Alapon

বাংলা নববর্ষঃ দুই বাংলায় উদযাপনের ভিন্নতা, অর্থনৈতিক তাৎপর্য, উত্তরণ ও এগিয়ে যাবার আবেদন তৈরির সামগ্রিক বোধ!

বাংলা একাডেমি ১৯৮৭ সনে ১৫ তারিখ থেকে ১৪ তারিখ বাংলা নববর্ষ প্রবর্তন করেছিল। উল্লেখ্য ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক গঠিত বাংলা একাডেমির পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি নিযুক্ত করা হয় বহু ভাষাবিদ পন্ডিত ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কে। তাঁর নেতৃত্বে বাংলা পঞ্জিকা একটি আধুনিক রূপ পায় (উইকিপিডিয়া)। এই রুপটিকেই ২ যুগ পরে এরশাদ সরকারের আমলে আইনে পরিণত করা হয়। বৈশাখ থেকে ভাদ্র ৫ মাস ৩১ দিনে। বাকি ৭ মাস ৩০ দিনে। প্রতি লিপ ইয়ারের বছর প্রতি ফাল্গুন মাসে ১ দিন বেশি ধরা হবে। ফাল্গুন মাসটি শুরু হবে লিপ ইয়ারের ফেব্রুয়ারী মাসের ২৯ তারিখের ১৪ দিন পর। এই হিসাবে বছর নির্ধারণ করতে যেয়ে ১৯৮৭ সনে ১৪ই এপ্রিল নববর্ষ ঘোষণা করেন জনাব এরশাদ।

১৯৮৭ সনের ১৪ই এপ্রিল মকর সংক্রান্তির সনাতন ধর্মীয় অনুষ্ঠান থাকায় হিন্দুরা ১৫ তারিখে নববর্ষ পালন করেন। এখানেই ইঙ্গিত রয়েছে যে, পহেলা বৈশাখ আসলে সনাতন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছিল না।হিন্দু ধর্মের পন্ডিতরা প্রাচীন কাল থেকেই সূর্য্য আর চাঁদের বিবর্তন দিয়ে বঙ্গাব্দ হিসাব করে এসেছে। এজন্যে কখনো কখনো বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের নববর্ষ আলাদা দিনে উদযাপিত হয়। ধর্মীয় কারণে পশ্চিম বঙ্গের নববর্ষ উদযাপিত হয় চাঁদ সূর্যের অবস্থানের ওপর নির্ভর করে, ঠিক যেভাবে মুসলমানরা চাঁদ নির্ভর ঈদের দিন ঠিক করে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন দিনে। ব্যক্তি আমার মন পুর্ব বাংলার ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রবর্তিত ৫>৩১+৭>৩০ কাঠামোতে সায় দিলেও মাথা বলে পশ্চিম বাংলার চাঁদ ভিত্তিক বৈশাখী ক্ষণ গণনাই বেশি সেন্সিবল।

খাজনার আদায়কে ফসল উৎপাদন এবং হারভেস্টের সাথে সমন্বিত করতে আকবর ও তাঁর অর্থমন্ত্রী রাজা তোদার মাল বঙ্গাব্দ ঠিক করার দায়িত্ব দিয়ে ছিলেন রাজ এসট্রলজার ফতেউল্লাহ সিরাজীকে। রাজকবি আবুল ফজল তার লেখায় জানিয়েছেন বঙ্গাব্দের ঘটনা। দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে মুসলিম রাজা ইসলাম শাহের হিন্দু জেনারেল হিমুকে পরাজিত করার পর আকবরের সিংহাসনে আরোহনের দিনটি ৫ই নভেম্বর ১৫৫৬ সন, ৯৬৩ হিজরী থেকে হিসাব করে প্রথম বঙ্গাব্দ ঘোষণা করা হয় ১৫৮৪ সনের মার্চের ১০/১১ তারিখ। তারিখে ইলাহী নামের এই বাদশাহী ফরমানে বাংলার মাসগুলির নাম ফার্সী ভাষায় ছিলো এভাবে-কারয়াদিন, ভিশু, খোরদাদ, তীর ,আমারদাদ, শাহরিয়ার ,আবান, আজুর,দেয়,বাহাম এবনহ ইস্কান্দার মিজ। বাংলা রূপান্তরের সময়ে পৌরাণিক মিথ অবলম্বনে মাসের নামগুলো নেয়া হয়েছে। অতি উল্লেখ্য যে, ১৪ কিংবা ১৫ এপ্রিল বাংলা শুধু নয়, বরং বেশ কয়েকটি ভারতীয় জাতিসত্তার নববর্ষ (আসাম বাংলা কেরালা, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিলনাডু), যেখানে বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিনে ধর্ম পরায়ন জাতি গুলো চৈত্র সংক্রান্তির পূজা পার্বণ করতো এবং এখনও করে। তবে আকবরের সময় থেকেই বাংলার সন গণনা (সুনির্দিস্ট নাম্বারিং শুরু হয়) এবং ভিন্ন ভিন্ন জাতি গুলোর সনের সংখ্যা ভিন্ন (উইকিপিডিয়া)।

নববর্ষ উদযাপন, বৈশাখী মেলা, হালখাতা, লোকজ উৎসব, লোকজ ঢাক, ডোল, ঝাঁজর ইত্যাদি হিন্দুদের আচার বা হিন্দু ধর্মের অনুষ্ঠান নয়। তবে ১৯৯৬ (মতান্তরে ১৯৮৯) সালে ঢাকার বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিক মঙ্গল শোভাযাত্রার যোগ এবং অন্যান্য হিন্দু ধর্মীয় আচার সংক্রান্ত সংশ্লিষ্টতা (সেখানে যে প্রতীক গুলো ব্যবহার হয় তার বিশেষ হিন্দু ধর্মীয় ব্যাখ্যা রয়েছে) বাংলা নববর্ষের উদযাপনের অধুনা রীতিটি দিনদিন কিছুটা সাম্প্রদায়িক হয়েছে। উল্লেখ্য ১৯৮৪ (বাাংলা ১৩৯০) সনের চৈত্র মাসের শেষ দিনে স্বৈরশাসনে অবরুদ্ধ প্রতিবাদী নতুন দিনের প্রত্যাশায় চট্রগ্রামবাসী এক শোভাযাত্রার সূচনা করে ঢাক, ডোল, ঝাঁজর ইত্যাদির সাথে দেশীয় পোশাকের সমন্বয়ে। কয়েকটি বছর পেরিয়ে ঢাকায় সেটাই "মঙ্গল শোভাযাত্রা"য় রূপ পায়। প্রায় প্রতিবারই দুষ্টের দমন কামনার নামে দাঁড়ি টুপি অংকিত ও পরিহিত কুশ পুত্তলিকার পুচ্ছ দেশে লাঠি দিয়ে এই শোভাযাত্রায় ইসলামী পোশাক ও বেশকে চরম কটাক্ষ এবং অমর্যাদা করা হোত (যদিও শৈল্পিক দিকে থেকে ৭১'রের বিশেষ স্বাধনীতা বিরোধীকে চিত্রিত করতে দাঁড়ি টুপি পাঞ্জাবির অবতারণা অবধারিত নয়)। ফিবছরই একই বিষয়কে অশুভ বলে তা প্রতিহত করার শপথ হয় যদিও সমাজে এর বাইরেও ধর্ষণ, রাজনৈতিক প্রশাসনিক দুর্বিত্তায়ন, প্রতারণা, জালিয়াতি, চাঁদাবাজি, ঘুষ, দুর্নীতি, খুন, গুম, অপহরণ, ভেজাল, দখল, নদী পানি বায়ু দূষণ, দখল, ব্যাংক লুট, পাচার, সড়ক দুর্ঘটনা সহ বহু বহু রকমের পাপ অপরাধ ও অশুভের উপস্থিতি রয়েছে যেগুলো কখনই মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য হয় না। নিরাপদ সড়কের দাবি, নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদ অথবা নাগরিকের উপর প্রশাসনের নির্লজ্জ আচরণের প্রতিবাদ চিত্র শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য বিষদায়িতে অনুপস্থিতই থেকে যায়। বোধ করি রাজনৈতিক প্রভাবে চারুকলার একটা প্রভাবশালী মহলের ইচ্ছামাফিক রাজনৈতিক বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা যা আমাদের সমাজের প্রধান চাহিদা নয়। ফলে এটা এমনিতেই বিবদমান সমাজে বিভেদ উস্কে দিচ্ছে, তাই নববর্ষ উদযাপনকে অসাম্প্রদায়িক রাখা জরুরী হয়ে গেছে।

অর্থাৎ জাতীয় অনুষ্ঠান এমন হওয়া দরকার যেখানে শুধু আবহমান বাংলার সংস্ক্রিতিক ভ্যালূ ও সামাজিক মূল্যবোধ গুলোকে উৎসাহিত করা হবে। আর্থিক ও সাংস্কৃতিক বঞ্চনার বিগত ইতিহাসকে স্মরণ করে তা থেকে উত্তরণের শপথ নেয়া হবে। জাতি হিসেবে আমাদের ভুল, খামখেয়ালীপনা, অব্যবস্থাপনা, অতি খরুচে ও নন টেকসই উন্নয়ন, রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুটতরাজ, সমাজের অপরাধ প্রবণতা, অনুন্নত জীবন, অনুন্নত আবাসন, অনুন্নত কাজের পরিবেশ, দারিদ্র, প্রাণ পরিবেশ প্রতিবেশের প্রতি দায়হীনতা ইত্যাদিকে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাবার নতুন দীক্ষা ও সুস্পষ্ট কর্ম পরিকল্পনার নেয়ার এবং সেগুলো বাস্তবায়নের গুরুত্ব ও বোধ তৈরি করা যায়।

সম্রাজ্যের আর্থিক ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রিক গণনা দিয়ে শুরু হলেও বাংলা নবর্ষের আজ কোন আর্থনৈতিক তাৎপর্য অবশিষ্ট নই যদিও ফসল উৎপাদনের সময়ে "হাল খাতা" কৃষি ও ব্যবসার পাওনা পরিশোধে সমাজে গুরুত্ব রাখতো। ফসলী মৌসুম ও কৃষি উৎপাদন নির্ভরতায় বাংলা সন ভিত্তিক রাষ্ট্রীয় অর্থবছর বাস্তবায়নের যে সুযোগ ও ঐতিয্য ছিল সেটাও উপেক্ষিত। উল্লেখ্য আজো বাংলাদেশে পাওনা পরিশোধ বেশ জঞ্জাল পুর্ণ এবং পাওনার ঠিক সময়ে না পাওয়ার ব্যাপার, আর্থিক লেনদেনে অস্বচ্ছতা বহুবিধ গুরুতর সামাজিক অপারাধের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। আদতে বৈশাখের জমিদারি খাজনা আদায় দিয়ে বাংলার কৃষকের স্বার্থে আঘাত করাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া এবং কৃষকের কষ্টের তীব্রতা বাড়ার শুরু হলেও উৎসবে বাংলার কৃষককে ও তার বর্তমান আর্থসামাজিক মুক্তির কথাকে আর কেউ মনে রাখে না, আজো ফলনের উৎপাদন মূল্য পায় না কৃষক বরং আজকের কৃষকের নেই জমি বীজ সার কিছুই আছে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ ঋনের দৈনিক যন্ত্রণা। শহরে বস্তিতে আজ মিছিলে মিছিলে ভীড় করে ভূমিহীন কৃষকের মলিন মূখগুলো। তাঁদেরই টোকাই সন্তান কুঁড়ায় বৈশাখী মেলা খাদ্য উচ্ছিষ্ট।

একদিকে কৃত্তিম ভাবে পান্তা বানিয়ে অন্যদিকে প্রজনন মৌসুমে নির্বিচার ইলিশ নিধনে উৎসাহ দিয়ে উদর পূর্তির "পান্তা ইলিশ" নামের এক হীনমান্য ও দৃষ্টিকটু শহুরে সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে যা একদিকে একবেলা রান্নায় অভ্যস্ত গরীব কৃষকের সকালের পান্তা আহারকে তাচ্ছিল্য করে অন্যদিকে প্রাণ ও প্রকৃতিকেও নিধনে উৎসাহিত করে। এর বাইরেও আছে উচ্চ শব্দে হিন্দি গানের উৎসব করার নব্য অপসংস্কৃতি।

ফলে নববর্ষ আমোদী, আবেগ প্রবণ ও টেকসই অর্জন বিহীন জাতীয় জীবনে উৎসব করার আরেকটি উপলক্ষ মাত্র! অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনে এর টেকসই কোন অর্থনৈতিক তাৎপর্য অবশিষ্ট নেই। মেলায় বেশ কিছু দেশীয় পণ্য বিকিকিনি হয়, তবে সেখানেও ইদানিং রয়েছে বিদেশী পণ্য ও কাঁচামালের আধিপত্য। আর মেলা উপলক্ষে শাড়ী শার্ট পাঞ্জাবী ও প্রাসাধনীর যে কর্পোরেট ও নন কর্পোরেট বাজার তার প্রায় পুরাটাই আমদানিকৃত বৈদেশিক পণ্যের বাজার, এই হীনতা রাখি কোথায়! প্রান্তিক উৎপাদনকারীকে সুরক্ষিত করে দেশীয় পণ্য গুলোকে কিভাবে টেকসই মানে উন্নীত করে গ্রামীণ ক্ষুদ্র শিল্প ও কর্মসংস্থানকে বাঁচিয়ে কিভাবে একটা শৌখিন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পণ্যবাজার হিসেবে গড়ে উঠানো যায় সেই আন্তরিক চেষ্টার বিরাট ঘাটতি আছে।

"এসো হে বৈশাখ, এসো এসো
তাপস নিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষূরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক৷৷"

পুরানো বছরের জঞ্জাল মোছার ডাক দিয়ে শুরু হলেও এটা আমাদের প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ সুরক্ষার বোধ সৃষ্টি করে না। ময়লা অবর্জনা ধুলিময় নগর বছরের শেষে ও শুরুতে নোংরাই থাকে। বাংলার নদী ও পাখ পাখলি মরতেই থাকে। ফসলের মাঠে কিষাণীর মুখ মলিনই হতে থাকে। ব্যাংক লুট হতেই থাকে, বছর শেষে খেলাপি ঋন বাড়তেই থাকে। প্রান্তিক জনতার আর্থিক দায় বাড়তেই থাকে। নাগরিকের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খরচ বাড়তেই থাকে। বছর শেষে বেকারত্বের গ্লানি ও হতাশার অন্ধকার ঘনই হতে থাকে। নগর জীবনের ক্লান্তি ও কষ্ট বছর শেষে শুধু প্রকটই হতে থাকে! শ্রম সর্বস্ব সাধারণ নাগরিক যান্ত্রিক, যানজট ও উচ্চ তাপমাত্রার নগরে ঘর্মাক্ত শরীরে এই জীবন যন্ত্রণা কায়িক পরিশ্রমে ঠেলার নিরন্তর চেষ্টা করলেও বছর শেষে অর্জনের (জীবন মান, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা) খাতায় শূন্যতাই দেখেন শুধু!

অন্যদিকে দুই বাংলায় উদযাপনের ভিন্নতা বাংলার বিভক্ত দুই সমাজের বক্রতা ও বৈরিতারই যেন প্রতীকী ইঙ্গিত! একই সমাজের সন্তান হয়েও আমরা একে অপরের নদী পানি ও প্রকৃতিকে সঙ্ঘার চিন্তায় নিমগ্ন।

তাই এই পোশাকি উদযাপনের ভিতরে সমস্যার উত্তরণের ও জাতি হিসেবে আমাদের এগিয়ে যাবার বোধ তৈরির কোন কার্যকর বোধ ও আবেদন নেই। আছে শুধু উৎসব করার একটা খোলস।

তথাপি পূর্ব বাংলা সহ এতদাঞ্চলের প্রায় কাছাকাছি যাপিত জীবন বোধ ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারী জাতিসত্ত্বা গুলোর সবাইকে শুভ নববর্ষ। শুভ বাংলা নববর্ষ ১৪২৬।

"রোদ উঠে গেছে তোমাদের নগরীতে,
আলো এসে থেমে গেছে তোমাদের জানালায়, 
আনন্দ হাসিমুখ, চেনা চেনা সবখানে, 
এরই মাঝে চল মোরা হারিয়ে যাই!"

হাসিমুখে থাকুক বাংলার মানুষ ও বাংলাদেশ।

 লিখেছেন: ফাইজ আহমদ তাইয়েব

পঠিত : ৬৪৯ বার

মন্তব্য: ০