Alapon

জামাল খাশুগজিঃ রহস্যেঘেরা হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে যত কিছু

জামাল খাশুগজি পর্ব ১ঃ
ওয়াশিংটন পোস্ট এর কলামিস্ট, ২০১৭ সাল থেকে আমেরিকার ভার্জিনিয়াবাসী, সৌদি বংশোদ্ভূত, সৌদি যুবরাজ মুহম্মদ বিন সালমানের কঠোর সমালোচক জামাল খাশুগজির সম্ভাব্য হত্যাকাণ্ডে তুরস্কের অবস্থানঃ

জামাল খাশুগজিকে জীবিত অবস্থায় শেষবারের মতন দেখা গিয়েছিল ইস্তাম্বুলে অবস্থিত সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশকালে, যার পর থেকেই তিনি নিখোঁজ। জামালের বাগদত্তা খাদিজা চেঙ্গিজ তুর্কি, এবং জামালের অন্তর্ধানের সময় খাদিজা বাইরে একটা সাদা ভ্যানে তার জন্য অপেক্ষা করছিল, এবং জামাল ফিরে না আসায় খাদিজাই প্রথম তুর্কি পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে। তাই তুরস্কের অথোরিটি এই ঘটনাকে খুব সিরিয়াসলি নিয়েছে এবং নিতে বাধ্য।

বিগত বেশ কিছু বছর ধরে তুরস্কের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ নয়। রিসেন্টলি সৌদি আরব জোট কাতার বয়কট করলে তুরস্ক কাতারের ঘাটিতে সেনা পাঠিয়ে আর সৌদি আরব কাতারে বিভিন্ন বাণিজ্য বন্ধ করে দিলে সেই সময় তুরস্ক তাদের বাণিজ্য নিয়ে এগিয়ে এসে কাতারের বারোটা বাজা ঠেকিয়ে দেয়। সৌদি আরব কাতারকে প্রেশারে রেখে যা করাবে ভেবেছিল তার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় তুরস্ক। সেই থেকে দুই দেশের সম্পর্ক খুব শিতল, বলতে পারেন এই দুই দেশের মাঝে একটা কোল্ড ওয়ার চলছে। কুর্দি প্রশ্নেও সৌদি আরব আর তুরস্ক বিপরীত ক্যাম্পে আছে, যা তুরস্ককে খুদ্ধ করেছে।

তাই জামালের অন্তর্ধানের বা হত্যা রহস্য উদ্ঘাটন করে সৌদি আরবের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার এক হাত নেয়ার চেষ্টা তুরস্ক করতেই পারে। আর সেটাই লজিক্যাল। কিন্তু তাই বলে তুর্কিরা এই ঘটনা সাজিয়েছে সেটা বেশ দুর্বল যুক্তি।

এই পুরা ঘটনায় তুর্কি অথোরিটি হিসাব করে ধীরে ধীরে ঘটনার ব্যাপারে মুখ খুলেছে আর একের পর এক প্রমান সামনে আনছে। বলা হচ্ছে বেশ কিছু প্রমান সরাসরি আমেরিকান সিনেটরস আর হোয়াইট হাউস আর আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থার হাতেও তুলে দিয়েছে।

তুরস্ক এখন পর্যন্ত যা দাবী করেছে তা হলো সৌদি আরব থেকে ১৫ জনের এক এলিট হিট স্কোয়াড এসে জামাল খাশুগজিকে সৌদি কনস্যুলেটে হাড়কাটার যন্ত্র দিয়ে হত্যা করে তার লাশ সৌদি কন্স্যুলারের বাসায় গুম করে দিয়েছে। এই হিট স্কোয়াডের বেশ কিছু সদস্য সৌদি রাজপরিবারের খুব কাছের লোক, যাদের মাঝে একজন অটপ্সি বিশারদ। তুরস্ক প্রথমে প্রমান হিসাবে এই ১৫ জনের নাম সহ ছবি তাদের মিডিয়ায় প্রকাশ করেছে।

পরের দিন প্রকাশ করেছে এদের গাড়ীর লাইসেন্স প্লেটের নাম্বার সহ ভিডিও। যেই ভিডিওতে এদের গাড়িকে প্রথম কনস্যুলেটের বাইরে দেখা গেছে, এরপর জামাল কনস্যুলেটে প্রবেশ করার প্রায় ১ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের মাথায় গাড়িকে কনস্যুলেট ছেড়ে চলে যেতে দেখা গেছে, এরপরের ভিডিওতে দেখা গেছে গাড়িটি সৌদি কন্সুলারের বাসার গ্যারাজে গিয়ে প্রবেশ করতে।

১৫ সদস্যের এই টিম হত্যাকাণ্ডের (এলেজড) দিন একটি প্রাইভেট প্লেনে করে তুরস্কে আসে আবার সেই দিনই তারা সৌদি আরব ফেরত যায়। একই দিন এই কন্স্যুলুটে কর্মরত সকল তুর্কি সিকিউরিটি গার্ড আর তুর্কি নাগরিকদের সেদিন ছুটি দেয় হয়েছিল। মনে হচ্ছে তা করা হয়েছিল প্রমান লুকাতে।

এর পর তুরস্ক দাবী করে কনস্যুলেটের সুয়ারেজ সিস্টেম থেকে তারা আলামত সংগ্রহ করেছে যার দ্বারা তারা শিওর হয়েছে জামাল খাশকজিকে হত্যা করা হয়েছে। এবং তারা কন্স্যুলারের বাসায় মাটি খোঁড়ার অনুমতি চায়। আর এই হত্যাকাণ্ডের (এলেজড) রহস্য উন্মচনে সৌদি আরবকে সহযোগিতা করার জন্য আহবান করে, যা সৌদি আরব প্রথমে প্রত্যাখান করে।

আজ তুরস্ক দাবী করেছে তাদের কাছে এই হত্যাকাণ্ডের (এলেজড) অডিও আর ভিডিও প্রমান আছে। এতে সবাই ধরে নেয় যে তুরস্ক নিশ্চই ফরেইন দূতাবাসগুলোর ভিতরে আড়িপাতা যন্ত্র লাগিয়ে রেখেছে। দিনের দ্বিতীয়ার্ধে খবর প্রকাশ করেছে যে এই ভিডিও/অডিও ভিতর থেকে একজন রেকর্ড করেছিল যার সাথে তুরস্কের কোন সম্পর্ক নাই। আর তুরস্কের গোয়েন্দা সংস্থার হাতে সেই এভিডেন্স এসেছে।

তার কিছুক্ষন পরে আজকে তুরস্কের সরকারী নিউজ মিডিয়া আল সাবাহ খবর প্রকাশ করেছে যে জামাল খাশুগজি নিজেই সেই রেকর্ড ধারণকারী ব্যক্তি। জামাল সৌদি কনস্যুলেটকে সম্ভবত সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারেন নাই। তাই সেদিন কনস্যুলেটে প্রবেশ করার আগে নিজের আইফোন রেখে গিয়েছিলেন খাদিজার কাছে, আর তাকে কন্স্যুলেটের বাইরে অপেক্ষা করতে বলেছিলেন। নিজের পরনে ছিল আপেল ঘড়ি।

এই ঘড়ির রেকর্ড বাটন অন করেই তিনি কনস্যুলেটে প্রবেশ করেন, আর রেকর্ডকৃত অডিও/ভিডিও ক্লাউডে সংরক্ষিত হয়ে যায়। রেকর্ড ধারন করে জামালের উপর করা প্রশ্ন উত্তর, টর্চার , আর সবশেষে হত্যাকান্ড। সৌদি হিট স্কোয়াড জামালের আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে কিছু ফাইল এক্সেস করে তা ডিলিট করে দেয়, কিন্তু ব্যাকআপ কপি থেকে যায় ক্লাউডে। পরে এই আইফোন খাদিজা তুর্কি অথোরিটর হাতে তুলে দিলে ধারণকৃত অডিও/ভিডিও রেকর্ডিং তুর্কিদের হাতে চলে আসে।

এখন পর্যন্ত তুর্কিরা যা যা বলেছে তার একটাও মিথ্যা প্রমাণিত হয় নাই। আর এসব যদি মিথ্যা হয় তাহলে ধরা পড়লে তুর্কিদের বারোটা বেজে যাবে, তাই পড়তি অর্থনীতির সময় এত বড় গ্যাম্বেল তুরস্ক করবে বলে আমি মনে করি না। আর আমেরিকান সিনেটরদের ( ট্রাম্প নয়) রিএকশান দেখে অনুমান করছি এসব প্রমান তাদের কাছেও এসেছে, এবং তারাও বিশ্বাস করেছে।

অতএব, সৌদিদের এই খেল তাদের জন্য বিশাল দুঃসংবাদ বয়ে আনার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে, কিভাবে?

জামাল খাশুগজি পর্ব ২ঃ সৌদি আরবের ভুমিকা আর অবস্থান

এখন পর্যন্ত সৌদি আরব জামাল খাশুগজির হত্যার ব্যাপার অস্বীকার করে যাচ্ছে। তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোন বক্তব্য না দিলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছে এসব গল্প মিডিয়ার তৈরি আর সৌদি ভাবমূর্তি বিনষ্ট করতে কুচক্রীদের চাল। সৌদি নিউজ মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়া জামাল খাশুগজিকে জঙ্গি, সন্ত্রাসী, মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য, বিন লাদেনের প্রতি সহমর্মিতা ধারণকারী বলে প্রচার চালাচ্ছে। এমনকি তার বাগদত্তা খাদিজাকে নিয়েও রিতি মতন নোংরামি করছে। বলছে খাদিজা আদতে একজন পুরুষ, সৌদির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী।

মোটামুটি এসব সংবাদের একটাই উদ্দেশ্য। যদি শেষ পর্যন্ত তুরস্ক প্রমান করে ছাড়ে যে জামাল খাশুগজিকে আসলেই সৌদি সরকার হত্যা করেছে তাহলে সৌদি জনগন আর সৌদি সাপর্টারেরা যেন এই হত্যাকে জঙ্গি হত্যা বা ইখওয়ান হত্যা হিসাবে জায়েজ করে নেয় অথবা একে যেন সৌদিদের বিরুদ্ধে কারো গভীর ষড়যন্ত্র হিসাবেই বিশ্বাস করে।

প্রশ্ন করতে পারেন মুহাম্মদ বিন সালমান ( এমবিএস ) কেন বিদেশের মাটিতে এমন এক ঝুঁকিপূর্ণ খুনের (এলেজড) অপারেশানের সিদ্ধান্ত নিলো? তাও নিজেরদের লোক পাঠিয়ে, কেন অজ্ঞাত হিট্ম্যান পাঠায়নি? এর জবাব খুজতে গিয়ে নজর দিতে হবে বিন সালমানের পূর্বের আরেক হঠকারী সিদ্ধান্তের উপর। সেটা ছিল লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরিকে সৌদিতে দাওয়াত দিয়ে এনে গৃহবন্দী করা আর জোরপূর্বক তাকে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করানো। অবশেষে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রনের হস্তক্ষেপে সেই ঘটনার অবশান ঘটেছিল।

এই একই ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত হচ্ছে জামাল খাশুগজিকে তুরস্কতে হত্যা ( এলেজড) করা। যেহেতু জামাল খাশুগজিকে প্রলুব্ধ করে সৌদিতে বা সৌদির মিত্র কোন দেশে নেয়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, জ্বি সেই চেষ্টাও করা হয়েছিল; আবার জামাল যেখানে বাস করেন অর্থাৎ আমেরিকা অথবা ইয়োরোপের কোথাও এই ধরনের কোন অপারেশান করা মানে নিজের পিঠে নিজেই ছুরি মারা তাই সৌদিদের হয়ত মনে হয়েছে সেকেন্ড বেস্ট অপশান হচ্ছে যেখানেই জামালকে পাওয়া যাবে সেখানেই কিছু করা। এসবই এখন পর্যন্ত সম্ভাব্য থিওরি মাত্র।

এই থিওরির সপক্ষে আরেকটা ঘটনা আছে। গতকাল সৌদি প্রিন্স খালিদ বিন সাউদ, যে এখন জার্মানিতে বাস করে, সৌদি সরকারের সমালোচক, ইন্ডিপেন্ডেন্টকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছে তাকেও প্রচুর প্রলোভন দেখিয়ে সৌদিতে ফেরত নেয়ার চেষ্টা করছে সৌদি রাজ সরকার, তার অর্থকষ্ট যাচ্ছে বলে বিশাল চেকের প্রলভন দেখিয়ে ৩০ বারের মতন অনুরোধ করেছে মিসরে অবস্থিত সৌদি কনস্যুলেটে যেতে। সে নিজ নিরাপত্তার ভয়ে যেতে অস্বীকার করেছে। এই খবর যদি সত্যি হয় তাহলে এখানে আমরা সৌদিদের চিন্তাধারার আর প্লটের একটা প্যাটার্ন দেখতে পাচ্ছি।

এও হতে পারে হয়ত জামালকে হত্যা করা তাদের মুল উদ্দেশ্য ছিলো না, তাদের উদ্দেশ্য ছিল জামালকে জোর করে সৌদিতে তুলে নিয়ে গিয়ে তার মুখ বন্ধ করা । সেজন্যই একজন দুইজন নয় বরং ১৫ জনকে তুরস্কে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু কোন কারনে তা ভেস্তে গেলে তারা জামালকে হত্যা করতে বাধ্য হয়। এসবের সঠিক উত্তর আমরা হয়ত কোনদিন জানতে পারব না; আনলেস কোন দিন ভিতরের কেউ যদি মুখ খুলে।

সৌদি আরবের ভিতরে এখন অনেক টারময়েল চলছে, তাদের নিজেদের প্রিন্সরাই সমালোচনা অথবা বিরোধিতা করলে গুম কিংবা গৃহবন্দি অথবা কারাগারে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে । হতে পারে নিজ মাটিতে যা খুশি করে পার পেতে পেতে তারা এখন দেশের বাইরেও যা খুশি করার সাহস পেয়ে গেছে। আর যতদিন ট্রাম্প ক্ষমতায় আছে ততদিন তারা যা খুশি করার গ্রিন সিগনাল পেয়ে গেছে বলে অনেকের ধারনা।

এক সাক্ষকাতকারে এমবিএস বলেছে সৌদি আরব আমেরিকাকে এখন নিজ পকেটে রাখে। এসব মিলিয়ে হয়ত এমবিএস ড্যাম কেয়ার পর্যায়ে চলে গেছে। অবশ্য সে যে ড্যাম কেয়ারেই চলে তার প্রমান ইয়েমেনের যুদ্ধ, রাজ পরিবার এতদিন যেই কন্সেন্সাস নিতিতে চলত তা থেকে ড্রাস্টিকভাবে সরে গিয়ে একক রাজত্বের পথে চলে যাওয়া, বিভিন্ন সৌদি প্রিন্সদের গৃহবন্দি বা কারাগারে নিক্ষেপ করার মাঝেই দেখতে পাই।

এবার প্রশ্ন করতে পারেন প্রচুর সৌদি বংশদ্ভুত লোক আছে যারা বিশ্বের চারিদিকে ছড়িয়ে আছে, যারা সৌদি রাজসরকারের আর রাজপরিবারের সমালোচনা করে, কই তাদের তো দেশের বাইরে সৌদি কর্তৃপক্ষ হত্যা করে নি, তাহলে জামালকে কেন?

জামাল খাশুগজি যেমন তেমন সৌদি সাংবাদিক ছিলেন না। তিনি একজন অত্যন্ত উচু লেভেলের আর ওয়াশিংটন আর লন্ডনে অত্যন্ত অয়েল কানেক্টেড একজন সাংবাদিক ছিলেন, যার টূইটার ফলয়ারের সংখ্যা প্রায় ১৬ লাখ। ওনার একেক লেখা, টুইট লাখ মানুষ পড়ত আর প্রভাব ফেলত।

জামাল খাশুগজি এক সময় আরেক সৌদি প্রিন্স তুর্কি আল ফায়সাল, ফর্মার ইন্টালিজেন্স চিফ, এর অধিনেও উচু পোস্টে চাকুরি করতেন, আর সেই সুবাদে সৌদি রাজপরিবারের ভিতরের অনেক গোপন খবর জানতেন; বলা হয় জামাল খাশুগজি সত্যিকারের রিফর্মিস্ট ছিলেন যিনি মোহাম্মদ বিন সালমানের রিফর্মের নামে করা এন্টাই রিফর্ম কাজ কারবারের প্রচুর সমালোচনা করতেন। ফলে ২০১৭ সালে প্রানের ভয়ে দেশ ছেড়ে আমেরিকায় চলে আসতে বাধ্য হন।

অবশ্য সৌদি আরব ততদিনে তার লেখালেখির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। কিন্তু আমেরিকায় এসে তিনি সৌদি সরকার তথা এমবিএস এর সমালোচনা করে বিশ্ববাসীর সামনে, এমনকি সৌদিদের কাছেও তার ভাবমূর্তি নষ্ট করে চলেছিলেন। তাই হয়ত আর চান্স না নিয়ে জামালের মুখ বন্ধ করার প্রয়াসেই জামালকে সরিয়ে ফেলার এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল।

কিন্তু মনে রাখতে হবে সৌদি সরকার কোন দিন এই হত্যাকাণ্ডের দায় কাঁধে নিবে না। যদি হত্যাকান্ড প্রমাণিতও হয় তখনও তারা কোন কনভেনিয়েন্ট স্টোরি বানিয়ে দায়মুক্ত থাকবে। বা ড্যাম কেয়ার নিতিতেই অটল থাকবে। তারা একবার বলেছে জামাল কনস্যুলেটে কাজ শেষে বের হয়ে গেছিল, এরপর বের হয়ে যাওয়ার ভিডিও দেখাতে বললে, বলেছে সেদিন ভিডিও সিস্টেম কাজ করে নাই। এরপর বলেছে জামাল খাশুগজির অন্তর্ধানের পিছনে কাতারিদের হাত আছে, মুসলিম ব্রাদারহুডের হাত আছে, যারা সৌদি আরবের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চায়। কিন্তু কথার কোন প্রমান এখন পর্যন্ত দেখাতে পারে নাই। অবশ্য ভবিষ্যতে কি দেখাবে বলা মুশকিল।

প্রথমে তুর্কিদের সাথে সহযোগিতা করতে না চাইলেও, তুরস্ক তাদের কাছে জামাল খাশুগজির হত্যাকাণ্ডের অডিও ভিডিও প্রমান আছে বললে এবং সম্ভবত আমেরিকান এডমিনিস্ট্রেশানের চাপে তুরস্কের সাথে এই ঘটনার তদন্ত করতে রাজি হয়েছে।

হতে পারে আমেরিকার সহযোগিতা পেতেই এই সময়ে তুরস্কে গৃহবন্দি করে ধরে রাখা আমেরিকান ধর্মযাজক এন্ড্রু ব্র্যান্সনকে তুরস্ক মুক্তি দিয়েছে। তুরস্ক যেভাবে সৌদি কন্স্যুলেটের ভিতরের হত্যা প্রমানে উঠে পড়ে লেগেছে সেখানে ঘটনা মিথ্যা হওয়ার চান্স খুবই নগন্য।

মুলত সৌদি সরকার আর তুর্কি সরকার উভয়ে ঘটনার বলয়ের দুই দিকে অবস্থান করছে আর এক গ্যাঁড়াকলে আটকে গেছে। যেখানে সৌদিরা সিমপ্লি সব এভিডেন্স বানোয়াট বলে এখন পর্যন্ত এড়িয়ে দিচ্ছে আর তুর্কিরা অনেক প্রমান সবার সামনে তুলে ধরছে। এখন কোন দেশ কিভাবে সেসব প্রমান বক্তব্য গ্রহন করবে তা নির্ভর করছে তাদের নিজেদের সেলফ ইন্টারেস্টের উপর। আর তুরস্কের জোরালো ভুমিকার উপর।

জামাল খাশুগজি পর্ব -৩ঃ আমেরিকা
জামাল খাশুগজির কেইসে যাওয়ার আগে সৌদি আমেরিকা সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলে নেয়া দরকার মনে করছি। তা না হলে পাঠকের কাছে জামাল খাশুগজির হত্যা নিয়ে আমেরিকান পজিশন আউট অফ সিঙ্ক মনে হবে।

তখন বারাক ওবামা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। সৌদিরা ইয়েমেনের হুথিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িত, যেই যুদ্ধে ওবামা এডমিনিস্ট্রেশানের কন্ডিশনাল সাপোর্ট দিয়েছে। কন্ডিশান ছিল সৌদি আরবকে যতদূর সম্ভব সিভিলিয়ান ক্যাজুয়ালটি এড়াতে হবে, আর সেই লক্ষ্যে যেসব অস্ত্র ম্যাক্সিমাম সিভিলিয়ান ক্যাজুয়ালটি করতে পারে আমেরিকা তা সৌদিরা চাইলেও বিক্রয় নিষিদ্ধ করেছে। সৌদিদের চরম অবজেকশান স্বত্বেও আমেরিকা ইরানের সাথে নিউক্লিয়ার ডিল করেছে। ওবামার সময়ে সৌদিদের চরম শত্রু ইরানের ক্ষমতার বলয় ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, এন্ড ফর অল অফ দিয সৌদিস হেটেড ওবামা।

ওবামার টার্মের শেষের দিকে, ২০১৬ সালে, রিয়াদে, প্রেসিডেন্ট ওবামা সৌদি বাদশাহ সালমানের সাথে সামনাসামনি এক বৈঠকে বসেন। এই বৈঠকের কিছুদিন আগে সৌদি আরব একজন প্রমিনেন্ট শিয়া ক্লারিক সহ ৪৫ জন সৌদি নাগরিক, ১ জন মিসরীয় আর ১ জন চাঁদ এর নাগরিককে সৌদি পুলিশ হত্যার দায়ে ফাঁসিতে ঝোলায়, যা ছিল ব্লেটেন্ট হিউম্যান রাইটস ভায়োলেশান।

বৈঠকে সৌদি আরবকে হুশিয়ারি করে ওবামা বলেন, " যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ আন্তর্জাতিকভাবে সৌদিদের এসব কর্মকাণ্ড ডিফেন্ড করবে না, এতে একদিন সৌদি আরব আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।" একই বৈঠকে ওবামা ইয়েমেনের সাথে যুদ্ধের ইতি টানতে আর ইরানের সাথে সংঘাতে না যেয়ে সংলাপে যাওয়ার জন্য বলেছিলেন।

বৈঠকে মোহাম্মদ বিন সালমান বা এমবিএস উপস্থিত ছিল, তখন সে ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স, বয়স ২০ এর কোঠায়। ওবামার এসব বক্তব্যে এমবিএস দৃশ্যত বিরক্ত প্রদর্শন করে। প্রোটোকল ভেঙ্গে এক সময় উঠে দাড়িয়ে ওবামাকে সরাসরি বলে, " আমাদের বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে আপনার কোন ধারনা নাই। আমাদের পাবলিক ক্রিমিনালদের বিচার চায় তাই রাজ্যের স্তিথিশীলতার জন্য এদের ফাঁসী দরকার ছিল।" ওবামা জেইল্ড ব্লগার আর সাংবাদিকদের জন্য কন্সার্ন প্রকাশ করলে এমবিএস তা উদ্ধতভাবে উড়িয়ে দেয়। সেই সময় আমেরিকা-সৌদি সম্পর্ক রীতিমত ক্রাইসিস পয়েন্টে চলে যায়। সৌদিরা ওবমার টার্ম শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকে।

অবশেষে ওবামা আউট, ট্রাম্প ইন; আর শুরু হয় ট্রাম্প-বাদশাহ সালমান-এমবিএস-জ্যারেড কুশ্নারের প্রেম কাহিনী। জ্যারেড কুশনার আর এমবিএস একে ওপরের দেশ ভ্রমন করে, রাত জেগে প্ল্যান করে, আর এমবিএস এক সাক্ষাতকারে বলে হি কিপ্স জ্যারেড ইন হিজ পকেট। সৌদিরা ট্রাম্পের প্রচুর রিয়েলস্টেট এসেট কিনে। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ২০১৭ সালে প্রথম বিদেশ ভ্রমনে রিয়াদ যান। আর রিয়াদের সাথে $১১০ বিলিয়নের এমওআই (মেমোরেন্ডাম অফ ইন্টেন্ট) স্বাক্ষর করে আসেন।

ফরেইন কান্ট্রিতে আমেরিকান আর্মস বিক্রিতে কংগ্রেসের পারমিশান লাগে। আর কংগ্রেস ট্রাম্পের আমলে ২০১৭-২০১৮ সালে, এখন পর্যন্ত কেবল $৩.৪ বিলিয়নের চুক্তি পাশ করেছে। ট্রাম্প যেই $১১০ বিলিয়নের গল্প শোনান তা কেবল এমওআই এর গল্প, আদতে কোন স্পেসিফিক অস্ত্র বিক্রির কন্ট্রাক্ট নয়। আর ওবামা ২০১৩-২০১৭ সাল পর্যন্ত, ৫ বছরে মোট $৯ বিলিয়নের অস্ত্র বিক্রয় করেছিল সৌদিদের কাছে।

নাউ কামিং টু জামাল খাসুগজি মার্ডার কেইস। জামাল ওয়াশিংটন পোস্ট এর কলামিস্ট ছিলেন, তার অন্তর্ধানের পর ওয়াশিংটন পোস্ট কলাম আফটার কলাম লিখতে থাকে। একই দিনে ৪-৫ টা কলাম, ২-৩ টা অপ-এড, এডিটোরিয়াল, ইত্যাদি ছাপাতে থাকে। নিউ ইয়র্ক টাইমস, সিএনএন, বিবিসি, গার্জিয়ান, ইত্যাদি ওয়াশিংটন আর লন্ডনের লিবারেল মিডিয়ার খবরের অন্যতম প্রধান বিষয় হয় উঠে জামাল খাশুগজি। এরপর শুরু হয় একের পর এক সিনেটারদের জামালকে নিয়ে টূইট, টুইট করেন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স, সেক্রেটারি অফ দ্যা স্টেট মাইক পম্পেও প্রমুখ। ট্রাম্প যেখানেই যান না কেন জামাল প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হন।

এই সময় ফরেইন রিলেশান্স কমিটির এক মিটিং এর আগে কমিটির সব সিনেটরদের হাতে জামাল খাশুগজির উপর ২০ পৃষ্ঠার এক রিপোর্ট আসে, সেই সাথে ইন্টালিজেন্স ব্রিফিং। মিটিং এর পর ২২ জন প্রমিনেন্ট বাইপার্টিসান সিনেটর গ্লোবাল ম্যাগনিস্টকি এক্ট আহ্বান করে আর হোয়াইট হাউস কে জামাল খাশুগজির অন্তর্ধানের ইনভেস্টিগেশান চালু করতে বলেন। সৌদি আরব দোষী প্রমাণিত হলে আইনত আমেরিকা অনেক ধরনের এম্বার্গো আর শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য থাকবে।

ইতিমধ্যে তুরস্কের অথোরিটি আমেরিকান ইন্টালিজেন্স কমিউনিটির কাছে খাশুগজির হত্যাকাণ্ডের উপরে তদন্তের বেশকিছু এভিডেন্স পাঠিয়ে দেয়। ছেড়ে দেয় তুরস্কে গৃহবন্দি করে রাখা আমেরিকান ধর্মযাজক ব্রান্সানকে। ট্রাম্প এই ব্যাপারে তুরস্কের সাথে কোন ডিলের কথা অস্বীকার করলেও বলেছেন তুরস্কের সামনে সুন্দর দিন অপেক্ষা করছে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ট্রাম্প বলে খাশুগজি কেইসে সৌদি সরকার দায়ী প্রমাণিত হলে তাদের চরম ভাবে শাস্তি দেয়া হবে, তবে সেটা ব্যবসায়িক ভাবে না। আর সেজন্যই ট্রাম্প বারবার বলছে আমেরিকা অস্ত্র বিক্রয় না করলে রাশিয়া করবে, চীন করবে, মাঝ খান থেকে আমেরিকান ডিফেস কোম্পানিগুলো তাদের সুযোগ হারাবে।

কিন্তু ফরেইন রিলেশান্স কমিটির চেয়ারম্যান রিপাবলিকান সিনেটর বব কর্কার বলেছেন এভিডেন্স দেখে কোন সন্দেহ নাই যে জামাল খাশুগজিকে হত্যা করা হয়েছে আর এই মুহূর্তে আমেরিকার কংগ্রেসের সাথে সৌদি সরকারের সম্পর্ক অত্যন্ত খারাপ। কিন্তু হোয়াইট হাউজ এর সাথে এমবিএস রাজের সম্পর্ক ভালো। কংগ্রেস আবারও নতুন কোন অস্ত্র বিক্রীতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার থ্রেট দিয়েছে। বলেছে তাদের হাতে প্রয়োজনীয় ভোট আছে যা দিয়ে ট্রাম্পের টেবিল থেকে আসা যে কোন সৌদি-আমেরিকা ব্যবসায়িক চুক্তি নাকচ করে দেয়া যাবে।

এদিকে এই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে রিয়াদে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এক বিজনেস সম্মেলন। কিন্তু ইতিমধ্যেই আমেরিকার অনেক কোম্পানি আর প্রায় সবগুলো সংবাদ মাধ্যম সম্মেলন থেকে তাদের নাম তু্লে নিয়েছে। কিছু কিছু কোম্পানি বলছে খাশুগজি হত্যায় সৌদি সরকারের দোষ প্রমানিত হলে কংগ্রেস তাদের নতুন কোন ব্যবসায়িক ডিল পাশ করবে না; তাই এই সম্মেলনে যেয়ে কোন লাভ নাই। ইয়োরোপিয়ান কিছু কোম্পানিও এই সম্মেলনে যেতে এখন অস্বীকার করছে।

এইসব খবর সৌদিদের জন্য দুঃসংবাদ বয়ে এনেছে। সৌদি স্টক এক্সচেঞ্জ গত দুই দিনে ১০% ড্রপ করেছে। এখন এমবিএস তেলের দাম বাড়ানোর হুমকি দিয়েছে। কিন্তু তাতে আমেরিকার খুব একটা কিছু হবে না, কারন আমেরিকা কেবল ১১% তেল সৌদি থেকে কিনে। আর ২০১৪ সাল থেকেই আমেরিকা ৯০% ভাবে এনার্জি ইন্ডিপেন্ডেন্ট। রিফাইন্ড পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্টের বেলায় আমেরিকা নেট এক্সপোর্টার। অতএব, তেলের দাম বাড়ালে আমেরিকারই লাভ।

গতকাল লন্ডনের গার্জিয়ান পত্রিকার হেডলাইন নিউজ ছিলো, "Saudi Arabia has found itself further isolated over the disappearance of Jamal Khashoggi after the business world turned its back on a high-profile investment conference in the kingdom।"

মানবাধিকার ভঙ্গের জন্য সৌদি আরব আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে ওবামার সেই হুশিয়ারি আজ আবার সৌদি আরবের সামনে এসেছে। দেখার বিষয় সৌদি আরব কিভাবে এর মোকাবেলা করে।

পঠিত : ৮১৪ বার

মন্তব্য: ০