Alapon

আল-রাজীঃ যাকে বলা হয় মুসলিম 'গ্যালেন'

আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজী আব্বাসীয় শাসনামলের একজন বিখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন। তার যোগ্যতার ফলে তিনি তখন সমগ্র ইসলামী খেলাফতের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসক হিসেবে পরিগণিত ছিলেন। চিকিৎসাশাস্ত্রে  তার মৌলিক অবদানের জন্য তাকে মুসলিম গ্যালেন হিসেবে সম্বোধন করা হয়। কিন্তু তিনি কখনো কল্পনাও হয়তো করেননি, তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করবেন।

৮৪১ ঈসায়ীতে পারস্যের রায়ে (বর্তমান তেহরানের সন্নিকটে) জন্মগ্রহণকারী আল-রাজী তার প্রাথমিক জীবনে সঙ্গীতচর্চা এবং গণিত ও রসায়নের গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। পরবর্তীতে চল্লিশ বছর বয়সে তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণায় মগ্ন হন।  

পাশ্চাত্যে ’রাজেস’ নামে পরিচিত আল-রাজী চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপর প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে বাগদাদের চিকিৎসা বিদ্যালয়ে গমন করেছিলেন। শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি রায়ে ফিরে আসেন এবং এখনকার হাসপতালের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।  

চিকিৎসক হিসেবে তার খ্যাতি শীঘ্রই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে তার খ্যাতিতে বাগদাদের নতুন সরকারী হাসপাতালের পরিচালক হিসেবে তাকে নিয়োগ প্রদান করা হয়। হাসপাতাল নির্মাণের সময় স্থান নির্বাচনের জন্য তিনি একটি অভিনব পদ্ধতি প্রয়োগ করেন।  

হাসপাতাল নির্মাণের জন্য শহরের বিভিন্ন স্থানে তিনি মাংসের খন্ড ঝুলিয়ে রাখেন। কিছুদিন পর এসে তিনি মাংস খন্ডগুলো পরীক্ষা করে যে স্থানের মাংস সবচেয়ে কম নষ্ট হতে দেখেন, সে স্থানেই হাসপাতাল নির্মাণের জন্য সিদ্ধান্ত প্রদান করেন।   

বিভিন্ন বিষয়ের উপর আল-রাজী মোট ২৩৭টি গ্রন্থ রচনা করেন। তার মধ্যে অর্ধেকই চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর রচিত। শিশু চিকিৎসার উপর তার রচিত ‘শিশুদের রোগাবলী’র কারণে অনেকেই তাকে শিশুচিকিৎসার জনক হিসেবে গণ্য  করেন। আল-রাজীই প্রথম ধূলোর কারণে অ্যালার্জির সম্পর্কে আলোচনা করেন। এছাড়া কিডনিতে পাথরের চিকিৎসায় তার রচনাকে কালোত্তীর্ণ রচনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 

চিকিৎসাসেবার অনুশীলনে তিনি উচ্চমান বজায় রাখার উপর গুরুত্ব প্রদান করতেন। চিকিৎসাসেবা প্রদানের সনদ অর্জনের পরেও চিকিৎসকদের চিকিৎসাবিদ্যায় নিয়মিত অধ্যয়ন অব্যাহত রাখার জন্য তিনি জোর দিতেন।  

বাগদাদের হাসপাতালের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর তিনি তার জন্মস্থান রায়ে ফিরে আসেন এবং চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর তার অভিজ্ঞতার আলোকে গ্রন্থ রচনা করতে থাকেন। এছাড়া স্থানীয় হাসপাতালের নবীন চিকিৎসকদের তিনি চিকিৎসা বিদ্যায় প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর তার প্রথম রচনা দশ খন্ডের ‘আলকিতাব আলমানসুরী’। এ গ্রন্থে তিনি মানব শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং মানব শরীরের উপর এর প্রভাব, মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, চর্মরোগ, পরিবেশবিজ্ঞান এবং মানবস্বাস্থ্যের উপর পরিবেশের প্রভাব প্রভৃতি সম্পর্কে আলোচনা করেন।

এছাড়া হাম ও বসন্ত রোগের উপর তিনি প্রথম ‘আল-যুদারী ওয়াল হাসবাহ’ রচনা করেন। এই গ্রন্থেই তিনি প্রথম বসন্ত ও হামের মধ্যকার পার্থক্য তুলে ধরেন। এছাড়া দুইটি রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে তিনি এই গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

এছাড়া পঁচিশ খন্ডের চিকিৎসাকোষ ‘আল-কিতাব আল-হায়ি’ তার সর্বাধিক বিখ্যাত রচনা। আল-রাজী তার সময়কার চিকিৎসাবিদ্যার যাবতীয় সারাংশ এতে সংকলন করেন। তৎকালীন প্রচলিত চিকিৎসাসমূহের পাশাপাশি তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও গবেষণা তিনি এতে সংকলিত করেন।  

তার এই গ্রন্থটি পরবর্তীতে ল্যাটিনে অনূদিত হয়। বর্তমানে এটি ইউরোপের চিকিৎসা বিদ্যালয় সমূহে চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। বিগত উনবিংশ শতাব্দি পর্যন্ত গ্রন্থটির কিছু অংশ ইউরোপের বিভিন্ন চিকিৎসা বিদ্যালয়ের পাঠ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে।   

৯২৬ ঈসায়ীতে এই মহান চিকিৎসাবিজ্ঞানী তার জন্মস্থান রায়ে ইন্তেকাল করেন।

পঠিত : ১১৮০ বার

মন্তব্য: ০