Alapon

অনাকাঙ্খিত প্রেম


একজন আইনজীবীর কাছ থেকে সাময়িক সময়ের জন্য পাওয়া একটি মামলার এজাহার। মামলা অপহরণের। স্কুল পড়–য়া দশম শ্রেণীর ছাত্রী অপহরণের মামলা। বাদী স্কুল ছাত্রীর মা। এজাহার নামা পড়িয়া খুব খারাপ লাগল। একটি বখাটে ছেলে একজন তার মেয়েকে তুলে নিয়ে গেছে। বিস্তারিত জানার জন্য একদিকে মন যেমন উদগ্রীব অন্যদিকে বখাটে ছেলের প্রতি ক্ষোভ জাগরিত হচ্ছে। যথারীতি ফোন দিলাম এডভোকেট সাহেবকে। জানালেন বিস্তারিত বলবেন সরাসরি। 

সকাল দুপুর গড়িয়া সন্ধ্যা নাগাদ এডভোকেট সাহেব কালো কোর্ট পড়িয়া আসিলেন। দেখা হলো কথা হলো কিন্তু এই কথা সেই কথার আড়ালে মূল যে কথা “অপহরণের কেস ডায়রী” শুনব তা বেমালুম ভুলে গেলাম। হঠাৎ মনে পড়তেই এডভোকেট সাহেবকে চেপে ধরলাম। তিনি মামলার বাস্তবিক কাহিনী যা শুনালেন, তাতে হৃদয়ে রক্তক্ষরণের পথ উল্টো রচিত হয়ে গেলো। এজাহারে যা পড়েছি, বাস্তবে কাহিনী সম্পূর্ণ বিপরীত। শুধু বিপরীত বললে ভুল হবে। এ যেন বঙ্গোপসাগরের জোয়ার-ভাঁটা। 

এজাহারে পড়লাম স্কুল ছাত্রীকে জোর পূর্বক তুলে নিয়ে গেছে এক বখাটে ছেলে। কোথায় নিয়ে গেছে, কিভাবে আছে তার কোন হদিস ভুক্তভোগী মেয়েটির মা জানেন না। তিনি আরও জানেন না তার মেয়ের জীবিত আছে কিনা। আর এডভোকেট সাহেব আমাকে বলিলেন, স্কুল ছাত্রী তার দীর্ঘ দিনের বখাটে প্রেমিকের হাত ধরে বাড়ি ছেড়েছেন। শুধু তাই নয় তাহারা বিয়ে-শাদী করে ঘর সংসার করছেন আজ ২০ দিনের অধিক। মনে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা খেলাম, হায়রে মানুষ!

চাকরীর সুবাদে দীর্ঘদিন সেভাবে বাড়ী যাওয়া হয় না। একটি বিশেষ কারণঃবশত গত সেপ্টেম্বর মাসে বাড়ীতে বেশ কয়েকদিন থাকার সুযোগ পেলাম। দীর্ঘ দিনের এলাকার খোঁজ খবর বিভিন্ন ভাবে আমাকে জানাচ্ছে এলাকার বন্ধু-বান্ধবরা। বেশ ভালোই লাগছিল। কিন্তু বন্ধুদের মুখে এলাকায় ঘটে যাওয়া অনেকগুলো ঘটনার মধ্যে দুটো ঘটনা শুনে একবারে মন খারাপ করতে বাধ্য হতে হলো। 

জনাব ওয়াহিদুল ইসলাম এলাকায় ধার্মিক লোক হিসেবে পরিচিত। এক সময়ে চলচিত্রে পার্শ্বনায়কের ভূমিকা অভিনয় করলেও পরবর্তীতে এসব ছেড়ে দিয়ে পুরোদস্তর ধার্মিক জীবন যাপন শুরু করেন। জনাব ওয়াহিদ সাহেবের সন্তান গুলো সব কন্যা ছিলো। যথেষ্ট আদর-মায়া মহাব্বত দিয়ে তাদের বড় করার চেষ্টা তিনি করেছেন। স্কুলে মেয়েদের তিনি রোজ মোটরসাইকেল চালিয়ে নিয়ে যেতেন আবার পুনরায় নিয়ে আসতেন। মেয়ে গুলো বলতে হবে অপরূপ সুন্দরী ছিলো। ওয়াহিদ সাহেবের বড় মেয়ে তানিশা তার বাবা-মায়ের এতদিনের আদর-ভালোবাসা কে তুচ্ছ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করলেন এলাকার মাদক ব্যবসায়ী রমিজ উদ্দীনকে!

অন্যদিকে লেগুনা চালক মাসুম আমাদের প্রতিবেশী ছিলো। আর দশজন লেগুনা চালকের ন্যায় তারও জীবন ছিলো যথেষ্ট উচ্ছৃঙ্খলতায় ভরপুর। মাদকের নেশায় বুঁদ থাকত সব সময়। এই নিয়ে সংসারে অশান্তি কম হয়নি। হঠাৎ তার জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন। লেগুনার পেশা ছেড়ে দিয়ে এক উচ্চশিক্ষিত ব্যবসায়ী মহিলার গাড়ী চালানোর কাজ করে বছর খানেক । এরপর উচ্চশিক্ষিত মহিলাকে সে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করে নেয়। অথচ এই মহিলার স্বামীর সংসারে দুজন কলেজ পড়–য়া ছেলে-মেয়ে রয়েছে। পরকিয়া প্রেম থেকে শুরু হওয়া এই জীবন সম্পর্কে অজ্ঞাত তার স্বামী-সন্তানরা। একই সাথে দুই সংসার চালিয়ে যাচ্ছে ভদ্র এই মহিলা!

বেশ কিছুদিন পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডে বয়ফ্রেন্ড কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা চালায় ইডেন কলেজের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত এক ছাত্রী। পত্রিকা পড়ে জানতে পারি দীর্ঘদিন যাবত পুরান ঢাকার ভাঙ্গারী ব্যবসায়ী এক যুবকের সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিলো এই ছাত্রীর। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে উক্ত ছাত্রীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তুলে নিজেকে প্রাইভেট ভার্সিটির ছাত্র পরিচয় দেওয়া ঐই যুবক। পরবর্তীতে মেয়েটি তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিলে যুবক টালবাহানা শুরু করে। মেয়ে যুবকের পারিবারিক পরিচয় খোঁজ করে জানতে পারে ছেলেটি তার সাথে প্রতারণা করেছে। সে কোন ছাত্র-ই না। বরং একজন ভাঙ্গারী ব্যবসায়ী। এতে মেয়েটি মনক্ষুন্ন হয়ে প্রতিশোধের নেশায় ছেলেটি কে হত্যা করতে ঢাবি ক্যাম্পাসে ঢেকে নেয়। কি এক ভয়ানক ব্যাপার!


রাজধানী ঢাকার একটি বিখ্যাত হাসপাতালের নিউরোলজিস্ট অধ্যাপকের একমাত্র সন্তান রাকিব। স্কুল জীবনে প্রেমে পড়ে যায় তারই প্রতিবেশী কথিত সুন্দরী ললনার। যে মেয়ে ইতিমধ্যে “বিগহার্ট লাভার গার্ল” খ্যাতি অর্জন করে তার একাধিক প্রেমের কারণে। রাকিব ঢাকার বিখ্যাত স্কুলে পড়–য়া মেধাবী ছাত্র। অপরদিকে মুক্তা স্কুলের বারান্দ্রা ছেড়েছে ষষ্ঠ শ্রেণীতে। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর সে ভর্তি হয় আরেক স্বনামে বিখ্যাত এক কলেজে। কলেজে ভর্তি হওয়ার মাস তিনেক পার হতে না হতে সুন্দরী ললনার স্বপ্নিল আকাশ জয় করার লক্ষ্যে তারা কোর্ট ম্যারিজ করে ফেলে। একমাত্র সন্তানের এমন করুণ পরিণিতি মেনে নিতে পারেননি ডাক্তার মহাদোয়। খবর যখন এলাকায় আলোর গতি কে হার মানিয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল, নিজের অর্জিত আত্মসম্মানবোধ রক্ষায় তড়িঘড়ি করে এতদিনের আদর, ভালোবাসার মিশ্রণে লালিত-পালিত সন্তানকে বাড়ী থেকে বের করে দিতে মোটেই দেরী করলেন না। সোজা গেট আউট!

এই ঘটনা গুলো কোন গল্পের বইয়ের রঙ্গিন মোড়ক নয়। একুশ শতাব্দীর বাংলাদেশে উপরোক্ত ঘটনা প্রতিনিয়ত সংঘটিত হচ্ছে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া কিংবা রূপসা থেকে পাথুরিয়ার অলিতে-গলিতে। তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের এই যুগে পৃথিবী এখন ছোট্ট একটি গ্রামে পরিণত হয়ে গেছে। উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির অপব্যবহারে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এদেশের তরুণ সমাজের রুচি বোধের। হারিয়ে যাচ্ছে ভালো-মন্দ বোঝবার ক্ষমতা। বলা হয়ে থাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গেলে একজন ব্যক্তির মস্তিকের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। তার স্বতন্ত্র রুচি বোধের সৃষ্টি হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেন প্রতিনিয়ত পথ হারাচ্ছে বারবার। 

একজন সন্তানকে তার পিতা-মাতা অনেক কষ্টে সহ্য করে আদর-ভালোবাসা দিয়ে বিদ্যালয়ে-বিশ্ববিদ্যালয় পাঠায়। যাতে সন্তান যেন সমাজে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে পারে। সেই জন্য তারা দিন-রাত এক করে হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করে যায় অবিরত। প্রতিটি সন্তান তাদের পিতা-মাতার কাছে যুবরাজ-রাজকন্যা। যুবরাজ-রাজকন্যার কোন চাহিদা অপূর্ণ যাতে না থাকে সেজন্য তারা কিনা করে। কিন্তু তাদের কষ্টের ফল কি প্রত্যাশিত ফসলে পরিণত হচ্ছে ? আজ জাতির কাছে বড় প্রশ্ন সন্তানরা কি তাদের পিতা-মাতার কষ্টের মূল্যায়ন করতে পারছে ?

১৬-২০ থেকে বছর পর্যন্ত একজন সন্তানকে পিতা-মাতা তাদের সাধ্যের সবটুকু ঢেলে দিয়ে যখন প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্নে বিভোর, ঠিক তখন-ই বিপত্তি। মা-বাবার অমতে সন্তান বেরিয়ে যাচ্ছে এক বখাটের হাত ধরে। নতুন পৃথিবী সৃষ্টির নেশায় উন্মাদ তরুণ-তরুণীরা আকাশে উড়িয়ে দিচ্ছে তাদের উদ্ভুত স্বপ্নগুলো। দুঃখজনক হলেও সত্যি এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে বিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহন করা তরুণ-তরুণীরা। ভালোবাসার মোহে অন্ধ হয়ে একজন শিক্ষিত সন্তান নিমিশে ভুলে যাচ্ছে নিজের আত্মপরিচয়। কার সাথে তার মানানসই তা কখনও বিবেচনা নিচ্ছে না সে। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে বিলিয়ে দিচ্ছে ভবিষৎত ক্যারিয়ার। 

নীল সমুদ্রের রাশি রাশি পানির উত্তাল ঢেউ প্রতিনিয়ত আঘাত হানছে তরুণ-তরুণীদের মনে। তাদের দুটি চোখে তখন সব কিছুর উর্দ্ধে শুধু অলৌকিক স্বপ্ন। একমুঠো হাসি ধরে রাখার জন্য তারা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ করতেও রাজী। এই অশান্ত মনকে কোন ভাবে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। এলোমেলো করে তুলে তাদের জীবন। ইচ্ছেগুলো ভবের হাটে বিক্রি করে দিয়ে সে জয় করতে চায় তার প্রাণাধিক প্রিয় মানুষের মনটি। ফলশ্রুতিতে নিমিশে হারিয়ে যাচ্ছে চোরাবালির অন্ধকার গহবরে।  

এই অনাকাঙ্খিত প্রেমের আড়ালে নিজের আপন সত্ত্বাকে বিক্রি করে দিয়ে নিজেকে অচল পণ্য করতে বেশী সময় নেয় না। প্রেমের মোহ কেটে যেতে অথবার বাস্তবতার মহাসড়কে সে যখন উঠে দেখে তার জন্য কেউ অপেক্ষা করছে না তখন তার ভুল বুঝতে বেশী সময় লাগেনা। কিন্তু তখন সে হারিয়ে ফেলে অনেক মূল্যবান ধনরত্ম। যা আর কোন দিন ফিরে পাওয়া সম্ভব না। অনেকাংশ চেষ্টা করে নিজ পরিবারে ফিরে যেতে। কিছু পরিবার নিজ সন্তান যেমন ফিরিয়ে নেয় আবার তেমনি কিছু পরিবার তার সন্তানের দরজা মুখের উপর বন্ধ করে দিতে দ্বিধা করেনা। তখন এই অচল পণ্যের সামনে সবচেয়ে বেশী অপেক্ষা করে আত্মহত্যার দরজা এবং এটাই হয় কিংবা হচ্ছে। 

সন্তানদের এই বিপথে যাওয়ার জন্য অনেকে পরিবারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দায়ী করে থাকেন। পরিবার দায় এড়াতে পারেনা এটা বাস্তব সত্য। সাথে সাথে এটা স্বীকার করতে হবে অত্যাধুনিক যুগে সন্তানকে কতক্ষণ পাহাড়া দিয়ে রাখা যায়? এটা সম্ভব না। তার পাশাপাশি এই সব পরিস্থিতির জন্য আকাশ সংস্কৃতির সাথে এদেশের চলমান উদার সংস্কৃতির নামে প্রেম-ভালোবাসার চলচিত্র, নাটক ও সর্বোপরি গানগুলো দায় এড়াতে পারেনা। ঠিক তেমনি ভাবে দায় এড়াতে পারেনা নৈতিক শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক গলদ গুলো। একজন শিক্ষার্থী কিভাবে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করবে তার সঠিক ধারণা থাকেনা পাঠ্যপুস্তুকে।  

এদেশকে সোনার বাংলায় গড়তে হলে আগে গড়তে হবে পরবর্তী প্রজন্মকে। এখনও সময় আছে তরুণ সমাজকে সংশোধনের মাধ্যমে কাঙ্খিত জাতি তৈরীর সুযোগ। সর্বোপরি সকল মহলকে এই বিষয়ে সুস্থ মানসিকতার সাথে চিন্তা করে সঠিক কর্ম পরিকল্পনা প্রস্তুত করে সেই আলোকে কাজ করতে হবে। তাহলে হয়ত আমরা ফিরে পাবো কাঙ্খিত পারিবারিক বন্ধনে সমৃদ্ধ আগামীর বাংলাদেশ।

বিঃদ্রঃ প্রত্যেকটি নাম ছদ্ম নাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

পঠিত : ৭৮৭ বার

মন্তব্য: ০