Alapon

প্রফেসর ডঃ ফুয়াদ সেজগিন, ইসলামী সভ্যতার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

ফুয়াদ সেজগিন, তার নাম শুনলেই যেন আত্মবিশ্বাস জেগে উঠে। তিনি তার সমগ্র জীবনকে ব্যয় করেছেন ইসলামী সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানের জন্য। জীবনের ইচ্ছা ছিল তিনি একজন ইঞ্জিনিয়ার হবেন, এই উদ্দেশ্যে কলেজ জীবন শেষ করে, ইস্তানবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সেখানে যাওয়ার পর তার শিক্ষক Hellmut Ritter এর একটি কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেন। কনফারেন্স থেকে বের হওয়ার পর তিনি সিধান্ত নেন যে, তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং না পড়ে সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের কোন বিষয়ে পড়বেন। কারণ এই ক্ষেত্রটি অনেক বেশী ফাঁকা এবং এই ক্ষেত্রটিতে করার মতো অনেক কাজ রয়েছে ।

এই সিধান্ত নেওয়ার পর তিনি ‘আরবী ও ফার্সি ভাষা সাহিত্যে’ বিভাগে ভর্তি হোন। ‘আরবী ও ফার্সি’ বিভাগ থেকে পাশ করেন। পাশ করার পর পত্রিকায় একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখতে পান। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটি ছিল, আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিওলজি ফ্যকালটিতে তাফসীর বিভাগে একজন রিসার্চ এসিসটেন্ট নেওয়া হবে। এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে তিনি আঙ্কারায় আসেন এবং পরীক্ষায় পাশ করে আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিওলজি ফ্যাকাল্টির তাফসীর বিভাগে এসিসটেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। তাফসীর বিভাগে যোগদান করার পর ‘ তাফসীর’ এর উপর মাস্টার্স করার সিধান্ত নেন। কিন্তু তাফসীরের কোন বিভাগ নিয়ে গবেষনা করবেন সে বিষয়ে পরামর্শ করার জন্য ইস্তানবুলে অবস্থানকারী তার শিক্ষক বিখ্যাত ওরিয়েন্টালিস্ট Hellmut Ritter এর সাথে পরামর্শ করতে যান। তাকে জিজ্ঞসা করেন যে আমি কোন বিষয়ে গবেষণা করলে ভালো হবে?

Hellmut Ritter তাকে বলেন, ‘তুমি যেহেতু আঙ্কারায়, আঙ্কারার ইসমাইল সাহিব লাইব্রেরীতে ইসলামের ইতিহাসের প্রথম দিকে লেখা একটি তাফসীর গ্রন্থ রয়েছে। তাফসীরটি হল আবু উবায়দা মা’মার বিন মুসান্নার লেখা ‘মাজাজুল কোরআন’। এটা শুধু আঙ্কারার ঐ লাইব্রেরীতেই রয়েছে। আমি খবর নিয়ে দেখেছি পৃথিবীর আর কোথাও নেই’। 
তাফসীরের লেখক আবু উবায়দা ২১০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

Hellmut Ritter এই তথ্য দেওয়ার পর ফুয়াদ সেজগিনকে বলেন যে, ‘আমি তোমাদের মুসলমানদের ব্যপারটা বুঝি না, তোমাদের ইসলামের ইতিহাসের প্রথম দুই শতাব্দীতে লেখা গ্রন্থের সংখ্যা খুবই কম। ঐ সময়ে লেখা খুব বেশী বই-পুস্তক নেই। অথচ বই গুলি অনেক গুরত্ত্বপূর্ণ। তোমরা এই বই গুলা নিয়েও কোন গবেষণা করো না? এইটা আমার বুঝে আসে না।

এই জন্য আমার মনে হয় তুমি যদি এই মাজাজুল কোরআনের উপর কাজ কর তাহলে ভালো হবে’। 
পরে তিনি (ফুয়াদ সেজগিন) আঙ্কারায় ফিরে আসেন এবং ঐ গ্রন্থাগার (লাইব্রেরী) থেকে মাজাজুল কোরআন নামক তাফসীর গ্রন্থটি খুঁজে বের করেন। এর পর তিনি অন্য আরও একটি খণ্ড খুঁজে পান। পরে এই দুই গ্রন্থকে একত্রিত করে এক সাথে করে তুলনা করেন এবং প্রকাশের উপযোগী করেন তুলেন।

এই দিক দিয়ে তিনি আঙ্কারায় বিশ্ববিদ্যালয়ের তাফসীর বিভাগের শিক্ষকের সাথেও যোগাযোগ রাখেন, এবং তার কাছে এসে এই মাজাজুল কোরআনের কথা বলেন। ফুয়াদ সেজগিনের মুখে মাজাজুল কোরআন এবং তার লেখক আবু উবায়দা মা’মার বিন মুসান্নার নাম শুনে বলেন, 
“ আমাদের বুখারী (ইমাম বুখারী) ও তোমার এই লোকের অনেক উৎস ব্যবহার করেছে”।

আঙ্কারায় বিশ্ববিদ্যালয়ের তাফসীর বিভাগের শিক্ষক তাইব হোজার মুখে এই কোথা শুনে তিনি আশ্চর্য হয়ে বলেন তাই নাকি? 
তাইব হোজা বলেন হ্যাঁ, ইমাম বুখারী, বুখারী শরীফের তাফসীর অধ্যায়ে ক্বালা মা’মার, ক্বালা মা’মার, বলে অনেক বার উল্লেখ করেছেন।

জনাব ফুয়াদ সেজগিন তার এই কথা শুনার পর বুখারীর দিকে ঝুকেন, এবং ইমাম বুখারী ও বুখারী শরীফ পড়া শুরু করেন। বুখারী শরীফ পড়ার পর, বুখারী শরীফে যতবার মা’মারের কথা উল্লেখ আছে সেগুলোকে একত্রিত করে ইস্তানবুলে তার শিক্ষক Hellmut Ritter এর কাছে যান।

Hellmut Ritter এর কাছে গিয়ে তাকে বলেন আমি এরকম কিছু জিনিস খুঁজে পাইছি। এগুলা কিভাবে কাজে লাগাব? ফুয়াদ সেজগিনের এই কথা শুনে হেলমুট রিটার আশ্চর্য হয়ে বলেন কি! আবার বলো তো। বুখারী, মা’মার কে উৎস হিসেবে উল্লেখ করেছে?
ফুয়াদ সেজগিন বলেন জবাবে বলেন যে, হ্যাঁ।

একথা শুনে হেলমুট রিটার তাকে বলেন যে, তুমি তোমার দ্বিতীয় থিসিস ও পেয়ে গেছ।

আমাদের ওরিইয়েন্টালিস্টদের গবেষনা মতে হাদীস লেখা শুরু হয়েছে তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যভাগে। আমরা জানি যে, বুখারী তার বুখারী শরীফ রচনা করেছে রাবীদের শুনা কথার উপর ভিত্তি করে। কিন্তু তুমি এখন বলতেছ যে, বুখারী তার বুখারী শরীফে মা’মারের কথা উল্লেখ করেছেন এবং তার লেখা গ্রন্থ থেকেও তিনি হাদীস নিয়েছেন। এখন তোমার কাজ হল, মাজাজুল কোরআনকে ঠিক করে প্রকাশ করার পর বুখারীর উৎস সমূহ নিয়ে গবেষণা করা। যদি তুমি আরও কিছু লিখিত উৎস পাও তাহলে হাদীস নিয়ে ওরিয়েন্টালিস্টদের যে সকল অভিযোগ রয়েছে তাদের সকল অভিযোগ যে ভুল সেটা তুমি প্রমান করতে পারবে।

তার এই কথা শুনে ফুয়াদ সেজগিন মাজাজুল কোরআন প্রকাশ করেন এবং তার ডক্টরেটের থিসিস হিসেবে বুখারীর লিখিত উৎস সমূহ নামে থিসিস করেন।

প্রথমে তিনি থিসিরের নাম দেন যে, বুখারীর লিখিত উৎস সমূহ, পরে তিনি তার গবেষণায় আরও অগ্রসর হয়ে দেখতে পান যে, ইমাম বুখারী তার সমগ্র বুখারী শরীফই লিখিত উৎসের উপর ভিত্তি করে রচনা করেছেন! পরে তিনি ‘লিখিত’ শব্দটি বাদ দিয়ে তার থিসিসের নাম দেন ‘ বুখারীর উৎস সমূহ’ এই ভাবে তিনি তার একটি থিসিসের মাধ্যমে ওয়ারিয়েন্টালিস্টদের হাদীস বিরোধীতার সকল অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রমান উপস্থাপণ করেন এবং তাদের অভিযোগকে ভুল প্রমান করেন।

বুখারীর উৎস নিয়ে কাজ করার সময় তিনি সবচেয়ে যে বইটিকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেন সেটা হল, Brockelmann এর লেখা A History of Arab Literature (تاريخ التراث العربي) নামক বইটি। এই সময়ে তিনি আরও যে কাজটি করেন তা হলেন, তুর্কীতে হস্ত লিখিত যত গ্রন্থাগার ছিল সকল গ্রন্থাগারে তিনি গিয়ে গিয়ে পড়াশুনা করতেন আর ব্রকেলম্যানের লেখা বইয়ের সাথে তুলনা করতেন। প্রথম তুলনা তিনি ইসমাইল সাহিব সেঞ্জের গ্রন্থাগারে বসে করেন। যেমন তিনি দেখতে পান যে, শুধুমাত্র ইসমাইল সাহিব সেঞ্জের গ্রন্থাগারেই তাফসীরের উপরে ১৫ টির বেশী উৎস রয়েছে কিন্তু ব্রকেলম্যান মাত্র ৩ থেকে চারটা বা কোথাও পাঁচটি এরকম উল্লেখ করেছেন।

যদি ব্রকেলম্যান রসায়ন নিয়ে ২ টি উৎস উল্লেখ করে থাকেন, ফুয়াদ সেজগিন রসায়ন নিয়ে ৯ থেকে ১০ টি উৎস খুঁজে পেয়েছেন। এটা দেখে তিনি সুলেইমানিয়া গ্রন্থাগারে যান সেখানে গিয়ে দেখেন জ্ঞানের এক মহাসাগর উৎস বা সোর্সের কোন শেষ নেই। এটা দেখে তিনি পুনরায় তার শিক্ষক Hellmut Ritter এর কাছে যান এবং তাকে বলেন যে, ব্রকেলম্যান তো কিছুই লেখে নাই। অনেক উৎস রয়েছে যার সে ৯০ ভাগের কোন উল্লেখই করেনি। যে যতটুকু পেয়েছে ততটুকুই উল্লেখ করে বিশ্লেষণ করেছে। আর আমরা এটাকেই একদম সব মনে করে বসে আছি, অথচ তিনি খুব কম উৎসই খুঁজে পেয়েছেন!

একথা শুনে তার শিক্ষক Hellmut Ritter তাকে বলেন যে, তুমি আমাদের ওরিয়েন্টালিস্টদের ব্যাপারে যে অভিযোগ ছিল সেটার জবাব দিয়েছ। এখন ব্রকেলম্যানকে ধরছ নাকি? তাকে কি এখন একদম শেষ করে দিতে চাও?

তাহলে তুমি একটা প্রজেক্ট আকারে দাঁড় করাও। যদি তোমার অভিযোগ সত্য হয়ে থাকে যে 'ব্রকেলম্যান ইসলামী সাহিত্যের উৎস নিয়ে সঠিক ভাবে কাজ করে নাই। তুমি তাহলে পুনরায় এটা নিয়ে কাজ করো।

তিনি আঙ্কারায় এসে প্রজেক্ট প্রস্তুত করেন। প্রজেক্ট প্রস্তুত করা শেষ হতে না হতেই তুর্কীতে ১৯৬০ সালে আর্মি ক্যু হয়। ক্যু এর পরে তাকে (ফুয়াদ সেজগিন) বিশ্ববিদ্যালয়য় থেকে বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কৃত হওয়ার পর তার শিক্ষক Hellmut Ritter এর সাহায্যে জার্মানিতে যান এবং জার্মানির ফ্রাঙ্কফুট বিশ্ববিদ্যালয়ে তার জন্য একটি ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিনি সেখানে বসে তার এই কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু এই কাজ ভালোভাবে করার জন্য কমপক্ষে ৯ টি ভাষা জানা দরকার ছিল। তিনি আগে এই ৯ টি ভাষা শিখেন এর পর পৃথিবীর প্রায় ৬০ টি দেশের গ্রন্থাগার ঘুরে ঘুরে ১৮ খণ্ডের সত্যিকারের تاريخ التراث العربي (আরবী সাহিত্যের ইতিহাস) রচনা করেন।

এই কাজ করার সময় আরও একটি বিষয় তার সামনে আসে। তিনি দেখতে পান যে, বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান কত বেশী! এই ভাবে তিনি গবেষণা করে 'ইসলামে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাস' নামে পাঁচ খণ্ডের গুরুত্ত্বপূর্ণ এক গ্রন্থ রচনা করেন। এই কাজের মাধ্যমে তিনি প্রমান করে দেন, পাশ্চাত্য হল ‘চোর’। 
তারা মুসলমানদের সকল আবিষ্কারকে নিজেদের নামে চালিয়ে দিয়েছে। 
এই ভাবে এই মহা মনীষী তার চারটি কাজের মাধ্যমে ওরিয়েন্টালিস্টদের গালে চপেটাঘাত করে ইসলামী সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্বকে তুলে ধরেন।

ঘটনাটির বর্ণনাকারী হলেন প্রফেসর ডঃ মেহমেদ গরমেজ 

পঠিত : ১৭৬০ বার

মন্তব্য: ০