Alapon

কেন নাস্তিকেরা ইসলাম ও নবী মুহাম্মদ এর উপর এত বেশি ক্ষিপ্ত?

সেদিন ক্লাস শেষে স্টুডেন্টদের সাথে ক্লাসরুমেই নানান একাডেমিক বিষয়ে কথা করছিলাম। তখন দেখলাম সদ্য এমএ পাস করা কয়েকজন স্টুডেন্ট রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে। একটু পরে তাদেরকে রুমে ডেকে নিলাম। তাদেরই একজন, যে কিনা চলাফেরা ও কথাবার্তায় অনেকখানি ব্যতিক্রমী ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। কি একটা প্রসঙ্গে একদিন সে আমাকে বলেছিল, “স্যার, আমার মা খুব মনে কষ্ট পাবে। তা না হলে আমি একজন নামকরা গ্যাং লিডার হতাম।” মনে পরে না তাকে কখনো দেখেছি সানগ্লাস ছাড়া। একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তাঁর কোনো চোখের সমস্যা আছে কিনা।

না, তার চোখে কোনো সমস্যা নাই। আসলে সে হলো একেবারে অন্যরকম একটা ছেলে। নেতা গোছের বলে মনে হয়। খুব সম্ভবত সে রাজনীতি করে। ক্ষমতাসীন দলের সাথে হতে পারে। অথবা প্রগতিশীল। ঠিক জানি না। কখনো জানতেও চাই নাই।

প্রতিটা ক্লাসে একজন স্টুডেন্টের সাথে আমি বিশেষ করে কথাবার্তা বলি। সে বুঝলে ধরে নেই অন্যরাও বুঝেছে। সাধারণতঃ অমনোযোগী স্টুডেন্টদের মধ্য থেকে কাউকে আমি বেছে নেই। এমনি করে সেকেন্ড ইয়ার কিংবা থার্ড ইয়ারে এই ছাত্রটিও ছিল আমার একদিনকার ক্লাসে ‘স্টুডেন্ট অফ দ্যা ক্লাস’। সেই থেকে ওর সাথে আমার আন্তরিকতা, সম্পর্ক।

ইদানিং সে কসমোলজি নিয়ে ইন্টারেস্টেড। মেধাবী হলেও তেমন কোনো পড়াশোনা করতো না। পরীক্ষার সময় শেষ হওয়ার বেশ খানিকক্ষণ আগে খাতা জমা দিয়ে বের হয়ে দোকানে বসে চা খাওয়া, এটি ছিল তার নিয়মিত অভ্যাস।

সে যাই হোক, আমাকে সে সালাম দিয়ে বলল, “স্যার, আপনাকে দুইটা প্রশ্ন করবো। ... আমার প্রথম প্রশ্ন হলো, যারা নাস্তিক তারা ইসলামের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি কথাবার্তা কেন বলে?

ওর দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল, নাস্তিকেরা নবী মোহাম্মদের উপরে এতো বেশি ক্ষিপ্ত কেন? তাদের কথা যদি সত্য হয়ে থাকে, অর্থাৎ নবী মোহাম্মদ যদি খারাপ, ভন্ড ও প্রতারকও হয়ে থাকেন, তাতে করে আস্তিকতা যেমন করে খন্ডন হয় না, তেমন করে নাস্তিকতাও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় না। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?

কিছু একটা লিখতে লিখতে এই দুই বিষয়ে ওকে যা কিছু বলেছি সেটা জানানোর জন্য এই লেখা।

হ্যাঁ, নাস্তিকরা ইসলামের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ভোকাল। এর কারণ তিনটি।

(১) যাদেরকে আমরা নাস্তিক হিসেবে আশেপাশে দেখি, তারা হয় মুসলিম পরিবারের সন্তান, অথবা মুসলিম প্রধান পরিবেশে গড়ে উঠেছেন। তাই তারা সঙ্গত কারণেই ইসলামের বিরুদ্ধে বেশি কথা বলেন। রিচার্ড ডকিন্সের মতো তারা ক্রিশ্চিয়ানিটি নিয়ে কথা বলা কিংবা প্রবীর ঘোষের মতো হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলার উৎসাহ বা প্রসঙ্গ খুঁজে পান না। এটা তো স্বাভাবিক।

(২) বর্তমানকালে প্রতিষ্ঠিত পাশ্চাত্য বস্তুবাদী সভ্যতার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে, দুনিয়াজোড়া আদর্শের বাজারে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী ও নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আদর্শ হচ্ছে ইসলাম। পাশ্চাত্য আধিপত্যের কাছে মুসলমানেরা পরাজিত। কিন্তু তাদের দৃষ্টিতে সঙ্গত কারণেই ইসলাম হলো রিট্রিট করা হাইলি পটেনশিয়াল থ্রেট।

আমরা জানি, পৃথিবীতে বর্তমানে 50 টির মতো উন্নত দেশ আছে। কিন্তু সিভিলাইজেশনাল পয়েন্ট অব ভিউ থেকে এই 50 টি দেশের আদর্শ কিন্তু মোটা দাগে একটাই। সেটি হচ্ছে বর্তমানকার ডমিন্যান্ট পাশ্চাত্য সভ্যতা। চীনের মাওবাদ বা কনফুসিয়ানিজম, জাপানের শিন্তইজম কিংবা ইন্ডিয়ার হিন্দুইজম, এগুলোর কোনোটিকেই বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতা নিজের জন্য হুমকি বলে মনে করে না।

আদর্শ হিসেবে কমিউনিজমের অবস্থান ইসলামের পরে। নিকট অতীতে পুঁজিবাদী পাশ্চাত্য সভ্যতার কাছে পরাজিত হওয়ার কারণে কমিউনিজমকে বর্তমান পশ্চিমা শক্তি নিজেদের জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখে না। তাইতো দেখা যায়, কমিউনিস্ট নাস্তিকেরা ইসলাম ঠেকানোর কাজে কার্যত পুঁজিবাদের ধারক-বাহক ও এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। কাউকে ঠেকাতে না পারলে মাস্তান টাইপের কোনো বড় ভাইকে ডেকে নিয়ে এসে তার পক্ষপুটে থেকে শত্রুপক্ষকে মোকাবেলার যে নীতি সেটি তারা অনুসরণ করছেন। তাদের দিক থেকে এটি ঠিকই আছে।

(৩) উপরের দুটি কারণের সাথে আরেকটি ভাইটাল কজ এক্ষেত্রে কাজ করে। সেটি হচ্ছে ইসলাম নিজেকে একটি সুসংহত সমগ্র তথা consistent whole হিসেবে দাবি করে। যার কারণে ইসলামের বিরোধী পক্ষ দেখাতে চায়, ইসলাম ততটা সুসংহত বা কন্সিস্তেন্ট নয়। তাদের দৃষ্টিতে, এতে রয়েছে নানা ধরনের সমস্যা ও অসংগতি। বিশেষ করে এর প্রবর্তক ও অনুসারীদের মধ্যে।

এই দৃষ্টিতে ইসলাম এর অবস্থান অনন্য। সব আদর্শকে দেখা হয় আরোহমূলক বা ইন্ডাক্টিভ পদ্ধতিতে। এটিকে bottom-up অ্যাপ্রোচও বলা চলে। অথচ, ইসলাম ছাড়া সব মত, পথ, ধর্ম ও আদর্শকে এই দৃষ্টিতে দেখা হয় যে, এটির ভালো দিক কী কী; সংশ্লিষ্ট এই মত, পথ, ধর্ম বা আদর্শের অবদান কতটুকু, ইত্যাদি। এই নির্দিষ্ট মত, পথ ও ধর্ম বা আদর্শ থেকে আমি কতটুকু নিতে পারি।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আপনি মার্কসবাদের 10 টা ভুল ধরেন, তাতে কিছু আসে যায় না। বরং পুঁজিবাদের গ্রাস থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচানোর জন্য মার্কসবাদের যে অবদান, সেটাকেই শত্রু মিত্র উভয়পক্ষ বড় করে তুলে ধরেন। ব্যক্তিমার্কসের চরিত্র বিশ্লেষণ তো নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক। কেউ সেটা করে না। আপনি শ্রীকৃষ্ণের নানা ধরনের কাজ কর্মের সাথে যতই দ্বিমত পোষণ করেন না কেন, তাতে কিছু আসে যায় না। কেননা, তিনি তো আসলে দেবতা। পৃথিবীতে এসেছেন অবতার হিসেবে। আমাদের মত সত‍্যিকারের মানুষ তো নন।

এর বিপরীতে, ইসলাম সম্পর্কে মানুষ ভাবে, আমি এটাকে নিবো, নাকি নিবো না। ইসলামকে যে আংশিকভাবে নেয়া যায় না, সেটা ইসলামের সমালোচক ও শত্রুরাও ভালো করে জানেন। নিতান্ত অজ্ঞ ও বেকুব জন্মগত কালচারাল মুসলমানদের কথা অবশ্য ভিন্ন।

ওই ছাত্রটির দ্বিতীয় প্রশ্নের প্রসঙ্গটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তাওহীদ ও রিসালাত এর সম্পর্ক ক্রমশোপানমূলক বা হায়ারারকিক্যাল। তাওহীদ যদি যুক্তিতে না টিকে তাহলে রেসালতও টিকবে না। কিন্তু, ব্যক্তি রাসূলকে বা তাঁর রেসালতের দাবীকে কেউ যদি ‘খন্ডন'ও করে তাতে করে স্বয়ং তাওহীদের ধারণা বাতিল হয়ে যাবে, এমনটা নয়।

যুক্তি ও তর্কের খাতিরে কথার কথা হিসেবে যদি আমরা ধরেও নেই, নবী মোহাম্মদ (স) এর রেসালতের দাবি মিথ্যা, তাতে করে মানুষের মধ্যে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠা মৌলিক ও অস্তিত্ববাদী প্রশ্নগুলো যে কনক্লাসিভলি আনসারড হয়ে গেছে, অথবা অটোমেটিক্যালি নাই হয়ে যাবে, তা তো না।

সত্যিকারের নাস্তিক্যবাদী পৃথিবী তখনই গড়ে উঠবে যখন সেখানে ‘নাস্তিক্যবাদ’ নামে কোনো কিছু থাকবে না। ধর্মের সাথে সাথে নাস্তিক্যবাদেরও অবলুপ্তি ঘটতে হবে। অবশ্য তাতে করে যে সত্যিকারের নাস্তিক্যবাদী পৃথিবী গড়ে উঠবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। কেননা, সেখানকার সেই ‘নাস্তিক্যবাদী পৃথিবীতে’ (?) জন্ম গ্রহণ করা শিশুদের মনে স্বভাবতই কিছু অস্তিত্ববাদী মৌলিক প্রশ্নের উদ্রেক ঘটবে, যে প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজতে গিয়ে মানুষ স্রষ্টার অস্তিত্ব বা তাওহীদের ধারণা পর্যন্ত পৌঁছে।

ধর্মকে হটিয়ে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিলেও চিন্তাশীল যে কোনো মানুষের মধ্যে প্রশ্ন জাগবে, “আমি কে?”, “এই জগৎটা এভাবে কেন?” “অন্য রকম হলো না কেন?” “আমার সাথে এই জগতের সম্পর্ক কী?” “আগে কী ছিল? বা পরে কী হবে?” "কেন আমি নৈতিক হবো?" "ন‍্যায়-এর ভিত্তি ও রুপরেখা কী হতে পারে?" ইত্যাদি।

বলাবাহুল্য, এই অস্তিত্ববাদী মৌলিক প্রশ্নগুলোর বিষয়ে সম্ভাব্য যেসব দার্শনিক উত্তর হতে পারে বা আছে, ইসলামের তৌহিদ ধারণা হচ্ছে তার অন্যতম। উপরোল্লেখিত মৌলিক প্রশ্নগুলোর এক ধরনের উত্তর হতে পারে আস্তিকতা। এর পক্ষে দার্শনিক ভিত্তি আছে। এর অন্য একটি বিকল্প ধারার উত্তর হতে পারে নাস্তিকতা। এর পক্ষেও আছে দার্শনিক যুক্তি। এরই মাঝে আছে অজ্ঞেয়বাদের অবস্থান, যার পক্ষেও রয়েছে মানবিক তথা দার্শনিক যুক্তি। ব্যক্তির সুনির্দিষ্ট ধাঁচের মন-মানসিকতা ও চিন্তাধারার নিরিখে প্রত্যেক ধরনের যুক্তিই শক্তিশালী।

দর্শন আপনাকে বিকল্প পথগুলোর সন্ধান দিবে। কোনো বিষয়ের পক্ষে বা বিপক্ষে কী কী যুক্তি থাকতে পারে, কোন দিকে গেলে কী হতে পারে, কোন পক্ষের কী সুবিধা ও কী অসুবিধা ফিলোসফি তা আপনাকে বলে দিবে। দেখিয়ে দিবে। ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আপনাকে, আমাকে ও প্রত্যেককে শেষ পর্যন্ত নিজের পথ নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে। বা নিতে হয়।

কোনো ধর্মের প্রচারক বিশেষকে বা সব ধর্মপ্রবর্তক ও ধর্মপ্রচারককে বা সব ধর্মকে সামগ্রিকভাবে আপনি যতই মিথ্যা প্রমাণ করেন না কেন, উপরে উল্লেখিত অস্তিত্ববাদী মৌলিক প্রশ্ন থেকে যাবে। এগুলো থেকে কারো নিস্তার নাই। হোন তিনি শিক্ষিত অথবা অশিক্ষিত, ছোট কিংবা বড়, একালের কিংবা সেকালের।

বিষয়টিকে এই দৃষ্টিতে দেখলে বুঝা যাবে, যারা নবী মুহাম্মদ এর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনায় লিপ্ত তারা আসলে নাস্তিক নামের কলঙ্ক। এ ধরনের ইসলামবিদ্বেষী নিউ-এথিস্টগণ আসলে ছদ্মনাস্তিক। কালচারাল মুসলিমদের মত তারা কালচারাল নাস্তিক। তাদের বুদ্ধিবৃত্তির লেভেল ও কথাবার্তার রুচি অতীব নিম্নমানের। যদিও তাদের অনেকেই উচ্চতর ও বাহারি অ্যাক্যাডেমিক ডিগ্রীধারী। কথায় বলে, “বৃক্ষ তোমার নাম কি? (উত্তর হচ্ছে) ফলে পরিচয়।” ফিলোসফির দৃষ্টিতে তাদের এই কুৎসা ও বিদ্বেষপ্রবণ অ্যাপ্রোচ হচ্ছে ব্যক্তি আক্রমনমূলক কুযুক্তি চর্চা, যাকে আমরা পারসন ফেলাসি হিসেবে জানি।


পঠিত : ১৩০৩ বার

মন্তব্য: ০