Alapon

গভীর ষড়যন্ত্র ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের শিকার প্রিয় বাংলাদেশ

 ১৯৭১ উত্তর সময় থেকে বাংলাদেশে জনগণের মধ্যে বিদ্যমান ভারত বিরোধী মনোভাব এটা স্পষ্টই প্রমাণ করে যে পতাকার পরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের জনগণ কোন অবস্থাতেই তাদের মুসলিম পরিচিতি মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিকে বিসর্জনতো দূরের কথা, বরং যে কোন মূল্যে যে তা রক্ষা ও উচ্ছকিত রাখতে ওয়াদাবদ্ধ থাকবে এতে কোন সন্দেহ নেই। 

ভারতীয় আধিপত্যবাদের কারুকাজ ও চক্রান্তঃ
এতে কোন সন্দেহ নেই যে ১৯৭২ সালের পর থেকে বাংলাদেশের মন ও মানসকে ভারতীয়করণের জন্য প্রচুর বস্তুগত আর্থিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সাহায্য ও সমর্থন ভারত যুগিয়ে আসছে। বাংলাদেশের প্রচার মাধ্যমসমূহের এক বিরাট অংশ ভারতীয় মার্কা অপপ্রচার-এর প্রতিপাদ্য দিয়ে পরিচালিত। তথাকথিত আধুনিক স্কুল সমূহের শিক্ষা কারিক্যুলাম বিশেষত সমাজ বিজ্ঞান সম্পর্কিত বিষয়াদি সম্পূর্ণভাবে ইসলামিক মূল্যবোধ ও গুণাবলী বিরোধী বৈদিক দর্শনের অনুকরণে প্রণীত।

আমলাতন্ত্র, প্রশাসন শিক্ষক সমাজ এবং কায়েমী স্বার্থবাজদের নতুন গোষ্ঠীর এক উল্লেখযোগ্য অংশ ভারতীয় সংস্কৃতির আজ্ঞাবহের ভূমিকায় অবতীর্ণ রয়েছে, সাধারণ মানুষের মধ্যে যাদের কোন অবস্থানই নেই। সম্ভাব্য সকল ধরণের মস্তিস্ক ধোলাইয়ের অপচেষ্টা চালানো সত্ত্বেও আজ অবধি তারা সফলকাম হতে পারেনি; জনগণ আজও ভারত বিরোধী এই জন্যে যে ভারত বাংলাদেশের সাধারণ জনগোষ্ঠীর জীবনাচারের মৌলিক ভিত্তিকে ধ্বংস করতে চায়।

দেশের অর্থনীতি ও উৎপাদনশীলতার যে কাঠামো সাধারণ গরীব ও নিরুঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জীবন ধারণের ভিত্তি তা ভারতের প্রভূসূলভ আচরণে হুমকিগ্রস্ত। ভারতের নির্মিত ফারাক্কা বাধ-এর বিষময় ফলে বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ এলাকা মরুভূমিতে পর্যবসিত হয়ে বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ জনগণের জীবন ও জীবিকাকে হুমকিগ্রস্ত করে ফেলেছে।

বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্যের এসব হচ্ছে যৎকিঞ্চিত নমুনা। উল্লেখ্য যে, দুই দেশের ৫৪ টি অভিন্ন নদীর মধ্যে বাংলাদেশের উজানের ভারতে প্রবাহিত ৫৩টি -যার প্রায় প্রত্যেকটিতে বাঁধ, গোয়েন, স্পার নির্মাণ করে উজানের পানি নিয়ন্ত্রণ পূর্বক শ্বাসরোধ করে বাংলাদেশের ভাটিতে বিপর্যস্তকর অবস্থায় ফেলে তার অর্থনীতির অস্বাভাবিক তথা অপমৃত্যূর ঘটনার চেষ্টায় লিপ্ত ভারত।

অর্থাৎ বহুল পরিচিত ভিত্তিক বাংলাদেশে আজ এক মৌসুমে খরা আর বর্ষা মৌসুমে বন্যার ছোবলে ক্রমবর্ধমানহারে বিপর্যস্ত হচ্ছে। [বেন ক্রো, ইটি এএল, শেয়ারিং দি গ্যাঞ্জেস, ইউনির্ভাসিটি প্রেস লিঃ, ঢাকা, ১৯৯৫, এম, রফিকুল ইসলাম গ্যাঞ্জেস ওয়াটার ডিসপ্যুটঃ ইটস ইন্টারন্যাশনাল লিগ্যাল এসপেক্টস, দি ইউনির্ভাসিটি প্রেস লিঃ, ঢাকা, ১৯৮৭, বি,এম, আব্বাস এটি, দি গ্যাঞ্জেস ওয়াটার ডিসপ্যুট, দি ইউনির্ভাসিটি প্রেস লিঃ, ঢাকা, ১৯৮২ ইত্যাদি]

এছাড়াও ভারতের শিল্পজাত পণ্যের অবাধ প্রবাহ বাংলাদেশের শিল্প উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে রেখেছে। আনুষ্ঠানিক চ্যানেল এই পণ্য প্রবাহের যে অবস্থা তার চাইতে অনেক অনেক বেশী এই পণ্য প্রবাহ চলছে দু’ দেশের ১৭০০ মাইল সীমান্ত পথের চোরাচালান রুটে।

বাংলাদেশের এই যাবতকালের সকল শাসক শ্রেণীই তারা যে মত ও পথের হোক না কেন; ভারতের পদাঙ্কই অনুসরণ করে আসছে। এটা বাস্তব অবস্থার আলোকে কেবল অযৌক্তিকও নয়; কেননা দিল্লীর গুডবুক-এ থাকা ও ভারতে কৃপা লাভের চাইতে অন্য কিছু চিন্তা করার অবকাশই শাসকশ্রেণীর নেই। ১৬ই ডিসেম্বরের কয়মাসের মধ্যে থেকেই ভারতের অনুকম্পা শেখ মুজিব (কলকাতার জনৈক অরুণ চক্রবর্তীর ছেলে যার নাম প্রথমে ছিল দেবদাস চক্রবর্তী, যাকে তিন বছর বয়সে ১৯২৩ সালে শেখ লুৎফুর রহমান পালক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করে নাম রাখেন মজিবুর রহমান -ডঃ এম,আই চৌধুরী, জীবনস্মৃতি, ঢাকা ২০০৬ পৃষ্টা, ৬৪২-৪৩) কর্তৃক ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে ভারতের সাথে ২৫-সালা মেয়াদী এক চুক্তি স্বাক্ষর করার ফলে ভারতের অনুকম্পায় থাকা বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর জন্য ফরজ হয়ে দাঁড়ায়।

উক্ত চুক্তির অষ্টম, নবম এবং দশ নম্বর ধারার শর্ত সমূহই হচ্ছে ঢাকার ক্ষমতায় আরোহনকারী সবারই ঘাড়ের উপর তলোয়ার স্বরূপ; যাদেরকে পরিচালনার জন্য দিল্লীর সরাসরি খবরদারীর তেমন প্রয়োজন পড়েনা। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ১৯৪৭ সাল থেকে সক্রিয় ভারতীয় লবীর ঘনিষ্ঠ সহযোগে বাংলাদেশের বড় বড় কর্তাব্যক্তিদের অব্যাহতভাবে হুমকি প্রদান করে থাকে। বাংলাদেশের আভ্যন্তরীন বিষয়াদিতে বহুমাত্রিক ভারতীয় হস্তক্ষেপ ও আধিপত্যবাদী তৎপরতা বাস্তব সত্যি -যা সর্বজনবিদিত।

ভারতের এই ধরণের হস্তক্ষেপ এর সাথে ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর ক্লাইভ ও ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হস্তক্ষেপ এর সাথে তুলনীয়। পলাশীর যুদ্ধেরর অনতিকাল পূর্বে মীর জাফরের সাথে কোম্পানী কর্মকর্তা ক্লাইভ যে চুক্তি (পরিশিষ্ট-২) করিয়ে নেয়, তার দুই নং ধারায় বলা হয়ঃ ‘ইংরেজদের শত্রু, তা সে ইউরোপীয় হোক কিংবা হোক ভারতীয়, তারা আমারও শত্রু।’

গত কয়েক দশক ধরে বিপদাপন্ন অবস্থায় দিনাতিপাত করতে গিয়ে বাংলাদেশের যে অভিজ্ঞান ও আক্কেল হয়েছে, তা থেকে যথেষ্ট শিক্ষা নেয়ার আছে। এই শিক্ষা প্রথমে হতে পারে ১৯৭১ সালের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে; যা নিতে হলে ১৯৭১ সালের পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণ নতুন ও নিরাবেগপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে মূল্যায়ন করতে হবে। এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গীর সূত্র হতে হবে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় অর্জিত বিজয় বাংলাদেশের জন্য তেমন কোন বিজয় ছিলনা, যতটা না ছিল ভারতের জন্যে।

দ্বিতীয় অত্যাবশ্যকীয় শিক্ষা নিতে হবে এই বাস্তবতা থেকে যে স্বাধীনতার যৎসামান্য স্বাদ বাংলাদেশীরা লাভ করতে না করতেই তা সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় শাসকরা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ফলে বাংলাদেশ বাস্তবে ভারতের দখলকৃত একটি ভূখন্ডেই পর্যবসিত হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওসমানীর রহস্যজনক অনুপিস্থিতিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিকট পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের আত্মসমর্পনের দলিলই ভারত কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তান দখল করার স্পষ্ট ও বৈধ প্রমাণ।

শেখ মুজিব ফিরে এসে ২৫ বছর মেয়াদী যে চুক্তিতে দেশকে আবদ্ধ করেন তা ছিল বস্তুতঃ ১৯৭১ সালের তাজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন প্রবাসী সরকার স্বাক্ষরিত গোপন চুক্তির ৭টি ধারার পরিবদ্ধিত সংস্করণ৫ এবং ২৫ বছরের সে চুক্তির দ্বারা প্রকারান্তরে আত্মসমর্পনের উক্ত দলিলের উপর বৈধতার সীল মেরে দেয়া হয়। যা ছিল আর এক অর্থে ভারতের গোলামীর নিশ্চয়তা এবং এতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আধিপত্য চালনার আইনানুগ কর্তৃত্ব লাভ করে ভারত।

১৯৭১ সালের ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে নিজেদের স্বার্থে যে সব ক্ষমতা ও অধিকার ভারত লাভ করে তা যে কোন মূল্যে চিরস্থায়ী করতে তারা বদ্ধপরিকর। ঐ কুখ্যাত চুক্তির নবায়ণ কিংবা অন্য নামে একই মাত্রায় আর একটি চুক্তিতে বাংলাদেশকে আবদ্ধ করার পরিকল্পনাও রয়েছে ভারতের।

বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়কার দেখা দেয়া রাজনৈতিক অচলাবস্থার অধিকাংশ কারণ হচ্ছে দিল্লীর ঐ লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাব্য কোন ক্ষেত্র। গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশকে নামেমাত্র স্বাধীন রাখার ভারতীয় কৌশলের এখানেই শেষ নয়। বাংলাদেশকে নিয়ে তার লক্ষ্য অর্জনে তাদের আরো কিছু অত্যাবশাকীয় কাজ রয়েছে। এই কাজগুলো হচ্ছে বাংলাদেশকে সর্বব্যাপ্ত ও অনতিক্রান্ত চাপের মধ্যে ফেলা। এই লক্ষ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সক্রিয় ভারতীয় তল্পীবাহীদের দিয়ে নেতিবাচক রাজনীতি করানো, ভারতের শিল্পজাত পণ্যের বাজার প্রতিষ্ঠার জন্যে শুরু থেকেই বিপদাপন্ন অর্থনীতিতে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালিয়ে আরো ক্ষতিগ্রস্ত করা, পরিকল্পিতভাবে ভারতীয়করণের জন্যে স্থানীয় সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা, বাংলাদেশের সাথে পানি বণ্টনে সমঝোতা আসার আহবান প্রত্যাখান করা পূর্বক সকল আন্তর্জাতিক আইন নিয়মনীতি পদদলিত করে৬ অভিন্ন ৫৩টি নদীর উজানে পানি প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে ভাটির দেশ বাংলাদেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করা।

পাকিস্তানের করাচীর ন্যায় ভারতীয় সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পরিচালনা করা, চাকমা ইস্যু নিষ্পন্নে অনাগ্রহ তথা সৎ প্রতিবেশীমূলক আচরণে অনীহা, তথাকথিত বঙ্গভূমি আন্দোলনের দ্বারা বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ ভূখন্ডকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে মদদ ও পৃষ্টপোষকতা প্রদান এবং সর্বোপরী দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপকে দখলে করে রেখে ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে রক্তচক্ষু ও বিষদাঁত দেখাচ্ছে বিগত তিন দশকব্যাপী। এ ছাড়াও ট্রানজিট সুবিধাসহ পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহে সেনা অভিযান চালানোর সুযোগ প্রদানের জন্যে ভারত বাংলাদেশের উপর অব্যাহত চাপ প্রয়োগ করে চলেছে এবং বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম বন্দরকে আনসেন্সরড ব্যবহারের জন্য ভারত চাপ প্রয়োগ করে চলেছে।

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের আধিপত্যের রকমফের অন্তহীন। সময়ে তাদের আধিপত্যের বিভিন্ন প্রকরণ জনপ্রিয় অবয়বও ধারণ করে, যা কেবল বাংলাদেশে তাদের তল্পীবাহী রাজনৈতিক দলসমূহের সৃষ্ট বিভিন্ন আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; নানাবিধ শ্রমিক আন্দোলনেও তা পরিস্ফুট হয়। আর এই সব আন্দোলন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা’র কর্তৃক পরিকল্পিত, সংগঠিত ও অর্থায়ন হয়ে থাকে। জামাতে ইসলামের নেতা গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১৯৯০ সালে ঘাদানিক আন্দোলন তেমন একটি। প্রায় ২০টি কিংবা তার কাছাকাছি বা তার বেশী সামরিক অভ্যুত্থান বা পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থান, যার দরুণ প্রকারান্তরে প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হোন, তা ছিল তাদের অন্যতম মিশন।

এটা কেবল ‘র’ এর কর্মকর্তাদের স্বীকারোক্তিতেই নয়; ভারতের বহু বিশ্বস্ত সূত্র ও মিডিয়া তা নিশ্চিত করে। [অশোক রায়না, স্পেশাল অপারেশানঃ বাংলাদেশ, ইনসাইড‘র’, বিকাশ পাবলিশিং হাউস (প্রাইভেট) লিঃ, দিল্লী, ১৯৮১, পৃ: ৫০-৬৩] প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তানে ‘র’ এর অনুপ্রবেশ ছিল অনেকভাবে, অনেক স্তর ও পর্যায়ে -যা বাংলাদেশ আমলে এত ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি ঘটে যে ‘র’ এবং দিল্লী কারো পক্ষেই এই সব তথ্য গোপন রাখা সম্ভব হয়নি।

পূর্ব পাকিস্তান জন্মের প্রায় শুরু থেকে ভারতের ষ্টেটসম্যান পত্রিকার ঢাকা অফিসে দায়িত্বপালনকারী ভারতীয় সাংবাদিক জ্যোতি সেন গুপ্ত স্বীকার করেছেন যে, শেখ মুজিবর রহমান সহ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বহু মহলের সাথে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। সেই গোয়েন্দা সংস্থাই এক বিভ্রান্তিকর রিসার্চ এন্ড এনালাইসিস উইং (RAW) নামে ষাট এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে কাজ শুরু করে।

‘র’ এর কর্মকর্তারা বাংলাদেশকে এই মর্মে সর্বদাই নছিয়ত দিতে থাকেন যে বাংলাদেশ সামাজিক পর্যায়ে অবশ্যই তাদের শিকড়ের সন্ধানে ব্যপৃত হওয়ায় উচিত; যে শিকড় ‘র’ এর মতে হচ্ছে নিখাদ সনাতন ধর্ম। আর এই দৃষ্টিকোন থেকে ইসলাম হচ্ছে বিদেশী ধর্ম যার উৎস আরবের মাটি থেকে উৎসারিত। এ থেকে কি এমন প্রশ্নের উদ্রেক হয়না যে তাহলে কি বাংলাদেশীদেরকে হিন্দু দেবতা শিব, কালী, দুর্গার পূজা করতে হবে? নবজাত শিশু হত্যা শুরু করতে হবে? মৃত স্বামীর সাথে স্ত্রীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা পুনঃরায় শুরু করতে হবে? মুসলমানদেরকে মানবিক সমতার আদর্শ পরিত্যাগ করে মানুষের মধ্যে সকল ক্ষেত্রে বনেদি ও অচ্ছ্যুৎ শ্রেণী প্রভেদ সৃষ্টির কাজ শুরু করতে হবে ?

বদ্ধপরিকর হওয়া দরকার

স্পষ্টতই এই প্রশ্নের উদ্রেক হয় যে, বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক শক্তি যারা জনগোষ্ঠীর ৯০ শতাংশ তারা সমেত ১৬ কোটি মানুষ কি বাংলাদেশকে অব্যাহতভাবে ভারতীয় কবজায় রাখার ব্যাপারটা অনুমোদন করে? তারা কি শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবেনা?

কোন অবস্থাতেই পাকিস্তানের পরিতৃপ্ত হয়ে থাকা যাবে না

১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষুদ্র বাংলাদেশ এক বিপদাপন্ন অবস্থার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান তেমন বিপদাপন্ন অবস্থায় পতিত হয়নি কিংবা ভারতের চাইতে দুর্বল হয়নি; তবে পাকিস্তান ততটুকু শক্তিশালী নয় যতটুকু হতো দুই অংশ ঐক্যবদ্ধ থাকলে। পাকিস্তান হয়তো কতগুলো ক্ষেত্রে তার অর্জিত অগ্রগতিতে পরিতৃপ্ত হতে পারে, যার মধ্যে উল্লেখ্য হচ্ছে অপমান এবং ধ্বংসস্তুপ থেকে সর্বক্ষেত্রের অবস্থার উন্নয়ন; কেননা অর্থনৈতিক সুচকের প্রণীত তথ্যাদি অনুযায়ী কেবল বাংলাদেশ থেকেই নয়, ভারতের চাইতেও পাকিস্তানের জীবন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে; যা পাকিস্তানের উন্নয়ন, সমৃদ্ধ জীবন ব্যবস্থা, দরিদ্রতা হ্রাস এবং গণতন্ত্র ও প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মোটামোটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের মধ্যেই নিহিত।

১৯৭১ সালের ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে যে আত্মবিশ্বাস পাকিস্তান হারিয়ে ফেলেছিল তা পাকিস্তান পুনরুদ্বার করে বর্তমানে অনেক বেশী আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। আফগানিস্তানে সোভিয়েট আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব মোকাবেলায় প্রায় এক দশকের যুদ্ধে পাকিস্তানের সাফল্য তাকে যে কোন বৃহৎ ও শক্তিশালী শত্রুর আক্রমণ থেকে নিজকে রক্ষা করতে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস যুগিয়েছে। কাশ্মীর সমস্যার কোন সমাধান আজ পর্যন্ত না হওয়া সত্ত্বেও কাশ্মীরিদের প্রতি কয়েক দশক ধরে পাকিস্তানের আর্দশিক ও নৈতিক সমর্থন ইস্যুটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের যে কোন আলোচ্যসূচীর অগ্রে স্থান দিয়েছে। ভারত কাশ্মীর ইস্যুতে বরাবরই কলংকজনকভাবে পরাভূত হয়ে আসছে।

মোট কথা এটা নিঃসন্দেহ যে পাকিস্তান তার শক্তিই কেবল পুনরুদ্ধার করেনি; স্বীয় ঐক্য ও সংহতি এবং সুস্পষ্ট স্বাতন্ত্র্যতা চিরতরে রক্ষা করতে যথেষ্ট আস্থাবান। ভারত হয়তো মাঝে মধ্যে আক্রমণ ও তার সক্রিয় দালালদের দিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালাতে পারে; কিন্তু পাকিস্তান দখল করার মত স্পর্ধা তার নেই যদি সে তার নিজকে ধ্বংস করতে না চায়। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থান সে রকম নয়। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ বরাবরই একটি অসহায় সত্ত্বা হিসেবে বিরাজ করছে। ভারতের প্ররোচনা ও পৃষ্টপোষকতায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নানা ধরণের ধ্বংসাত্মক অপতৎপরতা চরমে পৌঁছেছে।

বাংলাদেশের জনগণ অব্যাহতভাবেই ভারতের সামরিক আগ্রাসনের হুমকি অনুভব করে। যেভাবে সিকিম ভারত তার বশংবদ সংসদের মাধ্যমে গ্রাস ও হজম করেছিল সে ষ্টাইলে বাংলাদেশে ভারত তার তল্পীবাহী বা পঞ্চম বাহিনী দ্বারা আগ্রাসন চালাতে পারার একটা আশংকা সব সময়ে বাংলাদেশকে তাড়া করে। তথাকথিত চরম পন্থী বাঙালী জাতীয়তাবাদীরাই আসলে ৫ম বাহিনী হিসেবে সর্বজন বিদিত।

সহস্র বছর ধরে বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষের ৯০ শতাংশ মুসলমান যে মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও স্বাতন্ত্র্যতা অনুসরণ, রক্ষা ও চর্চা করে আসছে এই বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা হচ্ছে তার সবচাইতে বড় শত্রু। অতএব ভারতীয় আধিপত্য কার্যকরভাবে প্রতিহতকরণে বাংলাদেশকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে উপমহাদেশের মুসলমান জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতা থেকে। আর এই লক্ষ্যবোধ থেকে যথাযথ দিক-নির্দেশ-এ উদ্ধুধ হতে হলে বাংলাদেশ অবশ্যই পাকিস্তানের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে হবে।

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় ভারতের বিরোধীতা

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সৌভাতৃত্বমূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠাকে ভারত বরাবরই ঘৃণার চোখে দেখে আসছে। ভবিষ্যতেও এমন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে তারা ঘৃণা করবে। কেননা বাংলাদেশ প্রকৃতই একটি স্বাধীন স্বার্বভৌম শক্তিশালী দেশ হিসেবে টিকতে পারলে ১৯৪০ সালের লাহোরে গৃহীত পাকিস্তান প্রস্তাবের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা লাভ এবং আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে দ্বি-জাতিতত্ত্ব যাকে ইতিহাস বর্ণিত মতে কংগ্রেসী ও বাজপেয়ী, বসন্ত চ্যাটির্জী সহ হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয়রা তীব্রভাবে অবজ্ঞা করে- সেই দ্বি-জাতিতত্ত্বের যৌক্তিকতাই প্রমাণ হবে। [বসন্ত চ্যাটার্জী, ইনসাইড বাংলাদেশ টুডে, এস, চান্দ এন্ড কোঃ (প্রাইভেট) লিমিটেড, দিল্লী, ১৯৭৩]

যদিও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অভিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দুইটি দেশ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অভ্যুদয় ঘটে; কিন্তু ১৯৭১ সালের বিয়োগাত্মক নাটক মঞ্চায়ন এবং তার ধারাবাহিকতা ও জের অব্যাহত রাখার উৎকট প্রয়াসের লক্ষ্য একটাই -দুই দেশের মধ্যে স্থায়ী ঝগড়া জিইয়ে রাখা। একসময়ের তথাকথিত বৈষম্য ইস্যুকে আজও জিইয়ে রেখে তাকে সুযোগ পেলেই শান দেয়ার লক্ষ্যই হচ্ছে দুটি দেশের মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষ সৃষ্টি করে রাখা। অথচ সেই তথাকথিত বৈষম্যতত্ত্ব ছিল নিতান্তই ভিত্তিহীন যা বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও শক্তিশালী একটি মুসলিম দেশকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জনমত সৃষ্টির কাজে ভারত ব্যবহার করে।

ভারতীয় প্রচার মাধ্যমসমূহের অসত্য ও অর্ধসত্য প্রচারণাগুলোই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়। ১৯৭১ সালের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে অব্যাহতভাবে পরিচালিত অপ্রচারসমূহ বস্তুত সেই প্রচারণারই পরিবর্ধিত রূপ। তথাকথিত ৩০ লক্ষ মানুষের নিহত হবার মিথ্যা সংখ্যাতথ্য বাংলাদেশ ও ভারতের প্রচারমাধ্যম সমূহে অব্যাহতভাবে প্রচার করা হয়, যার লক্ষ্যই হচ্ছে নানাবিধ প্রেক্ষাপটের দুই বন্ধুপ্রতীম দেশের সাধারণ মানুষের মনে পারস্পরিকভাবে বিদ্বেষভাব জিইয়ে রাখা। বস্তুতঃ পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটানোই হচ্ছে এই ভয়াবহ অপপ্রচারের মূল সূত্র। [জুলফিকার আলী ভূট্টো, মাই ডিয়ারেষ্ট ডটার, ক্লাসিক, লাহোর, ১৯৯৫, পৃ: ৫১] বলা বাহুল্য যে, ঐ বিলুপ্তকরণের অপপ্রয়াস থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়।

বাংলাদেশের চাইতে অনেক শক্তিশালী দেশ পাকিস্তান যদি বিলুপ্ত হবার ভারতীয় হুমকিতে নিমজ্জিত থাকতে পারে, সেখানে মুসলিম সত্ত্বা নিয়ে ভারতীয় আক্রমণের মুখে বাংলাদেশের টিকে থাকা সত্যিই দুস্কর। পাকিস্তান অথবা বাংলাদেশের ভূখন্ডগত তথা ভৌগলিক অবস্থান ভারতের নিকট কোন গুরুতর উদ্বেগের বিষয় নয়; তাদের উদ্বেগ হচ্ছে দুই দেশের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিতে মুসলিম জাতিসত্ত্বা ও ইসলামিক স্বাতন্ত্র্যের প্রাবল্য। তাদের নিকট ইসলাম ও বিদেশী মুসলমানরা হচ্ছে তাদের বড় শত্রু -যা ১৯৪৭ সালে মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের অভ্যুদয় ঘটায় পাকিস্তানকে এক নম্বর শত্রু হিসেবে তারা চিহ্নিত করে।

কেননা পাকিস্তান সৃষ্টির পিছনে ছিল বৃটিশ ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের রাজনৈতিক আন্দোলনের ফসল যার ভিত্তি ছিল দ্বি-জাতিতত্ত্ব আর তার অর্থই ছিল মুসলমান ও হিন্দুদের সত্ত্বা ও স্বাতন্ত্র্যের স্পষ্ট ভিন্নতা। ফলে বৃটিশরা ভারত ছেড়ে দেয়ার আগে দুইটি সার্বভৌম পৃথক রাষ্ট্র সৃষ্টি করা পূর্বক উপমহাদেশকে স্বাধীনতা দেয়া ছাড়া বৃটিশ ও কংগ্রেস-এর সামনে আর কোন পথ খোলা ছিলনা। তবে তারা ১৯৪৭ সালে তাদের ভারত মাতার অঙ্গচ্ছেদন কোন শর্ত বা উদ্দেশ্য ছাড়া মেনে নেয়নি। আর পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ টিকে থাক -এমন উদারতার বশে ভারত বাংলাদেশকে একাত্তরে সমর্থন দেয়নি।

তাদের প্রকৃত স্বার্থের প্রথম ধাপ হচ্ছে বাংলাদেশকে ভারতীয়করণ এবং পরবর্তীতে সুযোগ মত বাংলাদেশকে সিকিমকরণের জন্য ঘুম পাড়ানীর টেবলেট খাইয়ে দেয়া। ভারতীয় প্রচার মাধ্যম ও তাদের বাংলাদেশী তল্পীবাহী মহলের অসত্য ও ভিত্তিহীন প্রচারনাসমূহ নিয়ে বার বার মাতম করার পিছনে রয়েছে ভারতের বাংলাদেশ বিরোধী চক্রান্তের কিছু নোংরা দিক। এই নোংরা দিকগুলো ভারতীয় হিন্দুদের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গী থেকে উদ্ভূত। তাদের হিন্দু ধর্মমতে অখন্ড ভারত অথবা রামরাজ্য তথা দেবরাজ্য খন্ডন করা যাবে না; কোন কারণে খন্ডিত হলেও তাকে পুনরায় একত্রীকরণ করা ধর্মীয় মতে বাধ্যবাধকতাপূর্ণ; কিন্তু বাস্তবের পরিস্থিতি যে ভিন্ন এটা তারা এখনো অনুভব করতে পারেনি।

তাদের দুই লক্ষ্য সাধনে তারা ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিশ্চিত করার জন্যে নিরুঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের লেলিয়ে দিয়ে রেখেছে। তারা চায় এই লক্ষ্য বাস্তবায়নেই উনিশ’ চল্লিশের দশকের ভারতীয় নেতা গান্ধী, নেহেরু, শ্যামাপ্রাসাদ মুখার্জী প্রমুখ পাকিস্তানের দুই অংশকে ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদান করতে বহুভাবে উদ্ধুদ্ধ করেছিল।

বাংলাদেশ সৃষ্টি ভারতের ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’

ভারতীয় সাংবাদিক প্রাণ চোপড়া ১৯৭১ সালের ঘটনাপ্রবাহের অব্যবহিত পরেই বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের সৃষ্টি হচ্ছে ভারতের জন্য ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন’। [প্রাণ চোপড়া, ইন্ডিয়াজ সেকেন্ড লিবারেশান, বিকাশ পাবলিশিং হাউস (প্রাইভেট) লিমিটেড, দিল্লী, ১৯৭৩]

প্রথমটি তারা হাসিল করেছিল ১৯৪৭ সালে যখন বৃটিশরা ভারত ছেড়ে চলে যায়। এই ধরণের ধারণা কেবল চোপড়ার একার নয়; এই ধারণা সমগ্র হ্নিদু জাতীয়তাবাদীদের যারা মুজিবকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের এক সহস্র বছরের বিজয়ের নায়ক বলে মনে করে। আর দেশপ্রেমিক বাংলাদেশীদের নিকট মুজিবের পরিচয় হচ্ছে বিংশ শতাব্দীর মীর জাফর যে সম্পর্কে বহু দেশপ্রেমিক বাংলাদেশীদের মত জনাব কে এ হক যথাযথভাবে তার ২০০৭ সালে প্রকাশিত একটি বইয়ের নামকরণ করেছে দুই পলাশী দুই মীর জাফর।

ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন যে কোন বিজ্ঞ পাঠক এমন উপসংহারই টানবেন যে বাংলাদেশকে ভারত মাতার দখলে নিতে পারলে তাকে তারা তাদের তৃতীয় স্বাধীনতা হিসেবে আখ্যায়িত করবে আর চতুর্থ স্বাধীনতা হবে বোধ হয় তখন, যখন তারা পাকিস্তানের সমগ্র এলাকা দখল করে ফেলতে পারবে। এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্যি যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয়েই ভারতমাতার অঙ্গচ্ছেদ থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল, যা গত ছয় দশকেও হিন্দুরা মনের দিক থেকে মেনে নিতে পারেনি। হিন্দুরা চায় উপমহাদেশের সমগ্র মুসলমানরা যেন হিন্দুয়ানী জীবনাচার -এ অভ্যস্থ হয়ে উঠতে অথবা যেন ভারতীয়করণে গা ভাসিয়ে দেয়, আর পক্ষান্তরে মুসলমানরা গৌরবের সাথে মুসলমান হিসেবে টিকে থাকতে বদ্ধপরিকর।

এটা কেবল মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসেরই অংশ নয়; এটা নিজস্ব স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসারও পরিচায়ক। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মহাসমুদ্রে সংখ্যালঘিষ্ঠ হিসেবে মুসলমানদের হজম হয়ে যাওয়া কোন অবস্থাতেই মুসলমানদের পক্ষে গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। অতএব দুই মূল্যবোধ ও জীবনাচারের প্রকাশ্য সংঘাত অব্যাহত রয়েছে এবং দু’য়েরই স্বাতন্ত্রতা রাজনৈতিক পর্যায়েও লক্ষ্যনীয়। পাকিস্তানের সাথে বৈরীতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হলেও মুসলিম জাতি হিসেবে সম্মানের সাথে বেঁচে ও টিকে থাকা ছাড়া বাংলাদেশের সামনে অন্য কোন বিকল্প নেই।

সে কারণেই কলিনস ও ল্যাপায়ার (১৯৭৫) যথাযথভাবেই বলেছেন যে, বাংলাদেশ হচ্ছে জিন্নাহের দ্বি-জাতি তত্ত্বের বাই প্রোডাক্ট। অতএব এটা নিশ্চিতভাবেই যে কেহ বলবে যে পাকিস্তান ও মুসলিম দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ স্থাপনের মধ্যে বাংলাদেশের উত্তম ভবিষ্যত নিহিত।

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার অপরিহার্যতা

বর্ণিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে সম্মানের সাথে বাস করার জন্যে উভয় দেশকেই বৃহত্তর ঐক্যের জন্য আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে। এই প্রয়োজনের গুরুত্ব আমাদের পূর্ব পুরুষরা উপলদ্ধি করেছিল মুসলিম লীগ সংগঠনের মাধ্যমে- যে মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ঢাকার মহৎ মানব হিতৈষী নবাব স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে। ঐ প্রয়োজন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শেষ হয়ে যায়নি; কিংবা যায়নি ১৯৭১ সালের বিচ্ছিন্ন হবার কারণেও -যা খ্যাতিমান ঐতিহাসিক মরহুম ড: মতিয়ার রহমান (নবীনগর ব্রাহ্মণবাড়ীয়া), মরহুম ব্যারিষ্টার আলী আব্বাস (চান্দাইকোনা, পাবনা), মরহুম মাহমুদ আলী (সুনামগঞ্জ) আমৃত্য বলে গেছেন। মরহুম মাহমুদ আলীর সর্বশেষ লেখা ‘এক জাতি দুই রাষ্ট্র’ বইয়ে এই সম্পর্কে তার অকাট্য যুক্তি উল্লেখ করে গেছেন।

একই ধরণের রীতিমত ভবিষ্যতবাণী করেছেন মহান অধ্যাপক খ্যাতিমান শিক্ষাবীদ-সাহিত্যিক এবং ঐতিহাসিক মরহুম ড: সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেইন তার এক বিবৃতিতে। ১৯৯৪ সালের অক্টোবরে প্রদত্ত উক্ত বিবৃতি পরবর্তীতে তার সর্বশেষ বইয়ে সন্নিবেশিত হয়, যা ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে মুদ্রণখানায় গেলেও বইটি প্রকাশিত হয় তার ইন্তেকালের (১২ জানুয়ারি, ১৯৯৫ইং) এক মাস পর। উক্ত বিবৃতিতে তিনি অত্যন্ত পরিষ্কার ও দ্ব্যর্থহীনভাবে মন্তব্য করেছিলেন যে, এমনকি নামমাত্র স্বাধীন একটি দুর্বল বাংলাদেশও ভারতের নিকট একটি নিরবচ্ছিন্ন জ্বালাতন বা উৎপীড়ণের হেতু রূপেই গণ্য যা তার নিকট সহনীয় হতে পারেনা। উত্তেজনা প্রশমিত হবার পর ভারত তার প্রধান শত্রু পাকিস্তানের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে বুঝাপড়া করা পূর্বক কিছু সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় অনেক বেশী স্বাধীনভাবে উদ্যোগী হবে।

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কে খাপ খাইলে, যদি তা পুরনো সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নাও হয়, তাহলেও সেটা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বড় গ্যারেন্টি হয়ে থাকবে আর পাকিস্তানের টিকে থাকার পক্ষে হবে বড় ধরণের উৎস। যারা এই সত্য হৃদয়ঙ্গম করবেনা, তাদেরকে ক্ষীনদৃষ্টিসম্পন্ন স্বপ্নবীদ অথবা ৫ম কলামভূক্ত মারাত্মক দেশদ্রোহী বলেই অভিহিত করা যায়। [সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেইন, দি ওয়েষ্টস অব টাইমঃ রিফ্লেকশানস অন দি ডিক্লাইন এন্ড ফল অব ইষ্ট পাকিস্তান, নতুন সফর প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৫, পৃ: ২৮৪]

তিন অনুচ্ছেদের উপরোক্ত মন্তব্যগুলো তিনি তার ঐতিহাসিক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন। এই মহান ব্যক্তি উনিশ ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন; অথচ একাত্তরের ঘটনা প্রবাহের সময় পঞ্চম বাহিনী ও ভারতের পোষ্য গুন্ডাদের হাতে নৃশংসভাবে নির্যাতিত হোন। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের পতনের পর তাকে নির্মমভাবে দৈহিক নির্যাতন করা হয় এবং দুই বছরের বেশী সময় কারা নির্যাতন এর একটি হচ্ছে একাত্তরে স্মৃতি এবং অন্যাটি হচ্ছে দি ওয়াষ্ট অব টাইমঃ রিফ্লেকশনস অন দি ডিক্লাইন এন্ড ফল অব ইষ্ট পাকিস্তান। তাঁর উপরোক্ত মন্তব্য সম্পর্কে কোন পর্যবেক্ষণ আমার করার দুঃসাহস নেই; তবে ঐ মন্তব্যের সর্বাংশকে এই জাতির জন্য নিখুঁত ভবিষ্যতবাণী বলে আমি মনে করি।

সৎ বুদ্ধিজীবি ও উল্লেখযোগ্য রাজনীতিবীদদের সবাই বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে একমত; যদিও তারা তা কৌশলগত কারণে প্রকাশ্যে বলবেননা। তবে তারা এটা স্পষ্টই অনুধাবন করেন যে উভয়ই ইসলামের সুমহান আদর্শে অভিন্নভাবে আত্মসঞ্জীবিত। অবশ্য অঞ্চল ভেদে এবং জনগণের মধ্যে ভাষা ও জীবনাচারে হয়তো বিভিন্নতা থাকতে পারে; কিন্তু ইসলামী মূল্যবোধ হচ্ছে উভয়ের অভিন্ন জীবনাচারের লাইফ ব্লাড। এই জীবনাচার থেকেই তারা তাদের জীবন ও জীবিকার মৌলিক প্রেরণা লাভ করে। এটা না থাকলে তারা তাদের ইসলামী মূল্যবোধ হারিয়ে বিশাল ভারতীয় সমাজে লীন হয়ে যেতো।

এটা সৎ বুদ্ধিজীবি ও সঠিক চিন্তা-চেতনায় উদ্দীপ্ত সবাই স্বীকার করবেন, কিন্তু ভারতের ভয়ে বা অন্য কোন অজ্ঞাত কারণে তারা এই সত্যের কথা প্রকাশ্যে বলবেননা। এ থেকে অনুমান করা দুস্কর নয় যে ভারতীয় অধিপত্যের অষ্টোপাশ

পঠিত : ২১৩১ বার

মন্তব্য: ০