Alapon

ফেলানী হত্যা ও আমাদের ধ্বসে যাওয়া সার্বভৌমত্ব

জীবিকার সন্ধানে সেদিন মা-বাবার সঙ্গে ইটভাটায় কাজ করতে ভারতে গিয়েছিল কিশোরী ফেলানী। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ভোরবেলা কাঁটাতারের প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে নিজ দেশে ফেরার চেষ্টা করে ফেলানী। এ সময় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বাংলাদেশি কিশোরী ফেলানীকে লক্ষ্য করে গুলি করে। গুলি করার পর তাকে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখা হয়। চার ঘণ্টা প্রাণ নিয়ে পানি পানি করে চিৎকার করতে থাকে ফেলানী। কিন্তু ভারতীয় নরপিশাচদের কাছে এক ফোটা পানিও পায়নি বাংলাদেশের কিশোরী ফেলানী। এক সময় কাঁটাতারে ঝুলন্ত অবস্থাতেই তার মৃত্যু ঘটে। দীর্ঘক্ষণ তার দেহ কাঁটাতারের বেড়ার ওপরেই ঝুলে ছিল। আজ সেই ঘটনার আট বছর। আজো ফেলানী হত্যার বিচার পেলাম না। 

আসক, অধিকার ও বিজিবি প্রদত্ত তথ্য অনুসারে, এই দশ বছরেই বিএসএফের হাতে নিহত হয়েছেন অন্তত ৪৩১ জন। আর আহত ও অপহরণের শিকার যথাক্রমে ৬২০ ও ৫৬২। সবচেয়ে নিষ্ঠুর, বর্বর হত্যাকান্ড ঘটায় ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে ৯৪৭ আন্তর্জাতিক সীমানা পিলারের কাছে। সেদিন তারা বাংলাদেশী কিশোরী মেয়ে ফেলানীকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে। 

ফেলানীর পিতা নুরুল ইসলাম বলেন, ওরা লাশ দিয়েছে ঠিক, কিন্তু মৃত ফেলানীর অলংকার নিতে ভুল করে নাই। ফেলানীর লাশের ছবি গণমাধ্যমে আসার পর সারা বিশ্ব ধিক্কার দিতে থাকে ভারতীয় এ বর্বব বাহিনীকে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিভিন্ন আঙ্গিকে ফেলানীর ছবিসহকারে নিউজ কাভার করে। মার্কিন অনলাইন সংবাদবিষয়ক নিউজ কোম্পানি ‘গ্লোবাল পোস্ট' বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া বর্ডার' ‘ওয়াল অব ডেথ' শিরোনামের রিপোর্টে বলে- চার হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ  বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম সীমান্ত স্থানীয়দের মৃত্যুর দেয়াল বলেই পরিচিত। তারা আরও বলে ভারতের পক্ষে বিএসএফ এ বিশাল সীমান্ত পাহারা দেয়। তারা কোন ধরনের সতর্কতা ছাড়াই নিরস্ত্র জনতাকে হত্যা করে। এদের বেশির ভাগই হচ্ছে বাংলাদেশী'।

তথাকথিত গণতান্ত্রিক ও সভ্য দেশ হিসেবে পরিচয় দানকারী ভারত আর্ন্তজাতিক কোন আইন মানতে নারাজ। তারা গায়ের জোরে সব কেড়ে নিতে চায়। তারা আমাদের পানি দিয়ে মারতে চায়। তাদের বেহেল্লাপনা সংস্কৃতি কৌশলে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যকে ধ্বংস করতে চায়। নেশা জাতীয় সামগ্রী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাচার করে আমাদের যুব সমাজের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিতে চায়। সর্বোপরি তারা সীমান্তে পাখির মতো নিরপরাধ মানুষ মেরে আমাদের ‘সবক' দিতে চায়। আমরা বাংলাদেশের মানুষ আতঙ্কিত, কি জানি কি, ওরা এদেশের কিছু মীরজাফর, জগৎশেঠ ও ঘসেটি বেগমদের কাঁধে ভর করে আমাদের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করে নিজেদের হীন চক্রান্ত বাস্তবায়ন করে বসে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তারপরও বলতে হবে ভারত আমাদের তথাকথিত বন্ধু রাষ্ট্র (!)। 

বিশেষ করে আওয়ামী সরকারের প্রিয়ভাজন দেশটি একের পর এক আমাদের ওপর অন্যায়-অত্যাচারের স্টিম রোলার চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সত্য, ‘বন্ধু নাখোশ হবে' ‘ক্ষমতার চেয়ার থাকবে না' এই ভয়ে, না অন্য কিছু মুযেজায় সরকার ভারতের বড় ভাইসুলভ এ অন্যায় অপকর্মের শক্ত প্রতিবাদ করতে পারছে না। একজন স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে তা দেখতে নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। আমাদের দেশের মন্ত্রী মিনিস্টারদের কথা শুনলে মনে হয় না, এদেশ দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে। তাদের দায়িত্বহীন কথাবার্তায় জাতিকে যে মেসেজ দিচ্ছে, তা হলো- আমরা এক পরাধীন জাতি, ভারত যা চায় তাই হবে, আমাদের বলার কিছু নাই। ভারতের বিরুদ্ধে যারাই কথা বলবে তারা হয় রাজাকার, না হয় যুদ্ধাপরাধী। ইতিমধ্যে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এ খেতাবে ভূষিত হয়েছেন বৈকি।

বর্তমান সরকার সীমান্তে হত্যা বন্ধ করাতো দূরের কথা বরং তারা বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশীদের হত্যাকে রীতিমতো বৈধতা দিতে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। তার বাস্তব প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছে সদ্য প্রয়াত ও আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মুখ থেকে। সীমান্ত হত্যার সাফাই গাইতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সীমান্তে এসব ঘটনা প্রায়ই ঘটছে, শুধু আজই নয়, অতীতেও এমন ঘটনা ঘটেছে। ভবিষ্যতেও ঘটবে। এগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে বিচারযোগ্য কোন বিষয় নয়। এ নিয়ে রাষ্ট্র খুব চিন্তিতও নয়। আর সব কাজ ফেলে রেখে শুধু এদিকে দৃষ্টি দেবার প্রয়োজন আছে বলেও আমরা মনে করি না।' 

তাহলে সরকার মনে করেন কি? ভারতকে ফ্রি ট্রানজিটের নামে করিডোর ও নৌবন্দর দেয়া? বাংলাদেশের ভূমি ভারতের হাতে তুলে দেয়া? নেশাজাতীয় মাদকদ্রব্য অবাধে ভারত থেকে বাংলাদেশের ভিতরে আসার রাস্তা সুগম করে দেয়া? ভারতীয় নর্তকীদের এনে সারা রাত্রব্যাপী উলঙ্গ নৃত্য পরিবেশন করে এদেশের যুবসমাজকে অন্ধকার পথে ঠেলে দেয়া? না ফেলানিসহ শত শত মানুষকে হত্যা ও অত্যাচার দেখিয়ে আমাদের ভীতি প্রদর্শন করে ভারত সেবার জন্য জাতিকে সবক দেয়া? 

আমাদের এমন দৈন্যদশা আগে ছিল না। স্মরণ করা যায় ২০০১ সালের ১৮ই এপ্রিলের কথা। বাংলাদেশ আর ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক আর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে এদিন নিহত হয়েছিল অসংখ্য ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী। বাংলাদেশের ইতিহাসে ভারতের সঙ্গে সীমান্তে এরকম সংঘর্ষের নজির আর নেই। ১৮ এপ্রিল ভোরে বিএসএফ নগ্ন হামলা চালিয়েছিল বড়াইবাড়ি গ্রামে। হামলার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছিল বিডিআর আর বীর জনতা। ১৬ জনের লাশ ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল বিএসএফ। ৩ জন বীর বিডিআর সৈনিক শাহাদাত বরণ করেছিলেন দেশের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখতে। বিএসএফরা যে বেআইনীভাবে বড়াইবাড়ি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ ভূ-খন্ডে প্রবেশ করেছিল তা নিয়ে কারো কোন সন্দেহ ছিল না। ৩০ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম একসঙ্গে ১৬ জন বিএসএফের মৃত্যু ঘটে। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর ১৬ সদস্য নিহত হওয়ার পরই পরাজয় স্বীকার করে তারা পিছু হটে।

দৈনিক যুগান্তরকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আ.ল.ম. ফজলুর রহমান বলেন, ‘বিনা কারণে রৌমারী সীমান্তে বিএসএফয়ের গুলীবর্ষণ, ও প্রাণহানির জন্য ভারতকে ক্ষমা চাইতে হবে। ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’ গা বাঁচাতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশোবন্ত সিং ১৯ এপ্রিল মন্তব্য করেন যে, ‘পাদুয়ায় বিডিআরের অবাঞ্ছিত প্রবেশে শেখ হাসিনা সরকারের সায় ছিল না।’ ২০ এপ্রিল বিকেলে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় পররাষ্ট্র সচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী বলেন, ‘সিলেটের তামাবিল এলাকার পাদুয়া থেকে বাংলাদেশ রাইফেলস বা বিডিআর-এর ঘেরাও তুলে নেয়া হয়েছে। ভারতও তার বিরোধপূর্ণ রাস্তাটি ভেঙ্গে দিয়েছে।’

বড়াইবাড়ীতে রাতের আধারে সীমান্ত অতিক্রম করে শত শত ভারতীয় সৈন্যের বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ, বিডিআর সৈন্যদের হত্যা, বাংলাদেশের গ্রাম লুট ও জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনায় যখন সারাদেশে ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার দাবি উঠেছে ঠিক তখনই তৎকালীন সরকার প্রধান ২২ এপ্রিল দিবাগত রাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর সাথে আধাঘণ্টাব্যাপী এক টেলিফোন সংলাপে বসেন এবং এই সময়ে ৩ বার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিডিআরের ভূমিকায় (বীরত্বের জন্য) দুঃখ প্রকাশ করেন। এদিকে নিজ দেশে বাজপেয়ী সরকারের মুখ রক্ষা করতে বাংলাদেশের সরকার প্রধান দুঃখ প্রকাশ করলে ভারতীয় পক্ষ থেকে তাদের দেশে শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে এ ঘটনায় দায়ভার এককভাবে বিডিআর প্রধানের উপর চাপিয়ে দেয়। 

এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালে আওয়ামীলীগ সরকারের ২য় বারের মত ক্ষমতায় পদার্পণের পর ভারতের মান রক্ষায় বিডিআর  এর নাম পরিবর্তনের জন্য উঠে পড়ে লাগে। অন্যদিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তাকে নিজের জন্য হুমকি ভাবতে থাকে আওয়ামীলীগ। এর ফলাফল ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহ। এ যেন এক ঢিলে দুই পাখি মারা। এ বিদ্রোহে তখনকার মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ বিডিআরে কর্মরত অর্ধশতাধিক সেনা কর্মকর্তা নিহত হন। যাদেরকে বিএনপি-জামাতপন্থী হিসেবে বিবেচনা করা হত। আর অন্যদিকে বিডিআর এর নাম পরিবর্তন করে বিজিবি করা হয়। 

জাতীয় সংসদে ২০১০ সালের ০৮ ডিসেম্বর ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আইন, ২০১০’ পাস হলে ২০ ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকর হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ২৩ জানুয়ারি বাহিনীর সদর দপ্তরে ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ’ (বিজিবি) এর নতুন পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করেন। সেই সঙ্গে নতুন মনোগ্রাম উন্মোচনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ বাহিনীর নতুন পথচলা। এর অংশ হিসেবে বাহিনীর নাম, পোশাকসহ বেশ কিছু পরিবর্তন আসে। এর মাধ্যমে বিডিআরের ৩৯ বছরের ইতিহাসের বিলুপ্তি ঘটে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ০৩ মার্চ এ বাহিনীর নামকরণ হয় বিডিআর (বাংলাদেশ রাইফেল্স)।

এতকিছুর পর এটা স্পষ্ট যে, সীমান্তে বিডিআর আর এখনকার বিজিবির মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। বিজিবি তাদের অতীতের ঐতিহ্য হারিয়েছে। যদি সীমন্তে এক শক্তিশালী বাহিনীর উদ্ভব করা না যায়, যদি এখনো মায়ানমার ও ভারতের পররাষ্ট্রনীতির মুখোমুখি হওয়ার সাহস না দেখানো যায়, যদি বাহিনীর মধ্যে দেশপ্রেমের আবেগকে জাগিয়ে তুলা না যায় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আমরা আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে হুমকির মুখে পড়ব এতে সন্দেহ নেই।

পঠিত : ৪০২৪ বার

মন্তব্য: ০