Alapon

আল্লামা মুসা জারুল্লাহ বিগিয়েফ (রহঃ) জ্ঞান সম্রাট ও সংগ্রামী এক মহানায়ক

মুসা জারুল্লাহ বিগিয়েফ একজন জ্ঞান তাপস, গবেষক ও একজন প্রখ্যাত আলেম। ১৮৭৫ সালে রাশিয়ার দখলাধীন খাজান নামক অঞ্চলে জন্ম গ্রহণ করেন। বংশগত দিক থেকে তিনি একজন তুর্কী। রাশিয়ার বিশেষ করে কাজান অঞ্চলের মুসলমানদের অধিকার আদায়ের জন্য অনেক সংগ্রাম করেন, কিন্তু যখন দেখতে পান যে, কাজানে অবস্থান করে তার পক্ষে আর কোন কিছু করা সম্ভব না তখন তিনি রাশিয়া থেকে চলে যান। জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে তিনি দীর্ঘ সময় সফররত অবস্থায় থাকেন এবং ফিকহ, হাদীস, তাফসীর, ইলমূল কালাম সহ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি ১২০ এর অধিক গ্রন্থ রচনা করেন। আন্দালুসিয়ার প্রখ্যাত আলেম আবু ইসহাক আল-শাতিবীকে এক অর্থে বলতে গেলে তিনিই আবিষ্কার করেন।

শিক্ষাজীবনঃ 
তিনি তার প্রাথমিক শিক্ষা তার মা ফাতেমা খানমের কাছ থেকে লাভ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করার পর তিনি ১১ বছর বয়সে রাশিয়ান টেকনিক সরকারী কলেজে ভর্তি হোন। এই কলেজ থেকে পাশ করার পর তিনি বুখারা তে চলে যান এবং সেখানে আরবী, ফার্সি ও ইসলামী জ্ঞান শিক্ষা করেন। তিনি সেখানে প্রখ্যাত আলেম শরীফ এফেন্দীর কাছ থেকে ম্যাথমেটিক্স (গণিত) ও এস্ট্রোনমির (জ্যোতির্বিদ্যা) পাশাপাশি ওক্লিড, পিথাগোরাস, আর্কিমিডিস, এরিস্টটল, দেকারতে, ব্যাকনের দর্শন পড়েন। বুখারা তে শিক্ষা শেষ করে সেখান থেকে তিনি ইস্তানবুলে আসেন। এবং সেখানে এসে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হোন, কিন্তু তার শিক্ষকদের পরামর্শে তিনি পুনরায় ইসলামী জ্ঞানের দিকে ফিরে যান। এই লক্ষ্যে তিনি সেখান থেকে মিসরে যান এবং আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হোন। কিন্তু কয়েকদিন ক্লাস করার পর তিনি দেখেন যে আল-আজহারে পড়ে আলেম হওয়া সম্ভব নয়, তাই তিনি আল আযহার ছেঁড়ে নিজে নিজে গবেষণা শুরু করেন। মিশরের জাতীয় গ্রন্থাগারে পড়াশুনা করার সময় তিনি মুহাম্মেদ আব্দুহুরর সাথে পরিরচিত হোন এবং তার কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া শুরু করেন এর পর আব্দুহুর ছাত্র রশিদ রিদার সাথে এক সাথে পড়াশুনা ও গবেষণা করেন। মিশর থেকে তিনি হিজাজে যান এবং সেখানে দুই বছর অবস্থান করে সেখান থেকে ভারতে আসেন।

ভারতে এসে দেওবন্দ মাদ্রাসায় ৬ মাস পড়াশুনা করেন এবং পাকিস্তানে গেলে সেখানে বন্দী হয়ে পেশোয়ারের জেলে যান এবং জেলে থাকা অবস্থায় আল্লামা ইকবালের চিন্তা ধারার সাথে পরিচিত হোন এবং আল্লামা ইকবালের দ্বারা প্রভাবিত হোন। পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তি পেয়ে পুনরায় মিসরে যান সেখানে ৩ বছর অবস্থান করার পর সেখান থেকে বৈরুত এবং শামে যান। এই সময়ে তিনি এই সকল জ্ঞানের কেন্দ্র সমূহে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেন। 
১১ বছরের এই দীর্ঘ সফর শেষে ১৯০৪ সালে তিনি একজন প্রাজ্ঞ আলেম হিসেবে নিজ জন্ম ভূমি কাজানে ফিরে যান। তিনি তার এই দীর্ঘ সফর কে এই ভাবে মূল্যায়ন করেন,

‘অনেক আশা নিয়ে মুসলিম বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়েছি। বুখারা, তুর্কী, মিশর, হিজাজ, হিন্দুস্তান এবং শামের বিভন্ন অঞ্চলে ঘোরাফেরা করেছি। সেখানে অবস্থিত সকল মাদারাসায় গিয়েছি কিন্তু খালি হাতে, শুন্য ও ভংগ্ন হৃদয়ে নিজের জন্ম ভুমিতে ফিরে এসেছি’।

সংগ্রামঃ

নিজের জন্ম ভূমি কাজানে ফিরে গিয়ে তিনি সেখানের মানুষকে জাগ্রত করার জন্য পত্রিকা প্রকাশ করেন। কিন্তু রাশিয়ার সরকার তার সেই পত্রিকাকে বন্ধ করে দেয়। পত্রিকা বন্ধ করে দিলেও তিনি বসে থাকেননি, তিনি বসে বসে পাথরের উপরে লিখে ২০ টির মত প্রাচীন মূল্যবান বই পাথরের ছাপ দিয়ে প্রকাশ করেন। এর মধ্যে ইমাম আবু ইসহাক আল শাতিবীর “ আল-মুওয়াফাকাত” অন্যতম। এই বিখ্যাত ও মহামূল্যবান বইটি ১৯৩০ সালে মিশরে প্রকাশ হওয়ার পূর্বে তিনি ১৯১০ কাজানে পাথরে ছাপ দিয়ে সেখানে প্রকাশ করেন। 
এই সকল কাজের পাশপাশি তিনি তার সংগ্রামও অব্যাহত রাখেন।১৯১৪ সালে রাশিয়ান মুসলিম কংগ্রেসের সভায় সভাপতিত্ত্ব করেন এবং মুসলমানদেরকে রাজনৈতিক ভাবে অগ্রসর করার চেষ্টা করেন। এই সময়ে তিনি গ্রেফতার হয়ে জেলে যান। ১৯১৭ সালে তিনি রাশিয়ান মুসলিম কংগ্রেসের সভাপতি হোন এবং বলশেভিক বিপ্লবের পর তিনি রাশিয়ার সংখ্যালঘুদের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করেন।

এই সময়ে রাশিয়ান মুসলিম কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের উপর নির্যাতন শুরু হলে অনেকেই রাশিয়া ছেঁড়ে চলে যান কিন্তু সংগ্রামী আলেম মুসা জারুল্লাহ তার সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন। তিনি মুসলমানদের অধিকারকে তুলে ধরার জন্য ১৯১৮ সালে আল মিনবার নামে একটি সাময়িকী বের করেন কিন্তু খুব বেশী দিন যেতে না যেতেই তার এই সাময়িকী বলশেভিক সরকার নিষিদ্ধ করে দেয়। এই সময়ের মধ্যে তিনি আরও কয়েকটি দেশ সফর করেন ও বিভিন্ন কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেন। ১৯২৭ সালে তিনি হজ্জ পালনের জন্য সৌদি আরবে যান এবং যাওয়ার পথে ইস্তানবুল হয়ে যান এই সময়ে তিনি তার লেখা ‘ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে মুসকিরা’ গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এবং হজ্জ থেকে ফিরে আসার সময়ে কুদুসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় খিলাফত কংগ্রেসে অংশগ্রহন করেন।

সেখান থেকে রাশিয়ার ফিরে গেলে তার উপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়া হলে তিনি ১৯৩০ সালের শেষের দিকে রাশিয়া ফিনল্যান্ডে চলে যান, ফিনল্যান্ডে যাওয়ার সময় তিনি আঙ্কারা হয়ে যান। তবে তিনি ফিনল্যান্ডে খুব বেশী দিন অবস্থান করেননি। ১৯৩৩ সালে তিনি ফিনল্যান্ড থেকে বার্লিনে যান এবং সেখানে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। তার ভাষায়, “ বড় বড় বিপ্লবের তুফানের ফলে যে সকল চিন্তা ও কলম সমূহ শুকিয়ে গেছে সেগুলোকে মানুষের সামনে আনতে চাই” এই কথা বলে তিনি বিখ্যাত গ্রন্থ সমূহকে বার্লিন থেকে ছাপানোর ঘোষণা দেন।

১৯৩৪ সালে তিনি পুনরায় ফিনল্যান্ডে যান এবং সেখান থেকে ইস্তানবুল হয়ে ইরানে যান। ইরানে গিয়ে ‘শিয়া’, হাদীস, ফিকহ উপর গবেষণা করেন। এই সময়ে তিনি মাশহাদ, তাব্রিজ এবং তেহরানে অবস্থান করেন। সেখান থেকে তিনি বাগদাদে এবং বাগদাদে গিয়ে ইমাম আযম আবু হানিফার কবর জিয়ারত করেন। সেখান থেকে ইস্তানবুল হয়ে পুনরায় মিশরে যান। সেখান থেকে তিনি তার আকাঈদে শিয়া, নিজামুত তাকবিন ফিল ইসলাম নামক গ্রন্থদ্বয় প্রকাশ করেন। ১৯৩৭ সালে কায়রো থেকে ভারত এবং সেখান থেকে জাপান, চীন, জাভা ও সুমাত্রা সফর করেন। ১৯৩৯ সালে পুনরায় ভারতে যান এবং সেখান থেকে আফগানিস্তানে যান।

আফগানিস্তানে যাওয়ার পথে পেশোয়ারে ব্রিটিশরা তাকে গ্রেফতার করে ২ বছর পেশোয়ার জেলে বন্দী করে রাখে। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তাকে আফগানিস্তানে গৃহ বন্দী করে রাখা হয়। এই সময়ে তিনি ৮ টি বই লেখেন ও প্রকাশ করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি সেখান থেকে দিল্লি এবং দিল্লি থেকে মুম্বাই যান। এই দীর্ঘ সফর ও অনেক নির্যাতনের কারণে তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। সেখান থেকে তিনি ১৯৪৭ সালে কায়রোতে ফিরে আসেন এবং ১৯৪৯ সালের ২৮ শে অক্টোবর তিনি কায়রোতে মৃত্যুবরণ করেন। 
তিনি বিবাহিত ছিলেন ও তার ৮ টি সন্তান ছিল। কিন্তু তার ঘর সংসার তাকে তার সংগ্রাম থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারেনি। জ্ঞান অর্জনের নেশায় তিনি সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়ান।

তার বিখ্যাত গ্রন্থ সমূহ হলঃ 
১। কোরআনের আয়াতের নুরের আলোকে নারী। তুর্কী ভাষায় এই বইটি ‘খাতুন’ নামে অনুদিত হয়েছে। নারীদের উপর লেখা আমার দেখা মতে সবচেয়ে সেরা গ্রন্থ। 
২। কিতাবুল মাসাহিফ
৩। বুলুগুল মারামের ব্যাখা। 
৪। উসূলুল ফিকহ ওয়াল মানাবিহু,
৫। কাওয়ায়ীদুল ফিকহিয়্যাহ, 
৬। মাজাল্লা- ই আহকাম-ই আদলিয়্যাহ, নামক বিখ্যাত গ্রন্থের দলীল উপস্থাপণ করেন ও আলেমদের সামনে তুলে ধরেন।

আল্লাহ এই মহান মনীষীকে চেনার ও তাকে ভালোভাবে পড়ার তওফিক আমাদেরকে দান করুন। আমীন।।

পঠিত : ১৪০৬ বার

মন্তব্য: ০