Alapon

মুজাদিদ্দে আলফেসানী কেন সশস্ত্র পথ গ্রহণ করেননি?

মুজাদ্দিদ আলফেসানী আহম্মদ সারহিন্দী (র.) ৯৭৫ হিজরীতে (১৫৬৩ খ্রি.) পাঞ্জাবের তৎকালীন পাতিয়ালা রাজ্যের বিখ্যাত সারহিন্দ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (র.)-এর ২৮তম অধঃস্তন বংশধর। তাঁর বয়সকাল ছিল ৬৩ বছর। তার জীবন ও কর্ম তাকে সত্যিকারের ওয়ারাছাতুল আম্বিয়ার মর্যাদা দান করেছে। তিনি হানাফী মাজহাবের অনুসারী ছিলেন, তবে ইমাম শাফেয়ীকে তিনি অত্যন্ত ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন এবং কোনো কোনো আমল ইমাম শাফেয়ীর তরীকায় সম্পাদন করতেন।

মুজাদ্দেদ আলফেসানী (র.) যখন সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন তখন সম্রাট আকবরের চূড়ান্ত উন্নতি, সমৃদ্ধি ও শানশওকতের কাল। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য আকবর তখন ইরানী শিয়া ও ব্রাহ্মণ্যবাদী ঠাকুর-পুরোহিতদের পরামর্শে সঠিক ইসলামকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দ্বীনে ইলাহী নামক কুফরী ধর্ম প্রচারে ব্যস্ত। এমতাবস্থায় মুজাদ্দেদ আলফেসানী অভিজ্ঞ ডাক্তারের মতো প্রথমে রোগীর রোগের কারণ নির্ণয় করেন এবং অতঃপর রোগমুক্তির দাওয়াই সংগ্রহ করে প্রয়োগ করা শুরু করেন। ক্রমান্বয়ে তাঁর চিকিৎসা পদ্ধতি সফলতার দিকে এগিয়ে যায় এবং মুরতাদ আকবর শেষ জীবনে তওবা করে নিজ ধর্মে ফিরে আসেন এবং সম্রাট জাহাঙ্গীর পর্যায়ক্রমে সংশোধিত হয়ে একপর্যায়ে শেখ আহমদ সারহিন্দের মাধ্যমে ইসলামের নিকট আত্মসমর্পণ করেন ও শরীয়া আইন জারি করেন।

আকবরের মৃত্যুর পর ১০১৪ হিজরীতে সম্রাট জাহাঙ্গীর সিংহাসনারোহণ করলে তিনি চূড়ান্ত লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। তিনি স্বমতে দীক্ষিত দরবারের সভাসদদের দ্বারা জাহাঙ্গীরের মনোভাবকে ইসলামের অনুকূলে আনতে সক্ষম হন এবং এক পর্যায়ে সম্রাট জাহাঙ্গীর মুজাদ্দেদ (রsmile-এর দাবিগুলো মেনে নেন। অবশ্য দাবি মানার পূর্বে সম্রাট জাহাঙ্গীর মুজাদ্দিদকে স্বীয় সিংহাসনের জন্য হুমকি মনে করে কুখ্যাত গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দী করেন। দুর্গাধিপতি এক সময় সম্রাটের নিকট এই মর্মে রিপোর্ট প্রেরণ করেন যে, ‘‘আহমদ সারহিন্দের সংস্পর্শে থেকে গোয়ালিয়র দুর্গের পশুসুলভ বন্দীরা মানুষে পরিণত হয়েছে এবং মানুষগুলো ফেরেশতায় পরিণত হয়েছে।’’ এরূপ রিপোর্ট পাওয়ার পর সম্রাট জাহাঙ্গীর নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং মুজাদ্দেদকে মুক্তি দান করে তাঁর সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। সাক্ষাতে মুজাদ্দিদ (রsmile সম্রাটের নিকট স্বীয় দাবিনামা পেশ করেন।


মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর

তাঁর দাবিগুলো ছিল :

(ক) সম্রাটকে সেজদা করার রীতি সম্পূর্ণভাবে রহিত করতে হবে।

(খ) মুসলমানদের গরু জবেহ করার অনুমতি দিতে হবে।

(গ) বাদশাহ ও তাঁর দরবারীদের জামায়াতে নামায আদায় করতে হবে।

(ঘ) কাজীর পদ ও শরীয়ত বিভাগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

(ঙ) সমস্ত বেদায়াত ও ইসলামবিরোধী অনাচারকে সমূলে উৎখাত করতে হবে।

(চ) ইসলামবিরোধী যাবতীয় আইন রহিত করতে হবে।

(ছ) ভগ্ন ও বিধ্বস্ত মসজিদগুলোকে পুনরায় আবাদ করতে হবে।

(উল্লেখ্য, সম্রাট আকবরের আমলে হিন্দুরা ভারতের অনেক মসজিদকে ধ্বংস করেছিল এবং অনেকগুলোকে মন্দিরে পরিণত করেছিল।)

সম্রাট জাহাঙ্গীর মুজাদ্দেদ (রsmile-এর দাবিসমূহ সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেন এবং শাহী ফরমান জারি করে তা কার্যকর করেন।

মুজাদ্দেদ (রsmile-এর দাবির সারকথা ছিল-নির্ভেজাল ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা। অপর কোনো ধর্ম বা ফেরকার বিরোধিতা করা বা ব্যক্তিগত লাভের কোনো ব্যাপার এতে ছিল না।

৭. প্রত্যেক শহর ও পল্লীতে মুজাদ্দেদ (রsmile সাহেবের একজন করে প্রতিনিধি ছিলেন যারা নিজেদের উদ্দেশ্যে প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, একাগ্রচিত্ত ও বজ্রকঠোর।

মুজাদ্দেদে আলফেসানী (রsmile কেন সশস্ত্র যুদ্ধের পথে যাননি?

রোগ বুঝে চিকিৎসা করা মুজাদ্দেদ (রsmile-এর নীতি ছিল। তিনি জানতেন, একশ্রেণীর দুনিয়াদার দরবারী আলেম, পীর ও সুফী সম্রাট আকবরকে ইসলামবিমুখ করেছে। তার সাথে যোগ হয়েছিল শিয়া মূলহেদ সম্প্রদায় ও হিন্দুরা। অথচ প্রথম জীবনে আকবর ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন। এমতাবস্থায় তিনি প্রথমে আকবরের সভাসদদের শুদ্ধ করেন এবং অতঃপর উক্ত সভাসদদের মাধ্যমে আকবরের মানসিক পরিবর্তনের প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন। এছাড়া আরো যেসব কারণ অনুমান করা যায় তাহলো :

১. হাদীসের নির্দেশ অনুযায়ী কোনো মুসলিম শাসনকর্তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লব ঠিক তখনই জায়েজ, যখন প্রমাণিত হবে যে, তিনি প্রকাশ্যে কুফরীতে ও ইসলামদ্রোহিতায় লিপ্ত রয়েছেন। মুশরেকী ও কাফেরী কার্যকলাপ সংঘটিত হওয়া যদিও হারাম তবুও কোনো ব্যক্তিকে ঠিক তখনই কাফের ঘোষণা করা যায়, যখন তাকে মুসলমান বলার মতো আর কোনো কারণই বিদ্যমান থাকে না। সম্ভবত আকবরের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদে অবতীর্ণ হওয়ার শক্তি মুজাদ্দিদ সাহেব তখনও অর্জন করতে পারেননি। অথচ শরীয়তের দৃষ্টিতে জেহাদ ঘোষণার জন্য শর্ত হলো-এতটুকু বৈষয়িক শক্তি অর্জিত হতে হবে, যা দ্বারা বিজয়ী ও সফল হওয়ার কিছুটা আশা করা যায়। তাছাড়া আকবরের জীবনে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসাটাও সশস্ত্র যুদ্ধ না করার কারণ হতে পারে।

২. মুজাদ্দেদ সাহেব আকবরকে স্বার্থপর ও ফাসেক মুসলমান বলতেন। অসাধু চাটুকার ও স্বার্থপর লোকদের দ্বারা আকবর পরিবেষ্টিত ছিলেন। এজন্য আকবরের তুলনায় তিনি এসব স্বার্থপর আলেম, বিলাসপ্রিয় সভাসদ এবং চাটুকারদের সমালোচনাই বেশি করেছিলেন। সম্রাটের সংশোধনের জন্য তাঁর পরিষদদের সংশোধনকেই তিনি অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন।

৩. সরকারের সংস্কার ও সংশোধনই যার একমাত্র লক্ষ্য সে রক্তাক্ত সংগ্রামকে ঠিক তখনই জরুরি মনে করেন যখন এছাড়া আর গত্যন্তর থাকে না। ক্ষমতাসীনদের সংশোধনই মুজাদ্দিদ সাহেবের উদ্দেশ্য ছিল। এ লক্ষ্যেই তিনি কাজ করেছেন। শরীয়তের হুকুম-আহকাম কায়েম করাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। এজন্য নিজকেই ক্ষমতাসীন হতে হবে এমন বিষয়কে তিনি জরুরি মনে করেননি।

৪. মুসলমান রাজা-বাদশাহরা তখন গৃহযুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। প্রত্যেকেই অন্যের বিরুদ্ধে অযোগ্যতা, দুর্নীতিপরায়ণতা ও বিলাসিতার দোহাই পাড়তেন এবং সংশোধনের দাবি জানিয়েই যুদ্ধ ঘোষণা করতেন। কিন্তু এই অবস্থায় মুজাদ্দিদ সাহেবও যদি সশস্ত্র যুদ্ধের ডাক দিতেন তবে জনগণ বিষয়টিকে ক্ষমতার লড়াই হিসেবে মনে করতেন। এমতাবস্থায় ক্ষমতার হাতবদল হলেও ভেতর থেকে সংশোধন ও সংস্কার সাধিত হতো না বরং মুসলমানদের রক্ত ঝরতো।

তদুপরি আকবরের অনুসৃত ধ্বংসাত্মক নীতির ফলে সাম্রাজ্যের উপর হিন্দু ও শিয়ারা বিশেষ আধিপত্য বিস্তার করে ফেলেছিল। তারা একটি আত্মঘাতী যুদ্ধ লাগার অথবা লাগানোর অপেক্ষায় ছিল। মুজাদ্দিদ সাহেব যুদ্ধ ঘোষণা করলে তারা সে সুযোগটি পেয়ে যেত এবং ভারতবর্ষের মুসলমানরা আত্মঘাতী যুদ্ধে নিঃশেষ হয়ে যেত। এ সকল কারণে মুজাদ্দেদ (রsmile সমস্যার সমাধান ও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে অহিংস নীতি অবলম্বন করেছিলেন।

পঠিত : ৬৩৩ বার

মন্তব্য: ০