Alapon

পারিবারিক বন্ধন


পৃথিবী নামক এই গ্রহে প্রথম মানব হযরত আদম (আঃ) ও প্রথম মানবী হাওয়া (আঃ) এর হাত ধরে পরিবার প্রথা শুরু। আল্লাহ বাবা আদম ও মা হাওয়ার মাধ্যমে জনশূন্য গ্রহে মানব বসতির দ্বার উন্মুক্ত করলেন। অতপর তাদের মাধ্যমে পৃথিবীতে একের পর এক ধারাবাহিক ভাবে সৃষ্টি নিয়েছে অসংখ্য আদম সন্তান। বিশাল আয়তনের পৃথিবীর ৩ ভাগ দখল করে রেখেছে সমুদ্রের নীল জল রাশি। বাকি একভাগে দ্রুত ছড়িয়ে মানব বসতি। সৃষ্টি হয় অসংখ্য জনপদ। প্রতিটি জনপদে আবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকারে তৈরী হয় পরিবার প্রথা। বলা যায় পৃথিবীর বয়স বৃদ্ধির সাথে তালে তাল মিলিয়ে পরিবার প্রথার বিকাশ ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবার মানব সমাজ সৃষ্টির মূল ভিত্তি। সামাজিক জীবনে মানব সভ্যতা তৈরীর রাস্তা করেছে পারিবারিক ব্যবস্থা।

বাঙ্গালী তথা বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীর উপর পারিবারিক বন্ধনের রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব। এদেশেই সৃষ্টি হয়েছিল একান্নবর্তী পরিবার প্রথা। যেখানে একই সঙ্গে মা-বাবা, ভাই-বোন, দাদা-দাদী, কাকা-কাকী, শুশুর-শাশুড়ি নিয়ে প্রাচীন কাল থেকে বসবাস করে আসছে অধিকাংশ মানুষ। এই প্রথা দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিক ঐতিহ্যে পরিণত করা সম্ভব হয়েছে কেবল একে অপরের মধ্যে নিবিড় ভালোবাসার বন্ধনের কারণে। বড় শহর কিংবা ছোট্টগ্রাম যাই বলি না কেন, যেখানে এখনো দু-একটি একান্নবর্তী পরিবার প্রথা টিকে আছে তা কেবল ভালোবাসা, পারস্পারিক শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাসের অদৃশ্য শক্তির দ্বারা। তাই তো এদেশে এখনো বড় অথবা ছোট্ট উৎসবে পরিবারের সদস্যরা বাড়ী ফিরে যায় নাড়ীর টানে।  

আঠারো শতাব্দীর মাঝামাঝিতে বিট্রিশদের হাত ধরে শুরু হওয়া শিল্প বিপ্লব পৃথিবীর আদি সভ্যতা বিলীন করার ভয়াবহ চেষ্টায় নেমে পড়ে। এই ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃত চেষ্টার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী বিট্রিশরা হলেও ছোঁয়াচে রোগের মতো তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীব্যাপী। একুশ শতাব্দীতে এসে তথ্য-প্রযুক্তি যখন পুরো পৃথিবী কে একটি ছোট্ট গ্রামে পরিণত করে দিয়েছে তখন বোঝা যাচ্ছে মানব সভ্যতা বিলিন হতে আর বেশী সময় নেই। বিশ্বায়নের এই যুগে সময়ের ব্যবধানে আমাদের চারপাশের চিত্র অতিদ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে এদেশের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। ভিন দেশের সংস্কৃতি হাতের কাছে পেয়ে আনন্দে নেচে উঠছি সবাই। কিন্তু ভিন দেশী ঐ সংস্কৃতি গুলো আমার মাটি, মানুষ ও সর্বোপরি দেশের জন্য আধো প্রযোজ্য কিনা তা ভেবে দেখার ফুসরাত পাচ্ছি না। তারই ফল আসছে হাতে নাতে। 

পশ্চিমা বিশ্বে শিল্প বিপ্লবের প্রথম আঘাত ছিলো পরিবার প্রথা ভেঙ্গে ছারখার করে দেওয়া এবং তারা যথাযথ ভাবে করতে পেরেছে। এখন ঐদেশ গুলোতে পরিবার প্রথার কোন গুরুত্ব নেই। যৌথ পরিবার ও একক পরিবার এখন আর সেখানে কোন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়না। তারা লিভ টুগেদারে বেশী স্বাচ্ছন্দবোধ করে। বিয়ের পূর্বে তরুণ তরুণীরা এক ছাদের নিচে দীর্ঘ দিন বসবাস করে তারা একে অপর কে বোঝার চেষ্টা করে। এই বুঝ শেষ হওয়ার আগেই তারা এক বা একাধিক সন্তানের মা-বাবা হয়ে পড়ে। অতপর তাদের মনে হয় তারা একে অপরের উপযুক্ত না। একে অপরের প্রতি অনাস্থা ও বিশ্বাসহীনতার অভিযোগ তুলে ব্রেকাপ দিয়ে খেলা শেষ করে। এই বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ডের সংস্কৃতির কুফল পশ্চিমা দেশগুলোর বর্ডার পার হয়ে দ্রুত গতিতে দৌড়িয়ে আসছে এদেশে। 

বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দৌলাচলে প্রথমে ভেঙ্গে দিয়েছে আমার যৌথ তথা একান্নবর্তী পরিবার প্রথা। বলা হয়ে থাকে তুমি কারও ক্ষতি করতে চাইলে, তার ভাইদের মধ্যে দ্বন্ধ লাগিয়ে দাও। এরপর বাকি কাজ তারা করে নিবে। তুমি শুধু ঘাপটি মেরে তাদের তামাশা দেখবে। এইভাবে ধ্বংস হয়ে গেলো যৌথ পরিবার প্রথা। অথচ সমাজ জীবনে যৌথ পরিবারের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। এখন মা-বাবা ও সন্তান নিয়ে গঠিত হচ্ছে “একক পরিবার”। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন যৌথ পরিবার থেকে একটি শিশু নৈতিকতা সম্বলিত আদর্শিক জীবন পেয়ে থাকেন। যা তার পরবর্তী জীবনে সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে তার নিজের অবস্থান তৈরীতে সাহায্য করে।  

উজান ভাটির দেশ বাংলাদেশ। নিজ সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য টইটম্বুর থাকার পরও উন্মুক্ত আকাশের মাধ্যমে পশ্চিমা সংস্কৃতি এদেশে উড়ে আসছে বিদ্যুৎ গতিতে। পশ্চিমা বিশ্বের ভিনদেশী কিংবা এদেশীয় এজেন্টরা যৌথ পরিবার প্রথা সুকৌশলে ভাঙ্গার পর তাদের পরবর্তী টার্গেট নব্য সৃষ্টি “একক পরিবার”। এলক্ষে তরুণ সমাজের কাছে পাশ্চাত্য সমাজের বস্তুবাদের রঙিন নেশার সাথে তরুণ-তরুণীর অবাধ মেলা মেশার সুযোগ করে দিতে বিভিন্ন আয়োজন নিয়ে হাজির তারা। নেশায় মাতাল হয়ে তরুণ-তরুণরী হুমড়ি খেয়ে পড়ছে একে অপরের উপর। ফলে সাময়িক উত্তেজনা বশত প্রকৃত আদর-¯েœহ, মায়া-মমতা দূরে ঠেলে দিয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে “ভালোবাসা” নামক মিথ্যা বন্ধনে। ফলশ্রুতিতে শিশু-কিশোর কিংবা যুবক-যুবতী জড়িয়ে পড়ছে অবৈধ যৌনাচারসহ নানাবিধ অন্যায়-অপকর্মে। মা-বাবার চোখে হয়ে পড়ছে অপরাধী, সৃষ্টি হচ্ছে দুরুত্ব। সমাজে নিজেদের মান-সম্মানের কথা চিন্তা করে অনেক সময় পিতা-মাতা সন্তানকে দূরে ঠেলে দিচ্ছেন। অথবা সন্তান নিজে থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন বাড়ী থেকে। এভাবে ভেঙ্গে যাচ্ছে একক পরিবারও প্রথা। 

আদর্শিক পরিবার গঠনের অন্তরায় হয়ে দাড়িয়ে যাচ্ছে অবৈধ্য প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক। পারিবারিক পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্বহীন করে তরুণ-তরুণীরা নিজেদের জীবন সাথী নিজেরাই খুঁজে নিচ্ছে। স্কুল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কর্মস্থলের আঙ্গিনায় তারা জড়িয়ে যাচ্ছে বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড জুটিতে। পশ্চিমা নতুন কৃষ্টির সাথে তারা তাল মিলিয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে শারীরিক সম্পর্কে। এদেশে এখনও বিয়ের পূর্বে সন্তান নেওয়া ভালো চোখে না দেখার কারণে সামাজিক দেয়ালে বাধাঁপ্রাপ্ত হলেও বাকি কাজ গুলো সূচারুভাবে করে যাচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে পরিবার কে পাশকাটিয়ে এসব সম্পর্ক মুড়ির টিনের মতো এতই দুর্বল যে বাতাসে উড়ে যেতে বেশী সময় নিচ্ছে না। এইভাবে ছেলে-মেয়েরা এক বা একাধিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে এদেশের আদর্শিক পরিবার সৃষ্টির প্রধান অন্তরায় হয়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে বিবাহ পরবর্তী জীবনে দাম্পত্যসঙ্গীতে যথাযথ মর্যাদা কিংবা গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন অশান্তি। বিংশ শতাব্দীর পূর্বে বিবাহিত নারীদের শেষ আশ্রয়স্থল ছিলো স্বামীর ঘর সংসার। তখন পুরুষ সমাজ অযাচিত ভাবে নারীদের প্রতি হস্তক্ষেপ করলেও তারা তা মুখ বুঝে সহ্য করত। কিন্তু এখন সময় পাল্টিয়েছে। বিশেষত একুশ শতাব্দীতে এসে বিশেষ করে নারীরা যখন উচ্চ শিক্ষার পাশাপাশি নারী স্বাধীনতার তথা কথিত অধিকার পেলো তখন তারা কোন বাঁধা বিপত্তি ও অন্যায় মুখ বুঝে সহ্য করবে না। এখন আর স্বামী তার শেষ আশ্রয়স্থল না। সে উপার্জন করে নিজের জীবন অতিবাহিত করতে পারে। এমতাবস্থায় কেন সে পুরুষ সমাজের অন্যায় মেনে নিবে ? ফলশ্রুতিতে পান থেকে চুন খসে পড়লে স্বামীর হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে ডিভোর্স লেটার। নারীর পাশাপাশি পুরুষ আবার কম যায়না। কর্মক্ষেত্রে নারীকে পাঠিয়ে দিয়ে চোখে চোখে রাখতে চায় তার স্ত্রী কারও সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে নাতো! কারো সাথে হাসি মুখে কথা বললে তার দুর্বল অন্তর কেঁপে উঠে কয়েকশত বার। তার এই সন্দেহ প্রবণতা সৃষ্টি করে খবরদারির নতুন মাত্রা। সে অযাচিত প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে স্ত্রীকে। ত্যাক্ত-বিরক্ত স্ত্রী যদিও প্রাথমিক অবস্থায় কোন সম্পর্কে না থাকলেও স্বামীর প্রতি বিরক্ত হয়ে জড়িয়ে পড়ছে নতুন সম্পর্কের বন্ধনে। বাধ্য হয়ে এইবার স্বামী স্ত্রী কে ধরিয়ে দিচ্ছে ডিভোর্স লেটার।

দ্বন্ধ কিংবা বিশ্বাসহীনতার চোরাবালিতে বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদ। অশান্তির দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের আনাচে-কানাচে। ব্যক্তি জীবন ধাক্কা খাচ্ছে উত্তাল সাগরের ঢেউয়ের সাথে। অতপর তারা বিবাহ বর্হিভূত জীবন বেছে নিচ্ছে। ভালো বন্ধুর সংজ্ঞার আড়ালে সমাজ বিবর্জিত লিভ টুগেদারে মজে যাচ্ছে এই সমাজের বড় একটা অংশ। সমাজ হারাচ্ছে তার আদর্শিক গতিপথ, রাষ্ট্রকে আড়াল হতে হচ্ছে কালো অন্ধকারের ভয়াল ছায়ার মাঝে।

সামাজিক স্থিতিশীলতা, শান্তি-শৃঙ্খলা এবং অগ্রগতি ইত্যাদি বহুলাংশে নির্ভর করে সুস্থিত পারিবারিক বন্ধনের উপর। কোন কারণে পারিবারিক জীবনে অসুস্থ ও নড়বড়ে, ভাঙ্গন-বিপর্যয় দেখা দেয় তাহলে  সেই সমাজ জীবনে অশুভ শক্তির কালো ছায়া পতিত হয়। সেখানে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হয় নানা অশান্তি ও উপদ্রব। পরিবারের নিবিড় বন্ধন ও কল্যাণকর ভূমিকাই পারে এসব অশুভ শক্তি দূর করতে। তাই বলা যায় আদর্শ সমাজ গঠনের পূর্বশর্ত আদর্শ পরিবার গঠন। 
 
বাংলাদেশ ফিরে আসুক তার অতীত ঐতিহ্যের শিরোমণিতে। প্রত্যেক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে তার প্রাপ্য সম্মান শ্রদ্ধা ফিরিয়ে দিয়ে ভালোবাসার প্রকৃত বন্ধনে আগলে রাখুক। সমাজ-রাষ্ট্রে প্রবাহিত হউক শীতল হাওয়া। হৃদয় জাগ্রত হউক বাঙ্গালী চেতনার দীপ্ত শিখরে। আজকের বাংলাদেশে এটাই প্রত্যাশা সবার। 


পঠিত : ১৪০১ বার

মন্তব্য: ০