Alapon

বাংলাদেশ সংবিধানের যে বিষয়গুলো কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়না


বাংলাদেশ সংবিধান। যা বাংলাদেশের সকল আইনের প্রধান আইন। এক কথায় “মাদার ল”। সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বা সংবিধানের সাথে বিপরীত মত পোষন করে এমন সকল আইন পরিপুর্নভাবে বাতিল যোগ্য। বাংলাদেশ সংবিধান নিয় সমালোচনা করার ন্যুনতম যোগ্যতা আমার নেই। তবে আমার সামন্য মন্তিষ্কে যা বাংলাদেশ সংবিধানের মধ্যে সাংঘর্ষিক বলে মনে হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করার দাবী থেকে আজকের আমার এই লেখা। কারো যৌক্তিক মতামত কিংবা প্রশ্ন থাকলে অবশ্যই আসতে পারে।


সংবিধানের মূলনীতি প্রসঙ্গেঃ


সংবিধানের ৮ম ধারায় বলা হয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার মুলনীতি সমূহ হলঃ জাতীয়তাবাদ,সমাজতন্ত্র,গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা হবে রাষ্ট্র পরিচালনার মুলনীতি বলিয়া গণ্য হবে।


প্রশ্ন হচ্ছে এই চারটি মুলনীতির কোন সংজ্ঞা আমাদের সংবিধানের কোথাও দেয়া হয়নি। তার মানে কি? তাহলে কি এখানে কোন সূক্ষ ফাক রাখা হয়েছে? যদি রাখা হয়ে থাকে তাহলে কোন? তা না হলে মুলনীতি সমূহের সংজ্ঞা কি হবে তা পরিষ্কার করা দরকার।


রাষ্ট্র পরিচালনার মুলনীতির তৃতীয়টি হচ্ছে গণতন্ত্র এবং চতুর্থটি হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন The British writer George Jacob Holyoake (1817-1906) । সেকুলারিজম এর সংজ্ঞাতে বলা হয়েছে ‍secularism means “indifference to, rejection, or exclusion of religion and religious considerations”.এখানে বলা হচ্ছে রাষ্ট্রের সকল শাখা থেকে ধর্মকে উচ্ছেদ করা হবে। অন্যদিকে গণতন্ত্র democracy means the opinion of the people or to give the priority the opinion of the majority. এখানে গণতন্ত্রের অর্থই হল, সর্বোচ্চ সংখ্যক জনগনের মতামতকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে।


তাহলে একদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা বলছে, এখনে কোন ধর্মের নাম গন্ধতো থাকবে না সবাই সমান । কারা স্পেশালী কোন ধর্মীয় পরিচয় থাকবে না। আবার গণতন্ত্র বলছে সর্বোচ্চ মতের লোকদের অবশ্যই প্রধান্য দিতে হবে। তাহলে বাংলাদেশে যদি ইসলাম ধর্মের লোক বেশী হয় তাহলে ইসলাম ধর্মকে অবশ্যই প্রাধান্য দিতে হবে। ঠিক হিন্দু বৈর্ধ্য ধর্মের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোয্য। তাহলে এখানে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্র দুটি নিজেরাই দুটির সাথে সাংঘর্ষিক।


অন্যদিকে জাতিয়তাবাদ মানে, কোন এক জাতি,ধর্ম,বর্ন,ভাষা,গোত্র,অঞ্চলকে কেন্দ্র করে যে মতবাদ গড়ে ওঠে তাকেই জাতিয়তাবাদ বলে। যেমন বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশী জাতিয়তাবাদ। এখানে একটি জাতির আদর্শ কিংবা ভাষা সকল কিছু ঐ জাতির প্রয়োজনে গড়ে ওঠে। কিন্তু বাংলদেশ সংবিধানের মুলনীতির ধর্মনিরপেক্ষতা বলছে এখানে কোন একটি ধর্ম,গোত্র,ভাষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে না। সবাই সমান।


তাহলে এখানে জাতিয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা সরাসরি একে অন্যের বিরোধী। যদি ধর্মনিরপেক্ষতা বাস্তবয়ন করতে যাই সে ক্ষেত্রে জাতিয়তাবাদ এবং গণতন্ত্রের সাথে সরাসরি মূলনীতিগুলো কনফ্লিক্ট। এটার সমাধান হওয়া জরুরী। আমরা আমাদের মাদার ল এর মধ্যে এমন সাংঘর্ষিক বিষয় দেখতে চাইনা। সমাধান কোথায় ?


রাষ্ট্রধর্ম প্রসঙ্গেঃ


সংবিধানের ২ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু,বৌদ্ধ,খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য সকল ধর্ম সমান অধিকার পাবে। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, সংবিধান ঘোষনা করছে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। এটি আবার ধর্মনিরপেক্ষতার সাথে সরাসরি বৈপরিত্য। কারন সেকুলারিজম বলে এখানে কোন ধর্মের প্রাধান্য থাকবেনা। সাবই সমান। রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মকে কোন বিশেষ মর্যাদা দেওয়া যাবে না।


তাহলে একদিকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখা হয়েছে অন্যদিকে সেকুলারিজমকে ও রাখা হয়েছে। কার স্বার্থে এমন গোজামিলের আশ্রয় নেওয়া হয়েেেছ? তবে কি পলিটিশিয়ানরা রাজনৈতিক ফয়দা নেওয়ার জন্য এমন ধারা রেখেছেন? রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম না থাকলে ভোটের রাজনৈতিতে পিছিয়ে পড়তে হবে, সে ভয়েই এমন কিছু? এটি সমাধান হওয়া দরকার।


অন্যদিকে ২ক তে বলা হচ্ছে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম কিন্তু বা তবে ইংরাজিতে (but) বাট শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্চে এখানে এবং (and) শব্দ না ব্যবহার করে (but) তবে ব্যবহার করা হয়েছে কেন? ইংরাজিতে বাট (but) শব্দ ব্যবহারের কিছু নীতিমালা আছে। বাট (but) এমন জায়গায় ব্যবহারিত হয় যেখানে কিছু গ্যাপ থাকে। যেমন আমি আজ ক্লাসে গিয়েছিলাম কিন্তু . . . . . যার মানে হল ক্লাসে গিয়েছি ঠিকই কিছু গ্যাপ বা কোনকিছু অপুর্নতা রয়েছে।


যার মানে হচ্ছে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম কিন্তু এখানে গ্যাপ বা অপুর্নতা আছে এবং অন্যন্য ধর্মগুলোকেও সমান মর্যাদা দেওযা হবে। আমরা বিশ্বাস করি ইসলাম পরিপুর্ন জীবন ব্যবস্থা এখানে কোন অপরিপুর্নতা নেই। অন্তত মুসলিম হিসেবে আমাকে সেটা বিশ্বাস করাটা ঈমানে অপরিহার্য্য দাবী। তাহলে কেন এই সূক্ষ ত্রটি রাখা হয়েছে ?? কার স্বার্থে ?? আমরা জানতে চাই।


সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রসঙ্গেঃ


সংবিধানের ৯৬ (৩) দফায় বর্ণিত ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’-এর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণ প্রক্রিয়া ছেঁটে ফেলে দিয়ে চালু করা হলো সংসদের মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণ প্রক্রিয়া। এখন দেশের সবচেয়ে সম্মানিত, জ্ঞানী, শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত মানুষদেরকে ‘অযোগ্য’ ঘোষণার অধিকার পেল জাতীয় সংসদের সেই সব সদস্য যাদের মধ্যে অধিকাংশই অশিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত, খুনের আসামি, কালোবাজারি বা দুর্নীতিবাজ। অর্বাচীন পুরাণের ভবিষ্যদ্বাণী হয়তো সত্য হলো ( ‘কলিকালে শূদ্র রাজা হবে’ )


সরকার যা বলবে, যেভাবে বলবে তা-ই করতে বাধ্য হবেন মাননীয় বিচারকগণ। এর অন্যথা হলে চাকরির গলায় ফাঁসির রশি পড়তে সময় লাগবে না। এককথায় জনগণের আশ্রয়ের শেষ ঠিকানাটিও নিরাপদ থাকতে পারল না। স্বাভাবিকভাবেই বিচারকগণ নিজেদেরকে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত অনুগত রাখাকেই নিরাপদ এবং সন্তুষ্টির পথ হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য হবেন।


ত্রয়োদশ শতাব্দিতে ব্রাকটন বলেছিলেন, ‘রাজাকে অবশ্যই ঈশ্বর ও আইনের অধীন হতে হবে’। পরবর্তীতে আইনবিদ হেনরি জে আবরাহাম ‘জুডিশিয়াল রিভিউ’-এর সংজ্ঞা উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু ধরেই নেয়া যায় যে, যিনি বিচারককে অপসারণের ক্ষমতা রাখেন তার প্রণীত কোন আইন বা কার্যকে বাতিল করার ধৃষ্টতা বিচারক দেখাতে যাবেন না। সুতরাং কোন আইন করতে বা কোন কাজ করতে গিয়ে সরকারকে আর সাত পাঁচ ভাবতে হবে না যে সেটি সংবিধান পরিপন্থী বা অন্যায়মূলক হচ্ছে কি হচ্ছে না। অনায়াসে যাচ্ছে তাই করে যাবে বাধাহীন, বল্গাহীনভাবে।


ধর্মীয় অপব্যবহার প্রসঙ্গেঃ


সংবিধানের ১২গ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতা বাস্তবায়নের জন্য “রাজনৈতিক উদ্যেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার” বিলোপ করা হবে। এখানেও একটি সুক্ষ ত্রটি রাখা হয়েছে। আমরা জানি ধর্মীয় অপব্যবহার কোন ক্ষ্রেত্রেই গ্রহন যোগ্য নয়। কিন্তু এখানে বলা হয়েছে শুধু রাজনৈতিক উদ্যেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার করা যাবে না। তার মানে রাজনৈতিক উদ্যেশ্য ছাড়া অন্যন্য ক্ষেত্রে ধর্মীয় অপব্যবহার করা যাবে ?? ওখানে বলা যেত, সবক্ষেত্রেই ধর্মীয় অপব্যবহার নিষিদ্ধি। কিন্তু তা না বলে শুধূ ধর্মের ক্ষেত্রে কেন?? গব ক্ষেত্রেই অপব্যবহার পরিতাজ্য বলে আমররা মনে করি। তাহলে কেন এমন সূক্ষ ত্রুটি রাখা হয়েছে??


ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রসঙ্গেঃ


যেখানে বলা হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা বাস্তবায়নের জন্য সকল প্রকার ধর্মকে বিলুপ্ত করা হবে। কারো কোন স্পেশালিটি থাকবে না। আবার সংবিধানের ৪১ ধারাতে বলা হচ্ছে প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম পালনের অধিকার রয়েছে। তাহলে কেমনে হল? ধর্ম পালন বলতে কি শুধু মসজিদে বা ঘরে বসে ইবাদত করা? আমরা জানি আমাদের প্রিয় নবী সাঃ একই সাথে মসজিদের ইমাম ছিলেন অন্যদিকে রাষ্ট্র প্রধানও ছিলেন। তাহলে একদিকে রাষ্টীয়ভাবে ধর্মকে অস্বীকার করা হচ্ছে অন্যদিকে বলা হচ্ছে ধর্মীয় স্বাধীনতা দেওয়া হবে। দুটিই একে অন্যের সাথে বিরোধী। নাকি ভোটের রাজনীতিতে এটা না রাখলে দল ক্ষমাতায় থাকবে না সেজন্য এমন আইন রাখা হয়েছে?? বুঝে আসে না!


সংবিধানের ৫৭ (৩) ধারা অনুসারে বর্তমান প্রধান মন্ত্রীর ক্ষমতার নির্দিষ্ঠ কোন মেয়াদ নাই। ৫, ১০, ১৫ যা ইচ্ছা তিনি ক্ষমতায় থাকতে পরবেন। যতোক্ষন অন্য কেউ ক্ষমতা না নেবেন। ক্ষমতা কুক্ষিগত করার নব্য আইনের জন্য বাংলাদেশ এখন রোল মডেল হিসেবে পুরষ্কার পেতেই পারে। এছাড়াও সংবিধানে ১২৩ (৩) ধারাটি যথেষ্ঠ প্রশ্নের সম্মোখিন। যেখানে পূর্র্ববর্তী সাংসদ দের ক্ষমতা ছাড়ার ব্যাপারে প্রশ্ন থাকতেই পারে।


বিতর্কীত সিদ্ধান্তঃ


রাষ্ট্রের মুলনীতি সমূহ নীয়ে স্বয়ং আমাদের মহামান্য কোর্টই বিতর্কিত রায় দিয়েছে। মাসাদর হোসেন কেসে কোর্ট বলেছে, “the state shall ensure the separation of the judiciary”. কিন্তু আমাদের সংবিধানের ২২ ধারা বলে মুলনীতি জুডিশিয়ারিতে কার্যকর না। অন্যদিকে কুদরাতে ইলাহি ভার্সেস বাংলাদেশ কেসে বলা হয়েছে “the court (Appellate Division) said that it is not judicially enforceable.”



সুতরাং দেখা যায় যে একটা দেশের মুলনীতির ক্ষেত্রে যখন দেশের সুপ্রিম কোর্টই স্বয়ং দু রকম সিদ্ধান্ত দেয়। সেখানে আমদের কি বা করার আছে।


 A constitution is a set of fundamental principles or established precedents according to which a state or other organization is governed এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সংবিধানকে ১৬ বার কাটাছেড়া করা হলেও স্বাধ মেটেনি গনতন্ত্রের মানস কন্যাদের। সংবিধানের হৃদপিন্ড আর জানি কতবার সার্জারি করা হয় তার ঠিক নাই।


যাই হোক দূর হোক সংবিধানের সকল দ্বিধা বিভক্তি। পক্ষের বিপক্ষের কিংবা দলাদলি না করে দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আপ্রান পচেষ্ঠা থাক আমাদের হৃদয়ে আমাদের কলমে। আমাদের শানিত বুদ্ধিদীপ্ত প্রচষ্ঠাই হোক আগামী দিনের পথ চলার হাতিয়ার।

পঠিত : ১১৩০ বার

মন্তব্য: ০