Alapon

মৌলিক গবেষণার প্রয়োজনীয়তা ও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতা

রিসার্চ নিয়ে অনার্স লাইফে আমাদের একটা কোর্স ছিলো 'রিসার্চ মেথডোলজি' নামে। সেই কোর্স থেকে কী পড়েছিলাম আর কী শিখেছিলাম- এখন আর তেমন একটা মনে নেই। জেনারেলি আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রিসার্চ ওরিয়েন্টেড না। এদেশে খুব কম ছাত্রই তাদের ছাত্রজীবনে রিসার্চ নিয়ে আগ্রহী হয়। শিক্ষকরাও প্রমোশনের স্বার্থে একান্ত বাধ্য হয়েই কয়েকটা রিসার্চ ওয়ার্ক করে, তাও একান্ত দায়সারা ভাবে। ছাত্ররা যখন স্ট্যাটিস্টিক্স বা একনোমিক্সের মতো খুব জীবনঘনিষ্ট আর গবেষণাধর্মী কোর্সগুলো পড়ে- তখন তাতে জানার আগ্রহ থাকে না, বরং যত আগ্রহ মার্ক্স তোলা আর সিজিপিএ বাড়ানোর প্রতি। তাই কেউ শিক্ষককে প্রশ্ন করে না যে মিউ কিম্বা স্ট্যান্ডার্ড ডিভিয়েশনের মান বের করে কী হবে, কিম্বা বাস্তব জীবনে এর এপ্লিকেশন কী! কোর্স শেষ করতে হবে আর ভালো মার্ক্স পেতে হবে- এই-ই যেন পড়াশোনার উদ্দেশ্য।

নতুন জ্ঞান গড়ে ওঠে গবেষণার মাধ্যমে। শিক্ষা যেমন মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা বাড়ায়- তেমনি আমাদের শৈল্পিক মনন আর রুচিশীলতাও গড়ে তোলে। শিক্ষালাভের প্রকৃত উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জন, কোন কিছুর প্রকৃত সরূপ সম্পর্কে জানা! তাছাড়া চমৎকার ক্যারিয়ার, ভালো স্যালারির চাকরি, উন্নত জীবনমান, সুন্দর সংস্কৃতিবোধ -এগুলো হলো শিক্ষার উপরি পাওনা। মানুষের কৌতুহল আর জানার অতৃপ্ত আকাঙ্খা মানুষকে জ্ঞানার্জনে চালিত করে। কিন্তু পোস্ট কলোনিয়াল বাংলাদেশে শিক্ষার উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ভালো চাকরি অর্জন আর প্রমোশন। শিক্ষাকে তাই পন্য কিম্বা টাকা বানানোর মেশিন হিসেবে ইউজ করে বাংলাদেশে (বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে) ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। আর সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চালিত হয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মৌলিক গবেষণার জন্য তেমন কোন বরাদ্দ থাকে না। আর যা-ও থাকে তা-ও মোটামুটি লুটপাট হয়ে যায়। 

আর প্রাইভেট ভার্সিটিগুলোর অবস্থা তো আরোও করুণ। এখানে চলে শিক্ষকদের প্রমোশন কেন্দ্রিক গবেষণার হিড়িক। খুব কম শিক্ষকই ছাত্রদের রিসার্চের ক্ষেত্রে উৎসাহিত করেন। আমার পরিচিত হাতেগোনা কয়েকজন শিক্ষককে দেখেছি যারা ব্যক্তিগত তাগিদ থেকে ছাত্রদের উৎসাহিত করতেন। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে রিসার্চ-ওয়ার্ক থাকাটা যে কত গুরুত্বপূর্ণ - অনেক উচ্চশিক্ষা প্রত্যাশী-ই একটা পর্যায়ের আগে উপলব্ধি করতে পারে না। আমাদের কাছে বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় আমরা এই নিয়ে পরবর্তীতে ব্যাপক ঝামেলায় পড়ে যাই।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মৌলিক গবেষণাকর্ম না হওয়াতে একাডেমিয়ায় মৌলিক গ্রন্থপ্রণেতাও তৈরী হচ্ছে না। ফলে এখনো পর্যন্ত আমাদের পঞ্চাশ বছরের পুরানো (প্রতীকী অর্থে) ইউরোপ কিম্বা আমেরিকা সেন্ট্রিক বইগুলো পড়তে হচ্ছে। জ্ঞানার্জন কিম্বা জ্ঞানের বিকাশের ক্ষেত্রে আমরা সময়মতো নিজেদের আপডেটেড করতে পারি না। অনার্স লাইফে থিসিস কিম্বা ইনটার্নশীপ রিপোর্ট আমরা তৈরী করেছিলাম কপি-পেস্ট করে। সেখানে জানার কোন আকুতি ছিলো না, বরং দ্রুত ভালো মার্ক্সসহ এই আপদ থেকে কীভাবে বের হওয়া যায় যেন সেই চেষ্টাই ছিলো। আমাদের টিচাররাও এসব জানেন, কিন্তু কিছু না বলে চুপ করে যান; বলা বাহুল্য শিক্ষকদের বেশিরভাগই এভাবেই তাঁদের ছাত্রজীবন শেষ করেছিলেন। এই সংস্কৃতি কিন্তু একদিনে গ্রো করেনি, বরং আমরা একধরণের করাপ্টেড একাডেমিক লিগ্যাসি বহন করে চলেছি।

সোশাল সায়ন্সের জ্ঞানগুলো সবসময়ই সাব্জেক্টিভ & রিলেটিভ। তাই একটা দেশের বা সোসাইটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সোশাল সায়েন্সেস, ল্যাংগুয়েজ, লিটারেচার, লজ, ফিলোসফি -এসব নিয়ে স্থানীয়ভাবে মৌলিক গবেষণা আর রচনার কাজ না হওয়া মানে হলো প্রাশ্চাত্য সভ্যতা এবং সংস্কৃতিকে নিজেদের মাথায় ইনডক্ট্রিনেইট করে নেয়া। আমরা অলসজাতি, জ্ঞানার্জনের সাধনা আর গবেষণার পরিশ্রম থেকে পলায়নপর; কিন্তু প্রতিনিয়তই আমরা হাহাকার করে চলি- "হায়, সবকিছু বিজাতীদের দখলে গেলো", কিন্তু কীভাবে গেলো এই নিয়ে ভাবার প্রয়োজনীয়তা বোধ করি না।

লেখার তারিখঃ ২৭/১১/১৮

পঠিত : ২৩৮৩ বার

মন্তব্য: ০