Alapon

কখনো হারিয়ে যাবে না যে 'আন্দোলন'

আজ যে ঘটনাটির আদ্যোপান্ত লিখতে বসছি, তা নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। খেটে খাওয়া মানুষ থেকে সরকার বাহাদুরের পর্যন্ত চোখ খুলে দেয়ার এক ঐতিহাসিক আন্দোলনের কথা বলছি। যার শুরু করেছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। উই ওয়ান্ট জাস্টিস কিংবা নিরাপদ সড়ক চাই শ্লোগানের এই আন্দোলনটি যেন কালের গহবরে হারিয়ে না যায়, সে জন্যই আজকের এই লেখার অবতারণা।



ঘটনার শুরুর ঘটনাঃ
২৯শে জুলাই (রবিবার) রাজধানীর এয়ারপোর্ট সড়কে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে জাবালে নূর পরিবহনের বাসের চাপায়, রোডের পাশে বাসের জন্য অপেক্ষারত দিয়া খানম মিম ও আবদুল করিম রাজিব নামে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়। এরপরই সহপাঠিদের হত্যাকারীদের বিচারের দাবী ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজপথে নামে শিক্ষার্থীরা।


ছবিঃ নিহত দুই শিক্ষার্থী

যেভাবে শুরুঃ
নিরাপদ সড়কের দাবীতে বহুদিন আগ থেকেই এদেশে আন্দোলন হয়ে আসছে। কিন্তু সড়ক নিরাপদ হওয়া তো দূরের কথা যেন মৃত্যুর ফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকায় সিটি বাসগুলো তো একেকটা পাগলাঘোড়া। তাই এসব পাগলাঘোড়া গুলোর হাতে যেন আর কোনো প্রাণ বিসর্জন দিতে না হয় এবং দিয়া ও করিমের হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবীতে স্কুলের বাচ্চা ছেলে-মেয়েরা উই ওয়ান্ট জাস্টিস শ্লোগান নিয়ে রাজপথে নেমে আসে। এবং তা মিডিয়া ও ফেইসবুকের মাধ্যমে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।



আগুনে ঘি ঢাললেন নৌমন্ত্রীঃ
সড়ক দুর্ঘটনার নির্মম খবর শুনে সারাদেশ যখন শোকাহত। তখনই সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে নৌমন্ত্রী শাহজাহান খান হাসতে হাসতে জবাব দেন- ভারতে দিনে ৩০-৪০ জন মানুষ মারা যায় সেখানে তো কোন কথা হয় না। আন্দোলন হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে দুইজন মারা যাওয়াতে এত কথা কেন? সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ বেদনার্ত, শোকাহত ও ক্ষুব্ধ, তখন ছাত্রছাত্রীর লাশ নিয়ে নৌমন্ত্রীর হাসি যেন বিদ্রুপের হাসি। হতে পারতো প্রথমদিন বিক্ষোভ করেই শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরে যেতো। কিন্তু মন্ত্রীর এহেন কান্ডজ্ঞানহীন মন্তব্যের কারণে শিক্ষার্থীরা আরো ক্ষুব্ধ হয়, এবং পরেরদিন আবার রাস্তায় নেমে আসে। নৌমন্ত্রীর ক্ষমাপ্রার্থনা ও পদত্যাগসহ নয় দফা দাবী নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়।



শুরু হয় গণআন্দোলনঃ
ডিজিটাল এই যুগে কোন একটি ঘটনা মুহুর্তের মধ্যেই সারা দেশে ছড়িয়ে যায়। এক্ষেত্রেও ভিন্নতর হয়নি। শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থীদের সাথে সংহতি জানিয়ে রাস্তায় নেমে আসে ঢাকার প্রায় সকল স্কুলের শিক্ষার্থীরা। ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়,মিরপুর রোড,ফার্মগেট,জিগাতলা, উত্তরা, মোহাম্মদপুর, মতিঝিল, রামপুরা, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করে। বিভিন্ন নতুন নতুন শ্লোগানে মুখরিত করে তুলে ঢাকার আকাশ-বাতাস।


 
নবদীপ্তের সূচনা করে নব ট্রাফিক বাহিনীঃ
নিরাপদ সড়কসহ নয় দফা দাবিতে আন্দোলন শিক্ষার্থীরা সড়কে অবস্থান নিয়ে ভেঙ্গে পড়া ট্রাফিক ব্যবস্থায়ও দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দেখিয়েছে। শিক্ষার্থীরা ঢাকার যানযট কমানো,গাড়ীর পারমিট,ড্রাইভারের লাইসেন্স পরীক্ষা করা শুরু করে। সব জায়গাতেই শিক্ষার্থীরা গাড়ি-মোটর সাইকেলের লাইসেন্স দেখতে চায়। পাশাপাশি অ্যাম্বুলেন্স বা ফায়ার সার্ভিসের মত জরুরি সেবাদানকারী সংস্থার গাড়ি যাওয়ার সুযোগ করে দেয়।



ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা সংশ্লিষ্ট বিভাগকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, ইচ্ছা থাকলে সবই করা সম্ভব। ভোগান্তির মধ্যেও তাদের এ কাজকে স্বাগত জানিয়েছে জনসাধারণ। টনক নড়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদেরও। টানা তিনদিন আন্দোলনে অবস্থা বেগতিক দেখে সরকার বৃহঃবার তথা চতুর্থদিন দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। ছুটির দিনেও তারা রাস্তায় ছিলো।


ছবিঃ লাইসেন্স চেক করছে শিক্ষার্থীরা

একে একে ধরা খেতে থাকেন এলিটরাঃ
গত চারদিন ধরে রাজপথ অবরুদ্ধ করে রেখে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করছে। লাইসেন্স না থাকলেই চাবি আটক করছে। এই ঘটনা শুধু বাসের ক্ষেত্রেই ঘটছে না,পুলিশের গাড়ি, সেনাবাহিনীর গাড়ি, মিডিয়ার গাড়ি, মন্ত্রী-এমপিদের গাড়িও আটকে রাখে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। আর এতে ধরা খায় সরকারের উচ্চপর্যায়ের মন্ত্রীরা এমনকী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গাড়িও লাইসেন্সবিহীন ধরা পড়ে।

ছবিঃ লাইসেন্সবিহীন বিজিবির গাড়ি শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়ে।

আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশেঃ 
নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকায় থেমে থাকেনি। এই আন্দোলন ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্যান্য বড় শহরগুলোতেও।



গাজীপুরঃ গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ,এএইচএম আরিফ কলেজ (কোনাবাড়ি),চান্দনা চৌরাস্তা উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজ, গাজীপুর সিটি কলেজ,কাজীম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজসহ আশপাশের স্কুল-কলেজের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী মহাসড়ক অবরোধ করে।
নারায়ণগঞ্জ: নারায়গঞ্জের শনিরআখড়া, দনিয়াসহ বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে।
চট্টগ্রাম:  নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা জিইসি মোড়, গরিবুল্লাহ শাহ মাজার,ওয়াসা এলাকায় কয়েকশ শিক্ষার্থী বৃষ্টিতে ভিজে মিছিল করে রাস্তায় নেমে আসে। 



রাজশাহী: নগরীর সাহেববাজার জিরোপয়েন্টসহ দফায় দফায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে রাজশাহী মহানগরীর বিভিন্ন সড়কে।
বরিশাল: নগরের হাতেম আলী কলেজ, অমৃত লাল দে কলেজ, সরকারি মহিলা কলেজ,সরকারি মডেল কলেজ,ইনফ্রা পলিটেকনিক কলেজসহ বেশ কিছু কলেজের শিক্ষার্থীরা  চৌমাথা এলাকার ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করে এ বিক্ষোভ করে।



পাবনা :  পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজ, পাবনা কালেক্টরের পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, জেলা স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পাবনা শহরের প্রধান সড়ক আব্দুল হামিদ রোডে এসে জোর হয়। পরে তারা সড়কে যানজট নিরসনে কাজ করে। এ সময় চালক ও যাত্রীদের ট্রাফিক আইন মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করে শিক্ষার্থীরা। 
এছাড়াও ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা,শেরপুর, নাটোর, ঠাকুরগাঁও, গোপালগঞ্জ, সিলেট ইত্যাদি স্থানে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল ও অবরোধ করে।


দেশবাসীর স্বত্বস্পূর্ত সমর্থনঃ
‘নিরাপদ সড়কের দাবিতে বাচ্চাদের আন্দোলন যৌক্তিক। তাদের ওপর আক্রমণ করা হলে ঘরে বসে থাকব না। মুখে দাবি মানার কথা বললে হবে না। এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে।'আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে অভিভাবকরা মিরপুর ও প্রেসক্লাবে মানববন্ধন করে এভাবে বক্তব্য দেয়।



শুধু তাই নয়, শিক্ষার্থীদের সমর্থন দেন দেশের সচেতন জনগণ। অভিভাবকরা সকালে তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে আন্দোলনে দিয়ে যায়। দুপুরে এসে খাবার দিয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা বৃষ্টিতে ভিজে রোদে পুড়ে আন্দোলন চালিয়ে যায়। এই এক অভিনব আন্দোলন যা ইতিপূর্বে বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেনি।

শিক্ষার্থীদের সংহতি জানিয়ে সরব থাকেন- অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী, খুশি, পরিচালক মোস্তফা সারোয়ার ফারুকী, কণ্ঠশিল্পী কোনাল পারভেজ সাজ্জাদ,আরজে টুটুল কন্ঠ শিল্পী মুনি চৌধুরী , কণ্ঠ শি‌ল্পি নওরিোন, নওশি,ন ,ব্রাউনিকয়া,সা‌ব্বির জামান,আরিফ,গি‌তিকার জিবক বরুয়া,ফেসবুক সেলেব্রেটি আইমান সাদিক, শোলাইমান সুকুনসহ প্রমূখ।



কেন এই আন্দোলনঃ
এই আন্দোলন কোন ব্যক্তির স্বার্থে নয়, নয় কোনো দলের জন্য। এই আন্দোলন হয়েছিলো নিজেরা নিরাপদভাবে বাঁচার জন্য। রাষ্ট্রে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে থাকা অসাধুদের দ্বারা পরিচালিত পরিবহন ব্যবস্থাকে ঠিক করার জন্য। তাই তো তারা শ্লোগান দেয়, রাষ্ট্রের মেরামত কাজ চলছে, সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত। আরো সুন্দর শ্লোগান ছিলো- যদি তুমি ভয় পাও, তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও, তবে তুমি বাংলাদেশ।



শিক্ষার্থীদের উপর শ্রমিকদের আক্রমণঃ 
শান্তিপূর্ণভাবে একটা আন্দোলনকে আর কতদিন চলতে পারে? এভাবে কী চলতে দেয়া যায়? আপনি আমি চলতে দেয়া যায় বললেও, তারা চলতে দিতে চায়নি। আর তাই নিরীহ, নিরস্ত্র, কোমলমতি শিশুদের উপর হামলা পড়ে বাসশ্রমিকরা। সর্বপ্রথম হামলা হয় মিরপুরে। তারপর যাত্রাবাড়ীর দনিয়া এলাকায় শিক্ষার্থীদের উপর হামলে পড়ে পরিবহন শ্রমিকরা। এতে আহত হয় অনেক শিক্ষার্থী।

ছবিঃ শ্রমিকলীগের হামলায় আহত শিক্ষার্থী

শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের হামলাঃ
ছাত্রলীগ প্রথম দিকে আন্দোলনকারীদের চকলেট বিতরণ করে সংহতি জ্ঞাপন করলেও একদিন পরেই তাদের প্রকৃতরুপ দেখিয়ে দেয়। লাইন্সল্যাব এলাকায় শিক্ষার্থীদের বর্বর হামলা করে ছাত্রলীগ। পুলিশকে সাথে নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা লাঠিসোঠা নিয়ে সায়েন্স ল্যাব থেকে শুরু করে জিগাতলা পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর ওপর হামলা করে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে।



এ সময় সাংবাদিকরা ছবি তোলার চেষ্টা করলে তারা তাদের ওপরও হামলা করে। পুলিশ আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল ছুড়ে। কিন্তু পুলিশের সাথেই লুঙ্গি পরা, হেলমেট পরা ব্যক্তিরা শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করে। পুলিশ তাদেরকে কিছু বলা তো দূরের কথা উলটো সহযোগিতা করে।


ছবিঃ লাটিসোটা হাতে হামলা ও আহত শিক্ষার্থী

দুঃখজনক বিষয় হলো পুলিশের সাথে ছাত্রলীগ কর্মীরা হেলমেট পড়ে পিস্তল উঁচিয়ে গুলি করে আর পাশেই বিজিবি নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকে।

ছবিঃ বিজিবি নির্বিকার

এই হামলায় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। তাদেরকে হাসপাতাল নিয়ে গেলে সেখানেও হামলা চালায় ছাত্রলীগ। নারী ডাক্তার, বৃদ্ধ পথচারী থেকে শুরু করে কেউ রেহাই পায়নি তাদের হামলা থেকে।

ছবিঃ পুলিশের হামলার প্রস্তুতি

প্রতিরোধের চেষ্টাঃ 
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা প্রথমে পিছু হটে গেলেও একটু পরে সংগঠিত হয়ে তাদের ধাওয়া করে। এরপর ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলতে থাকে। ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি চলে। এতে বেশ কিছু আওয়ামীলীগকর্মীও আহত হয়।


গুজব ও বাস্তবতাঃ 
হামলার ঘটনার কিছু পরে বেশ কয়েকটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন নিয়ে নানা গুজব রটানো হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ফেসবুক পেজে শনিবার বিকেলে (৪ আগস্ট) আয়াতুল্লাহ বেহেশতি নামে একজন গুজব ছড়িয়ে একটি পোস্ট দেয়। তার ওই পোস্টে বলা হয়েছে, ‘জিগাতলায় ৪ জন নিহত, ৪ জন ধর্ষিত ছাত্রলীগ নামের শুওরের বাচ্চাদের দ্বারা।


ছবিঃ হেলমেট পরে এক ছাত্রীর উপর ছাত্রলীগের হামলা

তখন বিভিন্ন স্থান থেকে উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা এসে জিগাতলায় জড়ো হন। এসময় দুই পক্ষেই অনেকে আহত হন। পুরো ঘটনার সময় পুলিশ নিষ্ক্রিয় অবস্থান নিয়েছিল। তবে পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাস্তবে এ ধরনের ঘটনা না ঘটেও। আওয়ামীলীগ অফিসে কিছু আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীকে আটক করে রাখা হয়। আর তা থেকে চলমান আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার উদ্দেশ্যে কেউ কেউ এভাবে নানা রটনা ছড়য়। কাজী নওশাবা আহমেদও একজন একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়। পরে তাকে গ্রেফতার করা হয়।


ছবিঃ গ্রেফতার অভিনেত্রী নওশাবা

ইন্টারনেট সেবা বন্ধঃ
দেশ যখন ডিজিটাল হওয়ার দৌড়ে স্যাটেলাইটের জগতে পা রাখছে। ফাইভ জি দুনিয়ায় এগিয়ে যাওয়ার গান গাচ্ছে, তখন সরকার হাট্লো উলটো পথে। আন্দোলন দমানোর জন্য দেশের ইন্টারনেট সেবা ২৪ ঘন্টার জন্য বন্ধ করে দেয়।



আন্দোলন স্কুল-কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়েঃ
পরদিন শিক্ষার্থীদের উপর হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করে। আর তাতেও পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীরা হামলা চালায়। এতে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জিগাতলায় ঢাবিয়ানদের উপর, রামপুরায় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের উপর, উত্তরায় নর্থ সাউথের ছাত্রদের উপর।



গ্রেফতার ও রিমান্ডঃ
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে গণহারে গ্রেফতার করা হয়। এবং অনেকেই রিমান্ডে নেয়া হয়। তাদের মধ্যে অভিনেত্রী নওশাবাকে ৫ দিন,  মো. আলমগীর হোসেন, মাহবুবুর রহমান ও সাইদুল ইসলাম তহিদের পাঁচদিন, আলোকচিত্রী শহীদুল আলমকে ৭ দিনের রিমান্ড  দেয় আদালত।


ছবিঃ গ্রেফতার আলোকচিত্রী শহিদুল আলম

আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আন্দোলনঃ
বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন’ বিশ্বের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় গুরুত্বসহকারে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত ‘দি নিউইয়র্ক টাইমস’ ‘ছাত্র বিক্ষোভ সরকারের জন্য বিব্রতকর’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। 
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী এই পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, সড়ক দুর্ঘটনায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ঢাকায় হাজারো ছাত্রদের বিক্ষোভকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়েছে। তাদেরকে লাঠিপেটা করেছে। প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় মিডিয়ার রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিক্ষোভকারী ছাত্রদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়।


ছবিঃ দেশীয় অস্ত্র হাতে ছাত্রলীগ কর্মী

রোববার আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, দূর্বৃত্তরা অনেক সাংবাদিককে পিটিয়েছে এবং তাদের ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। প্রতিবেদনে দেশজুড়ে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়ার প্রসঙ্গটি তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে কর্তৃপক্ষ মোবাইল অপােরেটরগুলোকে ২৪ ঘণ্টার জন্য থ্রিজি ও ফোরজি মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে। পুলিশ শিক্ষার্থীদের দিকে রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস ছুঁড়েছে।


ছবিঃ এপির সাংবাদিকের উপর ছাত্রলীগের হামলা

ডিপিএ নিউজ অ্যাজেন্সি বলেন, শিক্ষার্থীরা রোববার শান্তিপূর্ণ মিছিল করছিল। কিন্তু পুলিশ হঠাৎ করে তাদের দিকে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে। এবিসি নিউজের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলা হয়েছে, ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় পুলিশ ও সরকার সমর্থক কর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ শিক্ষার্থীদের লাঠিচার্জ করেছে এবং কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করেছে। এতে অনেক শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। বার্তা সংস্থা এপির একজন সাংবাদিকের বরাত দিয়ে বলা হয়, এ সংঘর্ষে কয়েকজন সাংবাদিকও আহত হয়েছেন।
প্রায় একই তথ্য দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে এপি


ছবিঃ আহত সাংবাদিক

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের খবরে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সহিংতায় রূপ পেয়েছে। জিগাতলা এলাকায় পুলিশ ও সরকার সমর্থক কর্মীদের হামলায় বেশ কিছু শিক্ষার্থী আহত হয়েছে এবং তাদের অনেকে পার্শ্ববর্তী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। 
শনিবারের জিগাতলার ঘটনায় কতজন আহত হয়েছেন, তার একটি চিত্র তুলে ধরেছে।


ছবিঃ ছাত্রলীগের হামলায় আহত শিক্ষার্থী

বিবিসি ও সিএনএন শনিবারের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্থান টাইমসের খবরেও শনিবারের সংঘর্ষে ১১৫ জনের আহত হওয়ার কথা বলা হয়েছে।


ছবিঃ ছাত্রলীগের হামলায় আহত সাংবাদিক
 
মন্ত্রীসভায় আইনের খসড়াঃ
আন্দোলন ও দেশী-বিদেশী চাপে পড়ে সরকার অবশেষে মন্ত্রীসভায় নিরাপদ সড়ক আইন’১৮ এর খসড়া উপস্থাপন করে। যদিও খসড়া পর্যালোচনা করে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন এই আইনে জনগণের আশার প্রতিফলন হয়নি।



আন্দোলনের অর্জনঃ
নিরাপদ সড়কের দাবীতে শিক্ষার্থীদের করা আন্দোলনের ফলেই সরকার দ্রুতগতিতে সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন করতে উদ্যোগী হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এত বড় একটি গণ আন্দোলন থেকে আসলে কী পেলো? সড়কই বা কত টুকু নিরাপদ হলো, সে প্রশ্ন থেকেই গেলো।



তবে এত টুকু বলা যায় আন্দোলনের কারণে সরকার নড়েচড়ে বসেছে, যা ছাত্রসমাজের এই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সাফল্য।

পঠিত : ২১৩৬ বার

মন্তব্য: ০