তারিখঃ ১১ আগস্ট, ২০১৮, ১২:৩৮
একটা হারমোনিয়ামের প্রতিটা কর্ড মিলেই যেমন একটা সম্পূর্ণ হারমোনিয়াম
হয়, তেমনি একটা সমাজ এবং পরিবারের সকল সদস্যের অংশগ্রহণেই সেই সমাজ এবং
পরিবার পূর্ণতা পায়। হারমোনিয়ামের কোন একটা কর্ড যদি নিজেকে বেশি
গুরুত্বপূর্ণ অথবা গুরুত্বহীন মনে করে নিজের ইচ্ছামতো বাজতে চায়, তবে
সঙ্গীতের মহান ভবন যাবে ধ্বসে। সুর বলতে এই পৃথিবীতে আর কিছুই বাকী থাকবে
না। তেমনি আদম-হাওয়া পরিবারের কোন সদস্য যদি নিজেকে অর্থহীন অথবা অতি
গুরুত্বপূর্ণ আলাদা কিছু মনে করে নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয় এবং তার মনে
জেগে ওঠা প্রতিটা ইচ্ছার বাস্তবায়নে সচেষ্ট হয়, তখন সে মূলত দুইটি মৌলিক
ভুলের দিকে আগায়-
১। সে নিজেকে অন্যের সাথে সম্পর্কহীন “ব্যাক্তিগত” স্বত্বা মনে করে, (এটা আমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার, এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না)
২।
দ্বিতীয় ধাপে সে নিজকে স্বাধীন, জবাবদিহিবিহীন অবস্থায় দেখতে চায়। (আমার
জীবনের ব্যাপারে আমিই যথেষ্ট, অন্যের কাছে এর কৈফিয়ত দিতে যাবো কেন?)
প্রথম
ধাপে সে মনে করে, "আমি যদি আমার মত করে চলি তবে অন্যের আর ক্ষতি কি? একটু
নিয়ম ভাংলে এমন কি মহাপ্রলয় হয়ে যাবে? আর কোন প্রলয় যদি হবার থাকেই তবে তা
আমার হবে, অন্যের কোন ক্ষতি না হলেই হল"। কিন্তু তার এই সিদ্ধান্তের ফল যে
অন্যকেই বেশি ভোগ করতে হয় সে তা বুঝতে পারে না অথবা বুঝতে চায় না।
এই
পৃথিবীর প্রতিটি উপাদান একে অপরের উপর প্রভাব বিস্তার করে। একটি উপাদানের
কৃতকর্মের প্রভাব অন্য একটি উপাদানের উপর পড়ে। একটির ভারসাম্য নষ্ট হওয়া
মানে অন্যের ভারসাম্যে আঘাত করা। যার কারণে, এই পৃথিবীর এবং পৃথিবীর বাইরের
সকল উপাদানকে কঠিন শৃঙ্খলার বশ করা হয়েছে। তাই এই সৃষ্টি জগতে একটা
ভারসাম্যের অবস্থা বিরাজ করছে।
মানুষ এর বাইরে নয়। তবে মানুষ এই সকল
উপাদানের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের জায়গায় অধিষ্ঠিত। কারণ সে নিয়ম মানতে বাধ্য
নয়, তবুও সে নিয়মের গুরুত্ব বুঝে তাকে মেনে নেয়। বিশুদ্ধ পানির নাম যেমন
জীবন, তেমনি স্রষ্টার আনুগত্যের সামনে নিজের ইচ্ছাকে বিসর্জন দিতে পেরেছে
যে, সে-ই সৃষ্টির সেরার মর্যাদায় আসন লাভ করবে। এজন্যেই একজন সন্ত্রাসী-
মানুষ হওয়া সত্ত্বেও, সৃষ্টির মধ্যে নিকৃষ্ট।
সৃষ্টির সেরা হওয়ার কারণেই মানুষের কৃতকর্মের প্রভাব পৃথিবীর অন্য যেকোন উপাদানের উপর পড়তে বাধ্য। কুরআন বলছে,
"এ পৃথিবীতে যত বিপর্যয় সৃষ্টি হয়, তা মানুষের নিজের হাতের কামাই"।
তাই কোন কাজ- তা যতো তুচ্ছ এবং তা যতো গোপনীয়তার সাথেই করা হোক না কেন, তার একটা অনিবার্য ফল অবশ্যই আছে।
একজন
লোক, তিনি ধূমপান করেন। তিনি যদি সবার সামনে সিগারেটে ফুঁ দিতে দিতে বলেন,
আমার পকেটের টাকা দিয়ে খাই তাতে তোর বাপের কি?- তাতে কিন্তু ঐ লোক নিজের
অজ্ঞতাই জাহির করলেন, কারণ তিনি জানেন না যে, তিনি তার পকেটের টাকা দিয়ে,
তার নিজের তো বটেই, তার সামনে উপস্থিত সকলকে এমনকি তার অনাগত প্রজন্মের
রক্তে বিষ ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। তিনি একাকী ঘরের কোণে বসেও যদি ধূমপান করেন তবুও
তার অনাগত সন্তানের উপর জেনেটিক কারণে এর ক্ষতির প্রভাব পড়বে।
এছাড়াও
লুকিয়ে ঘুষ খেয়ে, সুদের কারবার করে, ভেজাল মিশিয়ে, পর্দার বিধান লঙ্ঘন
করে, প্রবৃত্তির দাসত্ব করে, মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়ে (হতে পারে তা আইনের
আদালতে আর হতে পারে নিজের স্বামী বা স্ত্রী বা পিতামাতা বা সন্তানের সাথে)
সর্বোপরি আল্লাহ্র বিধান অমান্য করে মানুষ মূলত একটি দীর্ঘস্থায়ী ফলই রেখে
যায়। আর এভাবেই, একজন মানুষের করা কর্মের ফল, শুধু ঐ মানুষ পর্যন্ত
সীমাবদ্ধ থাকে না বরং এর প্রভাব সেই মানুষের সাথে সম্পর্কিত এবং অসম্পর্কিত
অনেকের উপরই পড়ে। এজন্যেই গুনাহ করতে নিষেধ করা হয়েছে, তা যতোই গোপনীয়তার
সাথেই করা হোক এবং আপাতদৃষ্টিতে এর কোন কুফল ধরা নাই বা পড়ুক। এর শাস্তিও
করা হয়েছে অত্যন্ত কঠোর।
আল্লাহ্ মহান এবং সকল জ্ঞানের আধার।
প্রথম
ধাপের চিন্তা যেমন অজ্ঞতা প্রসূত এবং ক্ষতিকর, ঠিক তেমনি, এই চিন্তাধারা
মানুষকে অনিবার্যরূপে দ্বিতীয় ধাপের ধ্যান-ধারণার দিকে ঠেলে দেয়। এই ধাপে
মানুষ নিজেকে স্বাধীন এবং জবাবদিহিবিহীন ভাবতে পছন্দ করে। “আমার কাজের
জন্যে অন্যের কাছে কেন জবাব দিতে হবে?"
প্রথম ধাপের চিন্তা থেকে মানুষকে
ফিরিয়ে আনা যায়। কিন্তু মানুষ যখন দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ করে তখন আর কারো
পক্ষে তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না, যদি না- সেই মানুষ নিজে ফিরে আসার
সিদ্ধান্ত নেয়।।
এ জাতীয় চিন্তাধারা আগের চিন্তাধারা থেকেও মারাত্মক,
প্রান্তিক এবং সবার জন্যেই বিপজ্জনক। এ পর্যায়ে এসে মানুষ তার স্রষ্টাকে
পর্যন্ত অস্বীকার করে বসে। কেউ অতদূর না গেলেও সে আর স্রষ্টার বিধান মানতে
পারে না।
কুরআন এই অবস্থা কেন তৈরি হয় তার যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে
দিয়েছে। কুরআন বলছে, "কক্ষনো নয়, বরং মানুষ নিজেকে দেখতে পায় অভাবমুক্ত"।
অর্থাৎ একজন মানুষ যখন নিজের পরিবেশ, কাজ করার ক্ষমতা, চিন্তা করার ক্ষমতা,
সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, অর্থনৈতিক অবস্থা- এসব দিক দিয়ে নিজেকে
স্বয়ংসম্পূর্ণ দেখতে পায়, তখন সে সকল কিছুর সাথে বিদ্রোহ করে বসে। কারো
কথাই তার কাছে আর গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। যতোটুকু কথায় তার মন সায় দেয়,
ততোটুকু কথাই তার কাছে মূল্য পায়। আর এর জন্যে কারো কাছে সে নিজেকে দায়ী
মনে করে না। পৃথিবীর যত ছোট বড়, গোপন প্রকাশ্য অপরাধ মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে
করে যাচ্ছে, তার প্রায় সবক'টাই এই ধারণা থেকে সঙ্ঘটিত হয়।
মানুষের আছে একটি খামখেয়ালী মন, যাকে সাধারণত বলা
হয় প্রবৃত্তি। এই মন মানুষকে ভোগ-আরাম-আয়েশ, দৈহিক আর জৈবিক চাহিদার দিকে
আহবান করে। তাছাড়া মানুষের মনের উপর প্রভাব বিস্তার করে শয়তান। শয়তান
নিরবচ্ছিন্নভাবে মানুষের মনোজগতে তার চিন্তাধারার
অনুপ্রবেশ ঘটাতে পরিশ্রম করতে থাকে, আর সেজন্যে সে নিয়মিত মানুষের মাথায় যুক্তির পর যুক্তি
দিতে থাকে । কেউ কেউ এসব যুক্তির উত্তর না জানার ফলে আর কেউ কেউ এসব
যুক্তির অনুপ্রবেশকে স্বাগত জানায় বলে বিভ্রান্তির আবর্তে নিমজ্জিত হয়।
সে একথা ভেবে দেখে না যে,
প্রকৃতপক্ষেই মানুষ ততোটা স্বাধীনতা দাবী করতে পারে কি, যতোটা স্বাধীনতা মানুষকে সকল জবাবদিহির বাইরে নিয়ে যায়?
সৃষ্টিজগতের প্রতিটি উপাদান যদি জবাবদিহির আওতাভুক্ত হয়ে থাকে তবে মানুষ সেই পরিবেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য উপাদান হয়েও কি করে জবাবদিহির
আওতামুক্ত হতে পারে?
মানুষ কি স্বয়ম্ভু কোন স্বত্ত্বা? এমন কোন মুহূর্ত কি
মানুষের জন্যে কখনোই আসেনি, যখন সে কিছুই ছিলো না? সে অবস্থা থেকে কে তাকে
অস্তিত্ব দিল?
মানুষ কি জীবনের কোন ক্ষেত্রেই অন্যের উপর নির্ভরশীলতা
অস্বীকার করতে পারে? কারা তার অসহায় অবস্থায় মমতা, আদর, স্নেহ আর অশ্রু
দিয়ে তার অসহায়ত্ব দূর করলো, তার অসহায়ত্বের মুহূর্তগুলোকে কারা আনন্দে
ভরিয়ে তুলল?
এভাবেই
একজন মানুষ- নিজেকে সকল জবাবদিহির আওতার বাইরে নিয়ে গিয়ে, প্রাথমিকভাবে
স্রষ্টার দেওয়া বিধান এরপর স্বয়ং স্রষ্টা এবং পরিশেষে
পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রের বিধি বিধানের সাথে প্রকৃত অর্থে বিদ্রোহ করে বসে। আর
এটা স্রষ্টা, সৃষ্টি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সকলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। আর
এর ফল কোন এক ব্যক্তি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে না। এর ফল সুদূরপ্রসারী। এর
ক্ষতিকর প্রভাব পুরো মানব সমাজকেই আক্রান্ত করে।
তাই সকল জ্ঞানের
ধারক আল্লাহ্ মানুষের উপর ভালো কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজ প্রতিহত করাকে
বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন। আর এভাবেই আল্লাহ্ তথাকথিত “ব্যক্তিস্বাধীনতা”র
অনিয়ন্ত্রিত কার্যকলাপের ক্ষতি থেকে মানব জাতিকে রক্ষা করেছেন।
হে
মানুষ! কোন জিনিসটি তোমাকে তোমার রবের ব্যাপারে ধোঁকায় ফেলে রেখেছে? যিনি
তোমাকে সৃষ্টি করেছেন (তোমার তো অস্তিত্বই ছিল না), তোমাকে সুঠাম ও
সুসামঞ্জস্য করে গড়েছেন (যাতে তোমার কোন নিয়ন্ত্রণ ছিলো না), এবং যেভাবে
চেয়েছেন তেমন আকৃতি দিয়েছেন (এতে তোমার কোনই কৃতিত্ব নেই)। কখনোই নয়, (কেউ
ধোঁকায় ফেলেনি, আসল কথা হচ্ছে) তোমরা পুরষ্কার ও শাস্তিকে মিথ্যা মনে করছ।
অথচ তোমাদের উপর পরিদর্শক নিযুক্ত আছে এমন সম্মানিত লেখকবৃন্দ, যারা
তোমাদের প্রতিটি কাজ জানে। ( আল ইনফিতার- ৬-১২)
পঠিত : ১১৯২ বার
মন্তব্য: ০