Alapon

কুরবানির জন্য যা জানা আবশ্যক

আত্মত্যাগ, আত্মউৎসর্গ, সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব, সাম্য, মৈত্রী, সম্প্রীতি, ভালবাসা, সহমর্মিতা, সহানুভূতি ও সর্বোপরি মহান আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের সুমহান মহিমায় চির ভাস্বর কুরবানি। কুরবানি মুসলিম জীবনের ইবাদতের এক তাৎপর্যপূর্ণ গৌরবের প্রধান উৎস। আদি পিতা আদম (আঃ) ও স্বীয় পুত্র হাবিল-কাবিল এবং মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইবরাহিম (আঃ) ও আদেশ অনুগত পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এর আত্মত্যাগের মহান স্মৃতি বিজড়িত কুরবানি। এ দিনটি বছর ঘুরে মুসলিম জাতির নিকট আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা-বিশ্বাস ও জীবনের সর্বস্ব উৎসর্গের মাধ্যমে মহান মহিয়ানের নৈকট্য লাভের বার্তা নিয়ে হাজির হয়।

কুরবানির আভিধানিক অর্থঃ 
আরবি ‘কুরবান’ শব্দটি উর্দু বা ফারসিতে ‘কুরবানি’ রূপে রূপান্তরিত হয়েছে। যার অর্থ সান্নিধ্য, নৈকট্য। আর ‘কুরবান’ শব্দটি ‘কুরবাতুন’ শব্দ থেকে নির্গত। আরবি ‘কুরবান’ ও ‘কুরবাতুন’ উভয় শব্দের শাব্দিক অর্থ সান্নিধ্য লাভ করা, নিকটবর্তী হওয়া, নৈকট্য লাভ করা। ইসলাম শরিয়ার পরিভাষায় কুরবানি ও ঐ মাধ্যমকে বলা হয়, যার দ্বারা আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য অর্জন ও তার ইবাদতের জন্য হালাল কোন জন্তু যবেহ করা হয়। (মুফরাদাত লি ইমাম রাগিব; আল-কামুসূল মুহিত)

কুরবানি অর্থ রক্ত প্রবাহিত করা, ত্যাগ স্বীকার করা, উৎসর্গ করা ইত্যাদি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য অর্জন ও তার ইবাদাতের জন্য পশু জবেহ করাকে কুরবানি বলা হয়। ইমাম আওযায়ী, ইমাম লাইস, ইমাম আবু হানীফা রহ. প্রমুখের মতে কুরবানি করা ওয়াজিব। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার নবীকে কুরবানি করতে নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন- ‘আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুণ ও কুরবানি করুন।’ (সূরা কাওসার : ২)
 
পবিত্র কুরআনে ‘কুরবানি’ শব্দটি ব্যবহার না হয়ে ‘কুরবান’ শব্দটি তিন জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে। যথা- সূরা মায়েদার ২৭নং আয়াত, সূরা আহকাফের ২৮নং আয়াত ও সূরা আলে ইমরানের ১৮৩নং আয়াত। অনুরূপভাবে কুরআন ও হাদীসে এর সমার্থ্যবোধক শব্দ পরিলক্ষিত হয়। যেমন-

১. ‘নাহরুন’ অর্থে। সূরা কাউছারের ২নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘‘সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশে সালাত আদায় করুন ও কুরবানি করুন।’’ এ অর্থে কুরবানির দিনকে ‘ইয়ামুন নাহর’ বলা হয়।

২. ‘নুসুক’ অর্থে। সূরা আনয়ামের ১৬২নং আয়াতে এসেছে- ‘‘আপনি বলুন, আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ সবই বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক মহান আল্লাহর জন্য নিবেদিত।’’

৩. ‘মানসাকুন’ অর্থে। সূরা হজ্জের ৩৪নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানির বিধান রেখেছি।’’

৪. ‘উদহিয়্যা’ অর্থে। হাদীসে এ শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়। এ অর্থে কুরবানির ঈদকে ‘ঈদুল আযহা’ বলা হয়।

ভারতীয় উপমহাদেশে কুরবানি বলতে জিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখ থেকে ১২/১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশে হালাল জন্তু (উট, গরু, বকরী, ভেড়া প্রভৃতি) যবেহ করা বুঝায়।
 
কুরবানির প্রচলনঃ
আল্লাহর নবী ইবরাহীম আলাইহিস সালাম স্বীয় পুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে কুরবানি করার পরীক্ষা থেকে বর্তমান পদ্ধতির কুরবানির সূচনা হয়েছে। আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু জবেহ করা তিন প্রকার হতে পারে:
১. হাদী ২. কুরবানি ৩. আকীকাহ। 
তাই কুরবানি বলা হয় ঈদুল আযহার দিনগুলোতে নির্দিষ্ট প্রকারের গৃহপালিত পশু আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য জবেহ করাকে।

ইসলামী শরীয়তে এটি ইবাদাত হিসেবে সিদ্ধ, যা কুরআন, হাদীস ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমত দ্বারা প্রমাণিত। কুরআন মাজীদে এসেছে- ‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সলাত আদায় কর ও পশু কুরবানি কর।’ (সূরা কাওসার : ২)

‘বল, আমার সলাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। তাঁর কোন শরীক নাই এবং আমি এর জন্য আদিষ্ট হয়েছি আর আমিই প্রথম মুসলিম।’ (সূরা আনআমঃ ১৬২-১৬৩)

হাদীসে এসেছে- বারা ইবনে আযিব রাদি আল্লাহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ঈদের সলাতের পর কুরবানির পশু জবেহ করল তার কুরবানি পরিপূর্ণ হল ও সে মুসলিমদের আদর্শ সঠিকভাবে পালন করল। (বুখারী- ৫৫৪৫, মুসলিম-১৯৬১)
আনাস ইবনে মালিক রাদি আল্লাহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ হাতে দুটি সাদা কালো বর্ণের দুম্বা কুরবানি করেছেন। তিনি বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার বলেছেন। তিনি পা দিয়ে দুটো কাঁধের পাশ চেপে রাখেন। (বুখারী-৫৫৬৫, মুসলিম-১৯৬৬) তবে বুখারীতে ‘সাদা-কালো’ শব্দের পূর্বে ‘শিংওয়ালা’ কথাটি উল্লেখ আছে।

কুরবানির প্রাক-ইতিকথাঃ
কুরবানির ইতিহাস মানব সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই লক্ষ্য করা যায়। কুরবানির প্রথম ঘটনাটি ঘটে আদি পিতা আদম (আঃ) এর স্বীয় দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের মাধ্যমে। ঘটনাটির বর্ণনা কুরআনে এভাবে এসেছে- ‘‘আদমের দুই পুত্রের বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে যথাযথভাবে শুনিয়ে দাও, যখন তারা উভয়ে কুরবানি করেছিল, তখন একজনের কুরবানি কবুল হলো এবং অন্যজনের কুরবানি কবুল হলো না। তাদের একজন বলল,  আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন বললো, আল্লাহতো সংযমীদের কুরবানিই কবুল করে থাকেন।’’ (মায়েদা-২৭)

কুরআনে বর্ণিত হাবিল ও কাবিল কর্তৃক সম্পাদিত কুরবানির ঘটনা থেকেই মূলত কুরবানির ইতিহাস গোড়াপত্তন হয়েছে। তারপর থেকে বিগত সকল উম্মতের ওপর এ বিধান জারি ছিল। আল্লাহ বলেন, ‘‘প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কুরবানির বিধান রেখেছিলাম।’’

কুরবানির প্রচলন আদি পিতা আদম (আঃ)-এর সময় থেকে শুরু হলেও মুসলিম জাতির কুরবানি মূলত ইবরাহিম (আঃ) এবং স্বীয় পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এর কুরবানির স্মৃতি অনুকরণ ও অনুসরণে চালু হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক যুগে যুগে প্রেরিত অসংখ্য নবী-রাসুলকে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাদের মধ্যে ইবরাহিম (আঃ) প্রতিটি পরীক্ষায় পাহাড়সম ধৈর্য্য ও ত্যাগের মাধ্যমে কৃতকার্য হয়েছিলেন। এ সম্পর্কে কুরআনে এসেছে- ‘‘যখন ইবরাহিম (আঃ)কে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা কররেন, অতপর তিনি তা পূর্ণ করলেন, তখন তিনি বললেন, আমি তোমাকে মানব জাতির নেতা বানিয়ে দিলাম।’’ (বাকারাহ-১২৪)

ইবরাহিম (আঃ)-এর কুরবানি প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনের বাণী- ‘‘দুজনেই যখন আনুগত্যে মাথা নুইয়ে দিল আর ইবরাহিম তাকে কাত করে শুইয়ে দিল। তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইবরাহিম! তুমিতো স্বপ্নকে সত্য প্রমাণিত করে দেখালে। এভাবেই আমি সৎ কর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। অবশ্যই এটা ছিল একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি এক মহান কুরবানির বিনিময়ে পুত্রকে ছাড়িয়ে নিলাম। আর আমি তাকে পরবর্তীদের মাঝে স্মরণীয করে রাখলাম।’’ (সূরা সাফ্ফাত-১০৩-১০৮)

সুতরাং যুগ যুগ ধরে এই কুরবানির পদ্ধতি প্রচলিত হয়ে আসছে। আল্লাহর নির্দেশের আলোকে ইবরাহিম (আঃ)-এর ঘটনা থেকে মুসলিম জাতির কুরবানির প্রচলন শুরু হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কুরবানির ইতিহাস ততটা প্রাচীন মানব জাতির ইতিহাস। মানবমন্ডলীর জন্য রবের পক্ষ থেকে যত শরীয়ত নাযিল হয়েছে, প্রত্যেক শরীয়তের মধ্যে কুরবানির বিধান জারি ছিল। প্রত্যেক উম্মতের ইবাদাতে এ ছিল একটি অপরিহার্য অংশ।

কুরবানির উদ্দেশ্যঃ
কুরবানির দু’ধরনের উদ্দেশ্য রয়েছে। পার্থিব ও অপার্থিব। অপার্থিব উদ্দেশ্য হল মহান আল্লাহর নির্দেশ প্রতিপালন। মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম (আঃ) ও সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ (সাঃ)-এর সুন্নাতকে বুলন্দ রাখা। রাসূল (সাঃ)-এর একটি হাদীসে এভাবে এসেছে- ‘‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে না আসে।’’ (ইবনে মাজাহ)

পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে দাতা রবের নৈকট্য লাভ করে থাকে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘‘আল্লাহর নিকট ওদের গোশত-রক্ত পৌঁছায় না। বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া বা খোদাভীতি।’’ (সূরা হজ্জ-৩৭)

সুতরাং মহান রবের সন্তুষ্টি লাভ, ত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং পশু-প্রবৃত্তিকে দমন করে তাকওয়া অর্জন কুরবানির মূল লক্ষ্য। কুরবানির পার্থিব উদ্দেশ্য হল পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, গরীব-মিসকিন, অভাবীদের আনন্দ দান, নিজে কুরবানির গোশত খাওয়া ও স্বজনদেরকে গোশত খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘‘যাতে ওরা ওদের কল্যাণ লাভ করে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে তার দেয়া পশুগুলো যবেহ করার সময়। অতপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দুস্থ-অভাবীদের আহার করাও।’’ (সূরা হজ্জ-২৮)

কুরবানির বিধানঃ
কুরবানি শরিয়াতসম্মত এ ব্যাপারে ওলামায়ে কিরাম সকলেই এক মত। তবে কুরবানি ওয়াজিব না সুন্নাত এ ব্যাপারে দুটি মত পাওয়া যায়।

একটি মত হল, কুরবানি ওয়াজিব। ইমাম আবু হানিফা, ইমাম আওযায়ী প্রমুখের মত এটা। তাদের দলিল হল, কুরআনের বাণী- ‘‘সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশে সালাত আদায় করুন ও কুরবানি করুন।’’ (সূরা-কাউসার) হাদীসে রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘‘হে মানবমন্ডলী! প্রত্যেক পরিবারের দায়িত্ব হল প্রতি বছর কুরবানি করা।’’ (ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ)

অপর মতে, কুরবানি সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মালেকসহ অধিকাংশ ওলামাদের মত এটা। তবে তারা আরো বলেছেন, সামর্থ্য থাকা অবস্থায় কুরবানি পরিত্যাগ করা মাকরূহ। সামর্থ্য থাকার পরও যদি কোন জনপদের লোকের সম্মিলিতভাবে কুরবানি পরিত্যাগ করে তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। তাদের দলিল হল রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘‘তোমাদের মাঝে যে কুরবানি করতে চায়, জিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার পর সে যেন কুরবানি সম্পন্ন করার আগে তার কোন চুল ও নখ না কাটে।’’ (সহীহ মুসলিম)

যাদের ওপর কুরবানি ওয়াজিব বা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহঃ
যে ব্যক্তির ওপর নিম্নোক্ত শর্তাবলী পাওয়া যাবে তার ওপর কুরবানি ওয়াজিব বা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ।
১. মুসলিম হওয়া : অমুসলিম ব্যক্তির ওপর শরিয়তের এ বিধান প্রয়োজ্য নয়।
২. স্বাধীন হওয়া : গোলাম বা দাস-দাসীর ওপর কুরবানি ওয়াজিব নয়।
৩. মুকিম হওয়া : মুসাফিরের ওপর কুরবানি ওয়াজিব নয়।
৪. সামর্থ্যবান বা ধনী হওয়া : গরীব বা মিসকিনের ওপর কুরবানি ওয়াজিব নয়।

উল্লেখ্য যে, কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য নিসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয় বরং কুরবানির দিন ব্যয়ের উদ্ধৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তুর নিসাব পরিমাণ মালিক হলে তার ওপর কুরবানি ওয়াজিব। দৈনন্দিন প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্যের মালিককে নিসাব মালিক বলা হয়।

কুরবানি বিশুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলীঃ
কুরবানি মুসলিমদের আর্থিক ইবাদতসমূহের অন্যতম ইবাদত। আর কোন ইবাদত কবুলের পূর্ব শর্ত দুটি, যা কুরআন ও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।
(১) ইখলাস বা একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশে হওয়া। যেমন সূরা মায়িদার ২৭নং আয়াতে আল্লাহ বলেন- ‘আল্লাহ তো মুক্তাদীদের কুরবানিই কবুল করে থাকেন।’

(২) তা যেন আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.)-এর নির্দেশিত বিধি-বিধান অনুযায়ী হয়। আল্লাহ তায়ালা সূরা কাহফের ১১০নং আয়াতে বলেন- যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সাক্ষ্য কামনা করে, সে যেন সৎ কর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে অংশীদার না করে।

বাহ্যিকভাবে কুরবানি সহীহ বা শুদ্ধ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে, তারমধ্যে-

১. এমন পশু দ্বারা কুরবানি দিতে হবে যা শরিয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেগুলো হল গরু, উট, মহিষ, ছাগল, দুম্বা, ভেড়া। কুরআনের পরিভাষায় এগুলোকে ‘বাহীমাতুল আনআম’ বলা হয়। কুরআনে এসেছে- ‘প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কুরবানির বিধান করে দিয়েছি, তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণস্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর ওপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে’। (সূরা হজ্জ-৩৪) 
গুণগত দিক দিয়ে উত্তম কুরবানির পশু হৃষ্টপুষ্ট, অধিক গোশত সম্পন্ন, নিখুত ও দেখতে সুন্দর হওয়া।

২. শরিয়তের দৃষ্টিতে পশুর নির্দিষ্ট বয়স হতে হবে। যেমন উট পাঁচ বছরের হওয়া, গরু বা মহিষ দুই বছরের হওয়া, দুম্বা, ভেড়া, ছাগল এক বছরের হওয়া। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমরা অবশ্যই নির্দিষ্ট বয়সের পশু কুরবানি করবে। তবে তা তোমাদের জন্য দুষ্কর হলে ছয় মাসের মেষশাবক কুরবানি করতে পার।’ (সহীহ মুসলিম)

৩. কুরবানির পশু যাবতীয় দোষ-ত্রুটি মুক্ত হতে হবে। যেমন হাদিসে আছে, বারা ইবনে আযেব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূল (সা.) আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন। অতপর বললেন- চার ধরনের পশু দিয়ে কুরবানি জায়েজ হবে না। অন্ধ, যার অন্ধত্ব স্পষ্ট, রোগাক্রান্ত, যার রোগ স্পষ্ট, পঙ্গু, যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট এবং আহত, যার কোন অংগ ভেঙ্গে গেছে। (তিরমিজি)

৪. ত্রুটিযুক্ত পশু দিয়ে কুরবানি করলে তা মাকরূহ হবে। যেমন শিং ভাঙ্গা, লেজ কাটা, কান কাটা ইত্যাদি।

৫. যে পশু কুরবানি করা হবে তার ওপর মালিকের পূর্ণ স্বত্ব থাকতে হবে, বন্ধকি পশু, জব্দ করা পশু বা পথে পাওয়া পশু দ্বারা কুরবানি করলে কুরবানি হবে না।

কুরবানির নিয়মাবলীঃ
কুরবানির জন্য পশু পূর্বেই নির্দিষ্ট করতে হবে। মুখের উচ্চারণ দ্বারা এভাবে বলা যায়, এ জন্তুটি আমি কুরবানির জন্য নির্দিষ্ট করলাম। কিন্তু আমি এ পশুটি কুরবানির জন্য রেখে দেব’ এ কথা দ্বারা পশু নির্দিষ্ট হবে না। কাজের মাধ্যমেও পশু নির্দিষ্ট করা যায়। যেমন- কুরবানির নিয়তে পশু ক্রয় করা এবং কুরবানির নিয়তে পশু যবেহ করা। এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়াবলী খেয়াল রাখতে হবে-

১. উক্ত পশু কুরবানি ব্যতীত অন্য কোন কাজে ব্যবহার করা যাবে না। যেমন, দান করা, বিক্রি করা। তবে কুরবানি ভালভাবে আদায়ের জন্য তার চেয়ে উত্তম পশু দ্বারা পরিবর্তন করা যাবে।

২. কুরবানির পশুর মালিক ইন্তিকাল করলে তার উত্তরাধিকারীদের (ওয়ারিশ) দায়িত্ব হল তা বাস্তবায়ন করা।

৩. এর থেকে কোন উপকার ভোগ করা যাবে না। যেমন- দুধ বিক্রি করা, কৃষি কাজে ব্যবহার করা, সাওয়ারি হিসেবে ব্যবহার করা, চামড়া বিক্রি করা, পশম বিক্রি করা। তবে পশম বিক্রির টাকা সদকা করে দিতে হবে অথবা চামড়া নিজের কাজে ব্যবহার করতে পারবে।

৪. কুরবানির দাতার অবহেলার কারণে পশু দোষযুক্ত হলে বা হারিয়ে গেলে বা চুরি হলে তার দায়িত্ব হল তার মত বা তার চেয়ে উত্তম পশু ক্রয় করে কুরবানি করা।

৫. যদি পশুটি হারিয়ে যায় অথবা চুরি হয়ে যায় আর কুরবানিদাতার ওপর পূর্ব থেকেই কুরবানি ওয়াজিব হয়ে থাকে তাহলে সে কুরবানি থেকে অব্যাহতি পাবে। আর যদি ওয়াজিব ছিল না কিন্তু সে কুরবানির নিয়তে পশু ক্রয় করেছে তাহলে চুরি হলে, মারা গেলে বা হারিয়ে গেলে তাকে আবার পশু কিনে কুরবানি করতে হবে।

৬. কুরবানির পশুর অংশ (গোশত, চর্বি, দড়ি, চামড়া ইত্যাদি) বিক্রয় করা বৈধ হবে না। কারণ, তা আল্লাহর উদ্দেশে নিবেদিত বস্তু। তাই কোনভাবেই পুনরায় তা নিজের ব্যবহারে ফিরিয়ে আনা বৈধ নয়।

৭. পশু ক্রয় করার পর যদি তার বাচ্চা হয়, তাহলে মায়ের সাথে তাকেও কুরবানি করতে হবে।

কুরবানির সময়সীমাঃ
কুরবানি নির্দিষ্ট সময়ের সাথে সম্পর্কিত একটি ইবাদত। এ সময়ের পূর্বে যেমন কুরবানি আদায় হবে না তেমনি পরে করলেও আদায় হবে না।
ঈদের সালাত আদায় করার পর থেকে কুরবানির সময় শুরু হয়। সালাত শেষ হওয়ার সাথে সাথে পশু কুরবানি না করে সালাতের খুৎবা দুটি শেষ হওয়ার পর যবেহ করা উত্তম। কেননা রাসূল (সা.) এরকম করেছেন। হাদিসে এসেছে-

জুনদুব ইবনে সুফিয়ান আল-বাজালি (রা.) বলেছেন, রাসূল কুরবানির দিন সালাত আদায় করলেন অতঃপর খুৎবা দিলেন তারপর পশু যবেহ করলেন। (সহীহ বুখারী)

আর কুরবানির সময় শেষ হবে জিলহজ্জ মাসের তের তারিখের সূর্যাস্তের সাথে সাথে। সুতরাং কুরবানির পশু যবেহ করার সময় হল, চারদিন অর্থাৎ জিলহজ্জ মাসের দশ, এগারো, বারো এবং তের তারিখ। এ মতটিই সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য। রাসূল (সা.) বলেছেন- আইয়ামে তাশরীকের প্রতিদিন যবেহ করা যায়। (আহমদ) আইয়ামে তাশরীক বলতে কুরবানির পরবর্তী তিনদিন বুঝায়।

সাহাবায়ে কেরামের আমল দ্বারা প্রমাণিত হয়, কুরবানির পরবর্তী তিনদনি কুরবানির পশু যবেহ করা যায়। ইবনুল কাইয়ুম (রাহ) বলেন, আলী ইবনে আলী তালিব (রা.) বলেছেন- কুরবানির দিন হল- ঈদুল আযহার দিন ও পরবর্তী তিনদিন। অধিকাংশ ইমাম ও আলেমদের এটাই মত। তবে যারা কুরবানির সময়সীমা তিনদিন (দশ, এগারো ও বার তারিখ) বলেন, তাদের মতের সমর্থনে কোন প্রমাণ ও মুসলিমদের ঐকমত্য (ইজমা) প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

কুরবানির গোশত বণ্টনঃ
কুরবানির গোশত বণ্টন ও খাওয়া সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- অতঃপর তোমরা তা হতে আহার কর এবং দুস্থ, অভাবগ্রস্তকে আহার করাও। (সূরা হজ্জ-২৮)। রাসূল (সা.) বলেন- তোমরা নিজেরা খাও ও অন্যকে আহার করাও এবং সংরক্ষণ কর। (সহীহ বুখারী)

‘আহার করাও’ বাক্য দ্বারা অন্যদেরকে খাওয়ানো, দান করা বুঝানো হয়েছে। তবে কুরআন ও হাদীসে নির্দিষ্ট করে কতটুকু খাবে এবং দান করবে তা বলা হয়নি। উলামায়ে কেরাম কুরবানির গোশ্ত তিন ভাগে ভাগ করে একভাগ নিজের খাওয়া, এক ভাগ দুস্থ, গরিব, অভাবীদের জন্য দান করা এবং অপর ভাগ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীকে উপহার দেয়া মুস্তাহাব বলেছেন।

কুরবানির গোশত যতদিন ইচ্ছা সংরক্ষণ করা যাবে। তিন দিনের বেশি সংরক্ষণ করা যাবে না বলে যে হাদীস রয়েছে তার হুকুম রহিত হয়ে গেছে। তবে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার ব্যাখ্যা হল, দুর্ভিক্ষের সময় তিন দিনের বেশি সংরক্ষণ করা জায়েয হবে না। দুর্ভিক্ষ না থাকলে যত দিন খুশি সংরক্ষণ করা যাবে।

কুরবানিতে অংশীদার হওয়াঃ
কুরবানিতে অংশীদার হওয়া সম্পর্কে একাধিক হাদীস থেকে প্রমাণ লক্ষ্য করা হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস বলেন, ‘‘আমরা রাসূল (সা)-এর সাথে এক সফরে ছিলাম। এমতাবস্থায় কুরবানির ঈদ উপস্থিত হল। তখন আমরা সাতজনে একটি গরু ও দশজনে একটি উটে শরীক হলাম। (নাসাঈ, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ)

জাবির (রা) বলেন, ‘‘আমরা আল্লাহর রাসূল (সা) এর সাথে হজ্জ ও উমরার সফরে ছিলাম।

জাবির (রা) বলেন, ‘‘আমরা আল্লাহর রাসূল (সা.) এর সাথে হজ্জ ও উমরার সফরে ছিলাম। তখন আমরা একটি গরু ও উটে সাতজন করে শরীক হয়েছিলাম। (সহীহ মুসলিম)

মৃত ব্যক্তির পক্ষে কুরবানিঃ
কুরবানি মূলত যথাসময়ে জীবিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। অবশ্য ইচ্ছা করলে তার মৃত আত্মীয়-স্বজনের পক্ষ থেকেও কুরবানি করা যেতে পারে। এটা জায়েয ও সওয়াবের কাজ। যেহেতু রাসূল (সা.) ও তাঁর সাহাবাগণ নিজেদের এবং পরিবার-পরিজনদের পক্ষ থেকে কুরবানি করতেন। কুরবানি একটি সদকা। মৃত ব্যক্তির জন্য সদকা ও কল্যাণমূলক কাজ প্রয়োজন ও এটা তার জন্য উপকারী। অনেক সময় দেখা যায় ব্যক্তি নিজেকে বাদ দিয়ে মৃত ব্যক্তির পক্ষে কুরবানি করেন। এটা মোটেই ঠিক নয়। ভাল কাজ নিজেকে দিয়ে শুরু করতে হয় তারপর অন্যান্য জীবিত ও মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে করা যেতে পারে।

হাদীসে এসেছে আয়েশা (রা) ও আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) যখন কুরবানি দিতে ইচ্ছা করলেন তখন দুটি দুম্বা ক্রয় করলেন। যা ছিল বড়, হৃষ্টপুষ্ট, শিংওয়ালা, সাদা-কাল বর্ণের এবং খাসি। একটি তিনি তাঁর ও উম্মতের জন্য কুরবানি করলেন, যারা আল্লাহ একত্ববাদ ও তাঁর রাসূলের রিসালাতের সাক্ষ্য দিয়েছে, অন্যটি তার নিজের ও পরিবারবর্গের জন্য কুরবানি করেছেন। (ইবনে মাজাহ)

কুরবানির পশু যবেহকালে লক্ষণীয় কতিপয় দিকঃ
১. কুরবানিদাতা যদি শরিয়তসম্মত পদ্ধতিতে ভালভাবে যবেহ করতে পারে, তাহলে নিজের কুরবানির পশু নিজেই যবেহ করবেন। কেননা আমাদের প্রিয়নবী (সা.) নিজে যবেহ করেছেন। আর কুরবানি করা আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম হওয়ায় প্রত্যেকের কুরবানি নিজে যবেহ করার চেষ্টা করা উচিত। তবে কুরবানির পশু যবেহ করার দায়িত্ব অন্যকে অর্পণ করা জায়েয আছে। কেননা, হাদীসে এসেছে- ‘‘রাসূল (সা.) তেষট্টিটি কুরবানির পশু নিজ হাতে যবেহ করে বাকিগুলো যবেহ করার দায়িত্ব আলী (রা) কে অর্পণ করেছেন।’’ (সহীহ মুসলিম)

২. পশুর প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করা। এমন ব্যবস্থা নিয়ে যবেহ করা, যাতে পশুর অধিক কষ্ট না হয়। যবেহ যেন খুব তীক্ষ্ম ধারালো ছুরি দ্বারা করা হয়, যাতে সহজেই প্রাণ ত্যাগ করতে পারে। বধ্য পশুর সম্মুখে ছুরি শান দেয়া উচিত নয় (মাকরূহ)। যেহেতু নবী (সা.) ছুরি শান দিতে এবং তা পশু থেকে গোপন করতে আদেশ করেছেন এবং বলেছেন- ‘‘যখন তোমাদের কেউ যবেহ করবে, তখন সে যেন তাড়াতাড়ি করে’’। (ইবনে মাজাহ) একইভাবে একটি পশুকে অন্য একটি পশুর সামনে যবেহ করা এবং  যবেহ স্থানে টেনে নিয়ে যাওয়াও মাকরূহ।

৩. কুরবানীর পশু যদি উট হয়, তাহলে তাকে বাম পা বাঁধা অবস্থায় দাঁড় করে নহর করতে হবে। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-‘‘সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান অবস্থায় তাদের ওপর তোমরা আল্লাহর নাম উচ্চারণ কর’’। ইবনে আববাস (রা) বলেন, এর অর্থ হল তিনি পায়ে দাঁড়িয়ে থাকবে আর সামনের বাম পা বাঁধা থাকবে। (তাফসিরে ইবনে কাসির)

৪. যবেহকালে পশুকে কিবলামুখী করে শয়ন করাতে হবে। অন্যমুখী শুইয়েও যবেহ করা সিদ্ধ হবে। যেহেতু কিবলামুখী করে শুইয়ে যবেহ করা ওয়াজিব হওয়ার কোন শুদ্ধ প্রমাণ নেই। (আহকামুল ইযহিয়্যাহ)

৫. যবেহ করার সময় বিসমিল্লাহ বলতে হবে। কারণ এটা বলা ওয়াজিব। কারণ আল্লা তায়ালা বলেছেন- ‘‘যাতে আল্লাহর নাম নেয়া হয়নি তা হতে তোমরা আহার করো না, এটা অবশ্যই পাপ’’। (সহীহ বুখারী) যবেহকালীন সময়ে বিসমিল্লাহর সাথে ‘আল্লাহু আকবর’ যুক্ত করা মুস্তাহাব। হাদীসে এসেছে- ‘রাসূল (সা.) দুটি শিংওয়ালা ভেড়া যবেহ করলেন, তখন ‘বিসমিল্লাহ’ ও আল্লাহু আকবর’ বললেন’। (সুনানে দারেমী)

৬. যবে হতে রক্ত প্রবাহিত হওয়া জরুরি। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘‘যা খুন বহায় এবং যাতে আল্লাহর নাম নেয়া হয় তা ভক্ষণ করো’’ (সহীহ বুখারী)। রক্ত প্রবাহিত ও শুদ্ধ যবেহ হওয়ার জন্য চারটি অঙ্গ কাটা জরুরি; শ্বাসনালী, খাদ্যনালী এবং পার্শ্বস্থ দুটি মোটা শিরা।

৭. প্রাণ ত্যাগ করার পূর্বে পশুর অন্য কোন অঙ্গ কেটে কষ্ট দেয়া হারাম। ঘাড় মটকানো, পায়ের শিরা টাকা, চামড়া ছাড়ানো ইত্যাদি কাজ জান যাওয়ার আগে বৈধ নয়। যেহেতু পশুকে কষ্ট দেয়া আদৌ বৈধ নয়। পশু পালিয়ে যাওয়ার ভয় থাকলেও ঘাড় মটকানো যাবে না। বরং তার বদলে কিছুক্ষণ ধরে রাখা অথবা চেপে রাখা যায়। যবেহ করার সময় পশুর মাথা যাতে বিচ্ছিন্ন না হয় তার খেয়াল করা উচিত। তা সত্ত্বেও যদি কেটে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে তা হালাল হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। যবাই ছেড়ে দেয়ার পর কোন পশু উঠে পালিয়ে গেলে তাকে ধরে পুনরায় যবেহ করা হালাল।

কুরবানির শিক্ষাঃ
মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম (আ) তাঁর কলিজার টুকরা প্রিয় সন্তান ইসমাঈল (আ)কে আল্লাহর রাহে কুরবানি দেয়ার সুমহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যেভাবে ঈমানী অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মানব জাতিকে আত্মত্যাগের শিক্ষা দিয়ে গেছেন, সে আদর্শ ও প্রেরণায় আমরা আমাদের জীবনকে ঈমানী আলোয় উদ্ভাসিত করব, এটাই কুরবানির মৌলিক শিক্ষা। ত্যাগ ছাড়া কখনোই কল্যাণকর কিছুই অর্জন করা যায় না।

মহান ত্যাগের মধ্যেই রয়েছে অফুরন্ত প্রশান্তি। ত্যাগ ছাড়া কখনোই কল্যাণকর কিছুই অর্জন করা যায় না। কুরবানি আরও শিক্ষা দেয় যে, দুনিয়াবী সকল মিথ্যাচার, অনাচার, অবিচার, অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতন, হানাহানি, স্বার্থপরতা, দাম্ভিকতা, অহমিকা, লোভ-লালসা ত্যাগ করে পৃথিবীতে শান্তি ও সাম্যের পতাকা সমুন্নত রাখতে। পশু কুরবানি মূলত নিজের কু-প্রবৃত্তিকে কুরবানি করার প্রতীক। কুরবানি আমাদেরকে সকল প্রকার লোভ-লালসা, পার্থিব স্বার্থপরতা ও ইন্দ্রিয় কামনা-বাসনার জৈবিক আবিলতা হতে মুক্ত ও পবিত্র হয়ে মহান স্রষ্টার প্রতি নিবেদিত বান্দা হওয়ার প্রেরণা যোগায় এবং সত্য ও হকের পক্ষে আত্মোৎসর্গ করতে অনুপ্রাণিত করে। কুরবানির সার্থকতা এখানেই।

তাই পশু গলায় খঞ্জর চালানোর সাথে সাথে যাবতীয় পাপ-পঙ্কিলতা, কুফর, শিরক, বিদআত, হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধ, পরনিন্দা-পরচর্চা, পরশ্রীকাতরতা, সংকীর্ণতা, গর্ব-অহংকার, কৃপণতা, গীবতের মত পশুসুলভ আচরণ সযত্নে লালিত হচ্ছে তারও কেন্দ্রমূলে ছুরি চালাতে হবে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি মুহূর্তে স্রষ্টার আনুগত্য ও খোদাভীতির দ্বিধাহীন শপথ গ্রহণ করতে হবে।

সমাপ্তিলগ্নে আমরা এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, কুরবানি নিছক কোন আনন্দ-উল্লাসের উৎসব নয়, বরং আত্মত্যাগ, আত্মোৎসর্গ, আত্মসমর্পণের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এটি কোন কপোল-কল্পিত উপাখ্যান বা কল্পনা ফানুসের ফলশ্রুতি নয় বরং এ কুরবানির সংস্কৃতির প্রবর্তক স্বয়ং মহান রাববুল আলামীন। মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইবরাহিম (আ) ও স্বীয় পুত্র ইসমাঈল (আ) যে অবিস্মরণীয় ত্যাগ, আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও আনুগত্যের চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সেই স্মৃতিকে চিরস্মরণীয় ও পালনীয়কল্পে কুরবানির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আবহমানকাল থেকে চলে আসছে।

শুধু পশুর গলায় ছুরি চালানোতে কোন সার্থকতা নেই, বরং হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, অহমিকা-দাম্ভিকতা, অবৈধ অর্থ লিপ্সা, পরচর্চা-পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতাসহ যাবতীয় মানবীয় পশুত্বের গলায় ছুরি চালাতে পারলেই কুরবানি সার্থকতা বয়ে আনবে।

পঠিত : ১২৬১ বার

মন্তব্য: ০