তারিখঃ ১৬ এপ্রিল, ২০১৯, ০২:৪৫
১৮৭০ সাল
থেকে নিয়ে এখন পর্যন্ত ইমাম গাজ্জালী ও ইসলামী জ্ঞান সভ্যতার ইতিহাস নিয়ে
ওরিয়েন্টালিস্টরা এক নির্জলা মিথ্যাচার করে আসছে। আর এতে যোগ দিয়েছে চরম
জাতীয়তাবাদী কিছু মুসলমান লেখক ও বুদ্ধিজীবী। তাদের ভাষ্য মতে, ইমাম গাজ্জালীর পরে
মুসলিম উম্মাহ চিন্তা, গবেষণা ও দর্শনে আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়ে। এর কারণ হিসেবে
তারা বলে থাকেন যে, ইমাম গাজ্জালী দার্শনিকদের সমালোচনা করে ‘তাহাফাতুল ফালাসিফা’
নামক বই রচনা করেছেন এবং তাদেরকে ২০ টি বিষয়ে কঠিন ভাবে সমালোচনা করেছেন ও তিনটি
পয়েণ্টে তাদেরকে তাকফীর করেছে।
যে তিনটি
বিষয়ে তিনি দার্শনিকদেরকে তাকফীর করেছেন সে তিনটি বিষয় হল,
ক) বিশ্বজগতের
চিরস্থায়িত্ব নিয়ে।
খ) আল্লাহ কুল্লি
( সামগ্রিক) সমূহ জানেন, কিন্তু জুযয়ী (আংশিক, অপ্রয়োজনীয়) সমূহ জানেন না।
গ) হাশর কি
শারীরিক (জিসমানী) হবে নাকি রূহানী হবে।
কিন্তু
ওরিয়েন্টালিস্টরা এই বিষয়টিকে ভুল ভাবে তুলে এনে তাকে চিন্তাশীলদের সামনে
ব্যাপকভাবে খাটো করার চেষ্টা করেছে। অথচ তিনি এখানে ঐ সময়ে এরিস্টটলের মেটাফিজিক্সকে
অনুসরণকারীদেরকে তাকফির করেছেন। ইমাম গাজ্জালীর তাহাফাতুল ফালাসিফা দার্শনিকদের
বিরুদ্ধে লেখা কোন গ্রন্থ নয়। নির্দিষ্ট একটি দার্শনিক গোষ্ঠীর জবাব দেওয়ার জন্য
তিনি এই বই লিখেছেন। যারা এরিস্টটলের মেটাফিজিক্সকে ধর্মীয় রূপ দেওয়ার চেষ্টা
চালিয়েছিলেন মূলত তাদের বিরুদ্ধে জবাব হিসেবে ‘তাহাফাতুল ফালাসিফা’ রচনা করেন। তিনি
নিজেও রাজনীতি, মানতিক, গণিত, ফিজিক্স ও আরও অন্যান্য বিষয়ে দার্শনিকদের কথার তিনি
বিরোধিতা করেননি এবং এই সকল বিষয়ে এরিস্টোটল বা অন্যান্য দার্শনিকদের চিন্তার
মধ্যে কোন সমস্যা নেই বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। এমনকি তাদের চিন্তা থেকে তিনি নিজেও
উপকৃত হয়েছেন।
অথচ যারা
সত্যিকারের সত্যপন্থী দার্শনিক তারা ‘মাকাসিদুল ফালাসিফা’ ও ‘তাহাফাতুল ফালাসিফা’
র লেখক ইমাম গাজ্জালী ‘ইন্টেল্লেকচুয়াল জায়ান্ট’ বলে অভিহিত করেছেন।
ওরিয়েন্টালিস্ট
ও জাতীয়তাবাদী কিছু মুসলমান চিন্তাবীদদের এই প্রোপ্যাগান্ডা এখনোও সারা দুনিয়ায়
বিশেষ করে আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক গ্রহণ যোগ্য। তাদের ভাষ্য মতে, আব্বাসী
খিলাফতের পতনের পরে এবং ইমাম গাজ্জালী সহ আরও অন্যান্য অনারব চিন্তাবিদদের কারণে
আমরা পেছনে পড়ে গিয়েছি!
আমরা সকলেই
জানি যে, ইমাম গাজ্জালী ১১১০ (হিজরী ৫০৫) সালে মৃত্যুবরণ করেন। ওরিয়েন্টালিস্ট কিংবা
মুসলিম ঐতিহাসিকদের লেখা ‘ইসলামী দর্শনের ইতিহাস’ নামক গ্রন্থ সমূহের দিকে যখন
তাকাই তখন দেখতে পাই যে, প্রায় সকলেই বলে থাকেন যে, ইমাম গাজ্জালী পরবর্তীতে সময়ে
মুসলমানদের মধ্যে ইসলামী দর্শন ও চিন্তা
বিলীন হয়ে যায়। তবে তার পরে দুইটি ধারা জারী ছিল এর মধ্যে একটি হল, উত্তর
আফ্রিকায়। ইবনে রুশদ, ইবনে খালদুন, ইবনে বাজা সহ আরও অন্যান্যরা ইসলামী দর্শন ও
চিন্তাকে উত্তর আফ্রিকায় জারী রাখেন। আর অপর ধারাটি হল ইরানের ইশরাকী ধারার
দার্শনিকগণ।
বর্তমান
সময়ে ইসলামী দর্শনের ইতিহাস সম্পর্কিত এনসাইক্লোপেডিয়া সমূহ কিংবা ইসলামী দর্শনের
ইতিহাস সম্পর্কিত বই সমূহের বেশীর ভাগ রচনা করেছেন ইরানী বংশোদ্ভূত চিন্তাবিদগণ। তাদের
কথা হল, না। ইমাম গাজ্জালীর পরে ইসলামী চিন্তা ও দর্শন মুলত উসমানী শাসনাধিন অঞ্চল
সমূহে নিঃশেষ হয়ে যায় কিন্তু মোল্লা সাদরার মাধ্যমে ইরানে তা জারী থাকে। তবে
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হল এই দুই অঞ্চলের বাহিরে সেলজুক সালাতানাত শাসিত অঞ্চল
সমূহ, সহ আরও অনেক অঞ্চলের কথা কেউ উচ্চারন করেনা! ইরান ও উত্তর আফ্রিকা ছাড়া কি
সেই সময়ে অবশিষ্ট মুসলিম শাসিত কিংবা মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল সমূহে কি কোন
চিন্তাবিদ বা দার্শনিক ছিলেন না? তারা আরও যে কাজটি করে থাকেন তা হল, ইবনে রুশদের
পরে সরাসরি উনবিংশ শতাব্দীতে চলে আসেন। আমার কাছে মনে হয়, এটা সম্পূর্ণভাবে
ওরিয়েণ্টালিস্ট ও জাতীয়তাবাদী মুসলিম লেখকদের একটি যৌথ প্রপাজ্ঞান্ডা।
আমাদেরকে
মনে রাখতে হবে যে, ইমাম গাজ্জলী একজন ছিলেন সেলজুকীয় চিন্তাবিদ। সেলজুক সুলতান মালিক
শাহ ও তার ওজীরে আযম নিজামূল মূলকের সাথে মিলেই তিনি মূলত তাকলিদের বিরুদ্ধে ইজতিহাদের
এক নতুন ধারা শুরু করেছিলেন। ইমাম গাজ্জালীর পরে ইসলামী চিন্তা ও দর্শন শেষ হওয়ার
অর্থ হল সেলজুল শাসিত অঞ্চল ও উসমানী অঞ্চলে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও দর্শন শেষ হয়ে
যাওয়া। আরব সহ বলতে সমগ্র ইসলামী বিশ্বে এই বিষয়টি শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে।
আমরা যদি
জ্ঞানের ইতিহাস সম্পর্কিত একাডেমিক গবেষনা কর্ম সমূহের দিকে তাকাই তখন দেখতে পাই
যে, গাজ্জালী পরবর্তী অর্থাৎ, সেলজুক ও
উসমানীদের সময় কালে ইসলামী দর্শন, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, গণিত, মানতিক,
চিকিৎসা বিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যায় বলতে গেলে কোন কাজি হয়নি! কেউ কেউ উল্লেখ করলেও
খুব যৎসামান্যই উল্লেখ করেছেন। শুধু দর্শন কিংবা বিজ্ঞান নয়, তাফসীরের ইতিহাসের
দিকে যদি তাকাই তাহলেও একই দৃশ্য আমরা সেখানেও দেখতে পাই। তাফসীরের ইতিহাসের
লেখকগণও পঞ্চম হিজরী পর্যন্ত আসেন এর পরে আরব তাফসীর কারকদের কিছু কাজকে উল্লেখ
করে মাঝখানে ৫ শত বছর বাদ দিয়ে সরাসরি আধুনিক তাফসীর লেখকদের কাছে চলে আসেন। তাহলে
মাঝখানের এই ৬০০ বছরে উসমানী খিলাফতের এত বড় বড় মুফাসসির, মুহাদ্দিস, জ্যোতির্বিদ,
পদার্থবিদ, স্থাপত্যবিদরা কি করেছেন? ঐ সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লাইব্রেরী ‘সুলেইমানিইয়া
কুতুবখানা’ তাহলে কে লিখে ভর্তি করল? মিমার সিনানের মত, চেলেবীর মত হাজার হাজার
চিন্তাবিদ কোথায় গেলো? ঊলূবেয়, ফাতিহ সুলতান মেহমেদ, জাওদাদ পাশা, তার মেয়ে আলিয়া বিশ্ববিখ্যাত
দার্শনিক, আল্লামা জাহিদ আল কাওসারী, মুস্তাফা সাবরী, ইসমাইল হাক্কি ইজমিরলি বলতে
গেলে এই সময়ে এত বেশী দার্শনিক, বিজ্ঞানী, আলেম উলামা জন্ম গ্রহণ করে যে যাদের নাম
লিখতেই শুধু কয়েকটি বইয়ের দরকার পড়বে।
প্রখ্যাত
জাপানী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক Toshihiko
Izutsu বলেন, ইসলামী দর্শন ও চিন্তা মূলত ইমাম গাজ্জালীর পরে
পূর্ণতা পেয়েছে।
তুরস্কের
প্রখ্যাত গবেষক ও দার্শনিক দুজানে জুন্দিওলু বলেন, আমাকে কেউ যদি বলেন, ইসলামী
জ্ঞানের ইতিহাসে ‘আল-মুকাদ্দিমা’ র সমপর্যায়ের আর কোন বই লেখা হয়েছে কিনা? তাহলে
আমি উত্তরে বলব, হ্যাঁ অবশ্যই হয়েছে আর সেটা হল, উসমানী খিলাফতের প্রখ্যাত ফকিহবিদ
আলী চেলেবি কিনালিযাদের লেখা ‘ আখলাকে আ’লা’। এমনকি মুকাদ্দিমার পাশে যদি কোন বই
আমার টেবিলে রাখি তাহলে এই বইকেই রাখব।
এখানে যদি
তাকাই তাহলে আরো মজার কিছু বিষয় আমরা দেখতে পাই, এই সকল বই পড়ে মনে যখন প্রশ্ন
জাগে, আচ্ছা চিন্তা ও দর্শনের ক্ষেত্রে এই মৃতাবস্থা কতদিন জারী ছিল? সবচেয়ে মজার
বিষয় হল এটা। ১৯১৪ সাল পর্যন্ত ইসলামী চিন্তা ও দর্শন মৃতাবস্থায় ছিল! আর এই সময়েই
আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সমগ্র আরব বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে!
পঠিত : ২৯৪৬ বার
মন্তব্য: ০