Alapon

বাংলাদেশীদের সৌদি বিদ্বেষ পর্ব ০৯

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম   

স্যার হুমায়ুন আহমেদ তখনো এত জনপ্রিয় হননি৷ বই বিক্রি বাবত একটা প্রকাশনী থেকে কিছু টাকা ঊনার হাতে আসে৷ এ টাকা দিয়ে তিনি পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভারতের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ভ্রমনে বের হন৷ যার মধ্যে আজমীর শরীফও ছিলো৷
আজমীর শরীফ যাওয়ার পর ঊনার ছোট মেয়ে বিপাশা বিরক্ত হয়ে বললো, "কোথায় নিয়ে এলে? চারদিকে ফকির৷" তিনি বিপাশাকে বললেন, "এখানে একজন অতি বড় সাধু মানুষের কবর আছে৷ এখানে এলে আল্লাহর কাছে যা চাওয়া যায়, তা পাওয়া যায়৷"এই কথা শোনে বিপাশা মানসিকভাবে স্বস্তিবোধ করলো৷ এরপর স্যার তাকে নিয়ে কবর যিয়ারত করলেন৷
কবর যিয়ারত শেষে তিনি চলে আসবেন, কিন্তু বিপাশা আসতে চাইছিলো না৷ তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, "ব্যাপার কি?" সে বললো, "আমি আল্লাহর কাছে যেটা চেয়েছি সেটা পাইনি৷ না পেলে যাব না৷" স্যার জিজ্ঞেস করলেন, "মা, তুমি কি চেয়েছ?" সে বললো, "আমি আল্লাহর কাছে এক বস্তা টাকা চেয়েছি৷" বাড়িতে গেলে আল্লাহ টাকা পাঠিয়ে দিবে, স্যার তাকে এসব বলে বুঝিয়ে শুনিয়ে সেখান থেকে নিয়ে আসলেন৷ আজমীর থেকে আসার পর অবিশ্বাস্যভাবে স্যারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং সেই সাথে দু'হাতে টাকাও আসতে থাকে৷
আমাদের দেশের বিশাল একটা জনগোষ্ঠী আছে যাদের ধ্যান, জ্ঞান, ধর্ম স্যার হুমায়ুন আহমেদ কেন্দ্রিক৷ তাদের কাছে স্যারের এই ঘটনায় যে মেসেজ যাবে তা সংক্ষেপে বর্ণণা করতে গেলে অর্থ দাঁড়ায়- "খাজা তোমার দরবারে, কেউ ফিরে না খালি হাতে৷" আমরা অনেকে বিভিন্ন কারনে এসব দরবারে ছুটে যাই৷ অধমেরও এক সময় দরবারে যাতায়াত ছিলো৷ দরবারে যাতায়াতের হাতেখড়ি হয়েছিলো টঙ্গীর মাছিমপুর কো-অপারেটিভ মার্কেটের পাশের এক দরবার থেকে৷ দরবার শরীফের নাম যথাসম্ভব হাফেজ আবদুর রশিদ সাহেবের দরবার শরীফ৷ হাফেজ সাহেব কবে গত হয়েছেন সেটা জানি না, তবে দরবারে ঊনার খাদেম আছে৷দরবারের এক পাশে পুরুষ এবং অন্য পাশে নারীরা বসতেন, মাঝখানে কাপড়ের পর্দা ছিলো৷ প্রতি বৃহস্পতি বার সেখানে হালকায়ে জিকিরের আয়োজন করা হত৷ আমাদের দেশের অনেক মসজিদ এবং মাহফিলেও এধরনের হালকায়ে জিকির হয়৷ জিকিরের নিয়ম হলো, নিঃশাস টান দিয়ে মাথাকে উপরের দিকে তোলে "আল্লা" এবং নিচে নিঃশ্বাস ছেড়ে "হু" বলতে হবে৷ আবার নিঃশ্বাস টান দিয়ে মাথাকে ডান দিকে নিয়ে "লা ইলাহা" বাম দিকে নিঃশ্বাস ছেড়ে "ইল্লাললা" বলতে হবে৷ এভাবে বেশ কয়েক বার জিকির করলে আপনি মনে শান্তি অনুভব করবেন৷
অনেক কিছুই আমাদের মনে শান্তি নিয়ে আসে, কিন্তু মনের শান্তিটাইতো ধর্ম নয়৷ এভাবে উচ্চস্বরে, হেলে দুলে, জিকির করা সম্পর্কে স্যার ডঃ খন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহঃ) বলেন, "উচ্চ স্বরে জিকির করা আবু জাহেলের সুন্নাত৷" পাঠকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, আবু জাহেলের আবার সুন্নাত আছে না কি? সুন্নাত কি, কত রকম হতে পারে এসম্পর্কে ঊনার "এহইয়াউস সুনান" গ্রন্থে বিস্তারিত বিবরণ আছে৷
বাইতুল্লাহ এবং মসজিদে নববী ছাড়াও, মসজিদে মীক্বাত, মসজিদে ক্বোবা, মসজিদে ক্বীবলাতাইন, মসজিদে গামামা, মসজিদে ইজাবার মত ঐতিহাসিক মসজিদগুলো দেখার সৌভাগ্য অধমের হয়েছে৷ কিন্তু কোন মসজিদে আমাদের দেশের মত এমন উচ্চস্বরে জিকির আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি৷ সৌদী প্রবাসী অন্যান্য ভাইদের হয়েছে কি না তা তারা ভালো বলতে পারবেন৷
মাহরাম ব্যতিত নারীদের কন্ঠ যেন অন্য পুরুষ না শোনেন, বিজ্ঞ আলেমগণ সে বিষয়েও সতর্ক করে থাকেন৷ নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে একটা দরবার শরীফ আছে, আমি সেখানেও দেখেছি নারী-পুরুষদের এভাবে উচ্চস্বরে জিকির করতে৷ দরবার শরীফের মূল মাজারের পাশে সম্পূর্ণ মোজাইক পাথরে বাধানো অনেকগুলো কবর আছে৷ মাজারের মূল কবরটিও গিলাফ দিয়ে ঢেকে দেওয়া, তবে ধারণা করা যায় সেটিও মোজাইক বা সিমন্ট দিয়ে পাকা করা; কারন কবরটি মাটির হলে আশেপাশে ধুলোবালি থাকত বা গোলাপ জল ছিটানোর কারনে গিলাফে কাদা লাগত৷
যে পীরের নামে মাজারটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বেগমগঞ্জের অনেকের ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আমি তাঁর ছবি ঝুলতে দেখেছি৷ তাঁর দেহটা ছিলো শীর্ণ, কিন্তু কবরের প্রশস্ততা দেখলে মনে হয় সেখানে কোন হাতিকে সমাহিত করা হয়েছে৷ কবরের উপর পাকা করা, সেটিকে উঁচু করা এবং চওড়া করা এসব বিষয়েও আলেমগণ নিষেধ করে থাকেন৷
দরবার শরীফের পাশেই মাজার কমিটির অফিস৷ অফিসে ঢুকতেই কমিটির একজন এক হিন্দু ভদ্রলোককে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো, "আজকের ওরশের গরুটা দাদা দিয়েছেন৷" হিন্দুদের দাদার গোমাতাকে বাবার দরবারে উৎসর্গ করতে শোনে অনেকেরই হয়ত মনে খটকা লাগতে পারে৷ সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজীর "রায়নন্দিনী" থেকে জানা যায় হিন্দুদের মাজার ভক্তি অনেক পুরনো৷ আজমীর শরীফেও অনেক হিন্দু ধর্ণা দেয়৷
মাজারের বাইরে দোকানগুলোতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আসর বসেছে৷ আসরের নিয়ম হলো আপনার যদি কল্কি টানার অভ্যাস থাকে তাহলে একটান দিয়ে পাশের জনকে দিবেন, না টানলেও আপনি হাতে নিয়ে পাশের জনকে দিবেন৷ আসরের আদব রক্ষার্থে কল্কি দু'হাতে ধরে আদান-প্রদান করতে হবে৷ সাধারণত মাদ্রাসার ছাত্ররা আদব রক্ষার্থে এভাবে দু'হাতে ওস্তাদদের কাছে খাতা, কিতাব ইত্যাদি প্রদান করে থাকে৷ একতারার টুন টুন শব্দে আসরের শিল্পী গান শুরু করেন৷ গানের অন্তরায় শিল্পী বলছে- "তুমি খোদা, তুমি রাসূল, তুমি মালিক রাব্বানা, দোজাহানের বাবা মাওলানা৷"
আমরা অনেকেই আল্লাহকে বোঝাতে খোদা শব্দ ব্যবহার করি, কিন্তু সালাফী আলেমগণ এ ব্যাপারে নিষেধ করে থাকেন; কারন আল্লাহর নিরানব্বই নামে খোদা শব্দটি নেই৷ গানের কথা গুলো যদি আমরা একটু লক্ষ্য করি, শিল্পী তার পীর বা মুর্শিদ কে উদ্দেশ্য করে বলছে, তার মুর্শিদই আল্লাহ, রাসূল, দুই জাহানের মালিক (নাঊজুবিল্লাহ)৷ যে কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মুসলমানই জানেন আল্লাহ স্রষ্টা, রাসূল তাঁর সৃষ্টি৷ আল্লাহর সাথে কারো তুলনা করা মানেই শিরক্৷ দরবার ভিত্তিক যত গান আছে তার প্রায় অধিকাংশই এমন শিরক, বিদআত পূর্ণ যা কল্কির নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা অসুস্থ মুসলমান ভাইয়েরা বোঝেন না৷ যাদের এসব বোঝানোর দায়িত্ব তারা নিজেরাই দরবারে গিয়ে মাথা ঠেকায়৷
বাংলাদেশের সাবেক একজন রাষ্ট্রপতি আটরশির দরবারে পড়ে থাকতেন৷ প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হয় হযরত শাহজালাল (রহঃ) এর মাজার যিয়ারতের মাধ্যমে৷ অধমেরও শাহজালাল (রহঃ) এর মাজারেও যাওয়া হয়েছে৷ এখানকার বাইরের দোকানগুলোতে দোয়া, দুরূদ ছাড়া রেডিমেড তবারক পাওয়া যায়৷ মনোবাসনা পূরণের জন্য লাল এবং হলুদের মিশ্রণে এক ধরনের সূতা পাওয়া যায়, সাধারণত হিন্দুরা রাখি উৎসবে এ ধরনের সূতা হাতে বাঁধে৷
ভিতরে বিশাল বড় পাতিল দেখে ভেবেছিলাম দর্শনার্থীদের জন্য বিরিয়ানির আয়োজন করা হয়েছে, কাছে গিয়ে দেখি সেটা দান বাক্স৷ তার পাশে গজার মাছকে খাওয়ানোর জন্য কুছো চিংড়ি বিক্রি চলছে৷ মূল মাজারে উঠার মুখে সাদা লুঙ্গি, সাদা শার্ট, সাদা টুপি, ক্লিন শেভড এক দল লোক দেখতে পেলাম৷ তারা না কি দরবারের খাদেম! সাধারণত হিন্দি মুভিতে এমন সাদা কাপড় পরিহিত পলিটিক্যাল লিডারদের দেখা যায়৷ মাজারের সাথে অবশ্য হিন্দি মুভির মিল আছে৷ তামিল, তেলেগু, হিন্দি মুভিতে নায়ক/নায়িকা যখন কোন বিপদে পড়ে তখন মায়ের দরবারে গিয়ে প্রার্থনা করে৷ এই মুভিগুলো যখন আমাদের দেশে কপি করা হয়, তখন মায়ের দরবারের স্থলে বাবার দরবারের দৃশ্য আনা হয়৷ খাদেমদের কাজ হলো দরবারে দান করা এক থেকে হাজার টাকার নোটগুলো আলাদা আলাদা করা৷
হযরত শাহপরাণ (রহঃ) এর দরবারটা পাহাড়ের উপর সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়৷ আপনি যেভাবে উঠবেন সেভাবেই নামতে হবে, কবররে পিঠ দিয়ে নামতে পারবেন না৷ কথিত আছে, ঊনার কবরকে পিঠ দেখিয়ে নামলে অভিশাপে জ্বলে যাবেন৷ অথচ ইসলামের ইতিহাস বলে, জীবিত রাসূল (সাঃ) কে পাথর মেরে রক্তাক্ত করার পরেও তিনি কাউকে অভিশাপ দেননি৷ রাসূল (সাঃ) এবং সাহাবীগণের কবরে লক্ষ লক্ষ মানুষ যিয়ারত করছে, কবররের দিকে পিঠ দিয়ে চলে যাচ্ছে, অভিশাপে জ্বলে গেছে এমন নজির আজও দেখা যায় নি৷


অনেক পিএইচডি ডিগ্রীধারী লোক থেকে শুরু করে নিরক্ষর লোক দরবার ভক্তিতে জড়িত৷ আমাদের এসব দরবার ভক্তি ধর্মহীনতা নয়৷ আমাদের প্রচুর ধর্মীয় আবেগ আছে কিন্তু ধর্মীয় শিক্ষা নেই৷ আর আমাদের এই অজ্ঞতাকে পুঁজি করে কিছু লোক ধর্মের নামে বিনা পুঁজির ব্যবসা শুরু করেছে৷ সৌদী আরব যদি ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করতে চাইত, তাহলে রাসূল (সাঃ) এর রওজার সামনে একটা দান বাক্স বসিয়ে রাখলেই হত৷ দুনিয়ার মুসলমানদের সব সম্পত্তি এসে এখানে জমা হত৷
আমাদের এসব দরবার ভক্তরা হজ্ব, ওমরাহ করতে এসে জান্নাতুল বাক্বীর মাটি নিয়ে টানাটানি শুরু করে, রাসূলের রওজার দিকে হাত তুলে নিজের মনোবাসনা পূরণের আকুতি জানায়৷ এদের দেখে সেখানকার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ বাধা দিয়ে থাকেন৷ তাদের কথা হলো, কবরে আমল যাবে মাটি যাবে না৷ আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে মনেবাসনা পূরণের প্রার্থণা করা শিরক৷
যেহেতু হাজীদের অধিকাংশই আরবী জানেন না, তাই না বোঝে অনেকেই মনঃক্ষুন্ন হয়৷ আর মনঃক্ষুন্ন হওয়ারই কথা, কারন মনের মাঝে বিদ্বেষের বীজতো দেশে দরবারের হুজুর কেবলা বপন করেই দিয়েছেন- "সৌদী আরব যান হজ্ব, ওমরাহ করেন, কিন্তু সৌদী যাই ঈমাণ নষ্ট কইরেন না৷" এসব ধর্ম ব্যবসায়ীগোষ্ঠী এবং তাদের ভক্তদের কাজ হলো সারাদিন সৌদীকে গালি গালাজ করে নিজেদের ঈমাণ মজবুত করা৷

পঠিত : ২০৩৮ বার

মন্তব্য: ০