Alapon

বাংলাদেশীদের সৌদি বিদ্বেষ পর্ব ১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
   জাযিরাতুল আরবের কিছু দেশ এশিয়া অঞ্চলে, কিছু দেশ আফ্রিকা অঞ্চলে অবস্থিত৷ এদের আরবী উচ্চারণও ভিন্ন ভিন্ন৷ ভাষার ভিন্নতার মত রাজনৈতিক মতাদর্শও ভিন্ন৷ আরবের রাজনৈতিক মতাদর্শকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায় একটা রাজতান্ত্রিক শাসন, অন্যটা রাজনৈতিক দলের শাসন৷ রাজতান্ত্রিক শাসনটা বংশ পরম্পরায় চলে আসছে এবং এসব নিয়ে আমাদের দেশে বহু আলোচনা- সমালোচনা আছে৷ রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে তেমন একটা সমালোচনা হয় না বললেই চলে৷
আরবের রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে আমরা প্রধানত দুটি দলে বিভক্ত করতে পারি একটি বাথ পার্টি, অন্যটি মুসলিম ব্রাদারহুড বা ইখওয়ানুল মুসলিমীন৷
১৯৪৭ সালে মিশেল আফলাক (খৃষ্টান), সালাহউদ্দিন আল বিতার ও জাকি আল আরসুজি সিরিয়ায় এই দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে এর শাখা আরবের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে যায়৷ এই দল বাথিজমকে অনুসরণ করে যা আরব জাতীয়তাবাদ, প্যান আরবিজম, আরব সমাজবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরোধী উপাদান নিয়ে গঠিত। বাথিজম আরব বিশ্বকে একটি একক রাষ্ট্র হিসেবে একীভূত হওয়ার ডাক দেয়। এর নীতিবাক্য হল, “একতা, স্বাধীনতা, সমাজবাদ”। এর দ্বারা আরব ঐক্য এবং অনারব নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব থেকে স্বাধীন থাকা বোঝায়।
১৯২৮ সালে হাসান আল বান্না মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠা করেন৷ শুরুতে এরা শিক্ষা এবং চ্যারিটির কাজে মনোযোগী ছিলো, অনেকটা আমাদের দেশের তাবলীগের মত৷ ধীরে ধীরে এটি রাজনৈতিক দলরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে৷ এই দলটি বর্তমানে মুসলিম বিশ্বে সবচেয়ে প্রভাবিত ও বৃহৎ ইসলামপন্থী আন্দোলন। দলটির নেতা-কর্মীদের দাবী অনুসারে তারা ইসলামের মৌলিক আদর্শকে সমাজে প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে৷ এদের দৃষ্টিতে বাথ পার্টি সেক্যুলার পার্টি৷ আবার বাথ পার্টির দৃষ্টিতে ব্রাদারহুড একটি জঙ্গী (সন্ত্রাসী) সংগঠন৷
১৯১৮ সাল পর্যন্ত সিরিয়া উসমানীয় সম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিলো৷ ফয়সাল বিন হুসাইন আরব জাতীয়তাবদের ঢেউ তোলে স্বাধীন এবং বৃহত্তর সিরিয়া গঠনের সংগ্রাম শুরু করেন৷ ফয়সালের পিতা হুসাইন বিন আলী ১৯০৮ সাল থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত মক্কার আমির ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি নিজেকে মক্কার বাদশাহ ঘোষণা করেন৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহের সূচনা করেন। ১৯২৪ সালে উসমানীয় খিলাফত বিলুপ্ত হলে তিনি নিজেকে মুসলিমদের খলিফা ঘোষণা করেন। ১৯২৪ সাল পর্যন্ত তিনি হেজাজে শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯২৫ সালে তিনি আবদুল আজিজ ইবনে আবদুর রহমান সৌদের কাছে পরাজিত হন৷
বৃটিশদের সহযোগিতায় আরব বিদ্রোহীদের নিয়ে ফয়সাল বিন হুসাইন ১৯২০ সালে সিরিয়াতে হাশেমী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন৷ এই রাজতন্ত্রের মেয়াদ ছিলো মাত্র চার মাস৷ এরপর ফরাসিরা সিরিয়া দখল করে নেয়৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে উপনিবেশবাদের পতনের মাধ্যমে অন্যান্য অঞ্চলের মত এটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে৷ এরপর অভ্যুত্থান, পাল্টা-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাথ পার্টি ক্ষমতায় আসে৷ বাথ পার্টির অভ্যন্তরে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পিতা হাফেজ আল আসাদ ক্ষমতায় আসেন৷ হাফেজ আল আসাদ নিজেও বাথ পার্টির একজন নেতা ছিলেন৷

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উসমানীয় ইরাকের কিছু প্রদেশ বৃটেনের নিয়ন্ত্রণে আসে। বৃটিশ সম্রাজ্যের অধীনে ইরাকে বিদ্রোহ দেখা দিলে ইরাক শাসন করা কঠিন হয়ে উঠে। তাই বৃটিশপন্থি শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯২১ সালে ফয়সাল বিন হুসাইনকে ইরাকের রাজা ঘোষণা করা হয়৷ সিরিয়াতে ফয়সাল বিন হুসাইন ব্যর্থ হলেও ইরাক প্রায় ৩৭ বছর হাশেমি রাজতন্ত্রের অধীনে থাকে৷ ১৯৫৮ সালে ইরাকি জাতীয়তাবাদি অভ্যুত্থানে রাজতন্ত্র উৎখাত করে ব্রিগেডিয়ার আল কাসিম ক্ষমতা দখল করেন এবং ইরাককে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেন৷
১৯৬৩ সালে আল কাশিমকে বাথ পার্টির সদস্যরা খুন করে দেশের মূল ক্ষমতা হস্তগত করে। বাথপার্টির নেতা জেনারেল আহমেদ আল বকর দেশটির রাষ্ট্রপতি এবং সাদ্দাম হোসেন আবদুল মাজিদ আল তিকরিতি উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন৷ ১৯৭৯ সালে জেনারেল আহমদ আল বকরকে সরিয়ে সাদ্দাম হোসেন ক্ষমতায় আসেন৷ শুরুর দিকে তিনি বেশ সুশাসকই ছিলেন। কিন্তু কুর্দিদের বিরুদ্ধে একের পর এক সামরিক অভিযান, গ্যাস হামলা, ইরান-ইরাক যুদ্ধ, উপসাগরীয় যুদ্ধ, একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম সবকিছু মিলিয়ে শেষের দিকে তিনি একা হয়ে পড়েন৷
১৯১১ সাল পর্যন্ত লিবিয়া উসমানীয় খেলাফতের অধীনে ছিল। এরপর ইতালির অধীন হয়৷ মুহাম্মদ ইদ্রিস আল-সেনুসিকে রাজা ঘোষণা করে ১৯৫১ সালের ২৪ শে ডিসেম্বর লিবিয়া স্বাধীনতা লাভ করে৷ ১৯৬৯ সালের পহেলা সেপ্টেম্বরে মুহাম্মদ ইদ্রিস আল সেনুসি চিকিৎস্যার জন্য তুরস্কে সফরে গেলে মাত্র ২৭ বছর বয়সী কর্ণেল মোয়াম্মার আল গাদ্দাফী তার অল্প কয়েকজন সামরিক অফিসারের সহায়তায় রাজধানী ত্রিপলীতে এক প্রতিরোধহীন এবং রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে লিবিয়ার শাসন ক্ষমতা দখল করেন।
রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করলেও গাদ্দাফী কিন্তু কোন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা লিবিয়ায় বিকশিত হ’তে দেননি এবং সেখানে কোন বিরোধী দলের অস্তিত্বও রাখেননি। অনেকটা বাথ পার্টির অনুকরণে বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করে তিনি দেশ চালান। যেখানে গাদ্দাফী ও তার গুটিকয়েক পরিষদের কথাই চূড়ান্ত। বিভিন্ন আরব দেশকে একসঙ্গে জুড়ে ‘ফেডারেশন অব আরব রিপাবলিক’ গঠন করার চেষ্টাও করেন। কিন্তু আরব নেতাদের কোন্দল, পারস্পরিক প্রতিহিংসা তার সে চেষ্টা সফল হ’তে দেয়নি এতে আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে দূরত্ব তৈরি হয়৷
ফিলিস্তিন নিয়ে আমাদের ইতিহাস জ্ঞান গাজী সালাহউদ্দীন আইয়্যুবী (রহঃ) পর্যন্ত থমকে আছে৷ কিন্তু ইতিহাস বলে বায়তুল মোকাদ্দাস বা জেরুজালেম শহরটি কমপক্ষে দুইবার ধ্বংস হয়েছে, ২৩বার অবরোধ হয়েছে, ৫২বার আক্রমণ হয়েছে এবং ৪৪বার দখল এবং পুনর্দখল হয়েছে ১১৮৭ খৃষ্টাব্দে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ূবী এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ক্রুসেডারদের ৮৮ বছরের জবর দখলের হাত থেকে জেরুজালেম উদ্ধার করেন৷ উদ্ধারের মাত্র ৪২ বছরের মাথায় ১২২৯ সালে তারই অযোগ্য ভাতিজা আল কামিল জেরুজালেম ক্রুসেডারদের হাতে তুলে দেয়৷ ১২৪৪ সাল জেরুজালেম হাতছাড়া হবার পনের বছর পর, সুলতান আস সালিহ মাত্র এগার বছর বয়সী কিশোর সেনাপতি রোকনউদ্দীন বাইবার্সকে সাথে নিয়ে পূনরুদ্ধার করেন৷ এভাবে বিভিন্ন শাসকদের হাত ঘুরে অবশেষে উক্ত এলাকা উসমানীয় খেলাফতের অন্তর্ভূক্ত হয়৷

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয় খেলাফত বৃটিশ সাম্রাজ্যের কাছে পরাজিত হলে ফিলিস্তিন বৃটিশদের আওতায় চলে যায়৷ বৃটিশ সরকার যে সময় ফিলিস্তিন দখল করে সে সময় ফিলিস্তিনে বসবাসকারী ইহুদিদের আনুমানিক সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার মাত্র ১১ শতাংশ। মুসলমান, খৃষ্টান ও ইহুদী তিন ধর্মের লোকের জন্যই এটি পবিত্র ভূমি৷ এছাড়া এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা এই তিন মহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক অবস্থানে রয়েছে ফিলিস্তিন৷ এসব গুরুত্বকে মাথায় রেখে উসমানীয় খেলাফতের সময় থেকেই ইহুদীরা ফিলিস্তিনের পতিত জলাশয় ও অনুর্বর ভূমি গণহারে কিনতে শুরু করেছিল৷ পরবর্তী বছরগুলোতে বৃটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদিদের অনেকে ফিলিস্তিনে আসতে শুরু করে এবং ১৯৩১ সাল নাগাদ ফিলিস্তিনে ইহুদি জনসংখ্যা বেড়ে প্রায় ১৭ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায় ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ ১১ সদস্যের কমিটি গঠন করে এবং তাদের মাসাধিক কাল গবেষণালব্ধ পরামর্শ অনুযায়ী ১৯৪৭ সালে ইহুদি অধ্যুষিত ‘ইসরাইল’ ও মুসলিম অধ্যুষিত ‘ফিলিস্তিন’ নামের দুটো পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব করা হয়৷ ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ সম্মেলনে ৩৩ বনাম ১৩ ভোট এর মাধ্যমে বিলটি পাস হয়। নবগঠিত আরবলীগ তথা আরব দেশগুলো বিলের বিপক্ষে ভোট দেয়। ১৯৪৮ সালের মে মাসে ব্রিটিশ ইসরাইল স্বাধীনতা ঘোষণা করে। স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই আমেরিকা ও ইরান ইসরাইলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দান করে। পরবর্তীতে অন্যান্য অনেক অমুসলিম দেশ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দান করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই খৃষ্টানদের সহযোগীতায় ইহুদীরা ফিলিস্তীনের মুসলমানদের উপর নিপীড়ন, নির্যাতন, উচ্ছেদ, খুন, জেল, জুলুম চালিয়ে আসছে৷ ইহুদীদের প্রতিরোধ করার জন্য ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে ১৯৫৯ সালে গঠিত হয় "ফাতাহ"৷ এটিও অনেকটা বাথ পন্থীদের মত সেক্যুলার দল৷ প্রাথমিকভাবে দলটি ইসরায়েলের অস্তিত্বের সম্পূর্ণ বিরোধী থাকলেও পরে আরাফাত ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করেন। ফাতাহ এর বিতর্কিত রাজনৈতিক কর্মকান্ডের উপর অনাস্থা জ্ঞাপন করে সেখানে "হামাস" নামে আরেকটি দলের আবির্ভাব হয়৷ হামাস এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন শেখ আহমেদ ইয়াসিন, যিনি মূলত ছিলেন ইখওয়ানুল মুসলিমীনের ফিলিস্তিন শাখার নেতা৷ বর্তমানে ফিলিস্তিনের কিছু অংশ ফাতাহ এবং কিছু অংশ হামাসের নিয়ন্ত্রণে৷ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এই দুই দলের মাঝে কখনো কখনো গোলাগুলিও হয়ে থাকে৷ একদিকে ইসরাঈলী আগ্রাসন, অন্যদিকে দুই দলের হামলা-পাল্টা হামলা এভাবেই চলছে ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলন৷
১৮৮২ সাল পর্যন্ত মিশর উসমানীয় খেলাফতের অংশ ছিল৷ ১৮৮২ সালে বৃটিশ সেনারা মিশর দখল করে। এরপর প্রায় ৪০ বছর মিশর বৃটিশ উপনিবেশ ছিল। ১৯২২ সালে দেশটি রাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে স্বাধীনতা অর্জন করলেও বৃটিশ সেনারা মিশরে থেকে যায়। ১৯৫২ সালে জামাল আব্দেল নাসের-এর নেতৃত্বে একদল সামরিক অফিসার রাজতন্ত্র উৎখাত করে এবং প্রজাতন্ত্র হিসেবে মিশর প্রতিষ্ঠা করে। এরপর এখানেও অভ্যুত্থান, পাল্টা-অভ্যুত্থান চলতে থাকে৷ প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পতনের পর ২০১২ সালে ব্রাদারহুডের নেতা মুহাম্মদ মুরসিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়৷ নির্বাচনের এক বছরের মাথায় সামরিক অভ্যত্থানের মাধ্যমে মুরসিকে ক্ষমতাচ্যূত ও বন্দী করা হয়৷
আরবের বাথপার্টি এবং ব্রাদারহুড কর্মীদের মাঝে শুরু থেকেই বিভক্তি এবং মতবিরোধ চলে আসছে৷ আমাদের দেশের সমাজতন্ত্রবাদী,  ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, গণতন্ত্রকামী, খেলাফতকামী কর্মীদের মাঝে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে বিভেদ থাকলেও সৌদী বিদ্বেষের ক্ষেত্রে এরা প্রায় সবাই ঐক্যবদ্ধ৷ এবং আরবের যত বিশৃঙ্খলা সব কিছুর জন্য এরা সৌদী আরবকে দোষারোপ করে খুব আত্মতৃপ্তি অনুভব করে৷
এধরনের লোকদের যদি প্রশ্ন করি, ইরাকের জনসংখ্যা কয়ভাগে বিভক্ত? সাদ্দাম হোসেন পরে ইরাকের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি কে ছিলেন? তিনি কোন ধর্মের? জাতিসংঘের শান্তি রক্ষী বাহিনী কিভাবে আরবে প্রবেশ করেছে? আরবে কতভাগ অমুসলিম বাস করে? ব্রাদারহুডের মুরসি শতকরা কত ভোট পেয়েছে? আল জাজিরা চ্যানেলে কত ভাগ মুসলিম সাংবাদিক আছে? ইত্যাদি
সেক্ষেত্রে দেখবেন পাশ কেটে যাবে বা প্রসঙ্গ বদল করে ব্যক্তিগত আক্রমনে লিপ্ত হবে৷ এর কারন হচ্ছে তারা মূলত বিষয়টা জানেই না, দলের কোন নেতা কর্মী সমর্থক থেকে শোনে হয়ত প্রচারে নেমে গেছে৷ অন্যের মুখ থেকে শোনে প্রচার করার সমস্যা হচ্ছে, নির্দিষ্ট গন্ডির বাইরে চিন্তা করার ক্ষমতা থাকে না৷
ইরাকের জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশ লোক (শিয়া এবং কুর্দি) ছিলো সাদ্দাম বিরোধী৷ ইরাকে সাদ্দামের পরে সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি উপ রাষ্ট্রপতি তারেক আজিজ ছিলো খৃষ্টান৷ এতে বোঝা যায় ইরাকে কিছু খৃষ্টানও আছে৷ যুদ্ধের সময় শিয়া এবং কুর্দিরা সাদ্দামকে কোন সহযোগিতা করেনি এটা আমি নিশ্চিত, কিন্তু তারেক আজিজ এবং সেখানকার খৃষ্টানদের ভূমিকা সম্পর্কে আমার জানা নেই৷ সাদ্দাম হোসেনের কুয়েত দখলের মত হঠকারী সিদ্ধান্তের কারনেই মধ্যপ্রাচ্যে জাতিসংঘের মূলত আমেরিকার সৈন্য প্রবেশের সুযোগ পায়৷
আরবলীগের দেশগুলোতে শতকরা ১০ ভাগ খৃষ্টান এবং অন্যান্য ধর্মের লোক বাস করে৷ আর যে ৯০ ভাগ মুসলিম আছে তারা আবার শিয়া-সুন্নী দুই ভাগে বিভক্ত৷ আমাদের দেশের লালন ভক্ত মানবধর্মের অনুসারীরা সাধারণত মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ এসব ধর্মীয় ভেদাভেদ মানে না, একই রকমভাবে ব্রাদারহুডের অনুসারীরা আবার শিয়া-সুন্নী ভেদাভেদ মানে না৷ এখানে আপনাকে মনে রাখতে শিয়া-সুন্নী ব্যবধানটা ১৪০০ বছর আগে সাহাবীগণের আমলেই হয়ে গেছে এবং ব্রাদারহুডের সমর্থক ব্যতীত প্রায় সকল সুন্নী আলেমগণই শিয়াদের মুসলিম হিসেবে মানতে নারাজ৷ আরবে শিয়াদের শতকরা হার আমার জানা নেই৷ 
শিয়াদের শতকরা হার যদি ৩০ ভাগও হয়, তাহলে আরবে অমুসলিমের সংখ্যা প্রায় ৪০ ভাগ এর সাথে ইহুদীদের শতকরা হার যোগ করা হয় তাহলে মুসলিম-অমুসলিমের সংখ্যাটা প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ের দাঁড়ায়৷
আরবে যেসব সুন্নী মুসলিম আছে এরা আবার সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক, খেলাফত বিভিন্ন মতবাদে বিভক্ত৷ সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়াতে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্রের নামে বাথপার্টি যেটা কায়েম হয়েছে সেটা হলো স্বৈরতন্ত্র৷ ব্রাদারহুডের কর্মীরা যেটির জন্য সংগ্রাম করছে সেটি হলো গণতন্ত্র৷ অধিকাংশ ব্রাদারহুড কর্মী শিয়া-সুন্নী বিভেদকে রাজনৈতিক বিরোধ মনে করে৷ আবার গণতন্ত্রকে ধর্মীয় দর্শন মনে করে৷ এদের যেকোন মতবাদের ধর্মীয় রূপ দাঁড় করাতে এরা সিদ্ধহস্ত৷
আরব বসন্তের বাহক হিসেবে ব্রাদারহুড খুব গর্ব করে৷ লিবিয়া, তিউনেশিয়া, সিরিয়ার মত দেশগুলোতে আরব বসন্ত বিশৃঙ্খলা আর সাধারণ মানুষের দুঃখ দূর্দশা ছাড়া আর কিছুই নিয়ে আসেনি৷ মিশর ব্যতীত আরবের আর কোন দেশে ব্রাদারহুড ক্ষমতায় যেতে পারেনি৷ মিশরে ব্রাদারহুড সমর্থক মুরসি প্রথম দফা ২৫% ভোট আর দ্বিতীয় দফা ৫১% ভোট পেয়েছিলেন৷ অর্থাৎ প্রথমদফা অনুযায়ী ৭৫% এবং দ্বিতীয় দফা অনুযায়ী ৪৯% লোক ব্রাদারহুড বিরোধী বা ব্রাদারহুডকে সমর্থন করে না৷ জনগণের সমর্থনের চেয়ে বড় কথা হলো আহমেদ নজীব থেকে শুরু করে সিসি পর্যন্ত মিশরে মোট ছয় জন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন এর মাঝে মুরসি ব্যতীত বাকি পাঁচ জনই সামরিক বাহিনীর৷ মিশর এখনো বেসামকরিক শাসনের উপযুক্ত হয়ে উঠেনি৷ পুরো আরবেই সাধারণত দু'টো তন্ত্র চলছে হয় রাজতন্ত্র, না হয় স্বৈরতন্ত্র৷
বাথপার্টি, ব্রাদারহুড, আলকায়দা প্রথম প্রথম সবগুলো দলের সাথেই সৌদী আরবের সুসম্পর্ক এবং পৃষ্ঠপোষকতা ছিলো৷ যখনই তাদের মতবাদ সৌদী রাজতন্ত্রের জন্য হুমকি স্বরূপ মনে হয়েছে তখনই সম্পর্কে ছেদ পড়েছে৷ বাহরাইন এবং ইয়ামেনে সৌদী আরবের যেভাবে সেনা প্রেরণ করেছে, আরবের অন্য দেশগুলোতে কিন্তু সৌদী আরব সেনা প্রেরণ করেনি৷ মিশরের সিসিকে সৌদী সরকারের সমর্থন, বাহরাইন, ইয়ামেনে সেনা প্রেরণ এসব নিয়ে আলোচনা করার আগে আমাদের অবশ্যই ধর্মীয় আক্বীদা, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামরিক বিষয়গুলো দেখতে হবে৷
সৌদী আরব এবং মিশর এশিয়া এবং আফ্রিকার এ দু'টি পাশাপাশি রাষ্ট্র৷ সৌদীতে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, এ্যাকাউন্টেট, বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষক সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে মিশরীয়রা কর্মরত৷ স্বল্প খরচে উন্নত চিকিৎস্যার জন্য বেশিরভাগ সৌদীর প্রথম পছন্দ মিশর৷ সৌদী আরবের বেশিরভাগ কৃষিজাত পণ্য মিশর থেকে আমদানী করা৷ আরব উপসাগরের কিছু দ্বীপের মালিকানা নিয়েও তাদের মাঝে দ্বন্ধ আছে৷ বিভিন্ন কারনে সৌদীকে মিশরের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হচ্ছে৷ সম্পর্কটা রাখবে কার সাথে?
নওয়াজ শরীফ যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি সৌদীতে ওমরাহ করতে আসলে তাকে স্পেশাল নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছিলো৷ পদ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর আবার যখন সৌদীতে আসলেন তখন তাকে কেউ জিজ্ঞেসও করেনি৷ রাজনীতি পরাজিত লোকের কোন কদর নেই৷ মুরসি ক্ষমতায় থাকতে পারেনি এটা তার ব্যর্থতা, সিসি ক্ষমতায় টিকে আছে এটা তার সফলতা৷ যেকোন রাষ্ট্র থেকে কিছু আদায় করতে হলে তার সরকারের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হয়৷ সিসির পরে যদি অন্য কেউও মিশরের ক্ষমতায় আসে সৌদী সরকার তাকেও সাধুবাদ জানাবে৷
গুজরাটের কসাইখ্যাত নরেন্দ্র মোদী যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছে তখন বাংলাদেশের অন্যান্য দলগুলোর পাশাপাশি ব্রাদারহুডের সমর্থক দাবীদার রাজনৈতিক দলটিও তাকেও অভিনন্দন জানিয়েছে৷ ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও অভিনন্দন জানিয়েছে৷ ব্রাদারহুড যখন ভিন্ন মতাদর্শের চিহ্নিত সন্ত্রাসীকে সমর্থন দেয় সেটা হয় রাজনৈতিক শিষ্টাচার, আর সৌদী আরব দিলে হয় দালালী৷
মিশরের মত ইয়ামেনও সৌদী আরবের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র৷ ইয়েমেনের পাশে দক্ষিণ পশ্চিমে আফ্রিাকার দেশগুলো অবস্থিত, যেগুলোতে সর্বদা গৃহযুদ্ধ লেগে আছে৷ সোমালিয়া ও ইথিওপিয়ার মত দেশগুলোতে অর্থের বিনিময় সহজে অস্ত্র কেনা যায়। দ্বিতীয় লোহিত সাগরের প্রবেশদ্বার, সৌদী আরবের বেশিরভাগ বিজনেস ঐ সাগরকে কেন্দ্র করে৷
বহুকাল ধরে উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেন বিভক্ত ছিল, তখন দু’টি দেশের মধ্যে সম্পর্ক ছিল কখনও সম্প্রীতির আবার কখনো বৈরিতার। ১৯৯০ সালের দিকে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি একীভূত হয়। জার্মানির দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেই ১৯৯০ সালে উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেন একদেশে পরিণত হয় এবং ঐক্যবদ্ধ ইয়েমেনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। শুরু হয় নতুন ইয়েমেনের অগ্রযাত্রা। তবে সহিংস গৃহযুদ্ধে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছিলো৷ সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা ছিল সৌদি আরব সীমান্তবর্তী দেশটির উত্তরাঞ্চলে। শিয়া ধর্মাবলম্বী জাইদি সম্প্রদায়ের লোকজন ওই অঞ্চলে বসবাস করে। জাইদি সম্প্রদায় হুতি নামেও পরিচিত।
আরব বসন্তের প্রেক্ষিতে ইয়েমেনেও গণতন্ত্রের দাবি উঠেছিল। প্রচন্ড বিক্ষোভের মুখে স্বৈরাচারী শাসক প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ শাসনক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। আশা করা হয়েছিল তার পদত্যাগের পর দেশটিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হবে, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। দেশটির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় শিয়া হুতিদের হাতে৷ সৌদী আরব তার আশেপাশে শিয়াদের উত্থান কখনোই ভালোভাবে দেখে না এবং তাদের শাসন ব্যবস্থার জন্য হুমকি মনে করে, যার জন্য তারা বাহরাইনের মত ইয়ামেনেও সৈন্য প্রেরণ করে৷ ইয়ামেন- সৌদী যুদ্ধ বিরতির পরিকল্পনা নিয়ে আবদুল্লাহ সালেহ ইয়ামেন গেলে হুতি বিদ্রোহীরা তাকে হত্যা করে৷ (শিয়াদের উত্থান সুন্নীদের জন্য কি রকম ভয়ংকর পরিণতি নিয়ে আসতে পারে তা, এই সিরিজের পূর্বের লেখাতে উল্লেখ করেছিলাম৷)
ইয়ামেন, মিশরের লক্ষ লক্ষ লোক সৌদীতে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকুরী করছে এসব নিয়ে তাদের কোন সমস্যা হয় না, সমস্যা হচ্ছে আমাদের বাঙ্গালী মুজাহিদদের৷ বাংলার কমিউনিস্টদের নিয়ে প্রবাদ চালু আছে, "মস্কোয় বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা ধরে৷" একই ভাবে আরবে বসন্ত হলে বাংলার মুজাহিদদের ফুল ফোটে৷
যেকোন জিনিষের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ থাকে৷ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর সৌদী রাজতন্ত্রও শেষ হয়ে যাবে৷ কিন্তু এর আগে বাংলার যেসব মুজাহিদ সৌদী রাজতন্ত্র উচ্ছেদের যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন তারা আসলে এখানে কি ধরনের শাসন ব্যবস্থা চান? বাথ পার্টির সমাজতন্ত্র? ব্রাদারহুডের গনতন্ত্র? ইরানের বিপ্লব? সৌদী আরবে আল সৌদ পরিবারের বিকল্প কোন শাসক তাদের নজরে আছে কি?
মিশরে মুরসির বিকল্প সিসি থাকাতে সেখানে মোটামুটি একটা স্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে৷ ইরাকে সাদ্দামের বিকল্প কোন শাসক তৈরি হয়নি, লিবিয়াতে গাদ্দাফীর বিকল্প কেউ ছিলো না, সিরিয়াতে বাশারের বিকল্প কেউ নেই, ইয়ামেনে আবদুল্লাহ বিন সালেহর বিকল্প কেউ তৈরি হয়নি৷ যেসব দেশে বিকল্প শাসক তৈরি হয়নি সেসব দেশে এখনো অস্থিরতা বিরাজ করছে৷ বাংলার মুজাহিদরা কি সৌদী আরবকে এমন একটা অস্থিতিশীল দেশ হিসেবে দেখতে পছন্দ করবেন?
আল কায়দা ও ওসামা বিন লাদেন, রাজতন্ত্র এবং আল সৌদ পরিবারের বিকল্প হতে পারত৷ সেক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতে পারে সৌদী সরকারতো তাকেও দমন করেছে৷ সৌদী সরকার যাকেই তাদের ক্ষমতার জন্য ক্ষতিকর মনে করেছে তাকেই দমন করেছে৷ যে কোন শাসক সাধারণত তাই করে৷ কিন্তু আরবের অন্য দেশ গুলোতে আল কায়দা আশ্রয় পায়নি কেন? সৌদীর সাথে বাথপার্টির সম্পর্ক ভালো না, ব্রাদারহুডের সম্পর্ক ভালো না, হিজবুল্লাহর সাথে সম্পর্ক ভালো না, হামাসের সাথে সম্পর্ক ভালো না, আইসিস এর সাথে সম্পর্ক ভালো না, কিন্তু আল আয়দা ছাড়া এরা সবাই আরবের বুকে রাজনীতি করছে৷
আরবের রাজনীতি যদি সৌদী সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকত তাহলে এরা কেউ রাজনীতি করতে পারত না৷ আরবের বিভিন্ন মতাবলম্বী দলগুলোর মাঝে কারা আসলে সত্যিকার অর্থে কোরআন এবং সুন্নাহর আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করছে সেটি অত্যন্ত গভীরভাবে ভাবনার বিষয়, যে ক্ষমতা আমাদের নেই বললেই চলে৷ সেক্ষেত্রে হালকা মুখস্ত বুলি ছেড়ে দিলাম সৌদী আরব ইসলামকে ধ্বংস করে দিয়েছে, বিশ্বস্ততার জন্য আমেরিকা আর ইসরাঈলকে যোগ করে দিলাম, ব্যস হয়ে গেলাম আন্তর্জাতিক ইসলামী চিন্তাবিদ৷ ফেসবুকে এধরনের আন্তর্জাতিক ইসলামী চিন্তাবিদ লাখে লাখে৷

পঠিত : ১৩৪৯ বার

মন্তব্য: ০