Alapon

কওমী রাজনীতির হালচাল

বাংলাদেশে কওমীদের গ্রুপ কয়টা? মানে তারা কয়টি ধারায় বিভক্ত? এর উত্তর দেয়া কোন সহজ কথা নয়। তবে সহজে যেটা বলা যেতে পারে তা হলো বাংলাদেশে যে কয়টা বড় কওমী মাদ্রাসা আছে তাদের গ্রুপও ততটা। এখানেই শেষ নয়, শীর্ষ যে কয়টা মাদ্রাসা আছে সেখানেও তারা দুই বা তিনভাগে বিভক্ত।

তাদের এই শতধা বিভক্ত হওয়ার নানাবিধ কারণ রয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই হলো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণ। ফিকহীগত কারণ খুবই সামান্য। ঈমানের দৃঢ়তা ভিত্তিতেও তাদের বিভক্তি লক্ষ্যনীয়।

বামদের আর ইসলামপন্থীরা যে কখনোই একত্রিত হতে পারে না তা কারো অজানা ছিলো না। যেমন অজানা ছিলো না মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং লিয়াকত আলীদের। পাকিস্তান রাষ্ট্র যখন গঠিত হচ্ছিলো তখনো এর ব্যাপক বিরোধীতা করেছিলো এদেশের কওমীদের একটি বড় অংশ। যেহেতু কওমীরা সাধারণত দেওবন্দ মাদ্রাসার অনুগত তাই তাদের সিদ্ধান্ত মেনেই বেশিরভাগ কওমী আলেম পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের চরম বিরোধীতা করেছিলো।

১৯৪৭ সালের আগে সিলেট আসামের অংশ ছিলো। মুসলিম লীগ চেয়েছিলো যেহেতু সিলেটে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ তাই সিলেট যেন পাকিস্তানের অংশ হয়। এর বিরোধীতা করেছে বাংলাদেশের কওমী আলেমরা।

প্রায় ৭০% মুসলিম হলেও পাকিস্তানে যোগ দেয়ার ব্যাপারে গণভোটে অল্পের ব্যবধানে মুসলিম লীগ জিতেছে। সেসময় এদেশের মুসলিমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছিলো কংগ্রেসী মুশরিকরা ও কওমী আলেমরা একইসাথে সিলেটকে আসামের সাথে রাখার জন্য ক্যাম্পেইন করেছিলো।

যাই হোক কওমীদের আরেকটি দূর্বলতা হলো এরা বেফাঁস (মূলত মিথ্যা বললে ভালো হতো) কথা বলে। আজকের এই সময়ে এসে বাংলাদেশের বেশিরভাগ কওমী আলেম বলে থাকেন আবুল আ'লা মওদুদী রঃ কত খারাপ! তিনি পাকিস্তানের বিরোধী ছিলেন। ইসলামী রাষ্ট্রের বিরোধী ছিলেন।

অথচ বিষয়টা তেমন কখনোই ছিলো না। মাওলানা মওদুদী পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্যই কাজ করছিলেন। কিন্তু যারা পাকিস্তানের রাষ্ট্রের কর্ণধার ছিলেন তাদের ব্যাপারে কোন আস্থা ছিলো না মাওলানা মওদুদী'র। মওদুদী রঃ যা বলতে চেয়েছেন তা হলো, যে ইসলামী রাষ্ট্রের স্বপ্ন এই জাতিকে দেখানো হচ্ছে তা বাস্তবায়ন করার যোগ্যতা ও ইচ্ছা কোনটাই নেই মুসলিম লীগ তথা জিন্নাহ গংদের। কারণ তারা মুখে বলে ইসলামী রাষ্ট্র অথচ তারা আদতে মোটেই ইসলামিক নন। তারা ছিলেন জাতীয়তাবাদী ও সেক্যুলার। এই বিষয়টাই মওদুদী রঃ ক্লিয়ার করেছিলেন 'ইসলামী হুকুমাত কিস্তারা কায়্যিম হতি হ্যায়' বইয়ে।

জামায়াতে ইসলামী তাই গোড়া থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে কাজ করে আসছিলো

শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে গিয়ে জিন্নাহ আলোচনা শুরু করেন পাকিস্তানের জন্য বৃটিশ পার্লামেন্টারি সিস্টেম উপযোগী, না আমেরিকান প্রেসিডেনশিয়াল সিস্টেম, তা নিয়ে। এতে ক্ষিপ্ত হয় ইসলামপন্থী মানুষরা।

১৯৪৮ সনের এপ্রিল মাসে করাচির জাহাংগীর পার্কে জামায়াতে ইসলামীর প্রথম রাজনৈতিক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান বক্তা ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী। তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য পেশ করেন। বক্তব্যে তিনি পাকিস্তানের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত গণপরিষদের প্রতি চারটি দফার ভিত্তিতে ‘আদর্শ প্রস্তাব’ গ্রহণ করার উদাত্ত আহ্বান জানান।

ইসলামী হুকুমাতের জন্য আন্দোলন চলতে থাকে। ইতিমধ্যে জিন্নাহ ইন্তেকাল করেন। গভর্ণর হন ঢাকার খাজা নাজিমুদ্দিন। প্রধানমন্ত্রী থাকেন লিয়াকত আলী খান। তার সরকার ১৯৪৮ সনের ৪ঠা অক্টোবর 'ইসলামী হুকুমাত' আন্দোলনের অন্যতম বলিষ্ঠ কণ্ঠ সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদীকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে। প্রায় ২০ মাস জেলে রাখার পরও যখন আন্দোলন কন্ট্রোল করা যাচ্ছিলো না তখন ১৯৫০ সনের ২৮শে মে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।

ইতিমধ্যে লিয়াকত সাহেব কিছু কওমী আলেমকে হাত করে ফেলেছেন। অনেকটা ফরিদ উদ্দিন মাসুদের মতো, হাসিনা যেভাবে তাকে ব্যবহার করেছে।

১৯৫০ সনের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন যে দেশের আলিম সমাজ যদি সর্বসম্মতভাবে কোন শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাব উপস্থাপন করে, গণপরিষদ তা বিবেচনা করে দেখবে। লিয়াকত আলী জানতেন যে বহুধাবিভক্ত আলিম সমাজ এই জটিল বিষয়ে কখনো একমত হতে পারবে না এবং কোন সর্বসম্মত প্রস্তাবও পেশ করতে পারবে না।

১৯৫১ সনের জানুয়ারি মাসে জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে করাচিতে সারা দেশের সকল মত ও পথের ৩১ জন শীর্ষ আলিম একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে একত্রিত হন। সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়েদ সুলাইমান নদভী। সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী একটি খসড়া পেশ করেন। আলাপ-আলোচনার পর চূড়ান্ত হয় একটি মূল্যবান দলীল “ইসলামী শাসনতন্ত্রের ২২ দফা মূলনীতি।”

কিন্তু অল্প কয়দিন সে আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে কওমী আলেমরা। ২২ দফার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দফা ছিলো কাদিয়ানীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করা।

জামায়াত সবসময় নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী। পাকিস্তানের সেসময়ের শাসকদের গড়মসির কারণে কওমী আলেমরা কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট একশন কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করে। তারা কয়েকটি স্থানে কাদিয়ানীদের হত্যা করে।

দাঙ্গা লেগে যায়। দাঙ্গা কন্ট্রোল করতে সেনাবাহিনী নামাতে হয়। অবশেষে দাঙ্গার জন্য মওদুদী রঃ কে গ্রেপ্তার ও ফাঁসীর হুকুম দেয়া হয়। কারণ কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার দাবী প্রথমে উত্থাপন করেন মওদুদী রঃ। ইসলামী হুকুমাতের আন্দোলন নস্যাৎ হয়ে যায় অনেকটা।

এরপর বহুদিন কওমী আলেমরা কোন বিষয়ে একত্রিত হতে পারেন নাই। লিয়াকতের কাছে যারা বিক্রি হয়েছিলো তারা অবস্থা বেগতিক দেখে চুপসে গিয়েছিলো। আইয়ুব এই কওমী আলেমদের বিভেদ সবসময় জিইয়ে রাখতো। এটা সকল স্বৈরশাসকের মতো আইয়ুবের দুর্দান্ত পলিসি ছিলো।

বিশ বছর পর ১৯৭১ সালে ভারতীয় মুশরিকদের বিরুদ্ধে তারা আবার একত্রিত হতে পেরেছিলো। এর খেসারত হিসেবে ১৬ ডিসেম্বরের পর এদেশের কওমী মাদ্রাসাগুলোতে কারবালা বয়ে গেছে। বহু কওমী আলেমকে শাহদাতবরণ করতে হয়েছিলো। আলেমদের একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল ছিলো 'নেজামে ইসলাম পার্টি'। সেই দলটিও আর মাথা সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। যার বর্তমান আমীর হেফাযতে ইসলামের নায়েবে আমীর মুফতি ইজহার।

১৯৭১ এ যারা বেঁচে গিয়েছিলো তাদের বেশিরভাগই আলেম হত্যাকারিদের সাথে হাত মিলিয়ে এখনো পর্যন্ত বেঁচে আছে।

২০১৩ সালে আবার কওমী আলেমরা একত্রিত হতে পেরেছেন নাস্তিক্যবাদী সরকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু সবাই কি এসেছেন? না, অনেক মাদ্রাসা যোগ দিতে সক্ষম হয় নি নাস্তিকদের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চট্টগ্রামের পটিয়া মাদ্রাসা।

বাংলাদেশে কওমীদের মধ্যে এখন বড় রাজনৈতিক দল চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (ইআবা)। তারা নাস্তিক্যবাদী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগ দেয় নি বা যোগ দিতে পারে নি।

নাস্তিক বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিতে না পারলেও কোন কওমী আলেম হিফাযতে ইসলামে বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায়নি। একমাত্র ফরিদ উদ্দিন মাসউদ ছাড়া।

কিন্তু আবার যে লাউ সেই কদু। বরাবরের মতই অর্থের কাছে, ক্ষমতার কাছে, ভয়ের কাছে, লোভের কাছে কওমী আলেমদের অধিকাংশরা পরাজিত হয়েছেন।

আগেই বলেছিলাম কওমী আলেমরা প্রচুর বেফাঁস কথা বলে। কওমী সনদ ইস্যুতে জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় জামায়াতের কারণে নাকি তারা সনদ পায়নি। অথচ মূল কথা হলো তারাই কওমী সনদের সরকারি মানের বিরোধী ছিল কারণ তাতে নাকি তাদের সিলেবাসের মৌলিকত্ব নষ্ট হবে। সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপে কওমী মাদ্রাসা আলিয়া মাদ্রাসার মতো মানহীন (তাদের ভাষায়) হয়ে পড়বে ইত্যাদি।  

সনদের স্বীকৃতি তারা আওয়ামী সরকার থেকে পেয়েছে ভালো কথা, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু ১৩ দফার কী হবে? ১৩ দফা যে বাস্তবায়ন হয়নি এখনো! তের দফার জন্য যারা জীবন দিয়েছে তাদের সামনে কী জবাব দিবে কওমী আলেমরা। আজ হেফাযতের আমীর মুফতি শফি বলছেন শেখ হাসিনা তাকে মোহাব্বত করেন। তিনি নাকি কওমীদের ভালোবাসেন। আওয়ামীলীগ ভালো। কারণ আওয়ামীলীগের অনেকে নাকি তাদের মাদ্রাসায় মোটা টাকা দেয়। 

মোটা টাকার কাছে আর কত আত্মসমর্পন?  

পঠিত : ৮৪০ বার

মন্তব্য: ০