Alapon

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ আর নেই

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ আর নেই। গতকাল শুক্রবার রাত ১১টার কিছু পরে রাজধানীর ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। কবির পারিবারিক বন্ধু কবি আবিদ আজম গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এছাড়া তিনি (কবি আবিদ আজম) তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন- ‘আল মাহমুদ জীব‌নের ওপা‌রে, প্রভুর সা‌ন্নি‌ধ্যে পৌঁ‌ছে গে‌ছেন রাত ১১টায়;‌ তি‌নি আর বেঁ‌চে নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মরহু‌মের রু‌হের মাহ‌ফেরা‌তের জন্য দোয়া প্রার্থনা।’
এর আগে ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় কবিকে ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। তিনি নিউমোনিয়াসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন।
মৃত্যুকালে আল মাহমুদের বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। তিনি স্ত্রী সন্তানসহ অসংখ্য গুনগ্রাহী রেখে গেছেন।সোনালী কাবিনের কবি আল মাহমুদ ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। তার পিতার নাম মীর আবদুর রব ও মাতার নাম রওশন আরা মীর। তার দাদা আব্দুল ওহাব মোল্লা হবিগঞ্জ জেলার বিখ্যাত জমিদার ছিলেন।স্রোতের গতি পরিবর্তন করতে পারা একজন অদম্য সাহসী যোদ্ধা কবি আল মাহমুদ। তিনি প্রতিজ্ঞা নিয়েই বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি এবং বিস্তার ঘটাতে সাহিত্যে কাজ করে গেছেন নিরলস। কবিতা এবং কথাসাহিত্য-উভয় ধারাতেই শক্তিশালী এই প্রতিভা বাংলা সাহিত্যের বিরাট অহংকার।কবি “সাহসের সমাচার”গ্রন্থে এক গদ্যে তার জীবন দর্শন তুলে ধরেছেন এই ভাবে- “প্রকৃতপক্ষে জীবন এক রহস্যঘন অশ্রুসজল অতিক্রমণ। সে ধীরে পার হয়, আস্তে কথা বলে, এবং শেষ পর্যন্ত অশ্রুসজল হয়ে পরিসমাপ্তি ঘটাতে চায়। কোথাও না কোথাও সমস্ত যাত্রারই একটা শেষ থাকে। জীবনেরও শেষ থাকবে এটাই নিয়ম’’।

সেই চিরন্তন নিয়মকে গ্রাহ্য করেই আজ বাংলা সাহিত্যে অনতিক্রম্য উচ্চতায় উপনীত কীর্তিমান কবি আল মাহমুদের জীবনাবসান হলো।

‘পার হয়ে যাচ্ছি’নামক একটি কলামে কবি চলে যাওয়া সম্পর্কে লিখেছিলেন ‘আমি যাচ্ছি উদ্দেশ্যহীন এক অপরিসীম পথের টানে’।

তবে কি কবি অনন্তের আহ্বান আগে থেকেই শুনতে পেয়েছিলেন? আবার বলেছেন-‘মাটির শীতলতা আমার মর্মে হাত বুলিয়ে না দিলে আমি শান্তি অনুভব করবো না। আমার জন্য কেউ যদি মৃত্যুর শীতলতা বুলিয়ে দিতে পারতো, তাহলেই আমার বিশ্রাম হতো’।

সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের জীবনের মূল্যবোধ জাগানিয়া, মমত্বময় মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন, দেশপ্রেমিক, মানুষের মঙ্গল প্রত্যাশী, মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সমৃদ্ধ এক কল্যাণময় মাতৃভূমির স্বাপ্নিক, প্রগতি ও সমাজ বদলের প্রেরণা, কাব্য ও সাহিত্য সাধক আল মাহমুদ তার কাঙ্ক্ষিত অপরিসীম পথ ধরেই যেন আজ শীতলতা খুঁজে পেয়েছেন।

তার কবিতা সমগ্রে “আমি আর আসবো না বলে” কবিতায় সহজ-সাবলীলভাবে কবির মুখে বিদায়ের সুর এভাবেই বেজে উঠেছে -

আমি আর আসবো না। 

প্রতিটি নামের শেষে, আসবো না। 

পাখি, আমি আর আসবো না। 

নদী, আমি আর আসবো না। 

নারী, আমি আর আসবো না, বোন।

আজ অতৃপ্তির পাশে বিদায়ের বিষণ্ণ রুমালে 

কে তুলে অক্ষর কালো, ‘আসবো না’ 

সুখ, আমি আসবো না। 

দুঃখ, আমি আসবো না।

প্রেম, হে কাম, হে কবিতা আমার 

তোমরা কি মাইলপোস্ট না ফেরার পথের ওপর?

তেমনি তিনি ‘অস্তাচলে নাম লিখেছি’কবিতায় বার্ধক্য-মৃত্যুকে সুরে-ছন্দে উপভোগ্য করতে চেয়েছেন এভাবে -

বদনখানি নেতিয়ে পড়া হাল ভাঙা এক নাও 

তাহার মাঝে বিরাজ করে তার বাঁধা এক লাও। 

লাওয়ের খোলে গান বেঁধেছি, ‘সোনার ময়না রে 

পিঞ্জিরা তো প্রাচীন হইল এবার উড়াল দে’।

জীবনে তার বৈরি সময় এসেছে বহুবার। কিন্তু তিনি কবিতার আঙিনা ছেড়ে কোথাও যাননি কোনো দিন। যেকোনো অনুশাসন– তা জীবনের হোক বা সাহিত্যের, অথবা সমাজের– তিনি প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছেন এক রাজকীয় অবহেলায়। ১৯৯০ দশক থেকে ব্যক্তি জীবনে ইসলামের অনুবর্তী হয়ে কবি আল মাহমুদ সমালোচনার শিকার হয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ইসলামকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এবং নিজেকে একজন বিশ্বাসী মুসলমান মনে করতেন। এটা নিয়ে তার কোনো রাখ-ঢাক ছিল না।



পঠিত : ৪০৫৮ বার

মন্তব্য: ০