Alapon

সভ্যতার বিকাশে অসভ্য মানুষ


রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে মিরপুরে যাচ্ছি। জ্যামে দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে দু-চোখ ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল। হঠা-ই চিৎকার চেচামেচিতে ঘুম ভেঙ্গে চৌচির। একজন কেতা দুরস্ত প্রায় সাড়ে ৫ ফুট উচ্চতার শার্টপ্যান্ট ইন করা এক “স্টুডেন্ট” বাসের হেল্পারকে একের পর এক থাপ্পর মেরে চলেছেন !। আর হেল্পার থাপ্পর খাওয়ার প্রতি উত্তরে বারবার বলছেন, থাপ্পর মারছেন কেন ? কেতা দুরস্ত স্টুডেন্টকে জিজ্ঞেস করলাম হেল্পারের অপরাধ কি ? উত্তরে সে বলিল, হেল্পার তার কাছ থেকে স্টুডেন্ট ভাড়া অর্থাৎ হাফ ভাড়া নিচ্ছে না। আমি বললাম, আপনি কি ফুল ভাড়া দিয়েছেন ? সে বলল-না। আমি পুনরায় তাকে বললাম- ফুল ভাড়া দিলেন না ভালো কথা, কিন্তু মারতে গেলেন কেন ? সে নিশ্চুপ ! আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলাম বাসে এত এত যাত্রী, কেউই হেল্পারের পক্ষে একটি টু-শব্দও উচ্চারণ করল না। 

২ 
গত ১২/১০/১৮ ইং তারিখ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম “ফেসবুকে” একটি ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেছে। রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা ফার্মগেটে দিশারী বাসের ভিতর একটি কলেজ পড়ুয়া মেয়ে একজন পুরুষের কলার ধরে থাপ্পর মারছে। মারার কারণ পুরুষটি পাবলিক পরিবহনে ৫/৬ বার সিটের ফাঁকা স্থান দিয়ে মেয়েটির গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করছে। ভাবা যায় কতটা অসভ্য হলে একটি মেয়ের স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেওয়ার সাহস করতে পারে! হয়ত অন্য মেয়ে বা মহিলা হলে নিজেকে সামলে নিয়ে চুপ হয়ে বাড়ী ফিরত।

যৌন হয়রানির অভিযোগে গত পহেলা অক্টোবর টাঙ্গাইল শহরের বিন্দুবাসিনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের এক সহকারী শিক্ষক কে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে ছাত্রীরা। পরে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে এক বছরের কারাদন্ড দিয়ে ঐ কুলাঙ্গার ব্যক্তিকে জেলহাজতে পাঠানো হয়। পাশাপাশি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উক্ত শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। 

এরকম ঘটনা প্রতিদিন-ই আমাদের চারপাশে সংঘটিত হচ্ছে। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। সৃষ্টিকর্তা মানবজাতিকে একমাত্র বিবেক-বুদ্ধির সক্ষমতা দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করছেন। পৃথিবীতে হাজার হাজার বছর ধরে বসবাসরত মানব জাতি বন-জঙ্গল ছেড়েছে ঠিকই কিন্তু ছাড়তে পারেনি তাদের মনের পশুত্বকে। পৃথিবীর নির্মল নির্জলা পরিবেশকে আরো বেশী অশান্ত করে তুলেছে সভ্যতার পানি পান করা শিক্ষিত মানুষ গুলো। বন-জঙ্গলের আদিম পোষাক ছেড়ে তারা আধুনিক পোষাক-পরিচ্ছেদে নিজেকে পরিপাটি করে তোলার চেষ্টা অব্যাহত রাখলেও মুখের ভাষা কিংবা হাতের ব্যবহার তাদের আদিম যুগের স্টেশনে রেখে দিয়েছে। 

আদিম যুগ থেকে বর্তমানের তথ্য-প্রযুক্তির অত্যাধুনিক যুগে মানুষকে সভ্য করে তোলার জন্য কত লক্ষ লক্ষ বিলিয়ান ডলার খরচ করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখান থেকে শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণ করে প্রতিনিয়ত বাড়ী ফিরছে অসংখ্য শিক্ষার্থী। সনদের ভারে নিমজ্জিত হচ্ছে তাদের জীবন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় ডিগ্রির সাথে সাড়ে ৩ হাত দেহের উপর কত রং বে-রংয়ের পোষাকের মিতালী তাকে করেছে অনন্য। 

কিন্তু আজ সারা বিশ্বের অগণিত মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, এই শিক্ষা কি মানুষকে সভ্য করে গড়ে তুলতে পেরেছে? নাকি এটি একান্তই সনদ সর্বস্ব।। 

উপরের ঘটনা ৩টি অতিসাধারণ বিষয়। আপনি চোখ বন্ধ করে ১০০-১২০ সেকেন্ড একটু ভেবে দেখুন। দেখবেন এই সমাজের অধিকাংশ অপরাধমূলক কাজের সাথে জড়িয়ে শিক্ষিত সমাজ। তাহলে আমরা কোন দিকে যাচ্ছি? আমরা কি পুনরায় আদিম যুগে ফিরে যাচ্ছি নাকি আদিম যুগের চেয়ে ভয়াবহ কোন সময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। 

আমাদের দেশে শিক্ষার হার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। মানুষের মধ্যে দুটো সত্তা রয়েছে, একটি হলো মনুষ্যত্ব অপরটি হলো পশুত্ব। শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্যে, মানুষের মধ্যকার পশুত্ব বিনাশ করে তাকে একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা। শিক্ষা দ্বারা মানবের বুদ্ধিবৃত্তির পাশাপাশি হৃদয়বৃত্তি সৃষ্টি হবে। যখনই শিক্ষা তার মূল্য উদ্দেশ্যের রাস্তা গুলিয়ে ফেলছে তখনই বিপত্তি ঘটেছে। শিক্ষা আজ অর্থোপার্জনের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূল্যবোধহীন ও আদর্শিক লক্ষ্যহীন শিক্ষার কারণে সমাজের প্রতিটি স্তরে সৃষ্টি করছে খুন, ধর্ষণ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস আর নোংরামির মহোৎসব। 

আজ শিক্ষিত ব্যক্তিরা এই সমাজকে বড়ই অসভ্য নগরীতে পরিণত করছেন। নারী ধর্ষনের সেঞ্চুরী, হত্যার পর লাশকে কেটে অসংখ্য টুকরো করা, কলমের খোঁচায় হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি, নিরীহ মানুষের প্রতি অত্যাচার নির্যাতন, সাইবার ক্রাইমের মতো ভয়াবহ অপরাধ, মাদকের নেশায় বুঁদ থাকে শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা, বৃদ্ধ মা-বাবাকে ঘর থেকে বের করে দেওয়ার লজ্জাজনক ঘটনা ঘটছে অহরহ। বিশ্ববিদ্যালয়ে সবুজ ক্যাম্পাসে, কর্মস্থানে কিংবা যাতায়াতের মাধ্যম গুলোতে নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন হয়রানি প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই যেন ছোঁয়াচে রোগ। মহামারিত্ব ধারণ করছে সমাজের রন্ধে রন্ধে। 

অর্থলোভে পেয়ে বসেছে সমাজের শিক্ষিত মানুষের মনে মনে। হাসপাতাল গুলোতে চলে ডাক্তারদের টাকা গুনার উৎসব। তাই ডাক্তারদের আজ সবাই কসাই নামে ডাকতে দ্বিধা করছে না। আইন আদালত-পুলিশ প্রশাসনে চলে সর্বত্র ঘুষের রাজত্ব। যেখানে টাকাই প্রথম কথা বলার চলক। ন্যায়-নীতির আচার-বিচার কবে উঠে গেছে। সাংবাদিকতার নামে চলছে হলুদ সাংবাদিকতা। মিথ্যার ফুলঝুড়ি দিয়ে জাতিকে করা হয় বিভ্রান্ত। ছাত্ররাজনীতির নীতি আদর্শ তৈরী করছে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজ অস্ত্রবাজ ক্যাডার। লেজুর ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি ছাত্রদের পড়ালেখার টেবিল থেকে নিয়ে গেছে অনেক দূরে। ফলশ্রুতিতে শিক্ষা-দিক্ষা আজ চলে গেছে রসাতলে। নিরীহ শ্রমিক গোষ্ঠীকে বিদেশ পাঠানোর নামে কত টাকা পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে দু-কলাম চালানো জানা আদম ব্যবসায়ীরা। 

শিক্ষকরা স্কুল-কলেজে পড়ানোর চেয়ে নিজ কোচিং সেন্টারে কিংবা বাসায় পড়াতে বেশী উৎসাহী। শিক্ষকতার মহান পেশা কে আবার কেউ লাগিয়ে দিয়েছে লজ্জাজনক ট্যাগ। নিজ ছাত্রীকে কু-প্রস্তাব বা ধর্ষনের অভিযোগ এখন অহরহ পাওয়া যাচ্ছে। প্রেমের নামে গড়ে তুলছে অবৈধ সম্পর্ক। বনের পশুরাও তো এত নিকৃষ্ট হয় না। 

এতসব সমস্যা সমাধানের পথও রুদ্ধ শিক্ষিত সমাজের কাছে। তারা যদি সঠিক পথে ফিরে না আসে তাহলে জাতির কপালে দুঃখ ছাড়া আর কোন পথ খোলা নাই। ন্যায়-নীতি, নৈতিকতা, সামাজিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় প্রকৃত অনুভূতি বিবর্জিত শিক্ষা ব্যবস্থা বাতিল করে একটি সঠিক আদর্শিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে মানব সভ্যতা রক্ষার প্রধান কাজ। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যে অর্জনের জন্য প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আমূল পরিবর্তন করতে হবে। শিক্ষকদের মাঝে জাগিয়ে তুলতে হবে শিক্ষার মূলনীতি। শিক্ষকরা তাদের আদর্শ বিলিয়ে দিতে হবে শিক্ষার্থীদের মাঝে। তবেই কোন একদিন এই জাতির সত্তা জেগে উঠবে। প্রকাশিত হবে মানব সভ্যতার সত্যিকারের রূপ। সকল অন্যায় অবিচার, মিথ্যার ভান্ডার ভেঙ্গে বেরিয়ে আসবে নতুন সূর্যের আলোক রশ্মি। যা এই সমাজের ভাইরাস গুলো কে ধ্বংস করে দিবে প্রতি ঝলকে। 

পথে ঘাটে নিরীহ জনগোষ্ঠীর প্রতি অন্যায় দেখে কেউ চুপ করে থাকবে না। কেউ না কেউ প্রতিবাদ, প্রতিরোধের ঝংকার তুলবে নিজ বাহুতে, কন্ঠে ঝরবে বিপ্লবী উচ্চারণ। ইভটিজার,ধর্ষণকারী, দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, সন্ত্রাসীদের দল কে আশ্রয় নিতে হবে এই সমাজ থেকে বহু দূরে পাহাড়ের গুহায়। শুধুমাত্র অপেক্ষা শিক্ষিত সমাজ জেগে উঠার। 

অপরাধের মাত্রা যখনই বৃদ্ধি পেতে থাকে, তখন ঐ নগরীর সভ্যতার ভিত্তি দুর্বল হতে থাকে। একটা পর্যায়ে ভিত্তিস্তর দুর্বল হয়ে চাঁপা পড়ে মাটির নিচে। সুতরাং এই সমাজ-সভ্যতা চুড়ান্ত ক্ষয়ে যাওয়ার আগেই নিজেদের অপরাধ মূলক কাজ সংশোধন করে সমাজের মানুষকে সঠিক পথ দেখাতে হবে। তাহলেই কেবল যুগের বিকাশের সাথে সাথে সভ্যতারও বিকাশ ঘটবে। নচেৎ সভ্যতার বিকাশের পথের কাঁটা হয়ে দাড়াবে অসভ্য মানুষ। 

পঠিত : ১১৮৯ বার

মন্তব্য: ০