Alapon

বাংলাদেশীদের সৌদি বিদ্বেষ পর্ব ০৭

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম 
 উপমহাদেশের কাওমী আলেমগণের সাথে সৌদী আরবের আলেমগণের অনেকাংশে মিল থাকায় "ঈদ এ মিলাদুন্নবীর" সমর্থকগণ সব সময় কাওমী মাদ্রাসার আলেমগণের বিরূদ্ধে "ওহাবী", "সৌদী দালাল", "দরবারী আলেম" ইত্যাদি অভিযোগ উত্থাপন করে আসছিলেন৷ কাওমী আলেমগণের সেসব নিয়ে তেমন কোন উচ্চবাচ্য ছিলো না৷ কিন্তু ইদানীং কাওমী আলেমগণের মাঝেেও একদল সৌদী বিদ্বেষী আলেম তৈরী হয়েছেন৷ তাদের এই বিদ্বেষের পেছনে কাজ করছে "আহলে হাদীস"৷
প্রায় গত চার বছর হজ্ব মৌসুমে ভারতীয় দূতাবাসের কিছু স্বেচ্ছাসেবক ভাইয়ের সাথে অধম একটা পার্ট টাইম জব করেছিলাম৷ এই স্বেচ্ছাসেবক ভাইদের প্রায় সবাই দেওবন্দ মাদ্রাসার সাবেক এবং বর্তমান মদীনা ইউনিভার্সিটির ছাত্র৷ ঊনাদের সাথে আলাপ করে যেটা জানলাম, সৌদী আরবে "আহলে হাদীস" বলে কোন মতবাদ নেই৷ তাহলে আমাদের দেশে "আহলে হাদীস" কিভাবে এলো?
মুসলিম ঐতিহাসিক গোলাম আহমেদ মোর্তজার মতে আঠারশ শতকে শাহ আহমেদ, সৈয়দ আহমেদ বেরেলভী, হাজী শরীয়তউল্যাহ সহ প্রমূখ যখন ইংরেজ বিরোধী জিহাদকে বেগবান করার জন্য মুসলমানগণকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করছিলেন, তখন ইংরেজরা এসব আন্দোলনের নাম দেয়, "আহলে হাদীস আন্দোলন", "ওহাবী আন্দোলন", "ফরায়েজী আন্দোলন" ইত্যাদি ৷
মুসলমানরা যাতে ঐক্যবদ্ধ না হতে পারে সে জন্য এক শ্রেণীর ইংরেজ গুপ্তচর গুজব রটায় যে এসব আন্দোলনের সাথে মূল ইসলামের কোন সম্পর্ক নাই৷ দ্বিধায় পড়ে স্বাভাবিক ভাবেই মুসলমানগণ তখন বিভক্ত হয়ে যায়( বিস্তারিত: ইতিহাসের ইতিহাস, চেপে রাখা ইতিহাস)৷ ডঃ আহমেদ শরীফ তার "বাউল তত্ত্ব" গ্রন্থে বলেন, ঊনিশ-বিশ শতকে আহলে হাদীস আন্দোলনের ফলে মুসলমান বাউলেরা অনেকে শরীয়তী ইসলামে ফিরে এসেছে৷
ইতিহাস পর্যালোচনা করে আমরা দেখতে পাচ্ছি, যে আহলে হাদীসকে নিয়ে আমরা এখন নতুন করে আলোচনা করছি প্রায় দুই, আড়াইশ বছর আগেই এটির অস্তিত্ব ছিলো৷ ইতিহাস বিমুখতার কারনে এসব আমাদের সামনে আসেনি৷ ডাঃ জাকির নায়েককে কেন্দ্র করে এই বিতর্ক আমাদের সামনে নতুন ভাবে এসেছে৷
মানুষ হিসেবে ডাঃ জাকির নায়েক ভুলের উর্ধ্বে নয়, কিন্তু দ্বীনী স্বার্থে ঊনার ভুলের আলোচনা-সমালোচনা না করে, ঊনাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা এক শ্রেণীর কাওমী আলেমগণের ওয়াজের প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ঊনাদের ওয়াজ শোনে অনেকেই ডাঃ জাকির নায়েকেকে নিয়ে সংশয়ে ছিলেন৷ সৌদী সরকার কর্তৃক "কিং ফয়সাল এ্যাওয়ার্ড" প্রদানের মাধ্যমে অনেকের সে সংশয় দূর হয়েছে৷ ফলে এতদিন যারা ঊনার নিন্দা করতেন নিজেদের রক্ষা করার তাগিদেই তারা এখন ঊনাকে আহলে হাদীস উল্লেখ করে ঊনার সাথে সাথে সৌদী আরবেরও নিন্দা করে থাকেন৷
উপমহাদেশের কাওমী আলেমগণের মাঝে আরেক দল আছে পীর পন্থী৷ পীর ফার্সী শব্দ৷ এটি বাংলা মুরুব্বী, আরবী শায়খ এর সমার্থক শব্দ৷ উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে পীরগণের অবদান অনস্বীকার্য৷ উপমহাদেশে যত পীর ছিলেন সবাই ইসলামের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে স্ব স্ব মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছেন৷ কিন্তু বর্তমানে অনেকে পীরপ্রথাকে উত্তরাধিকার সম্পত্তির মত বন্টন শুরু করেছেন৷ কিন্তু পীর প্রথাতো কোন ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় এটি ইলম বা জ্ঞানের বিষয়৷ আর জ্ঞান আল্লাহর দান, এটি কারো বেশি বা কম থাকতে পারে৷
বাইতুল্লাহ এবং মসজিদে নববীতে যদি আপনার পরিচিত কেউ কর্মরত থাকে, তাদের কাছ থেকে খোঁজ নিলে জানতে পারবেন এখানকার শায়খগণ রমজান এবং ঈদ উপলক্ষ্যে শ্রমিকদের বখশিস বা হাদিয়া প্রদান করে থাকেন৷ সৌদী আরবের শায়খগণ যখন গরীবদের দান করে নিজেদের পকেট খালি করছেন, আমাদের পীরগণ তখন গরীবদের দান গ্রহণ করে নিজেদের পকেট ভর্তি করছেন৷ কোনটি উত্তম? সেটা আমাদের বিজ্ঞ ইসলামী চিন্তাবিদগণ ভালো বলতে পারবেন৷
পীর পন্থার সাথে আবার সূফীবাদ জড়িত৷ সূফীবাদ সম্পর্কে এই সিরিজের পূর্বের লেখায় সামান্য ধারণা দিয়েছিলাম৷ সৌদী আলেমগণের মতে এটি ইসলাম বিধ্বংসী মতবাদ৷ পীর এবং সূফী পন্থী কাওমী আলেমগণ সাধারণত সৌদী আরবের প্রতি ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেন না৷ বাংলাদেশের কাওমী আলেমগণের মাঝে অনলাইনে অফলাইনে বর্তমানে আহলে হাদীস বনাম মাযহাব লড়াইটাও চোখে পড়ার মত৷
প্রতি শুক্রবার FM রেডিওতে বাইতুল্লাহ এবং মসজিদে নববীর খুতবাকে বিভিন্ন ভাষায় তর্জমা করা হয়৷ যেহেতু বাংলায় তর্জমার ব্যবস্থা এখনো করা হয়নি তাই আমাদেরকে 105.0 MHz উর্দূটাই শোনতে হয়৷ এখানকার আলেমগণ বলেন, "সিহাহ সিত্তাহ"র বাইরেও অনেক হাদীস আছে, সেগুলোতেও আমল করতে হবে৷ আবার হাদীসের নামে অনেক জাল হাদীসও আছে, সেগুলো থেকেও সাবধান থাকতে হবে৷ কোনটি সহীহ এবং কোনটি জাল সেটি নির্ভর করছে বর্ণণাকারী এবং সমর্থকদের উপর৷ ঊনারা যখন কোন হাদীস বলেন, হাদীসের বর্ণণাকারী এবং এটি সহীহ হওয়ার পক্ষে কে কে সাক্ষ্য প্রদান করেছেন তা উল্লেখ করেন৷

মাযহাব সম্পর্কে দেওবন্দ মাদ্রাসার সাবেক এবং বর্তমান মদীনা ইউনিভার্সিটির তালেব ইলম ভাইদের সাথে আলাপ করে যেটা জানলাম, তাদের মতে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) ফীকহ শাস্ত্রবিদ৷ আমরা যে চার মাযহাবের ইমামগণকে জানি তারা সবাই ফকীহ৷ এর বাইরেও অনেক ফকীহ আছেন৷ যেসব বিষয়ে ক্বোরআন এবং হাদীসের স্পষ্ট নির্দেশনা আছে সেসব বিষয়ে ফীকহ শাস্ত্রের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে না৷
কোরআন এবং হাদীসের বাইরে কোন ফতোয়া নিয়ে তারা যখন গবেষণা করেন তখন চার মাযহাবের বাইরে অন্যান্য ফকীহগণ যেমন- ইমাম বুখারী (রহঃ), হাসান বসরী (রহঃ) ইমাম গাযযালী (রহঃ), ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা (রহঃ), ইমাম নাসিরূদ্দীন আলবানী (রহঃ) এরকম বিখ্যাত ফকীহগণ কি মতামত প্রদান করেছেন এবং অধিকাংশের মতামত কি, এর মাঝে কার মতামতটা কোরআন এবং হাদীসের কাছাকাছি পর্যায়ের তা থেকে তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছান৷
আমাদের দেশে আহলে হাদীস এবং মাযহাব পন্থী যারা আছেন তারা গবেষণা করে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার চেয়ে, একদল আরেকদলকে "বিদাতি", "আহলে খবিস" এ জাতীয় কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করে বেশি আনন্দ পান৷ তাদের এসব কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি দায়ভার ঊনারা সৌদীর উপর চাপিয়ে দেন৷
আমরা সাধারণত রমজানের সাতাইশ তারিখে শবে ক্বদর পালন করি, কিন্তু এখানকার মানুষ বিশ রমজানের পর থেকেই শবে ক্বদরের তালাশে নফল ইবাদত শুরু করে৷ সোম এবং বৃহঃবার সপ্তাহে দুই দিন, মাসে আট দিন রোজা রাখে৷ প্রায় জামে মসজিদে রোজাদারদের ইফতারের ব্যবস্থা থাকে৷ ইফতারের আয়োজককে অধিকাংশ লোকেই চিনেনা৷ অথচ আমাদের দেশে ইফতারের আয়োজন নিয়েও দলাদলি চলে৷
আমরা ধর্ম না বোঝলেও দলবাজি ভালোই বুঝি, যার কারনে বাংলাদেশর মত ছোট্ট দেশে ৫৪টি শুধু ইসলামী দলই আছে৷ এসব দলের নেতাদের নিজেদের বেহেশত ঠিক থাকুক বা না থাকুক সমর্থকদের কাছে এরা পাইকারী দরে বেহেশতের টিকেট বিক্রি করে যাচ্ছে৷ আপনি ব্যক্তি জীবনে ইসলাম পালন করতে পারেন আবার নাও করতে পারেন কিন্তু ইসলাম নিয়ে ব্যক্তিগত মতামত প্রদান করে নেতাগিরি, দলাদলি, দলভারী করার কোন সুযোগ নেই সৌদী আরবে৷

পঠিত : ৮৭৬ বার

মন্তব্য: ০