Alapon

১৬৮৩ সালে উসমানী খিলাফতের দ্বিতীয় ভিয়েনা অবরোধ

১৬৮৩ সালে উসমানী রাষ্ট্র দ্বিতীয়বারের মত ভিয়েনা অবরোধ করে এবং পরাজিত হয়।

আর এই পরাজয়ের মাধ্যমেই শুরু হয় উসমানী খিলাফতের পতন। আর অভিযান পরিচালিত হয় সুলতান চতুর্থ মেহমেদের সময়ে। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ১৬৪৮ থেকে ১৬৮৭ সাল পর্যন্ত। আসুন এই ভিয়েনা অবরোধ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই।

সুলতান ইব্রাহীমকে মসনদ থেকে পদচ্যুত করার পর, তার পুত্র চতুর্থ মেহমেদকে মসনদে সমাসীন করা হয়। সুলতান চতুর্থ মেহমেদকে যখন সুলতান ঘোষণা করা হয় তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৭ বছর।  তিনি খুব ছোট হওয়ার কারণে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ত্ব অর্পিত হয় সদরে আজমের উপর। সদরে আজম রাষ্ট্রের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালালে সুলতান মেহমেদের মায়ের সাথে দ্বন্দ শুরু হয় এবং রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ঐতিহাসিকগণের মতে সদরে আজম এবং সুলতানের মায়ের মধ্যে এই দ্বন্দে সুলতানের মা ই বিজয়ী হোন এবং পরবর্তীতে তিনিই রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। 

সুলতান ৪র্থ মেহমেদ যখন উসমানী খিলাফতের মসনদে আসীন হোন তখনও গিরিত দ্বীপে যুদ্ধ চলছিল এবং ভেনেডিয়ান নৌবাহিনী মাঝে মধ্যেই উসমানী নৌবাহিনীর উপর আক্রমন করত।  উসমানী রাষ্ট্রের নৌবাহিনীও তাদেরকে প্রতিহত করার জন্য অভিযান পরিচালনা করতেন কিন্তু ভেনেডিয়ানদের মোকাবেলায় কোন সফলতা দেখাতে পারেনি। নৌবাহিনীর এই ব্যর্থতার দায় গিয়ে পড়ে সদরে আজম সফু মেহমেদ পাশার উপরে, ফলশ্রুতিতে তাকে পদচ্যুত করে দায়িত্ত্বে অবহেলার অভিযোগ এনে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়। সদরে আজম সফু মেহমেদ পাশা কে হত্যা করার পর কারা মুরাদ আগাকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়। 

এই সময়ে ইস্তানবুলে সিপাহী বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং মধ্য এনাতোলিয়াতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। এই বিদ্রোহকে দমন করার জন্য সদরে আজম কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন করতে বাধ্য হোন। এতে অনেক সিপাহীকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়। এদিকে রাষ্ট্রের অনুগত সিপাহী এবং বিদ্রোহীদের মধ্যেও সংঘাতের ফলে অনেক মানুষ মৃত্যু বরণ করে। 

একদিক দিক থেকে ইয়েনিচেরিরা (জাননিসার) তাদের বেতন দাবী করতে থাকে আবার অপরদিকে গিরিত দ্বীপে যুদ্ধরত নৌবাহিনীর জন্য সাহায্য পাঠানো প্রয়োজন ছিল কিন্তু রাষ্ট্রীয় কোষাগারে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকার কারনে তাদেরকে সাহায্য পাঠানোও সম্ভবপর হচ্ছিল না। উসমানী রাষ্ট্রের এই ভয়াবহ নাজুক অবস্থায় পারস যুদ্ধে ১৬৫১ সালে উসমানী নৌবাহিনী ভয়াবহ ভাবে পরাজিত হয়। এই সকল কিছু যেন একটি রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট ছিল না!! রাষ্ট্রের এই নাজুক পরিস্থিতিতে সুলতানের মনে শিকারে বের হওয়ার খায়েশ জাগে। তিনি পাইক পেয়াদা নিয়ে শিকার করতে বের হয়ে যান!!

রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে শক্তিশালী করার জন্য সদরে আজম, তারহুঞ্জু আহমেদ পাশাকে অর্থসংক্রান্ত বিষয়ে দেখাশুনা করার জন্য দায়িত্ত্ব দেন। তিনি দায়িত্ত্ব পেয়েই অর্থনীতিতে নতুন নতুন নীতিমালা নিয়ে আসেন এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে শক্তিশালী করার জন্য জনগণের উপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে দেন। জনগণ রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া এই অতিরিক্ত কর দিতে অস্বীকার করে এবং সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করে। এই বিদ্রোহ দমন করার জন্য তারহুঞ্জ পাশাকে দায়িত্ত্ব থেকে অব্যাহতি দেন এবং ব্যর্থতার দায়ে তাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেন। 

এত সব হতাশার মাঝে ১৬৫৪ সালে উসমানী রাষ্ট্রের জন্য একটি সুখবর আসে। সেই সুখবরটি ছিল নৌবাহিনীর প্রধান মুরাদ পাশা চানাক্কালে প্রণালীতে ভেনেডিয়ান নৌবাহিনীর সাথে যুদ্ধে ভেনেডিয়ান বাহিনীকে একদম নাস্তানাবুদ করে দেয়। এই খবর যেন উসমানী রাষ্ট্রে এক আনন্দের সুবাতাস বইয়ে দেয়। 

এদিকে রাষ্ট্রের মাথায় শক্তিশালী কোন শাসক না থাকার ফলে ঘন ঘন উজির পরিবর্তন হতে থাকে এবং মুদ্রার মানও কমে যেতে থাকে। রাষ্ট্র দিন দিন অর্থনৈতিকভাবে খারাপ অবস্থার দিকে ধাবিত হওয়ার কারনে জনগণের মধ্যে এক ধরণের অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠে। অবশেষে জনগণ এমন একবিদ্রোহ করে যে তারা রাজপ্রসাদ ঘীরে ফেলে এবং সুলতানের অনেক প্রহরীকে হত্যা করে সুলতান আহমেদ মসজিদের আশে পাশের গাছ সমূহতে তাদের লাশ গুলোকে টানিয়ে রাখে। দুঃখজনক ভাবে এই সময়ে উসমানী নৌবাহিনী ভেনেডিয়ানদের হাতে পরাজিত হয় এবং এই পরাজয়ের ফলে সমগ্র এজিয়ান সাগরের কর্তৃত্ব তাদের হাতে চলে যায়। ভেনেডিয়ান নৌবাহিনী এতটাই অগ্রসর হয়ে যায় যে, জনগণের মনে এই আশঙ্কা জন্মে যে ভেনেডিয়ানরা হয়তবা ইস্তানবুলও আক্রমন করে বসতে পারে। রাষ্ট্র যখন এইরকম অস্তিত্বের সংকটে উপনীত সুলতান চতুর্থ মুরাদ তখনও আমোদ প্রমোদে লিপ্ত ছিলেন। 
উসমানী রাষ্ট্রকে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সদরে আজম মেহমেদ পাশাকে পদচ্যুত করে খপরুলু মেহমেদ পাশাকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়।

খপরুলু মেহমেদ পাশার সময়কালঃ খপরুলু মেহমেদ পাশার সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সুলতান চতুর্থ মুরাদের চেয়ে খপরুলু পরিবারের আধিপত্য বেড়ে যায়। সুলতান চতুর্থ মেহমেদের শাসন কালের প্রথম দিকে ভেনেডিয়ানরা চানাক্কালে প্রণালী পর্যন্ত চলে আসে এবং সেখানে উসমানী নৌবাহিনীকে পরাজিত করে চানাক্কালে প্রণালীকে বন্ধ করে দেয়। যা উসমানী রাষ্ট্রকে খুবই বিপদজনক একটি পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। পরবর্তীতে খপরুলু মেহমেদ পাশা সদরে আজমের দায়িত্ব ভার গ্রহন করলে তার বিচক্ষনতায় উসমানী রাষ্ট্র তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতে সক্ষম হয়। 

উসমানী রাষ্ট্র যখন খুবই নাজুক অবস্থায় উপনীত তখন সুলতান চতুর্থ মুরাদের বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। রাষ্ট্রকে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ করার জন্য তার মা ৭৫ বছর বয়সী খপরুলু মেহমেদ পাশাকে তার রাজপ্রসাদে ডেকে পাঠান এবং তাকে সদরে আজমের পদ গ্রহন করার জন্য অনুরোধ জানান। তিনিও তার এই প্রস্তাব গ্রহন করেন এবং সদরে আজমের পদ অলঙ্কৃত করেন। খপরুলু মেহমেদ পাশা মূলত আলবেনিয়ান বংশোদ্ভূত ছিলেন। তিনি উসমানী রাষ্ট্রের অন্তর্গত আমাসিয়া অঞ্চলে জন্মগ্রহন করেন। মেহমেদ পাশার সকল সফলতার মূল উদ্দেশ্য ছিল তার জীবনের বাঁকে বাঁকে ঘটে যাওয়া বাস্তব অভিজ্ঞতা সমূহ। তাছাড়া পুথিগত বিদ্যায় তিনি খুব বেশী পণ্ডিত ছিলেন না, কিন্তু তিনি ছিলেন খুবই অভিজ্ঞ একজন মানুষ।

খপরুলু মেহমেদ পাশা দায়িত্ত্ব গ্রহন করেই অনেক সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হোন। তার সকল সফলতার মধ্যে দুটি বিষয়ে তার সফলতা ছিল খুবই বড় এবং গুরুত্ত্বপূর্ণ। সেগুলো ছিল

১। দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রের কাজীগন (বিচারকগন) বিচার বিভাগকে তাদের মন মত ব্যাবহার করছিলেন। বিচারক গন যেন আদালত থেকে ন্যায় বিচারকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু খপরুলু মেহমেদ পাশা সদরে আজম হয়েই আগে বিচার বিভাগে ন্যায়বিচার ফিরিয়ে আনেন এবং পুরাতন বিচারকদের মধ্যে কাউকে জেলে পুরে, কাউকে নির্বাসনে পাঠিয়ে আবার কাউকে গুরুত্ত্বহীন করে বিচার বিভাবে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন।

২। পান থেকে চুন খসলেই যে সকল সিপাহী বিদ্রোহ করত তিনি তাদেরকে খুব শক্ত ভাবে দমন করেন এবং তাদের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব কায়েম করেন।

খপরুলু মেহমেদ পাশা রাষ্ট্রের মধ্যে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করার পর অবরুদ্ধ চানাক্কালে প্রণালীকে মুক্ত করার জন্য পরিকল্পনা করেন এবং সেখানে নৌবাহিনী প্রেরণ করেন। শুধু তাই নয় তিনি ৭৫ বছর বয়স্ক একজন মানুষ হওয়ার পরেও নিজেই যুদ্ধক্ষেত্রে যান। এই যুদ্ধে ভেনেডিয়ানরা পরাজয় বরণ করে এবং চানাক্কালে প্রণালী খুলে দিতে বাধ্য হয়। এই ভাবে তিনি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলা একটি নৌবাহিনীর মধ্যে পুনরায় আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হোন। যুদ্ধের সময়ে যে সকল সেনাপতি অলসতা কিংবা দুর্বলতা দেখান তিনি তাদেরকে চিহ্নিত করে শাস্তি দিতেও কোন প্রকার কুণ্ঠাবোধ করেননি। এই সকল কাজ করার সময়েও তিনি চানাক্কালে প্রণালীকে তার পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য ভেনেডিয়ানদের বিরুদ্ধে নৌবাহিনী প্রেরণ অব্যাহত রাখেন তাদেরকে এজিয়ান সাগর থেকে সম্পূর্ণ ভাবে উৎখাত করে এজিয়ান সাগর এবং চানাক্কালে প্রনালীর উপরে পূর্বের মত পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করেন। খপরুলু মেহমেদ পাশা এই সকল কাজ করেই ক্ষান্ত থাকেননি। ইউরোপ মহাদেশের উসমানী রাষ্ট্র শাসিত অঞ্চলে সমূহতে শাসন ব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করার জন্য সেখানে নতুন নতুন দুর্গ স্থাপন করেন এবং সেই সকল অঞ্চলেও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। তিনি ইউরোপের বিভিন্ন গুরুত্ত্বপূর্ণ অঞ্চল দখল করে যখন সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন তখন খবর পান যে এনাতোলিয়া অঞ্চলে আবাযা হাসান পাশা বিদ্রোহ করেছে। তিনি তার এই বিদ্রোহের খবর পেয়ে ইস্তানবুলে ফিরে আসার সিধান্ত নিতে বাধ্য হোন। 

ইস্তানবুলে ফিরে আসার সময়ে এদিরনে পৌঁছে সেখানে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বয়স্ক হওয়ার পরেও এই মহান রাষ্ট্রনায়ক উসমানী রাষ্ট্রের অনেক খেদমত করেন এবং মাত্র পাঁচ বছরের শাসনামলে উসমানী রাষ্ট্রকে পুনরায় পরাশক্তিতে পরিনত করতে সক্ষম হোন। এরপর তিনি তার দায়িত্ত্বকে তার পুত্র ফাযিল আহমেদের কাছে হস্তান্তর করে ১৬৬১ সালে ইস্তানবুলে আসার পথে এদিরনেতেই মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি সুলতান চতুর্থ মেহমেদকে ওসিয়ত করে যান যে, তিনি যেন রাজপ্রাসাদে বসে না থাকেন এবং অনেক ধনী কাউকে উজির নিয়োগ না দেন। তার এই ওসিয়ত শোনার পর সুলতান তার কাছে উজির নিয়োগের ব্যাপারে পরামর্শ চান। তিনি এই ক্ষেত্রে তার পুত্রের চেয়ে অধিক যোগ্যতা সম্পন্ন আর কেউ নাই বলে উত্তর দেন।

খপরুলু মেহমেদ পাশার মৃত্যুর পর সুলতান চতুর্থ মুরাদ তার ওসিয়ত মোতাবেক তার পুত্র ফাজিল মেহমেদ পাশাকে সদরে আজম হিসাবে নিয়োগ দেন। ফাজিল মেহমেদ পাশা যখন সদরে আজম হোন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর। ফাজিল আহমেদ পাশা মাদ্রাসা শিক্ষিত একজন জ্ঞানী ব্যক্তিত্ত্ব ছিলেন। তার সততা এবং যোগ্যতার সাথে জ্ঞান একিভূত হওয়ার কারণে তিনি রাষ্ট্রপরিচালনায় সফলতার ক্ষেত্রে তার পিতাকে ছাড়িয়ে যান। প্রশাসন, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং প্রতিরক্ষায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করতে সক্ষম হোন। 

১৬৬২ সালে উসমানী রাষ্ট্র অষ্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধে সদরে আজম ফাজিল আহমেদ পাশাকে সেনাপতি করা হয়। সুলতান চতুর্থ মেহমেদ তার এই বাহিনীকে এদিরনে পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যান এবং উসমানী বাহিনী হাঙ্গেরী অভিমুখে যাত্রা শুরু করতে বলেন। সদরে আজম ফাজিল মেহমেদ পাশা তার বাহিনী নিয়ে বেলগার্ডে পৌঁছালে অষ্ট্রিয়ার দূত তার সাথে দেখা করতে আসেন। অষ্ট্রিয়ার দূত উসমানীদের প্রস্তাবকে গ্রহন না করে ফিরে গেলে সদরে আজম ফাজিল আহমেদ পাশা তার বাহিনী নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে থাকেন। ইউরোপের অনেক অঞ্চলকে বিজয় করে উসমানী বাহিনী এস্টারগনকে পৌঁছেন এবং একই সাথে তারা ৮০,০০০ এরও বেশী ইউরোপীয়ানকে বন্দী করেন। অষ্ট্রিয়া পুনরায় দূত পাঠিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দিলে সদরে আজম ফাজিল মেহমেদ পাশা শর্তারোপ করেন যে, যদি তারা কানুনী সুলতান সুলেয়মানের সময়ের দেওয়া শর্ত সমূহ মেনে নেন তাহলে তিনি তাদের সাথে আলোচনা করতে প্রস্তুত।

কিন্তু অষ্ট্রিয়া এই প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তিনি তার অভিযান অব্যাহত রাখেন। বুদিনে পৌঁছার পর পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করার জন্য তিনি তার সেনাপতিদেরকে নিয়ে বৈঠকে বসেন এবং পরামর্শ করে উয়ভার দুর্গ বিজয় করার সিধান্ত নেন। এর পর তারা বুদিন থেকে উয়ভারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন এবং সেখানে পৌঁছে উয়ভার দুর্গ অবরোধ করে রাখেন। দীর্ঘ ৩৮ দিন যুদ্ধের পর তারা উয়ভার দুর্গ বিজয় করতে সক্ষম হোন। বিজয়ী অঞ্চল সমূহকে পরিচালনা করার জন্য তিনি নতুন নতুন শাসক নিয়োগ করেন। এর পর শীতকাল শুরু হলে তিনি তার সেনাবাহিনী নিয়ে বেলগার্ডে ফিরে আসেন। বেলগার্ডে ফিরে আসার পর খবর পান যে, অষ্ট্রিয়ানরা কানিজে দুর্গ পুনরায় দখল করে নিয়েছে।

এই খবর পাওয়ার সাথে সাথেই তিনি পুনরায় তার সেনাবাহিনী নিয়ে সেখানে পাল্টা আক্রমন করে কানিজে দুর্গ পুনঃরোদ্ধার করেন এবং অনেক অঞ্চল দখল করে নেন। উসমানী বাহিনী যখন রাব (Raab River) নদীর তীরে পৌঁছেন তখন নদীর অপর পাশে অষ্ট্রিয়ান সৈন্যরা অবস্থান করছিল। এর পর সদরে আজম ফাজিল মেহমেদ পাশা সেখানে একটু সেতু তৈরির নির্দেশ দেন এবং সেতু তৈরি করার পর ১০,০০০ সৈন্যকে অপরপাশে গিয়ে অষ্ট্রিয়ানদের উপরে হামলা করতে বলেন। ১০,০০০ উসমানী সৈন্য নদী পার হয়ে অপর পাশে গেলে অষ্ট্রিয়ানদের সাথে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলে উসমানীদের তৈরি করা সেতু ভেঙ্গে যায় এবং তারা তাদের অপর পাশে যুদ্ধরত সৈন্যদেরকে সাহায্যকারী সৈন্য পাঠাতে ব্যর্থ হয়। এই কারণে সেখানে হাজার হাজার উসমানী সৈন্য শাহাদাত বরণ করে। এই যুদ্ধের পরে ১৬৬৪ সালে উসমানী রাষ্ট্র এবং অষ্ট্রিয়ানদের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি হয় এই চুক্তির শর্ত সমূহের বেশীর ভাগই ছিল উসমানী খিলাফাতের পক্ষে।

গিরিত সমস্যা এবং অন্যান্য ঘটনাবলীঃ 
গিরিত দ্বীপের সমস্যা যেন শেষই হচ্ছিল না। তাই এই সমস্যার সমাধানের জন্য সদরে আজম ফাজিল আহমেদ পাশা সেখানে অভিযান চালান এবং দীর্ঘ দুই বছর পর্যন্ত অবরোধ করে রাখেন। এই দীর্ঘ অবরোধ এবং যুদ্ধের পর ভেনেডিয়ানরা ১৬৬৯ সালে প্রথমে কান্ডিয়ে দুর্গ এবং পরবর্তীতে গিরিত দুর্গকে উসমানী বাহিনীর কাছে সমর্পণ করে। এই দীর্ঘ অবরোধ এবং যুদ্ধে ৩০,০০০ বেশী উসমানী সৈন্য মৃত্যু বরণ করে। 
১৬৭০ সালে আরও দুটি গুরত্ত্ব পূর্ণ ঘটনা সংগঠিত হয় এগুলো হল পানশালা (মদ পানের জায়গা) কে বিলুপ্ত করা হয় এবং মদকে নিষিদ্ধ করা হয়। 

১৬৭২ সালে লিথুনিয়ায় অভিযান পরিচালনা করা হয় এবং এই অভিযানে উসমানী রাষ্ট্র বড় বিজয় লাভ করতে সক্ষম হয়। লেহিস্তান বাৎসরিক ২২০,০০০ স্বর্ণমুদ্রা দিতে কর দিতে রাজি হলে উসমানী রাষ্ট্র তাদের সাথে একটি সন্ধিচুক্তি করতে সম্মত হয়। কিন্তু পোলিশরা এক বছর পার হওয়ার পর এই কর দিতে অস্বীকার করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে উসমানী রাষ্ট্র লিথুনিয়াতে পুনরায় অভিযান পরিচালনা করে কিন্তু কোন প্রকার ফলাফল বয়ে আনতে সক্ষম হননি। এর পর ১৬৭২ সালে পুনরায় কমানিচে দুর্গকে অবরোধ করে এবং অনেক প্রচেষ্টার পর এই দুর্গকে বিজয় করতে সক্ষম হয়। এর পরবর্তী বছর গুলোতে অর্থাৎ ১৬৭৫ এবং ১৬৭৭ সালে পরিচালিত অভিযান সমূহে অনেক সফলতার স্বাক্ষর রাখে এবং অনেক গুরত্ত্বপূর্ণ স্থান বিজয় করতে সক্ষম হয়। 
সদরে আজম ফাজিল আহমেদ পাশা একজন পণ্ডিত আলেম ছিলেন। তিনি আলেম উলামা এবং জ্ঞান অর্জনকে খুবই সম্মানের চোখে দেখতেন। তিনি রক্তপাত করাকে পছন্দ করতেন না। তিনি ছিলেন্ন একজন ন্যায়পরায়ন মানুষ, কোন প্রকার অন্যায় অবিচার কে তিনি প্রশ্রয় দিতেন না। তিনি ১৬৭৬ সালে একটি অভিযান থেকে এদিরনে ফিরে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে অসুস্থ হয়ে ৪২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

সদরে আজম কারা মুস্তাফা পাশার সময়কালঃ 
ফাজিল আহমেদ পাশার মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত হন তার ভগ্নিপতি কারা মুস্তাফা পাশা অর্থাৎ কপরুলু মেহমেদ পাশার জামাতা । 
কারা মুস্তাফা পাশার পিতা বাগদাদ অভিযানে মৃত্যু বরণ করলে কপরুলু মেহমেদ পাশা তাকে তার পালক পুত্র হিসাবে গ্রহন করেন এবং তাকে ভালোভাবে পড়াশুনা করিয়ে অনেক যোগ্য করে গড়ে তুলেন। পরবর্তীতে তিনি ইস্তানবুলের গভর্নর পদে আসীন হলে কপরুলু মেহমেদ পাশা কারা মুস্তাফা পাশার কাছে তার মেয়েকে বিয়ে দেন। 

এই সময়ে রাশিয়া উসমানী রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কিছু দুর্গকে দখল করে নেয়। এই সকল দুর্গকে পুনঃরোদ্ধার করার জন্য উসমানী রাষ্ট্র অভিযান পরিচালনার সিধান্ত নেয়। ১৬৭৮ সালে উসমানী বাহিনী সদরে আজম কারা মুস্তাফা পাশার নেতৃত্বে ইস্তানবুল থেকে যাত্রা শুরু করে। সুলতান চতুর্থ মেহমেদ নিজেও তাদের সাথে সিলিত্রে পর্যন্ত আসেন। এই অভিযানে তারা তাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে পারলেও অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। এই যুদ্ধে অনেক উসমানী সৈন্য শাহাদাত বরণ করে। অনেক ঐতিহাসিকগন বলে থাকেন যে, এই অভিযান পরিচালনা করার খুব বেশী দরকার ছিল না। মূলত সদরে আজম কারা মুস্তাফা পাশার অতি উৎসাহের কারণেই এই অভিযান পরিচালিত হয়। 

অষ্ট্রিয়া অভিযান এবং ২য় ভিয়েনা অবরোধঃ
কারা মুস্তাফা পাশা তার শ্যালক ফাজিল আহমেদ পাশার পাশাপাশি বড় হলেও এবং রাষ্ট্রীয় অভিজ্ঞতা থাকার পরেও তিনি তার মত এত বেশী যোগ্য ছিলেন না। তিনি ছিলেন উচ্চাকাংখী এবং কঠোর প্রকৃতির যারা ফলে তার সিধান্ত সমূহ খুব বেশী পরিপক্ক ছিল না। তিনি রাষ্ট্রীয় দূত এবং কর্মচারীদের সাথে কঠোর আচরনের ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে উসমানী রাষ্ট্র অনেক বড় বড় সমস্যার সম্মুখীন হয়। 

শুরা মজলিসে সকল রাজনৈতিক শিষ্টাচার পরিহার করে সকলের সামনে ফ্রান্সের রাজা XIV লুইসের দূতকে গালিগালাজ করে রাজপ্রসাদ থেকে বের করে দেন। একই ভাবে পোল্যান্ড এবং তাতারদের মধ্যকার সমস্যাকে সমাধান করার জন্য পোল্যান্ডের দূত অনেক উপঢৌকোন নিয়ে তার সাথে দেখা করতে আসেন। পোল্যান্ডের দূতের সাথে তিনি আরও খারাপ ব্যাবহার করেন। এই আচরন পোল্যান্ড ও উসমানী রাষ্ট্রের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি করে। ভিয়ানা অবরোধের সময়ে পোলিশরা অষ্ট্রিয়ানদের পক্ষাবলম্বন করার পেছনে এটি ছিল একটি বড় কারণ। কারা মুস্তাফা পাশা তার পূর্ববর্তী দুই সদরে আজমের রাজনীতিকে সামনে অগ্রসর করা তো দূরে থাক তিনি তাদের ধারে কাছেও ছিলেন না। তার রাজনৈতিক অপরিপক্কতা ও অদক্ষতা উসমানী রাষ্ট্রের সকল শত্রুকে একমঞ্চে একত্রিত হতে সাহায্য করে। 

এই সময়ে অষ্ট্রিয়া হাঙ্গেরীতে আক্রমন করে এবং হাঙ্গেরীকে দখল করে নেয়। অষ্ট্রিয়ান রা ছিল ক্যাথলিক খ্রিস্টান তাই প্রটেস্টান জার্মানের সাথে তাদের সব সময় দ্বন্দ লেগেই থাকত। অষ্ট্রিয়ার এই রাজনীতি অষ্ট্রিয়াকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বন্ধুহীন রাষ্ট্রে পরিণত করে। অষ্ট্রিয়ার এই ধর্মান্ধ রাজনীতির কারণে হাঙ্গেরীয়ানরা উসমানীদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং উসমানী রাষ্ট্রকে তাদের জন্য ত্রানকর্তা ভাবতে থাকে। 

হাঙ্গেরীয়ান এবং উসমানী বাহিনী ঐক্যবদ্ধ হয়ে অষ্ট্রিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং খুব সহজেই তাদেরকে পরাজিত করে অষ্ট্রিয়া থেকে বিদায় কর। সেই অঞ্চলে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করাই ছিল উসমানীদের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। কিন্তু উসমানী রাষ্ট্র হাঙ্গেরীয়ান রাজা তকেলীর পক্ষ নিয়ে অষ্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কারা মুস্তাফা পাশার এই সিধান্ত নেওয়ার মূল কারন ছিল ফ্রান্সের সাথে তখন অষ্ট্রিয়ার কোন সম্পর্ক ছিল না এবং হাঙ্গেরীও তাদের বিরুদ্ধে যাওয়ায় এর থেকে সুবিধা নেওয়া। 

উসমানী রাষ্ট্রের সাথে অষ্ট্রিয়ার দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে সমস্যা চলে আসছিল এবং উসমানী রাষ্ট্রকে এই দীর্ঘ সময়ে তারা বিভিন্ন ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে। এই সকল কারণে অষ্ট্রিয়ার কাছ থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ১৬৮২ সালে উসমানী রাষ্ট্র অষ্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে।কারা মুস্তাফা পাশা এই অভিযানকে মূলত উসমানী রাষ্ট্রের শক্তিমত্তা প্রদর্শন জন্য একটি সুযোগ হিসাবে বিবেচনা করেন। কিন্তু তার এই উচ্চাকাংখা পূর্ণতো হয়নি বরং এই অভিযানে উসমানী রাষ্ট্র অনেক ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। যদিও সুলতান চতুর্থ মেহমেদ এই অভিযান পরিচালনার বিপক্ষে ছিলেন কিন্তু সদরে আজমের উচ্চাকাংখাই এই অভিযান পরিচালনা করতে উৎসাহিত করে। 

উসমানী রাষ্ট্র তার অভিযান পরিচালনার প্রাক্কালে অষ্ট্রিয়ান রাজা লিওপল্ড উসমানী রাষ্ট্রের প্রতিনিধি সদরে আজম কারা মুস্তাফার নিকটে দূত প্রেরণ করে শান্তির প্রস্তাব দেয় এবং এই অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে উসমানী রাষ্ট্রের যত ক্ষতি হয়েছে তার সকল ক্ষতিপূরণ দিতেও রাজি হয়। কিন্তু সদরে আজম কারা মুস্তাফা পাশা তার উচ্চাকাংখাকে পরিত্যাগ না করে ভিয়েনা আক্রমণের দিকে জোর দেন এবং ভিয়েনার দিকে যাত্রা করেন। এছাড়াও অষ্ট্রিয়ান দূতগন ইস্তানবুলে এসে শাইখুল ইসলামের নিকট ফতওয়া চান যে, আত্ম সমর্পণ করার পরেও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা জায়েজ হবে কিনা? শাইখুল ইসলাম জবাবে বলেন যে, না জায়েজ হবে না। অষ্ট্রিয়ানরা এই ফতওয়াও সদরে আজমকে জানিয়ে দেন। কিন্তু তিনি কারোর কথাই না শুনে অভিযান পরিচালনা করার সিধান্তে অটল থাকেন। 

এখন পাঠকদের মনে একটি প্রশ্ন জাগতে পারে যে, সদরে আজম যখন এমন সেচ্ছাচারিতা করছিলেন তখন সুলতান কেন তার উপর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি? কিংবা সদরে আজম যা বলতেন সুলতান কেন তাই শুনতেন? এর জবাব হিসাবে বলা যায় যে, সুলতান সবসময় তার শিকার নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তিনি রাষ্ট্রের কোন কর্মকাণ্ড সম্পর্কেই খুব বেশী অবহিত ছিলেন না। যার ফলে সমগ্র রাষ্ট্র পরিচালনা এবং সিধান্ত নিতেন সদরে আজম। ফলশ্রুতিতে সদরে আজম যা বলতেন সুলতান তাই মেনে নিতেন। 
এই ভাবে সুলতান চতুর্থ মেহমেদ সেনাবাহিনীর সাথে এদিরনে থেকে বেলগার্ড পর্যন্ত আসেন। হাঙ্গেরীয়ান রাজাও সুলতানকে শ্রদ্ধা ও ভক্তি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উপঢৌকন নিয়ে সুলতানের সাথে বেলগার্ড থেকে তিনি ইস্তানবুলে ফিরে গেলে সদরে আজম সৈন্যবাহিনী নিয়ে অষ্ট্রিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। 

সুলতান চতুর্থ মুরাদ সহ সকলেই জানতেন যে, অষ্ট্রিয়া সিমান্তে উসমানী অধ্যুষিত অঞ্চলে উসমানীদের আধিপত্যকে শক্তিশালী করার জন্যই মূলত এই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। সদরে আজম কারা মুস্তাফা পাশাই কেবলমাত্র তার গোপন উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। সেনাবাহিনীও এই লক্ষ্যকেই সামনে রেখে উসমানী খিলাফাতের পতাকা নিয়ে বেলগার্ড থেকে তুনার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। এদিকে হাঙ্গেরীর সুলতান তকেলি ঐ অঞ্চল সম্পর্কে ভালো জানার কারণে উসমানী বাহিনীর পথপ্রদর্শকের দায়িত্ত্ব পালন করার পাশাপাশি সদরে আজম কারা মুস্তাফা পাশার উপদেষ্টার দায়িত্ত্বও পালন করতে থাকেন। কারা মুস্তাফা পাশা তারা সেনাবাহিনী নিয়ে রাব (Raab) নদীর কিনারায় পৌঁছালে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করার জন্য সেনাপতিদেরকে নিয়ে একটি পরামর্শ সভার আয়োজন করেন। এই পরামর্শ সভায় দক্ষ প্রশাসক,রাশিয়া ও পোল্যান্ডকে পরাজিতকারী বিখ্যাত সেনাপতি এবং বুদিনের তৎকালীন গভর্নর উজুন মুস্তাফা পাশাও উপস্থিত ছিলেন।

এই সভায় তিনি পরামর্শ দেন যে, আমাদের পেছনে এখনো অনেক অঞ্চল রয়েছে যা আমরা বিজয় করতে সক্ষম হয়নি তাই ভিয়েনা আক্রমন করার পূর্বে আমাদের উচিত হবে ঐ সকল অঞ্চল বিজয় করা এবং আমরা এখন যেখানে অবস্থান করছি এর আশেপাশের অঞ্চল সমূহকেও বিজয় করে নেওয়া। আমরা যদি এই সকল অঞ্চল সমূহকে আগে বিজয় করতে পারি তাহলে আমদের জন্য কৌশলগত দিক হতে অনেক বেশী ভালো হবে। ক্রাইমিয়ার গভর্নর মুরাদ গিরায়ও উজুন ইব্রাহীম পাশার মতকে সমর্থন করে বক্তব্য দিয়ে বলেন আমার মনে হয় এই সময়ে ভিয়েনা আক্রমন করা উচিত হবে না। বরং আমরা যদি আগে অষ্ট্রিয়ার অধিভুক্ত ছোট ছোট দুর্গ সমূহকে দখল করে নেই তাহলে কৌশলগত দিক থেকে আমরা অনেক এগিয়ে থাকব এবং শীতকালটা এখানে কাটিয়ে সেই সময়ের মধ্যে আমরা ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে যদি ভিয়েনা আক্রমন করি তাহলে সেটা আরও ভালো হবে। কিন্তু কারা মুস্তাফা পাশা তাদের পরামর্শ শোনা তো দূরে থাক তিনি আরও তাদেরকে সকলের সামনে অপমান করেন। ইব্রাহীম পাশার বয়স ছিল তখন ৮০ বছর। উসমানী রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য তার ত্যাগ ও অবদান ছিল অনস্বীকার্য। তার এই সকল অবদান এবং বয়সের কথা ভুলে গিয়ে কারা মুস্তাফা পাশা তাকে বলেন, “ আপনি একদমই ফালতু কথা বলতেছেন!এই বয়সে আপনি তো কিছুই করতে সক্ষম নন! তাই আমি চিন্তা করেছি আপনি সেনাবাহিনীর সবচেয়ে পেছনে থাকবেন এবং এদের জন্য খাবার দাবারের ব্যবস্থা করবেন!!” সকলের সামনে তিনি এমন কথা বলে তাকে অপমানিত করেন। 

অথচ সদরে আজম কারা মুস্তাফা পাশার উচিত ছিল তাদেরকে সম্মান করে কথা বলা, তাদের উপদেশ সমূহ মনোযোগের সাথে শুনে পছন্দ না হলেও তারা কষ্ট পান এমন কোন কথা তাদেরকে না বলা। এদের ছাড়াও সিরিয়ার গভর্নর হুসেইন পাশাও তাকে একই উপদেশ দেন। তিনি তার কথারও কোন ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের সিধান্তের উপর অটল থাকেন। 

এইভাবে এই পরামর্শ সভায় যারাই তার মতের বিরুদ্ধাচারণ করেছিলেন তাদের সকলের সাথে তিনি এমন আচরণ করেন যে, যেন তারা তার শত্রু। এইভাবে পরামর্শ সভা শেষ করার পর কারা মুস্তাফা পাশা ভিয়েনা অবরোধ করার সিধান্ত ঘোষনা করেন। তার এই সিধন্ত ঘোষণা করার পর তিনি ঘোষণা দেন যে, তিনি আর কারোর কোন কথা শুনবেন না এবং যারাই তার এই মতের বিরোধিতা করবে তিনি তারই কাল্লা উড়িয়ে দিবেন!

সদরে আজম কারা মুস্তাফার পাশার নেতৃত্বে উসমানী বাহিনী অত্যন্ত দাপড়ের সাথে রাব নদী পার হয়ে ভিয়েনার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অথচ এদিরনে থেকে যাত্রাকারী উসমানী সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য ভিয়েনা দখল ছিল না। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল অষ্ট্রিয়ান সীমান্তবর্তী অঞ্চলে উসমানী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চল সমূহতে উসমানী রাষ্ট্রের আধিপত্যকে বৃদ্ধি করা।

কারা মুস্তাফা পাশা যদি ইসলামের জন্যই এই অভিযান পরিচালনা করে থাকেন, তাহলে আমরা বলব তার এই অভিযান কোনক্রমেই ইসলাম সম্মত ছিল না। কেননা তিনি ইসলামের যুদ্ধনীতির কোন কিছুই অনুসরণ না করে একান্ত নিজের বাসনা পূর্ণ করার জন্য এই অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। তাই এটা সকলেই জানতেন যে এই অভিযানে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন প্রকার সাহায্য আসবে না। এক সময়ে যে বাহিনী সমগ্র পৃথিবীকে আখলাক এবং মানবতা শিখিয়েছিল অথচ সেই সেনাবাহিনী ভিয়েনা আক্রমনের সময় এমন কাজ করেছিল যা ইসলাম কোন ভাবেই সমর্থন করে না! এ যেন উসমানী সেনাবাহিনী নয় অন্য এক বাহিনী! একটি উৎসে এই ভাবে বলা হয়েছে;

“ অসৎ একজন সেনাপতির অধীনে উসমানী সেনাবাহিনীর ছোট্ট একটি অংশ ভিয়েনা দুর্গ থেকে দূরে একটি অঞ্চলে আক্রমন করে। কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধ করার পর তাদের মধ্য থেকে একজন বের হয়ে বলে যে আমি এই বাহিনীর নেতা। এই কথা বলে সে তাদের সাথে একটি প্রতারনা মূলক আচরণ করে। সেই সৈন্য ভিয়েনার ঐ সকল যুদ্ধরত সৈন্যদেরকে বলে যে, “ তোমরা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ কর। যদি তোমরা আত্মসমর্পণ কর তাহলে আমরা তোমাদের হত্যা করব না”। ভিয়েনার সৈন্যগনও তাদের এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। এই সময় উসমানী সৈন্যরা নির্দেশ দেয় যে, “ তাহলে এখন তোমরা তোমাদের সকল অস্র শস্র আমাদের কাছে জমা দাও আমরা নাম লিখে তোমাদেরকে সদরে আজমের কাছে নিয়ে যাব”। ভিয়েনার সৈন্যরাও তাদের কথামত সকল অস্রশস্র জমা দিয়ে একজন একজন করে বের হয়ে আসতে থাকে। এর ১৫০ জন ভিয়েনা সৈন্যর নাম লিস্ট করা হয়। এইভাবে তারা যখন তাদের অস্র সমর্পণ করে একদম নিরস্র হয়ে যায় তখন এই সকল অসৎ উসমানী সৈন্য ইসলামের যুদ্ধনীতিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে তাদের সকলকেই হত্যা করে। এর পর তারা সেই গ্রামে আক্রমন করে তাদের সমস্ত সম্পদ লুট করে নিয়ে আসে”!!

ইসলামী নীতি নৈতিকতা বিরোধী তাদের এই আচরণ ঐ অঞ্চলে ইসলাম বিদ্বেষ বাড়িয়ে দেয় এবং ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের মনে বিরূপ ধারনার জন্ম নেয়।
১৬৮৩ সালের ১২ জুলাই ভিয়েনা অবরোধ শুরু হলে অষ্ট্রিয়ার রাজা লিওপল্ড তার পরিবার পরিজন নিয়ে শহর ত্যাগ করে। যেকোন সময় এমন একটি আক্রমন হতে পারে এই কথা জেনে অষ্ট্রিয়ানরা তাদের দুর্গের সকল দরজা বন্ধ করে দেয়। দুর্গের ভেতরে তাদের প্রয়োজনীয় সকল কিছুই ছিল। দুর্গের ভেতরে চলে যাওয়ার পূর্বে তারা দুর্গের বাহিরে সমগ্র অঞ্চলকে জ্বালিয়ে দেয়। তাদের এই আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল উসমানীদেরকে একথা জানিয়ে দেওয়া যে, আমরা আমাদেরকে রক্ষা করার জন্য আমাদের সব কিছু দিয়েও তোমাদের বিরুদ্ধে লড়তে প্রস্তুত। 

উসমানী সেনাবাহিনী অর্ধা চন্দ্রাতিকার হয়ে সমগ্র শহরকে অবরোধ করে। তারা দুর্গের দেওয়ালকে ভাঙ্গার জন্য উপুরযপুরি গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে।এই অবরোধের সময় উসমানী রাষ্ট্রের অধিকাংশ বড় বড় শহরের গভর্নর বৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। 
এই সময়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশ সমূহ খবর পেয়ে যায় যে, উসমানী রাষ্ট্র ভিয়েনার উপর আক্রমণ করেছে। এই খবর পেয়ে পোপ ষষ্ঠ ইন্নোসেন্ট ভিয়েনাকে রক্ষা করার জন্য সকলকে আহ্বান জানান। তার এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইউরোপীয়ানরা ভিয়েনাকে মুক্ত করার জন্য খুব দ্রুত যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে। 

উসমানী বাহিনী দীর্ঘ দুই মাস ধরে অবরোধ করে দুর্গের উপরে আক্রমণ চালাতে থাকে। তাদের এই আক্রমনে দুর্গের দেওয়াল ব্যাপক ভাবে ক্ষতি গ্রস্ত হয়। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হল প্রধান সেনাপতি সদরে আজম কারা মুস্তাফা পাশা তখনও সর্বাত্মক কোন আক্রমণের নির্দেশ দিচ্ছলেন না। তিনি তখনও শহরবাসীর আত্মসমর্পণের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তার এই সময় ক্ষেপণের কারণ ছিল দুর্গকে সম্পূর্ণ ভাবে ধ্বংস না করে রক্তপাত বিহীন একটি বিজয় অর্জন করা। এই ভাবে অযথা সময় ক্ষেপণের ফলে সেনাবাহীনির মনোবল ভেঙ্গে যে

পঠিত : ১১৭৮৬ বার

মন্তব্য: ০