Alapon

পাঠকের অভাবে সাহিত্যের মৃত্যু ঘটে না, পেশাদার লেখকের অভাবেই সাহিত্যের মৃত্যু ঘটে।

কিছুদিন আগে এক লেখকের সাথে দেখা হয়ে গেল। সংগত কারণে তার নাম লিখছি না। প্রথম দর্শনেই নিজের লেখা একখানা বই আমাকে উপহার দিলেন। লেখক পরিচিতিতে দেখলাম, তিনি কর্পোরেট জব করেন।
তখন তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘কর্পোরেট জব করে লেখালিখি করেন কখন?’
তিনি একগাল হেসে বললেন, ‘অফিসের পর অথবা ছুটির দিনগুলোতে যখন অবসর পাই তখন লেখালিখি করি!’

তার কথায় আমি কিছুটা অবাকই হলাম। তারপর বাসায় ফিরে বইটা খুলে যা আশঙ্কা করেছিলাম, ঠিক তাই! লেখায় সাবলিলতা বা প্রাঞ্জলতার লেশ মাত্র নেই! বাক্যের শুরু আছে শেষ নাই! কোনো কোনো বাক্য এতোই জটিল যে, বাক্য পড়া শুরুর পর যখন দাড়িতে পৌঁছাই তখন আর মনেই থাকে না, বাক্যের শুরুকে যেন কী ছিল! আর ব্যাকরণগত ভুলের কথা নাই বা বললাম। বইটা ১৩০ পেজের বই হলেও বইখানা শেষ করতে হয়ত আমার কয়েকবছর কেটে যাবে! কিন্তু তারপরও শেষ করতে পারব কিনা বিস্তুর সন্দেহ রয়েছে।

দিন কয়েক আগে এক সাহিত্য আড্ডায় বলেছিলাম, ‘বাংলা সাহিত্যের অস্তিত্বের প্রয়োজনে আমাদের প্রফেশনাল লেখক দরকার। আমার বিশ্বাস একমাত্র প্রফেশনাল লেখকদের দ্বারাই সুস্থ বাংলা সাহিত্যের বিকাশ এবং অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব। নচেৎ বাংলা সাহিত্যের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় কিনা, তা নিয়ে আমার বিরাট সন্দেহ রয়েছে!

সাহিত্য আড্ডায় উপস্থিত একজন মধ্যবয়সি বললেন, ‘লেখক হতে হলে ব্যাকরণ জানতে হবে কেন? বাংলা সাহিত্যের অস্তিত্বের সাথে প্রফেশনাল লেখকের কী সম্পর্ক?’

তখন বললাম, ‘কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটা ছেড়ে দিলেন, তখন নানাজন নানা কথা বলেছিলেন। কেউ বলেছিলেন, লোকটা বোকা! এমন বোকা মানুষ দুনিয়ায় হয় নাকি! তাদের এই কথার জবাবে হুমায়ূন আহমেদ চুপচাপ ছিলেন, কোনো জবাব দেননি!
এর কয়েকবছর পর ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটা না ছাড়তাম তাহলে আজকের এই হুমায়ূন আহমেদ হতে পারতাম না।’

ধরুন, আপনি একটি প্রাইভেট কার কিনেছেন। গাড়িতে পর্যাপ্ত তেল রয়েছে। যদিও আপনি ড্রাইভিং জানেন না, কিন্তু তারপরও ভাবছেন, ড্রাইভিং পারি আর না পারি আমার গাড়ি, আমি চালাবোই। এবং আপনি গাড়ি স্টার্ট দিয়ে এক্সেলেটরে চাপ দিলেন! তারপর? 
তারপর নির্ঘাত একসিডেন্ট করবেন। আর এই একসিডেন্টে হয়তো আপনার গাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হবে অথবা আপনার জীবন সংশয় দেখা দিবে।

লেখালিখি একটা মৌলিক কাজ! কিন্তু তারপরও আপনার বাসায় পর্যাপ্ত খাতা-কলম রয়েছে, অথবা ল্যাপটপ রয়েছে। এখন আপনি ভাবছেন, এসব যেহেতু আছেই অতএব আমি লেখালিখি করব। লেখালিখি হয়ে গেলে এখন আপনি ভাবলেন, আমার যেহেতু পর্যাপ্ত টাকা আছে সেহেতু এটাকে বই আকারে প্রকাশ করবই!

ড্রাইভিং না জেনে গাড়ি চালালে যেমন জীবন সংশয় ঘটতে পারে, তেমনি ব্যকরণ, ছন্দ, সাহিত্য ও ভাষাজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা না নিয়ে বই লিখতে গেলেও একসিডেন্ট ঘটতে পারে। আর এই একসিডেন্টের ফলে বাংলা সাহিত্যের মৃত্যু ঘটতে পারে। এবং ক্রমান্বয়ে বাংলা সাহিত্যের মৃত্যুই ঘটতে যাচ্ছে!

আমাদের দেশে অধিকাংশ লেখকরাই চাকরির পাশাপাশি লেখালিখি করেন। যার কারণে, বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি হুমায়ূন আহমেদ জন্ম নিতে পারেনি। লেখালিখি করা একট মৌলিক কাজ। তাই এই কাজটি মৌলিকভাবেই সম্পাদন করা উচিত।

অনেকেই বলেন, ‘পাঠকের অভাবে সাহিত্যের মৃত্যু ঘটে।’ এই কথাটি ভুল, আমি বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি, ‘পেশাদার লেখকের অভাবেই সাহিত্যের মৃত্যু ঘটে।


পঠিত : ২২৭৪ বার

মন্তব্য: ০