Alapon

পয়গামে মুহাম্মাদীর উদ্দেশ্য হিসেবে আখলাক

        মূলঃ   প্রফেসর ডঃ মেহমেদ গরমেজ

আমি আমার জীবনের শুরু থেকে নিয়ে শিক্ষকতা সহ
রাষ্ট্রীয় দায়িত্ত্বপালন কালে আমাদের দেশ এবং মুসলিম উম্মাহর অবস্থাকে সবসময় খুব
কাছ থেকে পর্যবেক্ষন করার চেষ্টা করেছি। আমার এই পর্যবেক্ষণে যে বিষয়টি ধরা পড়েছে
তা হল মুসলিম উম্মাহ হিসেবে আজ আমরা অনেক সমস্যার সম্মুখীন।




 এই সকল
বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয় হল ইসলামকে বুঝা। ইসলামের বোধগম্যতার
ক্ষেত্রে কোন সমস্যা নেই। ইসলাম বোধগম্য কিন্তু আমাদের বুঝার ক্ষেত্রে সমস্যা
রয়েছে। এই ক্ষেত্রে আমি আজকে আখলাক নিয়ে আলোচনা করতে চাই।




আজ আমরা দুইটি গুরুত্ত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন।




১। সমগ্র উম্মাহ হিসেবে আজ আমরা ‘উসূল’ বা মেথডোলজির সমস্যার
সম্মুখীন। উসূল বলতে আমি কেবলমাত্র কুরআন এবং সুন্নাহকে বুঝার উসূলকে বুঝাচ্ছি না।
উসূল বলতে আমি সমগ্র দ্বীনকে সঠিক ভাবে বুঝার কথা বলছি। এবং এর মধ্যে আখলাক এর
অবস্থান এবং এর গুরত্ত্ব সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।




 




২) আজ সমগ্র মানবতা এক ভয়াবহ সমস্যার সম্মুখীন। এই
সকল সংকট একই সাথে এক আখলাকী সমস্যার জন্ম দিয়েছে। মানুষের পারস্পারিক সম্পর্কের
ক্ষেত্রে, পারিপারিক ও সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের
ক্ষেত্রে আজ আমরা অনেক বড় সমস্যার সম্মুখীন। আমরা আজ সকলেই একথার স্বাক্ষী যে,
আখলাকী দিক থেকে মানবতা আজ সবচেয়ে বেশী অধঃপতনের মধ্যে নিমজ্জিত। 




এই বিষয়ের চেয়ে আরও গুরত্ত্বপূর্ণ একটি বিষয় হল, আজ
আমরা মূল্যবোধের সংকটের মধ্যে নিমজ্জিত। আমরা শুধুমাত্র সম্পর্ককেই হারিয়ে ফেলিনি,
একই সাথে যে সকল মূল্যবোধ, আচার-আচরণকে আখলাকে পরিণত করে আমরা সে সকল বিষয়কে
হারিয়ে ফেলেছি
মুসলিম উম্মাহ হিসেবে আমাদের
দায়িত্ত্ব ছিল সমগ্র মানবতাকে আখলাকের শিক্ষা দেওয়া।




আজকের এই বিশ্বায়নের যুগে আখলাকের ৩ টি উৎস আমাদের
সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।




১। শক্তি,




২। কামনা-বাসনা,




৩। স্বার্থ।




 




এই সকল বিষয়ের মূল ভিত্তি সমূহ আমাদের সকলের কাছেই
সুস্পষ্ট। গ্রীক সভ্যতায়, রোমান সভ্যতায় এবং এনলাইটেনমেন্ট দর্শনে  (
Enlightenment Philosophy) একে অপরকে প্রতিপালিত কারী এই তিনটি ধারণা বা তাদের ভাষায় নৈতিক
মূল্যবোধ সবসময় সামনে এসেছে। শক্তি, স্বার্থ এবং কামনা এই তিনটি হল তাদের সভ্যতার
মূলভিত্তি। তাদের সকল কিছুই এই তিনটির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।




দুঃখ জনক হলেও সত্য এই তিনটি বিষয় অর্থাৎ শক্তি, কামনা
এবং স্বার্থ আজ মুসলমানদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ মুসলমানদের দায়িত্ত্ব ছিল
তাদেরকে আখলাকের মৌলিক মূল্যবোধসমূহ শিক্ষা দেওয়া। এই তিনটি বিষয় (শক্তি, স্বার্থ
এবং কামনা) মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় না। মুসলিম দার্শনিকগণ এই ‘কামনা-বাসনা’ না
সাদাতে দারাইন অর্থাৎ উভয় জগতে সুখ-শান্তি নামে নামকরণ করেন। কিন্তু আধুনিক সময়ে
এসে কামনা- বাসনা (
Pleasure, Enjoyment) পুনরায় সাদেত
(সুখ-শান্তি) র স্থান দখল করেছে। ‘শক্তি
,ক্ষমতা এবং আখলাক’
এদের মধ্যেকার সম্পর্ক এবং ব্যক্তিস্বার্থকে সামাজিক স্বার্থের উপরে স্থান দেওয়া
আজ আমাদের জন্য অনেক বড় একটি চ্যালেঞ্জ।




মৌলিক আখলাককে হারিয়ে ফেলার চেয়েও বড় বিষয় হল, যে সকল
মূল্যবোধ আচার- আচরণকে আখলাকে পরিণত করে সেসকল মূল্যবোধকে হারিয়ে ফেলা, মিয়ি’য়ার (
معيار) কে হারিয়ে ফেলা, মিযানকে হারিয়ে ফেলাকোন ধরণের আচরন আখলাকী এবং কোনটি
আখলাকী নয় সেটা হারিয়ে ফেলা। এই বিষয়টিও উসূলের সাথে সম্পৃক্ত একটি বিষয়। এর একটি
অংশ হিসেবে আমরা মূল্যবোধের ক্রমধারা (
Hierarchy of Values)  কে হারিয়ে ফেলেছি। যে সকল মূল্যবোধ,
আচার-আচারণকে আখলাকে পরিণত করে কেবলমাত্র সেই সকল বিষয়কে শনাক্ত করাটাই যথেষ্ট নয়।
একই সাথে সবসময় মূল্যবোধের ক্রমধারা (
Hierarchy of Values) কে
সঠিকভাবে শনাক্ত করাও অতীব গুরত্ত্বপূর্ণ।




যদি তা না করা যায় তাহলে, যে মু’মিন মূল্যবোধের
ক্রমধারা (
Hierarchy of Values) কে হারিয়ে ফেলেছে তার কাছে
হাজারে আসওয়াদকে চুম্বন করা হাজারো মুসলমানকে কষ্ট দেওয়ার চেয়ে শ্রেয়।




 যে মু’মিন মূল্যবোধের
ক্রমধারা (
Hierarchy of Values) কে হারিয়ে ফেলেছে, সে দুই
রাকাত তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করার জন্য শত শত মানুষকে কষ্ট দেওয়াটাকেও স্বাভাবিক
মনে করবে। 




মূল্যবোধের ক্রমধারা (Hierarchy of Values) কে হারানো একটি উম্মাহ, আরাফাতে ইহরাম অবস্থায় থাকার সময় একটি মশা-মাছি ও
যেন না মরে এই জন্য সতর্ক অবস্থায় থাকবে কিন্তু ফেরার সময় শয়তানকে পাথর মারতে
যাওয়ার সময় শত শত মানুষকে মাড়িয়ে যেতেও দ্বিধা করবে না।




মূল্যবোধের ক্রমধারা (Hierarchy of Values) কে হারানো একজন মু’মিন একটি নফল ইবাদতের জন্য অন্য মানুষকে কষ্ট দিতেও
দ্বিধা করবে না।




এই জন্য, মানুষের সাথে সম্পর্ক এবং  আখলাক যতটা গুরুত্ত্বপূর্ণ, মূল্যবোধের ক্রমধারা
(
Hierarchy
of Values) কেও শনাক্ত করা ততটাই গুরত্ত্বপূর্ণ।




আচরণকে আখলাকে পরিণতকারী মূল্যবোধ সমূহকে শনাক্ত করা
যতটা গুরত্ত্বপূর্ণ (যদিও এটা উসূলের বিষয়), মূল্যবোধের ক্রমধারা (
Hierarchy
of Values) কেও শনাক্ত করা ততটাই গুরত্ত্বপূর্ণ।




শুধুমাত্র মূল্যবোধের ক্রমধারা (Hierarchy
of Values) নয়, এর চেয়েও বড় ভুল এবং বিপদজনক বিষয় হল, মূল্যবোধ
সমূহের স্থান পরিবর্তন!




-খারাপ কে ভালো, আর ভালোকে খারাপ বলে আখ্যায়িত করা।




- সুন্দর এবং অসুন্দরের মধ্যে স্থানের পরিবর্তন।




-উপকারি এবং অপকারীর মধ্যে স্থানের পরিবর্তন




-হক্ব এবং বাতিলের মধ্যকার স্থান পরিবর্তন।




 




অবক্ষয়কে দ্বীনের সাথে সম্পৃক্ত করণ। আমাদের গাইরে
আখলাকী ভুল কাজ সমূহকে জায়েজ করার জন্য দ্বীনের মধ্যে রেফারেন্স খোঁজার চেষ্টা
করা। গাইরে আখলাকী বিষয়কে ধর্মীয়করণ করা। আমাদেরকে আখলাকে হামিদিয়া শিক্ষা দেওয়ার
জন্য যে দ্বীন এসেছে সে দ্বীনকে আমরা আমাদের গাইরে আখলাকী আচরণের সাথে সম্পৃক্ত
করার চেষ্টা করছি।




ফিকহের আখলাককে আমরা হারিয়ে আজ বাহ্যিক মাসআলা
মাসায়েল নিয়ে ব্যতি ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। ইবাদতের উদ্দেশ্যকে ভুলে গিয়ে কিছু বাহ্যিক
আচার আচরণের মধ্যে আজ আমরা নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রেখেছি। ইবাদত সমূহকে
শুধুমাত্র বাহ্যিক কিছু আচার আচরণের মধ্যে নামিয়ে নিয়ে আসা একজন মুসলমানের জন্য
এবং মুসলিম সমাজের জন্য সবচেয়ে বড় মুসিবত সমূহের মধ্যে একটি।




ইসলামকে বুঝার ক্ষেত্রে আমারা যে উসূল নির্ধারণ করেছি
সে উসূলে আমরা আখলাকের কোন স্থান দেইনি।




 




প্রিয় ভাইয়েরা আমার,




মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার রাসূলকে কেন এই
পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন এটাকে তিনি পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন। মহান আল্লাহ
রাব্বুল আলামিন তার রাসূলকে পাঠিয়েছেন; সমগ্র মানবতার জন্য হক্ব ও আদালত প্রতিষ্ঠা
করার জন্য এবং তাওহীদের বানীকে সমগ্র দুনিয়াতে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। এটাকে পয়গামে
(রিসালাতে) মুহাম্মদীর উদ্দেশ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।




রাসূল তার আগমের উদ্দেশ্যকে নিজে বর্ণনা করেছেন। তার
সেই বর্ণনা আমরা হাদীস শরীফের মাধ্যমে জানতে পারি। এই সকল হাদীস সমূহের মধ্যে
চারটি হাদীসকে যদি আমরা হাইলাইট করি তখন দেখতে পাই যে, এর মধ্যে একটি হল,




 بعثت بالحنيفية السمحة




 




অর্থাৎঃ ফিতরাতের সাথে সবচেয়ে সঙ্গতিপূর্ণ তাওহীদের
এই দ্বীনকে সমগ্র পৃথিবীতে প্রচার করার জন্য প্রেরিত হয়েছি।




এই সকল হাদীসের মধ্যে একটি হল,




بعثت رحمة




আমি রহ্মত হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।




পবিত্র কোরআনেও মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার
রাসূলকে প্রেরণের উদ্দেশ্য হিসেবে বলেছেন,




وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ




অর্থাৎঃ  হে
মুহাম্মাদ! আমি যে তোমাকে পাঠিয়েছি
, এটা আসলে
দুনিয়াবাসীদের জন্য আমার রহমত৷




আমাদের আজকের এই আলোচনার ‘শিরোনাম’ ঠিক করার ক্ষেত্রে
আমরা যে হাদীসের সাহায্য নিয়েছি সে হাদীসটি হল,




إنما بعثت لأتمم مكارم الأخلاق))  




অর্থাৎঃ আমি আর অন্য কোন কারণে নয়, শুধুমাত্র
মাকারীমে আখলাককে পরিপূর্ণ করার জন্য প্রেরিত হয়েছি।




রিসালাতে মুহামদ্দীর উদ্দেশ্য সম্পর্কিত সকল আয়াত এবং
হাদীসকে আমরা একত্রিত করলে দেখতে পাই যে, রাসূলে আকরাম (সঃ) কে দুনিয়াতে প্রেরণের
চারটি গুরুত্ত্বপূর্ণ হিকমত রয়েছে।




১। তাওহীদ,




২। আদালত




৩।  আখলাক




৪। রহমত




আমার আজকের এই আলোচনায় শুধুমাত্র আমি আখলাকের উপর আলোকপাত
করার চেষ্টা করব। কিন্তু আমাদের আখলাক, রহমত থেকে আলাদা নয়। আমাদের আখলাক তাওহীদ
থেকে আলাদা নয়। আমাদের আখলাক আদালত থেকেও ভিন্ন নয়।




দ্বীন ইসলামকে ঈমান, ইবাদত, আখলাক এবং মুয়ামালাতে
বিভক্ত করা কতটুকু সঠিক হয়েছে বা ভুল হয়েছে তা নিয়ে আমাদের নতুন করে চিন্তা-ভাবনা
করা প্রয়োজন।  




‘আখলাক’ শব্দটি শব্দগত দিক থেকে, মানুষের ‘সমগ্র আধ্যাত্মিক
অস্তিত্ব’ কে বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত একটি পরিভাষা। মানুষের ‘বস্তুগত’ বা ‘দৈহিক’
অস্তিত্বকে ‘খালক’ বলে থাকি। আর মানুষের সকল আধ্যাত্মিক অস্তিত্বকে ‘খুলক’ বলে
থাকি।




আখলাকের মাসদার খুলক শুধুমাত্র আচার আচরণ অর্থে নয়।
‘আদব’ নামক পরিভাষার চেয়ে এটা ভিন্ন। ইংরেজিতে
Morality and Ethics এর মধ্যে যেমন পার্থক্য রয়েছে তেমনিভাবে আদব এবং খুলকের মধ্যেও পার্থক্য
রয়েছে। ‘আদব’ খুলকের একটি শাখামাত্র। ‘আদব’ কেবলমাত্র ‘আখলাক’ এর আচার-আচরণকে
বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত একটি শব্দ। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে ‘খুলক’ শব্দের দ্বারা
মানুষের আধ্যাত্মিক অস্তিত্ব বুঝানো হয়ে থাকে। মানুষের আধ্যাত্মিক এবং বস্তুগত
অস্তিত্বের মধ্যে একটি সম্পর্ক রয়েছে। মানুষ কেবলমাত্র বস্তুগত অস্তিত্বের দিক
থেকে বেঁচে থাকতে পারে না, একই সাথে তাকে আধ্যাত্মিক অস্তিত্বের দিক থেকেই বেঁচে
থাকতে হয়।   




 




إنما بعثت لأتمم مكارم الأخلاق))  




 এই হাদীসটিকে
আগে আমি এই ভাবে বুঝতাম, হযরতে আদম থেকে শুরু করে ইসলাম নামক একটি প্রসাদ রয়েছে,
একই সাথে একটি আখলাক রয়েছে। নবীদের সাথে সাথে আখলাক পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। আমিও
সেই নবীদের মধ্যে সর্বশেষ নবী হিসেবে এই আখলাককে পরিপূর্ণতা দানের জন্য এসেছি।




কোন কোন আলেমগণ এই হাদীসটিকে এইভাবে ব্যখা করেছেন
আমিও এই রকমই ভাবতাম। কিন্তু পরে যখন এটা নিয়ে চিন্তা গবেষণা করলাম তখন দেখতে
পেলাম যে, এর অর্থ দাঁড়ায়ঃ মানুষ ফিতরাতগত (সৃষ্টিগত দিক থেকে) ভাবে আখলাকী একটি
সৃষ্টি। অর্থাৎ মানুষ সৃষ্টিগত দিক থেকে আখলাকের অধিকারী। মানুষের ফিতরাতের
মধ্যকার এই আখলাককে পরিপূর্ণতা দান করার জন্য আমি এসেছি। প্রতিটি মানুষের ফিতরাতের
মধ্যেই আখলাক রয়েছে। মানুষ জন্মগতভাবে যেমন খালকের অধিকারী, তেমনি ভাবে মানুষ
জন্মগতভাবে খুলকেরও অধিকারী। রাসূল (সঃ) এর এই হাদীসের মূল কথা হল, সকল মানুষের
মধ্যে যে আখলাক রয়েছে সে আখলাককে পরিপূর্ণ করার জন্য আমি এসেছি। তবে এটা কেবলমাত্র
ইসলামের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা পেতে পারে, রিসালাতে মুহাম্মদীর মাধ্যমে পরিপূর্ণতা
পেতে পারে।  




রাসূলে আকরাম (সঃ) এর একটি আয়না দোয়া রয়েছে। আয়না
দেখার সময় তিনি এই দোয়া পড়তেন । দোয়াটি হল,




 اللَّهُمَّ أَحْسَنْتَ
خَلْقِي فَأَحْسِنْ خُلُقِي




অর্থাৎ, হে
আল্লাহ তুমি আমার বাহ্যিক অবয়বকে যেমভাবে সুন্দর করেছ তেমনি ভাবে তুমি আমার
আখলাকেও সুন্দর করে দাও।




তুমি আমার
বস্তুগত অস্তিত্ব (বাহ্যিক) কে যেমন ভাবে সুন্দর করেছ আমাদের আধ্যাত্মিক
অস্তিত্বকেও সুন্দর করে দাও।  আখলাককে এই
ভাবে সামগ্রিকভাবে দেখার প্রয়োজন।




 




এই আখলাককে যখন আমরা সামগ্রিকভাবে দেখার পর, যখন আমরা
উলুমে ইসলামিয়ার শ্রেনীবিন্যাসের দিকে তাকাই, তখন আমরা রিসালাতে মুহাম্মদীর
উদ্দেশ্য হিসেবে আখলাককে আমরা দেখতে পাই না। আখলাককে আমরা উসূলের মধ্যে খুঁজে পাই
না। ইতিকাদীর বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত করে আমরা আখলাককে পড়ি না।




আল্লাহ এবং মানুষের মধ্যে যে সম্পর্ক এর আখলাকী
দৃষ্টিকোনকে আমরা গুরত্ত্ব দেই না। মুয়ামালাতের যে ফিকহ রয়েছে সেখানেও আমরা
আখলাককে খুঁজে পাই না। খুঁজে পেলেও দেখতে পাই যে, আখলাককে এক কিনারায় রেখে দেওয়া
হয়েছে। ফিকহের মৌলিক বিষয় হিসেবে আমরা আখলাককে পাঠ করি না। উসূলের উদ্দেশ্যে
হিসেবে আমরা আখলাককে পাঠ করি না।




ইবাদতের উদ্দেশ্য যে আখলাক এটা উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে
আমরা সবসময় দুর্বলতার পরিচয় দিয়ে থাকি।




এই জন্য আমি আখলাককে কেবলমাত্র একটি আখলাকী বিষয়
হিসেবে নয়, ইসলামকে বুঝার ক্ষেত্রে আমাদের যে উসূল রয়েছে সেটার মধ্যে এটাকেও
সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।




কেন আমি এই কথা বলছি? এই কথা বলার কারণ হল, যখন আমি
সমগ্র মুসলিম উম্মাহর মধ্যকার পারস্পারিক সম্পর্কের দিকে তাকাই তখন দেখতে পাই
যে,  তাদের পরিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে,
রাস্তা-ঘাটে এবং হাট-বাজারে ‘আখলাক’ নামক বিষয়টি দ্বীনদার শব্দের মধ্যে যেন হারিয়ে
গেছে। দ্বীনদারীর মধ্যে আখলাককে খুঁজে পাওয়া খুব কষ্টকর হয়ে যায়।




আমাদের দ্বীনদারিত্ত্ব কেন আখলাকের জন্ম দিচ্ছে না?
দ্বীনদার মানুষরা কেন আজ আখলাকী একটি জীবন যাপন করতে পারছে না?




যুবকরা সব সময় আমাদেরকে যে প্রশ্নটি করে থাকে তা হল,
কেন মুসলমানগণ অনুকরণীয় মানুষ হতে পারে না?




গভীর রাতে উঠে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় কারী মানুষটির
মধ্যে কেন আমরা তার প্রতিবেশীর সাথে, তার স্ত্রী ও সন্তানসন্তুতির সাথে আচার আচরণে
এবং তার ব্যবসা বাণিজ্যে আখলাকে হামিদার (প্রশংসিত চরিত্র) কোন নিদর্শন দেখতে পাই
না।




মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে তাকওয়া শব্দটি দুইশত বারের বেশী
উল্লেখিত হয়েছে। এই ২০০ স্থানে উল্লেখিত ‘তাকওয়া’ পরিভাষাটির আগে ও পরে যদি আমরা
ভালো করে তাকিয়ে দেখি তাহলে দেখতে পাই যে, শতকরা ৯০ ভাগই হল আখলাক সম্পর্কিত




কিন্তু আমরা ‘তাকওয়ার’ সংজ্ঞা দেওয়ার সময় এইভাবে দিয়ে
থাকি, ‘অমুক ভাই আওয়াবিনের নামাজ কখনোই পরিত্যাগ করেন না। তিনি কতই না মুত্তাকী
একজন মানুষ’। এই ধরণের কথা আমরা অনেক শুনে থাকি।  




দয়া করে কেউ আমাকে ভুল বুঝবেন না। নফল ইবাদত সমূহকে
একজন মু’মিন কখনোই ছোট করে দেখতে পারে না। এমন ভুল একজন মুমিন করতে পারে না।
নৈশকালীন এবং যে কোন ধরণের সুন্নতকে পালন করার ক্ষেত্রে একজন মু’মিন কখনই সেটাকে
ছোট করে দেখতে পারে না। এই সকল ইবাদতের গুরুত্ত্ব অনেক।




কিন্তু কেউ একথা বলে না যে, ‘ অমুক ব্যক্তি তার
প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকা অবস্থায় রাতে ঘুমায় না। সেই কতই না মুত্তাকি একজন
ব্যক্তি’। তাকওয়ার এই ধরণের সংজ্ঞা আমরা সাধারণত শুনি না।




‘অমুক ব্যক্তি চল্লিশ বছরের মধ্যে একবারের জন্যও তার
স্ত্রীকে কষ্ট দিয়ে কোন কথা বলেনি। সে কতই না মুত্তাকি একজন ব্যক্তি’।




‘অমুক ব্যক্তি তার প্রতিবেশীর সাথে অনেক সুন্দর আচরণ
করে, সে কতই না মুত্তাকী একজন মানুষ’। এই ধরণের সংজ্ঞা আমরা শুনি না।




কিন্তু ‘অমুক ব্যক্তি দিনে এত হাজার বার আল্লাহর
জিকির করে। সে কতই না মুত্তাকী একজন মানুষ’। ‘অমুক কখনোই তাহাজ্জুদ নামাজ পরিত্যাগ
করে না। সে কতই না মুত্তাকী একজন ব্যক্তি’। 
এই ধরণের কথা আমরা অনেক বেশী বেশী শুনে থাকি।  




তাকওয়া এবং কোরআনে উল্লেখিত তাকওয়া পরিভাষার সাথে
সম্পৃক্ত সকল শব্দের আখলাকের সাথে সম্পর্ক রয়েছে, ইতিকাদের সাথে সম্পর্ক রয়েছে
ইবাদতের সাথে সম্পর্ক রয়েছে। তবে আখলাককে ইবাদতের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করা
হয়েছে। এই কথা আমি বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে চাই।




উসূল সম্পর্কিত যত বই আছে আমি সকল বই দীর্ঘদিন ধরে
পড়ার চেষ্টা করছি। আমাদের উসূলে ‘মাকাসিদ’ নামে একটি পদ্ধতি রয়েছে। এটা শুরু করেন
ইমাম জুয়াইনি ও ইমামা গাজালি। পরবর্তীতে এই ধারণা নিয়ে আরও কাজ করেন ইজজ বিন
আব্দুস সালাম সহ আরও অনেকেই।




পরবর্তীতে আন্দালুসিয়াতে ইমাম শাতিবি তার তার
শিক্ষকদের সাথে এটাকে একটি আলাদা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। তারা ইসলামের সকল হুকুম
আহকামকে তিনভাগে বিভক্ত করেন।




১।    ضَرُورِيَّاتِ




২। حاجِيَّاتِ




৩। تحسينيات




কিন্তু তারা আখলাককে تحسينيات  এর মধ্যে স্থান দিয়েছে। এটাকে নিয়ে
আমাদের পুনরায় আলোচনা ও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।   
ضَرُورِيَّاتِ   এর
মধ্যে কি আখলাক নেই?
حاجِيَّاتِ এর মধ্যে কি আখলাক নেই?

পঠিত : ৬৮৫ বার

মন্তব্য: ০