Alapon

শান্তি ও ভালোবাসার বার্তা

নিউজিল্যান্ডের ইন্সিডেন্টের পর নিউজিল্যান্ডারদের অসাধারণ প্রতিক্রিয়া আমাদের সুন্দর বার্তা দিয়েছে। সারা পৃথিবীর শত পৈশাচিকতা আর অন্যায়ের পরও এই সুন্দর পৃথিবীটা যে অসংখ্য সুন্দর হৃদয়ের মানুষের বাসভূমি- তা আবারও প্রতীয়মাণ হয়েছে। সকল ধর্মীয় আর রাজনৈতিক মতপার্থক্য ব্যতিরেকেও যে কিছু কমন মূল্যবোধের অধিনে থেকে সুন্দরভাবে একসাথে থাকা যায়- তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে।

বুঝ হওয়ার পর থেকেই চারপাশে এতএত ঘৃণার চাষ হতে দেখেছি- অনেকসময় হৃদয়টা নিজের অজান্তের বারবার ভয়ে কুকড়ে গেছে। নাইন ইলাভেনের পর থেকে সারা পৃথিবীতে ইসলাম বিদ্বেষের প্রচার যেভাবে হয়েছে, যেভাবে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে অসংখ্য সিভিলিয়ানকে হত্যা করা হয়েছে, আর তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে কিছু মুসলিমদের মধ্যে যেভাবে উগ্রপন্থা জন্ম নিয়েছে- তাতে আমাদের হৃদয় ভেঙেছে বারবার। 

আমাদের দেশে আমরা এক চরম আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগি। আমরা না পুরোপুরি বাঙালি, না পুরোপুরি মুসলিম। দু'টো আইডেন্টিটি নিয়ে যে একসাথে থাকা যায়- এ ধারণাকে আমাদের মহলগুলোতে যেন একপ্রকার নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। মেয়েদের বোরকা পরা বেড়ে যাওয়াতে কিম্বা ছেলেদের দাঁড়ি রাখাতে একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা সাম্প্রদায়িকতার ছাপ দেখতে পায়। অথচ এদেশের সেক্যুলারিজমের তত্ত্বকথা ছিলো- সবার যারযার ধর্ম পালনের অধিকার। এখানে মানুষের ব্যক্তিপছন্দ নিয়ে রাষ্ট্রের মাথাঘামানোর কথা ছিলো না। অথচ রাষ্ট্রীয় ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা কিছু বুদ্ধিজীবী ব্যক্তিগত ইসলাম পালনের স্পেইস দিতেও নারাজ ছিলো। যার ফলশ্রুতিতে এদেশের মানুষ এমন দ্বিচারিতার কারণে সেক্যুলারিজমকে ঠিকভাবে নিজেদের সাথে রিলেইট করতে পারে নি। ফ্যাসিবাদী এবং দূর্নীতিবাজ শাসকশ্রেণির সাথে বরং প্রতিনিয়ত তাদের দূরত্ব বেড়েই চলেছে। এতে করে এদেশের কিছু মানুষের মাথায় সংখ্যালঘু বিদ্বেষ আর সাম্প্রদায়িকতাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

কিছু মানুষ সবকিছুতেই ইহুদী নাসারার ষড়যন্ত্র খুঁজে পান। নিজের মত বা মানহাজের সাথে না মিললে কোনো মুসলিম ক্লেরিককে ইহুদী খ্রিস্টানদের এজেন্ট ট্যাগ দেয়া হয়। এদেশের হিন্দুসম্প্রদায়ের মানুষদের কিছু লোক মালাউন, ডান্ডি- ইত্যাদি অশ্রাব্য নামে ডাকতেও ছাড়ে না। এসব নামের পেছনে কোনোপ্রকার ধর্মীয় অনুপ্রেরণা নেই, বরং সাম্প্রদায়িক ঘৃণা প্রধান চালিকা হিসেবে কাজ করে। যারা এসব গালি এবং বিদ্বেষের চর্চা করে, ধর্মীয় জীবনে এরা মোটেও ধার্মিক নয়। এদেশে সংখ্যালঘু গৃহে অগ্নীসংযোগ এবং সংখ্যালঘু উচ্ছেদের মত লজ্জাজনক ঘটনাও ঘটেছে। অথচ যারা এসব ঘটনা ঘটিয়েছে- তাদের এসব কর্মকাণ্ডের পেছনে ধর্মীয় অনুপ্রেরণা নেই, আছে নোংরা রাজনৈতিক স্বার্থ। এসব বিদ্বেষী আচরণের কারণে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের কাছে ইসলাম সম্পর্কে দুঃখজনকভাবে অত্যন্ত ভুল ম্যাসেজ যাচ্ছে। এসব ন্যাক্কারজনক ঘটনা প্রতিরোধে আমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে।

নিউজিল্যান্ডের ঘটনা দেখিয়েছে কীভাবে একসাথে দু'টো আইডেন্টিটি নিয়েই একটা সমাজে অন্যান্যদের সাথে একসাথে বসবাস করা যায়। বাংলাদেশেও আশাকরি আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সরকারেরা সেক্যুলারিজমের নামে ডাবলস্ট্যান্ডবাজী থেকে বেরিয়ে এসে বরং প্রত্যেকের ধর্মীয় এবং পরিশীলিত মতপ্রকাশের অধিকারকে নিশ্চিত করবে। এদেশের মুসলিমরা তাদের মুসলিম এবং বাংলাদেশি/বাঙালি আইডেন্টিটি নিয়ে একসাথে গর্বের সাথে বাস করবে। আজ যে ভালোবাসা আমরা নিউজিল্যান্ডে পেয়েছি- সে ভালোবাসার বাণী এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্বও আমাদেরই নিতে হবে, যাতে করে তারাও তাদের ধর্মীয় পরিচয় এবং জাতীয় পরিচয় নিয়ে একসাথে গর্বিত নাগরিক হিসেবে বসবাস করতে পারে। 

পরিশেষে একটি কথা, একজন বর্ণবাদ বিরোধী আমেরিকান নেতা বলেছিলেন- "অন্ধকার কখনো অন্ধকারকে দূর করতে পারে না, একমাত্র আলোই তা পারে। ঘৃণা দিয়ে কখনো ঘৃণাকে দূর করা যায় না, একমাত্র ভালোবাসা দিয়েই তা সম্ভব।" আসুন, ভালোবাসা ছড়িয়ে দেই প্রাণ থেকে প্রাণে। পৃথিবী হয়ে উঠুক বাসযোগ্য এবং নিরাপদ।

-- ২২/০৩/১৯

পঠিত : ১৩৪১ বার

মন্তব্য: ০