পুরোধা ড. হাসান তুরাবি ব্রিটিশ টেলিভিশন চ্যানেল ফোর এর সিরিজ প্রোগ্রাম ISLAMIC CONVERSATIONS এ ২০১২ সালে এটি প্রচারিত হয়। তার সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ উদ্ধৃত করা প্রয়োজন মনে করছি। 

প্রশ্ন : আপনার ইসলামী রাষ্ট্রে নাগরিকেরা কেমন স্বাধীনতা ভোগ করবে? বিশেষ করে সেক্যুলার জীবনযাপনের ক্ষেত্রে?
হাসান তুরাবি : আমি মনে করি, জীবনের এমন কোনো অংশ নেই যা ধর্মের বাইরে। মানুষ যদি স্রষ্টায় বিশ্বাসী হয়- হোক সে মুসলিম কিংবা খ্রিষ্টান- তাহলে তাকে বিশ্বাস করতে হবে যে, স্রষ্টা সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান। স্রষ্টার ক্ষমতা কেবল গির্জা বা মসজিদে সীমাবদ্ধ? সুতরাং আপনি যদি স্রষ্টাকে বিশ্বাস করতে চান, তাহলে আপনি সম্পূর্ণ স্বাধীন। এতে স্রষ্টার কোনো ক্ষতি নেই। ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয়, ধর্ম হলো সামগ্রিক জীবনব্যবস্থার নাম- হোক সেটা ইহুদী বা খ্রিষ্টান ধর্ম। 

স্রষ্টা আপনার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। আপনি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা বলুন কিংবা রাজনৈতিক ক্ষমতার কথা বলুন- সবকিছুই স্রষ্টাপ্রদত্ত দিকনির্দেশনার আওতাভুক্ত। ক্ষমতা পেয়েছেন বলে আপনি স্বৈরাচারী হয়ে যাবেন, এটা ইসলামের শিক্ষা নয়। জনগণকে ভালোভাবে পরিচালনা করা ইসলামের ইবাদাততুল্য কাজ। আমাদের জীবনের সবকিছু স্রষ্টার কাছে নিবেদন করতে হয়। এটা আসলে ইহুদী ও খ্রিষ্টান ধর্মেরও শিক্ষা। ইসলাম কখনো বলে না যে, এটা কেবল মোহাম্মদ (সা.) এর বার্তা। ইসলাম বলে এটা ইব্রাহিম (আ.), মুসা (আ.), ঈসা (আ.) এবং মোহাম্মদ (সা.) সহ সকল নবী-রাসূলের বার্তা।

প্রশ্ন : সুদানকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করা জরুরি হলো কেন?
হাসান তুরাবি : আমি মনে করি, ইতিহাস থেকে আমরা শিক্ষা পেয়েছি। এ দেশে ছয়টা অস্থিতিশীল সরকার শাসন করেছে। কিন্তু দেশের ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি। সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ, গণতন্ত্র, সামরিক একনায়কতন্ত্র- সকল ব্যবস্থাই এখানে প্রয়োগ করা হয়েছে; কেউ দেশের জন্য কিছুই করতে পারেনি। না পেরেছে গৃহযুদ্ধ নিরসন করতে, না পেরেছে গ্রোত্রীয় সমস্যার সমাধান করতে এবং না হয়েছে দেশের উন্নয়ন। কৃষিতে বিশ্বের অন্যতম সম্ভাবনাময় দেশ হয়েও মানুষকে না খেয়ে থাকতে হয়েছে। এর কারণ হলো, আমাদের পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বণ্টন না হওয়া। এ দেশে কোনো প্রকৃত স্বাধীনতা ছিলো না। গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতা কেবল দুই পরিবারের দুইজন ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত করে রাখা হয়েছিলো। যার ফলে স্বাধীনতার কোনো স্বাদ পাওয়া, সামাজিক শান্তি বা অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল পাওয়া ছিল অসম্ভব ব্যাপার। পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাগুলো আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি। কিন্তু আমরা কিছুই পাইনি। অতএব, ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে- আমাদেরকে আসলে আমাদের প্রকৃত মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যে ফিরে যেতে হবে।

প্রশ্ন : বর্তমান সময়ে ইসলামী রাষ্ট্রগুলো কেন এত কর্তৃত্ব ও সর্বাত্মকবাদী?
হাসান তুরাবি : এরা কেউ আসলে ইসলামিক নয়। তারা বরং সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করছে। যখন কেউ এই ধরনের সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতার ভিত্তিতে শাসন করে, তখন সে পুরোপুরি সর্বাত্মকবাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। এমনকি জাতীয়তাবাদী সরকারও একনায়কতন্ত্র এবং স্বৈরাচারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আসলে তারা কেউই ইসলাম অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করছে না। কেননা, ইসলাম মানে হলো- যে কেউই ক্ষমতায় যাক না কেন, সে আসলে চূড়ান্ত ক্ষমতার মালিক নয়। ফলে সে আল্লাহর কাছে সমস্ত ক্ষমতা সমর্পণ করে। সুতরাং যদি কেউ ক্ষমতায় গিয়ে কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে, তাহলে সেটা মূলত ইসলামী শাসন নয়।

প্রশ্ন : ভবিষ্যতে ইসলামী মূল্যবোধের সাথে সেক্যুলার মূল্যবোধের কোনো দ্বন্দ্ব হবে বলে কি আপনি মনে করেন?
হাসান তুরাবি : হ্যাঁ, কিছু পার্থক্য তো থাকবেই। আমি মনে করি, মানবজাতির মধ্যে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য থাকা উচিত। গণতন্ত্র মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন মত গ্রহণের স্বাধীনতা দেয়। মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে তার মতপ্রকাশ করবে, পরস্পর মতবিনিময় করবে। পশ্চিমারা যেমন তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও অন্যান্য ব্যবস্থাকে একমাত্র স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে বাদবাকি বিশ্বের উপর চাপিয়ে দেয়, আমরা তেমনটা করতে পারি না।

মানবজাতির জন্য এটা মোটেও গণতান্ত্রিক কোনো পদ্ধতি নয়। মুসলিম, ইহুদী, খ্রিষ্টান, পৌত্তলিক নির্বিশেষে সবাইকে তাদের মূল্যবোধ প্রকাশ এবং মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেয়া উচিত। আমরা যে কারো সাথে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ উপায়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত।” সুদানের মাটিতে ইসলামের আলোকে প্রসারিত করার প্রয়াসে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন ড. হাসান তুরাবি। এ মানুষটির বহুবিদ প্রতিভা বিশ্ববাসীকে কেবল অবাক করেই দেয় না, আত্মবিশ্বাসী মানুষকে সামনে চলার পথও বাতলে দেয়। মহান আল্লাহর কাছে করজোর করে মিনতি করছি, তিনি যেন তাকে জান্নাতুল ফেরদাউসের মেহমান বানিয়ে নেন।

পঠিত : ১৭৬৪ বার

মন্তব্য: ০