Alapon

শেষ বিচারদিবস এবং আমাদের উপলবদ্ধি...

সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। এক অভিজাত পরিবার। পরিবারের বড় ছেলে, শিক্ষিত, সুদর্শন। বিদেশে গেল, সেখান থেকে নিখোঁজ হয়ে গেল। বছর দেড়েক পর তারই এলাকার এক ব্যক্তির মাধ্যমে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়। কিন্তু এর মধ্যে তার মানসিক সমস্যা দেখা দিল। এরকম এক পরিস্থিতিতে ছেলের মানসিক সমস্যার কথা লুকিয়ে ছেলের বাবা ছেলেকে বিয়ে দিলেন এক মেয়ের সাথে। স্বাভাবিকভাবেই খুব অল্পদিনের মধ্যেই জানা হয়ে গেল ছেলের সমস্যা। তারপর...

উপরের চরিত্রগুলো কাল্পনিক নয়। সেদিনেরও অনেক বছর পর এই চরিত্রগুলোর সাথেআমার পরিচয় হয়েছিল। সেদিনের সেই ছেলের বাবা এখন মৃত্যুশয্যায়। মানসিক সমস্যা নিয়ে সেই ছেলেও এখন শেষ বয়সে, মেয়েটিও এখন বুড়ি। তাদের বিচ্ছেদ হয়নি, তাদের একমাত্র মেয়ে সেও দিব্যি সংসার করছে। 

সেদিনের সেই মেয়ে তার শ্বশুরের বিরুদ্ধে মামালা করেনি, ক্ষতিপূরণও চায়নি, সংসার ফেলে চলেও যায়নি। মৃত্যুশয্যায় থাকা শ্বশুর নিজে খেতে পারেনা, তার পুত্রবধু তাকে খাইয়ে দেন। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে, ছোট বাচ্চাকে যেভাবে খাওয়ায় সেভাবে, সেখানে মমতা আছে-- দূর থেকে অবাক হয়ে এই দৃশ্য আমি বেশ সময় নিয়ে দেখেছি। রাত্রীবেলা স্বামী ঠান্ডায় কাতরাচ্ছে দেখে তাকে আর কোনদিন নদীতে নেমে গোসল না করার উপদেশ আমি শুনেছি, সেই উপদেশে এক বুক ভালোবাসা ছিল, ছিল আগলে রাখার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। 

এই মহিলার সাথে যা হয়েছে সেটা জুলুম, অতি উঁচু মাত্রার জুলুম। আর সেই জুলুমের বিপরীতে সে যা করেছে, করছে সেটার নাম ইহসান। এটা তার জন্য বাধ্যতামূলক ছিল না। শরিয়াহ মতে, দেশের আইন মতে তিনি চাইলে বিচার দাবী করতে পারতেন। এই ইহসান দেখে হঠাৎ করে আমার আবু বকর (রাঃ) এর কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। আবু বকরের ইহসানের বিষয়ে রাসূল (সাঃ) বলেছিলেন, এই দুনিয়াতে আমি সবার ইহসান পরিশোধ করেছি কিন্তু আবু বকরের ইহসান পতিশোধ করতে পারিনি। কারণ তার ইহসানগুলো এমন যা স্বয়ং আল্লাহ পরিশোধ করবেন।

আমি অনেক চিন্তা করে দেখেছি। এই মহিলার সাথে যা হয়েছে সেটার যদি ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় তাহলে দুনিয়ার কোন জিনিসটা দিয়ে সেটা সম্ভব? আমি যুতসই কিছুই পাইনি। 

আল্লাহ যদি মানুষের আমলের পাই পাই করে হিসেব নেন তাহলে কেয়ামতের দিন আমরা সবাই আটকে যাবো। যদি দুনিয়ার বিচারের নিয়মে আখিরাতেও আমাদের বিচার হয় তাহলে আমাদের বাঁচার কোন উপায় নেই। কিন্তু আল্লাহ কেয়ামতের দিন শুধু বিচারক হবেন না, তিনি সেদিন হবেন মালিকীও মিদ্দীন--বিচারদিনের মালিক। পুরো বিচার ব্যবস্থাটারই মালিক তিনি। সেদিন আমাদের ইহসানগুলো অন্য মাত্রা পাবে। আমাদের ইহসানগুলোর জন্যই আল্লাহর কাছে একেকজনের অবস্থান একেক রকম হবে। এজন্যই আবু বকর আম্বিয়াদের পর সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবেন। 

আমরা যদি সব হিসেব এই দুনিয়াতেই চুকিয়ে ফেলি তাহলে আখিরাতের জন্য কী রাখলাম! যারা জান্নাতুল ফেরদৌসের বাসিন্দা হতে চায়, যারা চায় আখিরাতে তাদেরও একটা বাড়ী হোক, লাল নীল হীরার বাড়ী, যারা চায় জান্নাতে তাদের প্রতিবেশী হোক রাসূল (সাঃ), আবু বকর, উমারেরা-- তারা অবশ্যই অন্যদের থেকে আলাদা। তাদের ক্ষমা আলাদা, তাদের প্রতিশোধ আলাদা, তাদের রাহমাহ আলাদা, তাদের স্বপ্ন আলাদা। আল্লাহ যেন আমল দিয়ে আমাদেরকে আর দশজন থেকে আলাদা করে দেন। আল্লাহ যেন আমাদের ভুলে ভরা এই আমলগুলো কবুল করেন। আল্লাহ যেন দয়া করে তার জান্নাতে আমাদেরকে একটু ঠায় দেন। আমীন।

পঠিত : ১১৩৪ বার

মন্তব্য: ০