Alapon

বাংলাদেশীদের সৌদি বিদ্বেষ পর্ব ১১

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
 আরবের এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলো বিশেষ করে সৌদী, আমিরাত, ওমান, বাহরাইনের খাবার সবাই খেতে পারলেও; আফ্রিকা অঞ্চলের মিশর, লিবিয়া, সুদানের খাবার অনেকের রুচিতে বাধবে৷ আবার আরবের লোকেরা আমাদের খাবার খেতে চায় না৷ এমন না যে ওদের খাবার হালাল, আমাদেরটা হারাম; বা আমাদেরটা হালাল ওদেরটা হারাম৷ ব্যবধানটা হচ্ছে রন্ধন প্রণালীতে৷ আমাদের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের লোকদের মত অত মশলাযুক্ত খাবার আর পৃথিবীর আর কেউ খায় বলে জানা নেই৷
রন্ধন প্রণালীর মত রাঁধুনীদের সাজ সজ্জাও ভিন্ন৷ আরবের মেয়েরা আমাদের উপমহাদেশের মেয়েদের মত নাক, কান ফুটো করে না৷ যদিও ইদানিং আরবের কিছু কিছু দেশে কান ফুটো করার প্রচলণ ঘটেছে৷ তবে সেটা ব্যাপক নয়৷ আফ্রিকা অঞ্চলের কিছু দেশে আবার মেয়েদের খতনা করানো হয়৷ কিছু অঞ্চলে বিয়ের পর এ্যাসিড বা অন্য কোন পদ্ধতিতে স্থায়ী ভাবে মেয়েদের মুখে এক ধরনের বিশেষ চিহ্ন এঁকে দেওয়া হয়৷ যাতে সবাই বুঝতে পারে মেয়েটি বিবাহিত৷
পোশাক ব্যবহারেও আছে ভিন্নতা৷ আরবের পুরুষেরা সবাই জুব্বা পৱলেও, সেলাইয়ে আছে ভিন্নতা৷ অভিজ্ঞ লোকেরা সাধারণত পোশাক দেখেই বলতে পারবেন কে সৌদী, কে মিশরী, কে সুদানী৷ আরবের মেয়েরা ভিতরেই যাই পড়ুক, বাইরে আসলে তারা বোরকা পড়বে৷ সুদান, মৌরাতানিয়ার মত কিছু দেশের মেয়েরা সেলোয়ার কামিজের উপর শাড়ি পড়ে৷ ইন্দোনেশিয়া এবং মালেশিয়ার মত দেশগুলোতে নারী, পুরুষ সবাই লুঙ্গি এবং ফতুয়া পড়ে৷
ইন্দোনেশিয়াতে বিয়ের পর সন্তান ইচ্ছে হলে মা-বাবার ভরণ পোষণের দায়িত্ব নিতেও পারে আবার নাও নিতে পারে৷ বিয়ের পরেও স্বামী-স্ত্রী দু'জনেই উপার্জন করে৷ আরবে দেখা যায় এক ভাই ফুফুকে বিয়ে করেছে, আরেক ভাই চাচাত/মামাত/খালাত ভাতিজিকে বিয়ে করেছে, অর্থাৎ এথানে ফুফু-ভাতিজির সম্পর্ক হচ্ছে জা৷ কিন্তু আমাদের সমাজে এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও চারদিকে ছিঃ ছিঃ রব পড়ে যাবে৷
'ভারতবর্ষের বিবাহের ইতিহাস' বইয়ে ডঃ অতুল সুর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের হিন্দুদের ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে বিবাহ, আলাদা চাল চলন, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি বৈষম্য নিয়ে আলোচনা করেছেন৷ মুসলমানদের মাঝে সাধারণত এমন কোন ভিন্নতা নেই৷ নেই কোন বৈষম্য৷ গ্র্যান্ড মুফতির জন্য যা বৈধ, আমাদের জন্যও তা বৈধ৷ ঊনার জন্য যা অবৈধ, আমাদের জন্যও তা অবৈধ৷ রাজা-প্রজা, আমির-ফকির, সাদা-কালো, বিশ্বের সকল মুসলমানের জন্য এক আইন৷ মুসলমানদের একেক অ়ঞ্চলে একেক রকম খাদ্যাভ্যাস, ভিন্ন ভিন্ন পোশাক, সামাজিক রীতিনীতি ইত্যাদি আলাদা কেন?
বিশ্বের একেক অঞ্চলের আবহাওয়া একেক রকম৷ আবহাওয়া এবং জলবায়ুর উপর নির্ভর করে প্রত্যেক অঞ্চলের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য গড়ে উঠে৷ সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের কারনে একেক অঞ্চলের মানুষের সামাজিক রীতিনীতি একেক রকম, যার কারনে আপনি চাইলেও বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর বা সৌদী আরবের মত করতে পারবেন না৷ ইসলামী চিন্তাবিদগণ সাধারণত সুক্ষ্মভাবে স্থান, কাল, পাত্র চিন্তা করে ফতোয়া দিয়ে থাকেন৷ যার কারনে একই বিষয়ে একেক অঞ্চলে একেক রকম রীতিনীতি পরিলক্ষিত হয়৷
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “ইসলাম যেথায় গিয়েছে, সেথায়ই আদিম নিবাসীদের রক্ষা করেছে। সেসব জাত সেথায় বর্তমান। তাঁদের ভাষা, জাতীয়ত্ব আজও বর্তমান।” আমাদের দেশের বর্তমানে অনেক ইসলামী চিন্তাবিদগণ স্থান, কাল, পাত্রের চিন্তা না করেই ফতোয়া দেওয়া শুরু করেন৷
আরবের লোকেরা সাধারণত যখন কোন ব্যক্তির কাজে খুশি হয় তখন এই বলে দোয়া করে, আল্লাহ আপনাকে বিয়ে করার তৌফিক দান করুক৷ অনেক সময় ছেলেও বাবাকে এভাবে দোয়া করে৷ এতে তারা দোষের কিছু মনে করে না, এটা তাদের সংস্কৃতি৷ কিন্তু আমাদের দেশে কোন সন্তানের কাছেই বাবার দ্বিতীয় বিয়ে কাম্য নয়৷ যদি কেউ ফান করেও এমন দোয়া করে, বাবা কিছু না বললেও মা ঝাড়ু নিয়ে দৌড়ে আসবে৷ সৌদীদের বিয়ে নিয়ে নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি-
আমাদের বাসার পাশে অনেকগুলো লেডিস টেইলার্স আছে৷ এক পাকিস্তানী টেইলারের মোবাইলে কিছু প্রোগ্রাম ডাউনলোড করে দিচ্ছিলাম৷ এমন সময় মাঝ বয়সী এক সৌদী মহিলা আসলো৷ একটা কাগজে মাপ আর একটা ব্যাগে কাপড় দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কবে শেষ হবে? টেইলার বললো, পনের দিন পর৷ ভদ্রমহিলা তার পাশে দাঁড়ানো মাঝ বয়সী লোকটাকে দেখিয়ে বললো, আগামী সপ্তাহে আমার স্বামীর বিয়ে, টাকা পয়সা কোন সমস্যা না আমাকে এই সপ্তাহের মাঝেই জামাটা দিতে হবে৷ নেকাবে মুখ ঢাকা থাকলেও বোঝা যাচ্ছে মহিলা স্বামীর দ্বিতীয় বিয়েতে সে খুবই উৎফুল্ল৷ আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম!
এখানে বিয়ে করাটা অত সহজ নয়৷ এক আফগানীকে জানি, যে আরেক আফগানী মেয়েকে বিয়ে করেছে চল্লিশ হাজার রিয়াল বাংলা প্রায় নয় লক্ষ টাকা দেনমোহর দিয়ে৷ সৌদীদের ক্ষেত্রে দেনমোহরের পরিমাণ আশি হাজার রিয়াল থেকে আরো বেশি হয়৷ এছাড়া গাড়ি, বাড়ির ব্যবস্থাতো আছেই৷ দুই বিয়ে করলে দুই বৌ এর দেনমোহর, দুইটা বাড়ি, দুইটা গাড়ি৷ সৌদীদের সবাই একাধিক বিয়ে করে না৷ আমার পরিচিত প্রায় পঞ্চাশজন লোকের মাঝে একজনের কপিলকে দেখেছি যার দুই স্ত্রী, বাকি সবারই এক স্ত্রী৷ অথচ এদের সবারই দ্বিতীয় স্ত্রী রাখার মত আর্থিক সামর্থ্য আছে৷
সৌদীরা মেয়ে হলে খুশি হয়, নিঃশ্চিন্ত থাকে; আর আমাদের মেয়ে হওয়া মানে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়া৷ মেয়ের বিয়ের যৌতুকের টাকা জোগাড় করার জন্য বাবার রক্ত মাংশ পানি করা৷ আমাদের দেনমোহরের প্রচলণ কাগজেই সীমাবদ্ধ৷ দেনমোহর আমাদের জন্য ফরয, যৌতুকের প্রচলণটা এসেছে মুশরিকদের কাছ থেকে৷ এসব নিয়ে কথা না বলে আমরা আছি একাধিক বিয়ে করা যায় তা নিয়ে৷
বাবার দ্বিতীয় বিয়েতে সন্তানদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশ গ্রহণ, কিংবা স্বামীর বিয়েতে স্ত্রীর উৎফুল্ল হওয়ার মত একটাও নজির নেই আমাদের দেশে৷ আবার যারা দ্বিতীয় বিয়ে করেন তাদের প্রথম স্ত্রী আর ভালো লাগে না, প্রথম স্ত্রীর সন্তানদের আর খোঁজ খবর নেন না৷ আবার প্রথম পক্ষের স্ত্রী যদি দাপুটে হয়, তাহলে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর স্থান হয় রাস্তাঘাটে৷ দ্বিতীয় স্ত্রী এবং তার গর্ভের সন্তান হারিয়ে যায় গহবরে৷
সৌদীদের সাথে আমাদের ধর্মীয়, ঐতিহ্য, শাসন ব্যবস্থায় অনেক অনেক পার্থক্য৷ আমাদের বাসার পাশে মদীনা কোবা রোডে লেডিস মার্কেটে অবস্থিত৷ যথাসম্ভব এটি মদীনার ব়ৃহত্তম লেডিস মার্কেট৷ এখানে একটা মোবাইল মার্কেটও আছে৷ প্রথম যখন সেখানে মোবাইল কিনতে যাই এক মুরুব্বী সাবধান করে বললেন, ঐদিকে সাবধানে যাইও এখানকার আইন-কানুন বড় খারাপ৷ কি খারাপ! আসরের পর থেকে সেখানে মহিলারা গিজগিজ করে৷ কিন্তু ইভটিজিংতো দূরের কথা কেউ তাকিয়ে থাকারও সাহস পায় না৷ কারন এখানে মহিলাদের অভিযোগকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়৷ সেক্ষেত্রে সাক্ষী, প্রমাণ ছাড়াই সাজা হয়ে যেতে পারে৷ আমরা যারা গার্লস স্কুল, লেডিস মার্কেটের সামনে ভীড় করতে পছন্দ করি তাদের জন্যতো এসব আইন খারাপই৷
এখানকার প্রায় মসজিদেই মেয়েদের জন্য নামাযের ব্যবস্থা থাকে৷ আমাদের দেশের অনেকেই এখন মেয়েদের মসজিদে নামাযের ব্যবস্থার দাবী তুলেছেন৷ একদল তাদের দাবীকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন, আরেকদল বিরোধীতা করছেন৷ যারা সাধুবাদ জানাচ্ছেন তারা সামাজের ভয়াবহ পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পারছেন না৷ কাল যদি সংবাদের শিরোনামে আসে, মসজিদে যাওয়ার পথে তরুণী লাঞ্চিত; তাহলে আজ যারা তাদের মসজিদে যেতে উৎসাহ দিচ্ছেন তারা কিন্তু এই লাঞ্চণার বিচার করতে পারবেন না৷ সেই ক্ষমতা তাদের নেই৷ সেক্ষেত্রে অনেক মেয়ের ধর্মের প্রতি বিশ্বাস উঠে যাবে৷ আর যারা বিরোধীতা করছেন তারা করছেন ধর্মীয় গোঁড়ামী থেকে৷ ইসলামে মেয়েদের মসজিদে যেতে বাধা নেই৷ উভয় পক্ষের উচিত ছিলো মেয়েদের মসজিদে যাওয়ার পথকে নিরাপদ করা৷
আমাদের এসব অজ্ঞতা, অক্ষমতা, বিভক্তি, ফরয বিধান বাদ দিয়ে নফল নিয়ে লাফালাফির মূল কারন হলো আমাদের দ্বীনি শিক্ষা ফুটবলের মত৷ বাংলাদেশ জীবনে কখনো বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশগ্রহণ করতে পারবে কি না, সে গ্যারান্টি নেই কিন্তু আমাদের ঘরে ঘরে ফুটবল বিশেষজ্ঞ৷ ইসলামের ইতিহাসে এমন কোন বাঙ্গালী বীর বা আলেমের কথা আমার জানা নেই যিনি বাংলার বাইরে ইসলাম প্রচার এবং প্রসারে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন৷ অথচ বাংলার ঘরে ঘরে ইসলামী বিশেষজ্ঞ৷
এই ইসলামী বিশেষজ্ঞরা আবার সবকিছুতে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, জার্মানীর ভক্তদের মত বিভক্ত৷ সৌদী ফুটবল খেলায় অংশগ্রহণ করার পরেও তাদের মাঝে এটা নিয়ে তেমন কোন উচ্ছ্বাস এবং উদ্দীপনা আমার চোখে পড়েনি৷ আর আমরা ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চার মত লাফালাফি করতে করতে একজন আরেকজনের রক্ত ঝরাতেও দ্বিধা করি না৷ যে কোন বিষয়ে না বোঝে লাফালাফি, বিভক্তি, বিশৃঙ্খলতা প্রিয় ধার্মিকদের কাছে সৌদী আরবকে অনৈসলামিক দেশ মনে হতেই পারে৷

পঠিত : ১২১৩ বার

মন্তব্য: ০