Alapon

ঝাড়ফুঁক-তাবীয-কবজঃ ইসলাম কী বলে?

সমাজে লক্ষ করলে দেখা যায়, আমরা অন্য অনেক কিছুর মত ঝাড়ফুঁক-তাবীয ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বেশ সীমালঙ্ঘন করে চলেছি। আবার ইদানীং কোনো কোনো মহল তাবীযকে ঢালাওভাবে শিরক বলে মুসলমানদের মাঝে এ বিষয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রয়াস চালাচ্ছে। তাই এ বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনামূলক দালীলিক আলোচনা জরুরি মনে হচ্ছে এবং সীমালঙ্ঘনগুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে। আল্লাহ্ই তাওফীকদাতা।

মূল প্রসঙ্গে প্রবেশের আগে প্রথমে ভূমিকাস্বরূপ কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা মুনাসিব মনে হচ্ছে, যেগুলোর আলোকে বিষয়টি বোঝা সহজ হবে ইনশাআল্লাহ।

এক.

আল্লাহর কাছে সবচে’ ঘৃণ্য ও জঘন্যতম পাপ হল শিরক। কুরআন মাজীদে পুত্রের প্রতি লুকমান হাকীমের ওসিয়তগুলো বিশেষ গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে তিনি নিজ পুত্রকে ওসিয়ত করে বলেন-

وَ اِذْ قَالَ لُقْمٰنُ لِابْنِهٖ وَ هُوَ یَعِظُهٗ یٰبُنَیَّ لَا تُشْرِكْ بِاللهِ  اِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِیْمٌ.

স্মরণ কর, যখন লুকমান উপদেশচ্ছলে নিজ পুত্রকে বলেছিল, বৎস! তুমি আল্লাহ্র সাথে শরীক করো না। কেননা র্শিক নিশ্চয় মারাত্মক অবিচার ও পাপ। -সূরা লুকমান (৩১)

আল্লাহ তাআলা নবীকে সতর্ক করে বলেছেন- وَ لَقَدْ اُوْحِیَ اِلَیْكَ وَ اِلَی الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِكَ  لَىِٕنْ اَشْرَكْتَ لَیَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَ لَتَكُوْنَنَّ مِنَ الْخٰسِرِیْنَ.

নিশ্চয় আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্ববর্তীদের প্রতি এই ওহী প্রেরণ করা হয়েছে যে, যদি আপনি শিরক করেন তাহলে অবশ্যই আপনার সকল আমল বরবাদ হয়ে যাবে এবং নিশ্চিত আপনি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন। -সূরা যুমার (৩৯) : ৬৫

অন্যত্র আল্লাহ আরো বলেছেন- اِنَّهٗ مَنْ یُّشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَیْهِ الْجَنَّةَ وَ مَاْوٰىهُ النَّارُ.

আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। -সূরা মায়েদা (৫) : ৭২

আরেক আয়াতে আল্লাহ বলেছেন- اِنَّ اللهَ لَا یَغْفِرُ اَنْ یُّشْرَكَ بِهٖ وَ یَغْفِرُ مَا دُوْنَ ذٰلِكَ لِمَنْ یَّشَآءُ وَ مَنْ یُّشْرِكْ بِاللهِ فَقَدِ افْتَرٰۤی اِثْمًا عَظِیْمًا.

নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করা ক্ষমা করেন না। এ ছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। এবং যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে এক মহাপাপ করে। -সূরা নিসা (৪) : ৪৮

একজন মানুষ যত ভালো কাজই করুক কিন্তু সে যদি র্শিক করে আল্লাহ তাআলার কাছে তার কোনো কিছুরই মূল্য নেই। এজন্য কিয়ামতের দিবসে মুশরিকরা যত ভালো কাজই নিয়ে আসুক আল্লাহ তাআলা সেগুলোকে ধুলিকণা-রূপ করে দিবেন। আল্লাহ বলেন- وَ قَدِمْنَاۤ اِلٰی مَا عَمِلُوْا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنٰهُ هَبَآءً مَّنْثُوْرًا.

তারা (দুনিয়ায়) যা-কিছু আমল করেছে, আমি তার ফায়সালা করতে আসব এবং সেগুলোকে শূন্যে বিক্ষিপ্ত ধুলোবালি (-এর মত মূল্যহীন) করে দেব।  -সূরা ফুরকান (২৫)

যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, জীবন ধারণের সব উপকরণ দান করেছেন, আমাকে অগণিত নিআমত দান করেছেন; তাঁকে অস্বীকার করা বা তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরীক করা এবং অবাস্তব বিশ্বাস করা যে, তারাও তাঁর মত ক্ষমতাবান ও দাতা, এটা শুধু আল্লাহর কাছেই নয়, যে কোনো বিবেকবানের কাছেই জঘন্যতম অপরাধ।

তাই মুশরিকরা যতই ভালো কাজ করুক শিরকের কারণে আল্লাহ তাআলা তাদের কোনো ‘ভালো’ কাজই গ্রহণ করবেন না।

দুই.

শিরক দুই প্রকার: এক. শিরকে জলী, দুই. শিরকে খফী। শিরকে জলী সবচেয়ে মারাত্মক। শিরকে জলীর অনেক প্রকার রয়েছে। যেমন ইবাদত, যা একমাত্র আল্লাহ তাআলার হক, তাতে আল্লাহ ছাড়া কাউকে শরীক করা, উপায়-উপকরণের ঊর্ধ্বের বিষয়ে গাইরুল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা, উপায়-উপকরণকে উপায়-উপকরণের সৃষ্টিকর্তার মান দেওয়া, গাইরুল্লাহকে উপকার ও ক্ষতির ক্ষমতাধারী মনে করা ইত্যাদি। এ বিষয়গুলি এবং এ ধরনের আরো অনেক বিষয় শিরকে জলীর অন্তর্ভুক্ত। ‘তাকবিয়াতুল ঈমান’ গ্রন্থে দলীলসহ বিস্তারিতভাবে বিষয়গুলি আলোচনা করা হয়েছে আর সংক্ষিপ্তাকারে ‘বেহেশতী জেওর’ প্রথম খণ্ডেও আলোচনা আছে। গ্রন্থদ্বয় দেখে এ বিষয়গুলো সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করা, অতপর এগুলো থেকে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করা কর্তব্য।

তিন.

কিছু বিষয় আছে এমন, যা তাওহীদ-পরিপন্থী তো নয়, তবে তা ‘তাওয়াক্কুলে’র সর্বোচ্চ স্তর থেকে নিম্নস্তরের। এ ধরনের বিষয়গুলোকে শিরক বলা স্পষ্ট ভুল। যে বিষয়ে যতটুকু কমতি আছে তাতে ততটুকু কমতির কথাই বলা উচিত। বাড়াবাড়ি করে বিদআতকে শিরক বলে দেওয়া অথবা তাওয়াক্কুলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের পরিপন্থী বিষয়কে তাওহীদের পরিপন্থী আখ্যা দিয়ে শিরক বানিয়ে দেওয়া ঠিক নয়।

 চার.

দুআ (আল্লাহকে ডাকতে থাকা, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে যাওয়া) এবং ইস্তেআনাত (আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকা) তাওহীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা এবং অনেক বড় ঈমানী আমল। যা প্রতিটি মুমিনের কাছে সবসময় কাম্য। এই দুআ ও ইস্তেআনার একটি অংশ হল, কুরআন-হাদীসে শেখানো ঝাড়ফুঁকের দুআসমূহ। এগুলোর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করাকে তাওয়াক্কুল পরিপন্থী মনে করা মূর্খতা। কারণ, এটি তো দুআ ও ইস্তেআনার অংশ, যা ঈমান ও তাওহীদ এবং তাওয়াক্কুলের গুরুত্বপূর্ণ প্রকার। তাই এক্ষেত্রে অবহেলা করা বাস্তবেই অনেক বড় লোকসানের কারণ।

পাঁচ.

যে-ঝাড়ফুঁক ‘মা’ছূর’ নয়, কিন্তু তার উপকারিতা অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রমাণিত এবং তাতে ঈমানবিরোধী ও শরীয়তবিরোধী কোনো বিষয় নেই তা মুবাহ উপায়-উপকরণের পর্যায়ে। যেমনিভাবে অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রমাণিত উপকারী ওষুধ-পথ্য ব্যবহার করা মুবাহ, তেমনিভাবে এই ঝাড়ফুঁকও মুবাহ।

ছয়.

তাবীযের (تعويذ) হাকীকত হল, আশ্রয় প্রার্থনা করা। তাবীয ব্যবহারকারী যদি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনার নিয়তেই তাবীয ব্যবহার করে এবং তাবীযের লেখা যদি কুরআন-হাদীসেরই কোনো দুআ হয় তাহলে এই তাবীয ব্যবহার মুবাহ হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যেহেতু তাবীয ব্যবহারকারীর পক্ষ থেকে তার নিজের কোনো আমল পাওয়া যাচ্ছে না, আবার এই আশঙ্কাও থাকে যে, তাবীয ব্যবহারকারী অবচেতনভাবে দুআ ও ইস্তেআনার বদলে তাবীযের উপরই নির্ভর করে বসবে, তাই সালাফের কতক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব একে পছন্দ করেননি, কিন্তু এমন নয় যে, তারা একে না-জায়েয বলেছেন। তাইতো সালাফের একটি বড় জামাত এটি মুবাহ হওয়ার প্রবক্তা।

সাত.

কারো কারো অভ্যাস হল, আপদ-বিপদে নিজে দুআ ও ইস্তেআনাতের প্রতি গুরুত্বারোপ না করে কারো কাছ থেকে তাবীয গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হয়। জানা উচিত যে, এটি অনেক বড় মাহরূমি। আর এই দৃষ্টিভঙ্গি -কোনো সন্দেহ নেই- তাওয়াক্কুল পরিপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি, যা নিঃসন্দেহে সংশোধনযোগ্য।

মূল কাজ হতে হবে, দুআ ও ইস্তেআনার প্রতি নিজেই যত্নবান হওয়া। এই বিষয়ের মা’ছূর দুআ ও আমলগুলোর প্রতি যত্নবান হওয়া। তারপর ঝাড়ফুঁক নেওয়া হলে তাও ভালো। আর মা’ছ‚র তাবীয নিলে তাও নিষিদ্ধ নয়।

আট.

কেউ কেউ তাবীয নেওয়ার ক্ষেত্রে এত বাড়াবাড়ি করে যে, অনেক সময় বে-দ্বীন ও বে-শরা লোকদের কাছ থেকেও তাবীয নিতে যায়। স্পষ্টতই এ ধরনের লোকের তাবীযে লিখিত শব্দ-বাক্য শিরকী হওয়ার সমূহ আশঙ্কা থাকে। মহিলারা অনেক সময় পর্দার হুকুম লঙ্ঘন করে গায়রে মাহরামের সামনেও চলে যায়, যা স্পষ্ট হারাম। এই কার্যাবলি এবং এ ধরনের সকল বাড়াবাড়ি থেকে বেঁচে থাকা ফরয। 

নয়.

তাবীযে যদি কুফরী বা শিরকী কোনো কথা লেখা থাকে অথবা তাবীযের নামে যাদু করা হয় বা তাবীয প্রদানকারী/তাবীয গ্রহণকারীর কেউ -আল্লাহ মাফ করুন- তাবীযকেই সরাসরি সমস্যা সমাধানকারী এবং প্রয়োজন পূরণকারী মনে করে। তেমনি যদি তাবীযের সঙ্গে গাইরুল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে কৃত মান্নতকে জুড়ে দেওয়া হয় কিংবা অন্য কোনো শিরকী কাজ তাবীযের সাথে যুক্ত থাকে, তাহলে এই তাবীয কুফর ও শিরক হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এ থেকে যদি খালেস দিলে তওবা করে সম্পূর্ণরূপে তা পরিত্যাগ না করা হয়, তাহলে ঈমান ও ইসলামের নিআমত থেকেই মানুষ মাহরূম হয়ে যাবে।

দশ.

আমাদের এই আলোচনা কেবল মা’ছূর ও মুবাহ তাবীয সম্পর্কে। যারা বাড়াবাড়ি করে একে শিরক বলে দেয় এবং যারা التمائمشرك -এই হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা বুঝে বসে আছে, দলীলসহ তাদের খণ্ডন করাই কেবল এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য। এ প্রবন্ধকে কোনো ‘মুনকার’ তাবীয অথবা কোনো মুনকার দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থন মনে করা ভুল হবে।

 এগার.

শিরক যেমন আল্লাহর কাছে  সবচেয়ে ঘৃণিত বিষয় তেমনিভাবে তাওহীদে বিশ্বাসী কোনো মুসলিমকে মুশরিক বলা বা শিরকের অপবাদ দেয়াও আল্লাহর কাছে জঘন্য অপরাধ। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, নবীজী সাল্লাল্লাহু   আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- أَيّمَا امْرِئٍ قَالَ لِأَخِيهِ: يَا كَافِرُ، فَقَدْ بَاءَ بِهَا أَحَدُهُمَا، إِنْ كَانَ كَمَا قَالَ، وَإِلا رَجَعَتْ عَلَيْهِ.

কোনো ব্যক্তি তার অপর ভাইকে যদি বলে, ‘হে কাফের!’, তাহলে একথা এ দুজনের কোনো একজনের উপর পতিত হবেই হবে। যে ব্যক্তিকে কাফের বলা হয়েছে সে যদি  কাফের হয় তাহলে তো হলোই, অন্যথায় যে বলেছে (কথাটি) তার দিকেই ফিরে আসবে। -সহীহ মুসলিম হাদীস ৬০; সহীহ বুখারী হাদীস ৬১০৪

আরেক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে- مَنْ رَمَى مُؤْمِنًا بِكُفْرٍ فَهُوَ كَقَتْلِهِ.

কোনো ব্যক্তি কোনো মুমিনকে কুফরীর অপবাদ দিল সে যেন মুমিন ব্যক্তিটিকে হত্যাই করে ফেলল। (অর্থাৎ কুফরীর অপবাদ দেওয়াটা হত্যার সমানই অপরাধ।) -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬১০৫

তাই এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, বাড়াবাড়ির শিকার হয়ে তাওহীদে বিশ্বাসী কারো উপর কুফর বা শিরকের অপবাদ না দেওয়া।

মূল প্রসঙ্গ

এবার আসি মূল প্রসঙ্গে। ইসলামের আগমনের পূর্বে জাহিলিয়্যাতের যুগে রোগ-বালাই থেকে মুক্তির ক্ষেত্রে কয়েক ধরনের উপায় ও পন্থা অবলম্বন করা হত। তন্মধ্যে একটি হল ঔষধের মাধ্যমে চিকিৎসা। ঐ যুগে যেহেতু আল্লাহপ্রদত্ত কোনো ধর্ম তারা অনুসরণ করত না তাই তাদের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তাওহীদ-পরিপন্থী কর্ম ও চরিত্র এবং মানবতা বিবর্জিত বহু বিষয় তাদের ধর্ম বা রীতিতে পরিণত হয়েছিল। ইসলাম এসে তাদের পূর্বের সকল রীতিনীতি পর্যবেক্ষণ করে; যেগুলো তাওহীদ-পরিপন্থী সেগুলো নিষিদ্ধ করে আর যেগুলো এসব থেকে মুক্ত সেগুলোকে আপন অবস্থায় ছেড়ে দেয়।

ঔষধ-পত্রের মাধ্যমে চিকিৎসাতে যেহেতু তাওহীদ-পরিপন্থী তেমন কিছু নেই তাই ইসলাম এসে তা পূর্বের ন্যায় বহাল বা বৈধ রাখে। তবে, ইসলাম তাতে এ সংশোধনী অবশ্যই এনেছে যে, ঔষধকে সুস্থতাদানকারী  মনে করা যাবে না; বরং সুস্থতাদানকারী হলেন একমাত্র আল্লাহ আর ঔষধ মাধ্যমমাত্র। আর যারা এ চিকিৎসাকর্মে  নিজেকে নিয়োজিত করবে সে যেন পরিপূর্র্ণরূপে চিকিৎসা-জ্ঞান অর্জন করে এবং পুরো পারদর্শী হয়ে এ কাজে ব্রত হয়; আংশিক বা ভুল জ্ঞান ও অপরিপক্ক জ্ঞান নিয়ে যেন এ কাজে অগ্রসর না হয়। নিম্নে এ সংক্রান্ত কয়েকটি হাদীস পেশ করা হল :

হযরত আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কোনো ব্যক্তি যদি চিকিৎসাজ্ঞান অর্জন করা ছাড়া চিকিৎসা শুরু করে, আর তার চিকিৎসায় কেউ মারা যায় বা ক্ষতিগ্রস্থ হয় তাহলে এর দায় ঐ ব্যক্তির উপরই বর্তাবে (তার ক্ষতিপূরণ তাকেই বহন করতে হবে)। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৫৭৭

হযরত যায়েদ ইবনে আসলাম থেকে বর্ণিত, নবীজীর যুগে এক ব্যক্তির শরীর যখম হয় এবং ফুলে রক্ত-পুঁজ জমে যায় তখন লোকটি বনী আনমারের চিকিৎসক দুই ভাইকে ডাকলেন। নবীজী তাদের উভয়জনকে দেখে বললেন, চিকিৎসায় তোমাদের মধ্যে কে বেশি পারদর্শী? তারা দুজনে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! চিকিৎসাকর্ম কি ভালো? তখন নবীজী বললেন, যিনি রোগ নাযিল করেছেন তিনি চিকিৎসাও নাযিল করেছেন। -মুয়াত্তা মালেক, হাদীস ১৭৫৭

হযরত সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. বলেন, আমি একদা অসুস্থ হই, তখন নবীজী আমাকে দেখতে আসেন এবং তাঁর হাত আমার বক্ষে রাখেন। আমি তাঁর হাতের শীতলতা আমার কলিজা পর্যন্ত অনুভব করি। তখন নবীজী  আমাকে বললেন, তুমি হৃদরোগী, তুমি হারেস ইবনে কালদার কাছে যাও, সে চিকিৎসক। সে যেন সাতটি আজওয়া খেজুর নেয় এবং তা বিচিসহ চূর্ণ করে, অতপর যেন তোমাকে পান করায়। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৭১

হযরত আবুদ দারদা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ রোগও নাযিল করেছেন এবং তার নিরাময়কও। আর তিনি প্রত্যেক রোগের জন্য নিরাময়কও রেখেছেন তাই তোমরা চিকিৎসা কর,  তবে হারাম বস্তু দিয়ে চিকিৎসা করো না। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৭০

হাদীস ও আসারের কিতাবে এ বিষয়ে বহু হাদীস, সাহাবা-সালাফের উক্তি ও নির্দেশনা রয়েছে। এখানে মাত্র কয়েকটি উল্লেখ করা হল।

ঝাড়ফুঁক

রোগ-বালাই নিরাময়ে জাহেলিয়্যাতের যুগে যেসব উপায় অবলম্বন করা হত তন্মধ্যে আরেকটি হল ঝাড়ফুঁক অর্থাৎ কিছু পড়ে রোগীর গায়ে দম করা। এ ঝাড়ফুঁকের প্রচলন সে যুগে বেশি ছিল। এমনকি অনেক রোগের জন্য বিশেষ বিশেষ মন্ত্রও ছিল, যা পড়ে এ রোগের রোগীকে দম করা হত। সাপে কাটলে এক মন্ত্র, জ্বরের জন্য আরেক মন্ত্র, বদ নজরের জন্য এক মন্ত্র, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক স্থাপনে আরেক মন্ত্র ইত্যাদি। এ ঝাড়ফুঁককে আরবীতে বলা হয় الرقية (আররুকইয়া)। বলাবাহুল্য, জাহিলিয়্যাতের যুগে এসব তন্ত্র-মন্ত্রের অধিকাংশই ছিল কুফর আর শিরক সম্বলিত। আর ইসলামের প্রধান ভিত্তি হল তাওহীদ। তাই ইসলাম এসেই কোনো প্রকার শর্র্ত ছাড়াই এ ধরনের সকল ঝাড়ফুঁককে নিষিদ্ধ করে দেয়। নবীজী তখন ঘোষণা করেন- إِنّ الرّقَى، وَالتّمَائِمَ، وَالتِّوَلَةَ شِرْكٌ.

নিশ্চয় ঝাড়ফুঁক, তামীমা (পাথরবিশেষ) ও তিওয়ালা (স্বামীকে আকৃষ্ট করার মন্ত্রবিশেষ) শিরক । -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৭৯

এবং ঝাড়ফুঁকের ব্যাপারে কঠোরভাবে শর্ত করে দিলেন যে, তাতে কোনো শিরকী-কুফরী শব্দ বা বিষয় থাকতে পারবে না। এ ধরনের শিরকমুক্ত ঝাড়ফুঁক হলে নবীজী তার অনুমোদন তো দিয়েছেনই সাথে সাথে যারা এসব ঝাড়ফুঁক জানে তাদের তা চালিয়ে নিতে এবং অন্যকে শেখাতেও বলেছেন। আর স্বয়ং নবীজীও ঝাড়ফুঁককারীদের মন্ত্রগুলো শুনতেন এবং দেখতেন তাতে কোনো কুফরী কথা আছে কি না, থাকলে তা নিষিদ্ধ করে দিতেন আর না থাকলে তার অনুমোদন দিতেন।

হযরত আউফ ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা জাহিলিয়্যাতের যুগে ঝাড়ফুঁক করতাম। আমরা নবীজীকে বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি বিষয়টি কেমন মনে করেন? তখন নবীজী বললেন- اعْرِضُوا عَلَيّ رُقَاكُمْ لَا بَأْسَ بِالرّقَى مَا لَمْ تَكُنْ شِرْكًا.

তোমরা ঝাড়ফুঁকে কী বল তা আমাকে শোনাও। যতক্ষণ পর্যন্ত ঝাড়ফুঁক শিরকমুক্ত হবে তাতে কোনো অসুবিধা নেই। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৮৬

হযরত জাবের রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসমা বিনতে উমাইস রা.-কে বললেন-       

مَا شَأْنُ أَجْسَامِ بَنِي أَخِي ضَارِعَة أَتُصِيبُهُمْ حَاجَةٌ قَالَتْ لَا وَلَكِنْ تُسْرِعُ إِلَيْهِمْ الْعَيْنُ أَفَنَرْقِيهِمْ قَالَ وَبِمَاذَا فَعَرَضَتْ عَلَيْهِ فَقَالَ ارْقِيهِمْ.

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন আসমা বিনতে উমাইস রা.-কে বললেন, (আসমা নবীজীর চাচাতো ভাই ও প্রসিদ্ধ সাহাবী জাফর তাইয়ার রা.-এর সহধর্মিণী) আমার ভ্রাতুষ্পুত্রদের কী হল, তারা সকলে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তারা কি অভাবে রয়েছে? আসমা বললেন, না, তবে তাদের প্রতি বদ নযর বেশি লাগে; আমরা এর জন্য কি ঝাড়ফুঁক করব? নবীজী বললেন, কী পড়ে তোমরা বদ নযরের জন্য ঝাড়ফুঁক কর- তা আমাকে শোনাও। তখন আসমা রা. তা পড়ে শোনালেন। তখন নবীজী বললেন, অসুবিধা নেই এ দিয়ে ঝাড়ফুঁক কর। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৪৫৭৩

হযরত উবাদা ইবনে সামেত রা. বলেন- كنت أرقي من حمة العين في الجاهلية فلما أسلمت ذكرتها لرسول الله صلى الله عليه و سلم فقال : " اعرضها علي " فعرضتها عليه فقال : "ارق بها فلا بأس بها" . ولولا ذلك ما رقيت بها إنسانا أبدا. (رواه الطبراني وإسناده حسن)

আমি জাহিলিয়্যাতের যুগে বদ নযরের   ঝাড়ফুঁক করতাম। যখন ইসলাম গ্রহণ করি তখন নবীজীকে বিষয়টি বলি, নবীজী বললেন, তুমি যা বলে ঝাড়ফুঁক কর তা আমাকে শোনাও। আমি তাঁকে শোনালাম। তখন নবীজী বললেন- ارق بها، ليس بها بأس.

অসুবিধা নেই এ দিয়ে ঝাড়ফুঁক করতে পার ।

আল্লাহর কসম, নবীজী আমাকে অনুমতি না দিলে আমি কোনো এক লোককেও ঝাড়ফুঁক করতাম না। -মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ৮৪৪৪ (তবারানীর বরাতে। হায়ছামী বলেছেন, এর সনদ হাসান।)

হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- كَانَ خَالِي يَرْقِي مِنَ الْعَقْرَبِ، فَلَمّا نَهَى رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ عَنِ الرّقَى، أَتَاهُ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ، إِنّكَ نَهَيْتَ عَنِ الرّقَى، وَإِنِّي أَرْقِي مِنَ الْعَقْرَبِ، فَقَالَ: " مَنْ اسْتَطَاعَ أَنْ يَنْفَعَ أَخَاهُ فَلْيَفْعَلْ ".

 আমার মামা বিচ্ছুর দংশনের ঝাড়ফুঁক করতেন। যখন নবীজী ঝাড়ফুঁক নিষিদ্ধ করেন তখন তিনি নবীজীকে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি ঝাড়ফুঁক থেকে নিষেধ করেন, আমি তো বিচ্ছু কাটার ঝাড়ফুঁক করি। নবীজী বললেন কেউ তার ভাইয়ের উপকার করতে পারলে সে যেন তা করে। -মুসনাদে আহমাদ ৩/৩০২, হাদীস ১৪২৩১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৯৯

আমর ইবনে হাযম-এর পুরো পরিবার ঝাড়ফুঁক করত। নবীজী যখন ঝাড়ফুঁক নিষেধ করেন তখন আমর ইবনে হায্ম-এর পরিবার নবীজীর কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি ঝাড়ফুঁক নিষেধ করেছেন, আমরা বিচ্ছুর দংশনের ঝাড়ফুঁক করি; এই বলে তারা তাদের পঠিত কথাগুলো পড়ে শোনায়। তখন নবীজী বললেন, কেউ তার ভাইয়ের উপকার করতে পারলে সে যেন তা করে। -মুসনাদে আহমাদ ৩/৩০২, হাদীস ১৪৩৮২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৯৯

যেহেতু হযরত জাবেরের মামা এবং  এই আনসারী সাহাবীর ঝাড়ফুঁকে পঠিত কথাগুলোতে শিরক ছিল না তাই নবীজী তাদেরকে এমন বলেছেন।

হযরত আয়েশা রা. বলেন- رخص رسول الله صلى الله عليه و سلم لأهل بيت من الأنصار في الرقية من كل ذي حمة.

নবীজী আনসারী এক পরিবারকে বিষাক্ত প্রাণীর ঝাড়ফুঁকের অনুমতি দিয়েছেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৯৩

অর্থাৎ তাদের পরিবার এ ঝাড়ফুঁক করত।

হযরত আয়েশা রা.আরো বলেন- كان رسول الله صلى الله عليه و سلم يأمرني أن أسترقي من العين.

নবীজী আমাকে বদ নযরের জন্য ঝাড়ফুঁক নিতে বলেছিলেন। (-সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৯৫) একবার উম্মে সালামার বাদীর মুখ হলদে বর্ণ হয়ে যায়, তখন নবীজী বলেন-

بها نظرة فاسترقوا لهاএর প্রতি কারো বদ নযর লেগেছে, তাই বদ নযরের ঝাড়ফুঁক করাও । -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৯৭

শিফা বিনতে আব্দুল্লাহ বলেন- دخل علي رسول الله صلى الله عليه و سلم وأنا عند حفصة فقال لي " ألا تعلمين هذه رقية النملة (النملة قروح تخرج في الجنبين ) كما علمتها الكتابة؟

একদা আমি হাফসা রা.-এর কাছে বসা ছিলাম। নবীজী ঘরে আসলেন এবং আমাকে বললেন, তুমি হাফসাকে যেভাবে লেখা শিখিয়েছ তাকে ‘নামলা’ (এক ধরনের গোটা বিশেষ)-এর ঝাড়ফুঁক  শিখিয়ে দাও। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৮৭

যেহেতু এতে পঠিত কথাগুলোতে শিরক নেই এবং এর দ্বারাও মানুষের উপকার হয়, তাই হাফসাকে তা শিখিয়ে দিতে বললেন।

সাহাবী উমায়ের বলেন- عرضت على النبي صلى الله عليه و سلم رقية كنت أرقي بها من الجنون فأمرني ببعضها ونهاني عن بعضها وكنت أرقي بالذي أمرني به رسول الله صلى الله عليه و سلم.

আমি উন্মাদের ঝাড়ফুঁক করতাম। নবীজীকে আমার পঠিত কথাগুলো শোনালাম। তখন নবীজী কিছু বাক্যের অনুমোদন দিলেন (অর্থাৎ এগুলো পড়ে ঝাড়ফুঁক করা যাবে) আর কিছু বাক্য থেকে নিষেধ করলেন (এগুলো পড়ে ঝাড়ফুঁক করা যাবে না)। নবীজী যেগুলোর অনুমতি দিয়েছিলেন পরবতীর্তে আমি শুধু তা দিয়েই ঝাড়ফুঁক করতাম। -শরহু মাআনিল আসার, হাদীস ৭০৪৫

কুরায়ব আলকিন্দি বলেন- أخذ بيدي علي بن الحسين، فانطلقنا إلى شيخ من قريش يقال له : ابن أبي حثمة يصلي إلى أسطوانة، فجلسنا إليه، فلما رأى عليا انصرف إليه، فقال له علي : حدثنا حديث أمك في الرقية قال : حدثتني أمي أنها كانت ترقي في الجاهلية فلما جاء الإسلام قالت : لا أرقي حتى أستأذن رسول الله صلى الله عليه و سلم فأتته فاستأذنته.

একদা আলী ইবনুল  হাসান আমাকে কুরায়শের এক বৃদ্ধ লোকের কাছে নিয়ে যান। তিনি তখন মসজিদের এক খুঁটির কাছে নামায পড়ছেন। আমরা তার কাছে গিয়ে বসলাম। আলীকে দেখার পর তিনি তার দিকে ফিরলেন, তখন আলী তাকে বললেন, আপনি আমাদেরকে ঝাড়ফুঁকের বিষয়ে আপনার আম্মার হাদীসটি শোনান। তিনি বললেন, আমার আম্মা আমাকে বলেছেন, তিনি জাহিলিয়্যাতের যুগে ঝাড়ফুঁক করতেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি বললেন, আমি নবীজী  থেকে অনুমতি নেওয়া ব্যতীত আর কোনো ঝাড়ফুঁক করব না। তাই তিনি নবীজীর কাছে আসলেন, এবং বিষয়টি বললেন। তখন নবীজী উত্তরে বললেন- ارقي ما لم يكن فيها شرك.

শিরক-কুফর ব্যতীত অন্য সবকিছু  দিয়ে ঝাড়ফুঁক করতে থাক। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৬০৯২

ইমাম ইবনে হিব্বান রাহ. এই হাদীসের শিরোনাম দেন- ذِكْرُ الْخَبَرِ الدّالِّ عَلَى أَنّ الرّقَى الْمَنْهِيّ عَنْهَا إِنّمَا هِيَ الرّقَى الّتِي يُخَالِطُهَا الشِّرْكُ بِاللهِ جَلّ وَعَلَا دُونَ الرّقَى الّتِي لَا يَشُوبُهَا شِرْكٌ.

পঠিত : ৮২৬ বার

মন্তব্য: ০