Alapon

দাদন ব্যবসায়ীদের দৌরাত্বে জীবন হারাচ্ছে শফিকুলরা...

হাতে দুই বোতল বিষ! শেষরাত, কিছুক্ষণ পরেই হয়তো ফজরের আজান হবে। আলো আধারির মাঝে বোতল গুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন। তারপর একে একে দুই বোতল বিষ ঢোক ঢোক করে গিয়ে ফেললেন! বিষ খেয়ে চুপচাপ বসে আছেন। চারদিক কেমন যেন ঝাপসা লাগছে! খানিকটা অস্থিরতা...

এমন সময় মেয়েলি কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘আপনি এইখানে কী করেন? বিষ খাইছেন নাকি! বিষের গন্ধ আসে ক্যান?’
এ কথা বলেই গগনবিদারী কান্না জুড়ে দিলেন। তার কান্না শুনে আসেপাশের মানুষজন ছুটে আসতে লাগল। মহিলা কান্না জড়িত কন্ঠে বললেন, ‘আমার স্বামী বিষ খাইছে! ওরে ধরেন, একটু সাহায্য করেন। ওকে হাসপাতালে নিতে হবে।’

মানুষটার নাম শফিকুল। স্থানীয় কলেজে চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দুই মেয়েকে নিয়ে বেশ সুখের সংসার। একদিন জানতে পারলেন, তার বাড়ির পাশের জমিটা বিক্রি হবে। জমির দাম এবং রেজিষ্ট্রি খরচ বাবদ প্রায় কয়েক লাখ টাকার মামলা!

রাতে ভাত খাওয়ার বউকে বললেন, ‘সিদ্ধান্ত নিছি জমিটা কিনব! দরকার হইলে সমিতি থাকি লোন করে হইলেও কিনব।’
তার বউ সিদ্ধান্তটাকে পছন্দ করতে পারলেন না। বললেন, ‘ধার করে জমি কেনার কি দরকার। হামরা তো ভালোই আছি!’

কিন্তু তিনি বউয়ের কথা শুনলেন না। স্থানীয় সমিতি থেকে সুদের বিনিময়ে বেশ কিছু টাকা ঋণ নিলেন। সেই লোনের বিপরীতে মাসে মাসে সুদ পরিশোধ করতে হয়। কয়েকমাস সুদ পরিশোধ করতে না পারায়, সেই সুদেরও সুদ বাড়তে থাকল। এভাবে কিছুদিন চলার পর তিনি অন্য একটি সমিতি থেকে সুদের বিনিময়ে ঋণ গ্রহণ করলেন এবং সেই টাকা দিয়ে পূর্বের ঋণ পরিশোধ করলেন।

এভাবে চলতে চলতে একদিন সুদসমেত ঋণের পরিমাণ দাড়ালো ১৪ লাখ টাকা!

নির্দিষ্ট আয় দিয়ে সংসার, ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ মেটাবে নাকি সুদ পরিশোধ করবে! সময়মত সুদের টাকা না পাওয়ায় সুদের কারবারিরা প্রায়ই তার বাড়িতে এসে গালাগালি করত। এমনই একদিন পাওনাদার এসে পাওনা টাকার জন্য চাপাচাপি করতে থাকে। টাকা পরিশোধ করতে অপারগতা প্রকাশ করলে, সেই সুদের কারবারি গালিগালাজ শুরু করে। এক পর্যায়ে সে বলে, ‘টাকা পরিশোধ করবার না পারলে, তোর মা’কে নিয়া আসবি(!)’

এতোবড় অপমানজন কথা শোনার পর থেকেই শফিকুল স্তবদ্ধ হয়ে যায়। কেমন যেন শান্ত হয়ে যায়!

এরপর রাত নামে, কিন্তু শফিকুলের চোখে ঘুম আসে না। সারারাত ছটফট করতে থাকে। তার স্ত্রী প্রশ্ন করে, ‘আপনে এমন করতেছেন ক্যান?’
খানিকটা ধমকের সুরে বলেন, ‘ঘুমাইস না ক্যান? ঘুম দে!’
এক পর্যায়ে তার স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়ে!

স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়লে, শফিকুল শেষরাতের দিকে ঘর থেকে বের হয়ে যায়! বাড়ি থেকে অদূরে গিয়ে নিজ হাতে বিষ পান করে! তারপর?

তারপর, প্রথমে তাকে মিঠাপুকুর স্বাস্থ্য কমলেক্স-এ নেওয়া হয়। হাসপাতালে নেওয়ার সাথে বমি এবং পায়খানা করে দেয়! অবস্থা বেগতিক দেখে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে দ্রুতই রংপুর মেডিকেলে কলেজে নিয়ে যেতে বলেন।

রংপুর মেডিকেল কলেজে নেওয়া হলে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শেষে তাকে আইসিইউ-তে নেওয়া হয়। পরদিন চিকিৎসারত অবস্থায় শফিকুল ভাই ইন্তেকাল করেন।

আমার জন্মস্থান, মিঠাপুকুরকে বলা হয় সুদের ‘স্বর্গপুরি’! আর এই সুদের কারবারিদের আঘাতে এক শফিকুল আত্মহত্যা করলেও, শতশত শফিকুল প্রতিনিয়ত ধুকে ধুকে মরছে! এ-যেন আইয়্যামে জাহেলিয়াতের চেয়েও অন্ধকার অবস্থা!

পঠিত : ১২২০ বার

মন্তব্য: ০