Alapon

ওরিয়েন্টালিস্টদের হাদীস বিরোধিতার অন্তরালে

ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে হাদীসের ভূমিকা অপরিসীম। হাদীসের ভূমিকা ও মধ্যকার অন্তর্নিহিত শক্তির কারণেই আজ মরোক্কো থেকে মিন্দানাও পর্যন্ত মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনের আচরণের মধ্যে সাদৃশ্য পাওয়া যায়। মিন্দানাওয়ের একজন মুসলমান যেমনি ভাবে খাওয়ার আগে বিসমিল্লাহ বলে কেনিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন মুসলমানও খাওয়া শুরু করার আগে বিসমিল্লাহ বলে শুরু করে। শ্রীলঙ্কায় বসবাসকারী একজন মুসলমান যেমন তার অপর ভাইকে দেখলে সালাম দেয় তেমনি ভাবে মালিতে বসবাসকারী একজন মুসলমানও তার অপর মুসলিম ভাইকে দেখলে সালাম দিয়ে থাকে। শুধু দৈনন্দিন জীবনেই নয়, শিল্প কলা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রেও মিন্দানাও ও কর্ডোভার স্থাপনা ও সাহিত্যের মধ্যে গঠনগত ও রূপগত সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।

ধর্ম বিদ্বেষী ব্রিটিশ-যায়নবাদী পাশ্চাত্য সভ্যতা খ্রিষ্টান ধর্মকে নাস্তানাবুদ করার পর ইসলামের দিকে নজর দেয়। কিন্তু ইসলামের দিকে নজর দিয়ে দেখে যে না, খ্রিষ্টান ধর্মকে যেভাবে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে উৎখাত করতে পেরেছি ইসলামকে সেভাবে উৎখাত করা সম্ভব নয়। খ্রিষ্টান ধর্ম কিভাবে ইউরোপীয়ান রেনেসাঁর সামনে অসহায় হয়ে পড়েছিল আমরা সকলেই কমবেশী জানি। আমি এখানে দুইটি উদাহরণ দেখাতে চাই,

১। ছাপাখানা আবিষ্কার হওয়ার পর সবার হাতে হাতে ইঞ্জিল পৌঁছে গেলে গির্জার পাদ্রীরা মানুষের উপর তাদের কর্তৃত্ব হারাতে থাকে।

২। বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার। খ্রিষ্টান ধর্ম এর প্রচণ্ড বিরোধিতা করলেও সময়ের ব্যাবধানে ইউরোপে শিল্প বিপ্লব ও বৈজ্ঞানিক বিপ্লব সংগঠিত হয়। এখানে আমাদের মনে প্রশ্ন জন্মায় খ্রিষ্টান পাদ্রীরা কেন বিজ্ঞানের বিরোধীতা করত? এর কারণ হল খ্রিষ্টান ধর্ম জ্ঞান গবেষণার উপযোগী কোন ধর্ম নয়, নতুন তত্ত্বকে খ্রিষ্টান পাদ্রীরা সব সময় ভয়ের চোখে দেখত। যেমন সৌর-জগত দুনিয়া কেন্দ্রিক ( Geo-Centric) নাকি সূর্য কেন্দ্রিক ( Helio-Centric)? কোপারনিকাস এসে যখন তার তত্ত্ব দিয়ে প্রমান করেন যে সৌর-জগত সূর্য কেন্দ্রিক ( Helio-Centric)। তার এই তত্ত্ব খ্রিষ্টান ধর্ম তত্ত্বের উপর বড় আঘাত হানে এবং অল্প সময়ের মধ্যে গির্জার কতৃত্ত্বের ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেয়। কিন্তু মুসলমানদের উপর বা ইসলামের উপর নতুন কোন প্রভাবই বিস্তার করতে পারেনি। মুসলমানগণ এটাকে নতুন একটি আবিস্কার বলে ধরে নেয়। বিশেষ করে, সৌর জগতের দুনিয়া কেন্দ্রিক নাকি সূর্য কেন্দ্রিক এটা ইসলামে আকিদাগত কোন বিষয় নয়। দ্বিতীয়তঃ কিবলা কিংবা মহাসাগরে জাহাজের দিক নির্ণয়ের জন্য এস্ট্রোনমিক হিসাবের দিক থেকে দুনিয়ার স্থলে সূর্যকে কেন্দ্র হিসেবে ধরে নিলেও হিসাবের কোন পরিবর্তন হয় না। তৃতীয়তঃ মুসলিম বিজ্ঞানীগন আগেই গবেষণা করে বের করেছিলেন যে, দুনিয়া সৌর জগতের কোন কেন্দ্র নয় এবং দুনিয়া গোলাকার।

এই ধরণের আরও অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলো খুব সহজেই বিজ্ঞান এবং গির্জার মধ্যে দন্দ বাধিয়ে দিয়েছিল। আর এই দন্দে বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানীরা বিজয় লাভ করলে ইউরোপ থেকে ধর্মকে বিদায় করে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায় এবং তাদের সকল তত্ব ও থিওরীকে ধর্মের বিপরীতে গড়ে তুলে।

কিন্তু ইসলাম ছিল এর সম্পূর্ণ বিপরীত, কারণ ইসলামের মূল উৎস কোরআন নিজেই মুসলমানদেরকে জ্ঞান-বিজ্ঞান, গবেষনার প্রতি উৎসাহিত করেছে। যার ফলে তারা জ্ঞানের সকল শাখা প্রশাখাকে কোরআনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের আলোকে ঢেলে সাজিয়েছিল এবং বিজ্ঞানকে এনে দিয়েছিল এক নতুন মাত্রা। যে যুগে মহান আল্লাহর অনুসন্ধান করতে গিয়ে মানুষ সৃষ্টিকে মূল্যহীন মনে করে বর্জন করেছিলে সে যুগে মুসলমানগণ প্রকৃতি এবং ইসলামের মধ্যে খুজে পেয়েছিল এবং বিশেষ সম্পর্ক। আল্লাহ এবং বিশ্বের সাথে মানুষের বহুবিদ সম্পর্ক বিরাজমান। এই সম্পর্ক সম্পর্কে মানুষের মনে গভীর চেতনার উন্মেষ করাই হচ্ছে কোরআনের প্রধান উদ্দেশ্য। ইসলামে মানুষ এবং প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক হল কৃষির সাথে প্রকৃতির এবং মাটির সাথে কৃষকের সম্পর্কের মত। ব্যবসায়ী এবং বাজারের মধ্যকার সম্পর্কের মত।

এই বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরে ওরিয়েন্টালিস্টরা খুঁজতে থাকে যে ইসলামকে কোন দিক দিয়ে আঘাত করা যায়? তখন তারা দেখতে পায় যে ইসলামে হাদীসে ভাণ্ডার অনেক বিশাল এবং এটা নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে ভুলবুঝাবুঝি রয়েছে এবং এই হাদীস সমূহই ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে দিয়েছে আলাদা এক মর্যাদা। তাই তারা আরোও অনেক বিষয়ের সাথে হাদীসকেও বেছে নেয়। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে তারা নেদারল্যান্ডের লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ বছর ধরে হাদীস নিয়ে গবেষণা করে এবং এখানে মুসলমানদের দুর্বলতাকে সামনে রেখে হাদীস উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন চিন্তা মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়।

আব্দুল গাফফার নামধারী একজন ওরিয়েন্টালিস্ট মক্কাতে যান সেখানে হাদীস চর্চাকে দেখার জন্য সেখান থেকে তিনি অন্য একজন ওরিয়েন্টালিস্টকে লেখেন যে, এটা কেমন বিষয় সাইবেরিয়ার মুসলমান যা করে মক্কার মুসলমানও তা করে, সিজদা করার সময়ও একই কথা বলে, একে অপরের সাথে দেখা হলেই একই ভাবে অভিবাধন জানায়, এটা হয়েছে কেবলমাত্র সুন্নতের কারণেই। যেভাবেই হোক আমাদেরকে এই সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে হবে।

একই ভাবে ইংল্যান্ডের একটি লাইব্রেরীতে ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানির দস্তাবেজে লেখা আছে যে, “ ‘মিশকাতুল মাসাবিহ’ এর অনুবাদের দায়িত্ব দেওয়া হয় জেমস রবসনকে। কারণ ভারতীয় উপমহাদেশের সকল মুসলমানের কাছেই এই হাদীস গ্রন্থটি রয়েছে। তারা তাদের সমগ্র জীবনকে এর উপরে ভিত্তি করে গড়ে তুলেছে। এই জন্য তাদের চিনতে হলে আমাদেরকে এই বইকে অনুবাদ করার কোন বিকল্প নেই”।

এই জন্য আমাদের সকলের দায়িত্ব হল হাদীসকে সঠিক ভাবে বুঝা এবং অতীতের বড় বড় আলেম ও ইমাম গণ হাদীসকে বূঝার জন্য যে উসূল দাড় করিয়েছেন সেটাকে ভালো ভাবে পড়ে আমাদের ইসলামী চিন্তাকে পাকাপোক্ত করতে হবে। হাদীসের উপর ভিত্তি করে আমরা একে অপরকে যেন গালি গালাজ ও তাকফির না করি।


পঠিত : ৬৯০ বার

মন্তব্য: ০