Alapon

মাশরাফিঃ আমাদের ক্রিকেটের রাজপুত্র

মাশরাফি বিন মর্তুজা, এই নামটাই একটা আলাদা অনুভূতি, আলাদা আবেগ। বেশ কয়েক বছর ধরে স্টেডিয়ামে একটা জিনিস খেয়াল করেছি। মাশরাফি যখন ব্যাট করতে নামেন তখন প্রায় শতভাগ দর্শক উঠে দাড়ায়, বিশাল করতালি দেয়। এই পরিমাণ ভালোবাসা, শ্রদ্ধা বাংলাদেশের আর কোন খেলোয়াড় কখনো পেয়েছেন কিনা আমি জানিনা, অন্তত আমি দেখিনি। আচ্ছা কেউ কি আশা করেন তিনি সেঞ্চুরী করবেন? না। আশা করেন মাশরাফি নিয়মিত পাঁচ উইকেট নিবেন?

মনেহয় সেটাও না, কারণ বারবার ইনজুরির কারণে মাশরাফি বাধ্য হয়েছেন উইকেট নেবার বদলে সঠিক লাইনে বল করে রান আটকে ব্যাটসম্যানদের চাপে ফেলতে যাতে অন্য বোলাররা উইকেট পায়। নিজের পেস বিসর্জন দিতে হয়েছে ইনজুরির জন্য। এক সময় নতুন বলে বাংলাদেশের একমাত্র ভরসা ছিলেন মাশরাফি, মুস্তাফিজ আসার পর নতুন বলটা তুলে দিয়েছিলেন ফিজের হাতে। সাম্প্রতিক সময়ে ফিজ, রুবেল, তাসকিনরা কিছুটা বিবর্ণ; তাই আবার নতুন বল তুলে নিচ্ছেন হাতে। এটাকেই বুঝি বলে “ক্যাপ্টেন লিডিং ফ্রম দা ফ্রন্ট”। হেটার্সরা কত কথা বলে, ক্যাপ্টেন কোটায় খেলেন, এই সেই..অমুক তমুক…. পরিসংখ্যান কিন্তু বলে গত বিশ্বকাপের পর থেকে মাশরাফিই দেশের সেরা পেসার। আচ্ছা মাশরাফির হেটার্স কেন থাকবে দেশে?

এই মাশরাফি বাংলাদেশের প্রথম স্পিডস্টার, একটা প্রকৃতি প্রদত্ত উপহার বাংলাদেশের জন্য। প্রথম যখন দলে আসেন প্রচন্ড গতি ছিলো বলে। সম্ভবত মাশরাফিই বাংলাদেশে পেস বোলিং এর একটা স্ট্যান্ডার্ড বা ক্রেজ তৈরী করেছিলেন যার ফলে তাকে দেখেই কিশোররা পেসার হতে চেয়েছে। অবশ্যই মাশরাফির আগেও আমাদের দেশে ভালো মানের পেসার ছিলেন, যেমন শান্ত, প্রিন্স, আনিসুর রহমান, সাইফুল ইসলাম প্রমুখ, তবে সে সময় ক্রিকেটের উপর এতো আগ্রহ ছিলোনা মানুষের।

আজকে ১৭ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার, কোনদিন ডিসিপ্লিন ভাঙার অভিযোগ উঠে নাই, একটা বিতর্ক হয়নি তাকে নিয়ে। মাশরাফির তুলনা কেবল মাশরাফি নিজেই। প্রতিবার মাঠে নামার সময় মাঠের ভেতর ডান পা আগে দিয়ে মাটিতে সালাম করে আকাশের দিকে তাকিয়ে যখন ব্যাটিং এ নামেন, অন্যরকম এক আবেগ ছুঁয়ে যায় সবাইকে। তার বক্তব্য- ক্রিকেট রুটি রুজি তাই সালাম করি মাঠ, আর আকাশের দিকে তাকাই আল্লাহর নাম নিয়ে তাঁকে স্মরণ করে।

মাঠের ভেতর এবং মাঠের বাইরে এমন শ্রদ্ধাভাজন ক্রিকেটার এই দেশে আর আসেনি। মাশরাফি হাঁটলেই মানুষ খুশি, সিঙ্গেল নিলেই খুশি, বল ধরলেই খুশি। আর কিছু না করলেও, শুধু মাঠে থাকলেই মানুষ খুশি। আমার অনেকদিন আগে থেকেই মনেহয় মাশরাফি ক্রিকেটের সীমানা ছাড়িয়ে দেশ এবং রাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষে পরিনত হয়েছেন। মাশরাফি একটা কথা বললে, কোন বিষয়ে মন্তব্য করলে সেটা মানুষের উপর ভালোভাবেই প্রভাব ফেলে। জীবনের যেকোন পর্যায়ে সংগ্রামরত মানুষের জন্য মাশরাফি একটা প্রেরণা, নিশ্চিত এই ব্যাপারে আমি। আমরা ছোট বেলায় রবার্ট ব্রুস আর মাকড়সার গল্প শুনেছি, কিন্তু হার না মানা, হাল না ছাড়ার কথাই যদি বলি তাহলে মাশরাফির ফিরে আসার গল্পগুলা কম কিসে?

ইদানিং একটা জিনিস ভাবলেই কষ্ট পাই, মাশরাফি আর কয়বছরই বা খেলবেন? সম্ভবত সামনের বিশ্বকাপ পর্যন্তই? তারপর কোথায় পাবো মাশরাফির মতো একজন ক্রিকেটার? মাশরাফির মতো একজন অনুপ্রেরণাদায়ী অধিনায়ক সহজেই কি পাবো আমরা? একজন অধিনায়ককে মাঠের বাইরেও সর্বজন শ্রদ্ধেয় হতে হয়। সেই জায়গায় মাশরাফি সবার চেয়ে এগিয়ে। দেশের ক্রিকেটে অসংখ্য মানুষের অবদান আছে, ক্রিকেট ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে অনেক মানুষের অবদান জানতে পেরেছি। সবার প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, মাশরাফি আমার চোখে বাংলাদেশের প্রথম লিজেন্ড। এর ব্যাখ্যা এখানে দেয়া সম্ভব না। কয়েক প্যারাগ্রাফ লিখে মাশরাফিকে প্রকাশ করার সাধ্য আছে কার? আমারতো মোটেই না। আমি শুধু মাশরাফির একজন ভক্ত, একজন ফলোয়ার। ক্রিকেটার মাশরাফির চেয়ে আমার কাছে মানুষ মাশরাফি আরো বেশি শ্রদ্ধেয়, মানুষ মাশরাফির ভক্ত আমি, ক্রিকেটার মাশরাফির চেয়েও। আর এটা হয়েছে “মাশরাফি” বইটা পড়ার পর থেকে। কি অসাধারণ সব জীবনবোধ মানুষটার! আমরা ক্রিকেটে দেশপ্রেম খুঁজি অথচ একটা কলার খোসা ডাস্টবিনে না ফেলে রাস্তায় ফেলে রাখি! মানুষ মাশরাফিকে জানতে হলে এই বইটা সবার জন্য পড়া বাধ্যতামূলক।

আমার জীবনে তিনবার সরাসরি কথা বলার সুযোগ হয়েছে মাশরাফির সাথে, প্রতিবার এতো ভালো ব্যবহার পেয়েছি যে আমি মুগ্ধ। প্রথমবার আমি কলেজে পড়ি। কলেজ ইউনিফর্ম পরে মিরপুরের ইনডোরের বাইরে দাঁড়িয়ে কথা হয়েছিলো। তখন এতো কড়াকড়ি ছিলোনা, সরাসরি নেট প্র্যাকটিস দেখা যেত মাঠে ঢুকে, ইনডোরের গ্রিল থেকে অনুশীলন দেখা যেত। সেদিন প্রায় দশ মিনিট কথা বলেছিলেন, দোয়া চেয়েছিলেন ২০০৭ বিশ্বকাপের জন্য। তখন স্টার বলতে মাশরাফি আর আশরাফুল; সাকিব মাত্র দলে এসেছেন আর তামিম তখনো পরিচিত না সেভাবে। মনেহয়, কেবল দলে চান্স পেয়েছেন। সেদিন আরো কথা হয়েছিলো প্রয়াত মানজারুল ইসলাম রানা এবং শাহরিয়ার নাফীসের সাথেও। সেদিন নেয়া মাশরাফির এই অটোগ্রাফটা আমার সারাজীবনের এক অমূল্য সম্পদ। তখন মোবাইল ক্যামেরা ছিলো বটে, তবে সেলফির চলন ছিলোনা! মানুষ অটোগ্রাফ নিতেই বেশি পছন্দ করতো।

neon aloy মাশরাফি নিয়ন আলোয়

আমাদের মাশরাফি গেল বছর সেরা বাঙালির পুরস্কার নিয়েছেন। বিষয়টা আমাদের জন্য অবশ্যই গর্বের। এটা নিয়ে অনেক মানুষের নেগেটিভ মন্তব্য দেখেছি। কিছুদিন আগে উত্তর কলকাতার একজনের একটা স্ট্যাটাস পড়েছিলাম, তিনি বলেছেন কলকাতায় মাশরাফির অনেক ভক্ত আছেন। তারা মাশরাফিকে দেশ হিসেবে না বাঙালি হিসেবে সমর্থন করেন, পছন্দ করেন। মাশরাফির লড়াই, সংগ্রাম, একটা দলকে দারুণ ভাবে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেকোন বাঙালির জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে। এই পুরস্কার তেমনই। এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা মারাত্মক বাজে মানসিকতার পরিচয়।

শেষ করবো একটা মজার বিষয় দিয়ে। আমার আম্মু মনে হয় মাশরাফির আরো বড় ফ্যান। আম্মুর মুখে কেবল মাশরাফি আর মাশরাফি। প্রায়ই বলেন তার খুব ইচ্ছা মাশরাফির সাথে দেখা করার। আম্মুর ভাষায় “মরার আগে কি মাশরাফির সাথে একবার দেখা হবেনা? সরাসরি তার খেলা দেখবো না?”। সবসময় মাশরাফির জন্য দোয়া করেন আম্মু, আবার যেন ইনজুরিতে না পড়ে। সামান্য ব্যাথা পেলে বা এইরকম কোন খবর আসলেই বিচলিত হয়ে যান, দোয়া দুরুদ পড়া শুরু করেন!

যাইহোক, আম্মুকে বলেছি খুব দ্রুতই সরাসরি মাশরাফির খেলা দেখাবো মাঠে নিয়ে, আর সামনাসামনিও দেখা করাবো। মাশরাফির সাথে দেখা করাই যায়, বাড়িতে থাকলে দিনে অন্তত একবার বাসার নীচের চায়ের দোকানে এসে বসেন, মানুষের সাথে কথা বলেন। সেসময় তার ঘাড়ে প্রিয় পোষা টিয়াপাখিটাও শুনেছি থাকে। যেটা নাকি চার, ছয়, আউট, ইস! হলোনা! ধরে দিবানি, ম্যাশ, মাশরাফি, সাকিব ইত্যাদি বলতে পারে!

একজন সাধারণ ক্রিকেটভক্ত এবং মাশরাফির ফ্যান হিসেবে আমি চাই মাশরাফি যতদিন খেলবেন যেন ইনজুরি মুক্ত হয়েই খেলতে পারেন। আর দেশের প্রতি তার অবদানের কথা যেন কেউ ভুলে না যায়। মাশরাফির অবসরের সিদ্ধান্ত যেন মাশরাফির হাতেই থাকে। মাশরাফি বলেছেন তার সময় শেষ হয়ে আসলে তিনিই সবার আগে বুঝতে পারবেন এবং নিজেই অবসর নিবেন। এইটুকু বিশ্বাস মানুষটার উপর রাখতেই হবে। অবশ্যই রাখতে হবে কারণ মানুষটা যে মাশরাফি বিন মর্তুজা!

 

পঠিত : ৭৪৭ বার

মন্তব্য: ০