Alapon

বাংলাদেশীদের সৌদি বিদ্বেষ পর্ব ১৭

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
আবুধাবি, আজমান, দুবাই, আল ফুজাইরাহ, রাআস আল খাইমাহ, আশ শারিকাহ এবং
উম্ম আল ক্বাইওয়াইন আরবের এই সাতটি দেশ বৃটিশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিলো৷
১৯৭১ সালে দেশগুলো স্বাধীনতা লাভের পর আবুধাবির শাসক শেখ জায়েদ বিন সুলতান
আল নাহইয়ানকে প্রেসিডেন্ট এবং দুবাইয়ের শাসক শেখ রশিদ আল মাখতুমকে
প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করে "সংযুক্ত আরব আমিরাত" নামে আত্মপ্রকাশ করে৷শুরুতেই এই দুই শেখ বুঝতে পারেন, তেল এবং তেলের টাকা বেশিদিন থাকবে না,
অতএব এ টাকা অপচয় করা চলবে না ৷ এ টাকা  এমনভাবে ব্যয় এবং বিনিয়োগ করতে হবে
যাতে তেল ফুরিয়ে গেলেও আরব আমিরাতের অর্থনীতিতে কোন মন্দা প্রভাব না পড়ে৷
সেজন্য শুরুতেই তারা পর্যটিন শিল্পের দিকে গুরুত্ব দেন৷ পর্যটকদের আসা-
যাওয়ার জন্য এমিরেটস, ইতিহাদের মত এয়ারলাইন্স গড়ে তুললেন৷ দুবাই বিমান
বন্দর এখন আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের প্রধান জংশন৷ বুর্জ আল খলিফার মত
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্র, পার্ক, স্টেডিয়াম বিভিন্ন দিক দিয়ে আরব
আমিরাত এখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে উন্নত৷

আরব দুনিয়ার সবচেয়ে
ছোট দেশ কাতার৷ সৌদী আরবের পর উপসাগরীয় অঞ্চলে সবচেয়ে রক্ষণশীল সমাজ ছিলো
কাতারে৷ ১৯৯৫ সালে এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কাতারের আমির শেখ
খলিফা বিন হামাদ আল-থানিকে অপসারণ করে তার জৈষ্ঠ্যপুত্র যুবরাজ হামাদ
ক্ষমতা দখল করেন৷ ক্ষমতায় বসেই আমির হামাদ বিভিন্ন সংস্কার মূলক কাজ হাতে
নেয়৷

আমির হামাদ নারীদের ভোটাধিকার দিয়েছেন, যা আরব বিশ্বে বিরল।
তার দেশে আমেরিকান কলেজের ক্যাম্পাস খোলারও ব্যবস্থা করেছেন। এছাড়া
আমেরিকান সেনাঘাঁটি স্থাপন, আলজাজিরা চ্যানেল, কাতার এয়ারওয়েজ, দোহা
এয়ারপোর্ট, স্টেডিয়াম ইত্যাদি কাতারকে বিশ্ব দরবারে দিন দিন পরিচিত করে
তুলছে৷ গ্যাস থেকে অর্জিত রাজস্ব এর অর্থনীতিকে ফুলিয়ে- ফাঁপিয়ে দিয়েছে৷
ফলে কাতার এখন বিশ্বের সবচেয়ে ধনাঢ্য দেশগুলোর একটি।

আমিরাত এবং
কাতারের তুলনায় আয়তনে বড়, শক্তিশালী এবং সম্ভাবনাময় হওয়া সত্ত্বেও সৌদী
আরব এ দু'টো দেশ থেকে পিছিয়ে আছে৷ যদিও প্রত্যক্ষভাবে সৌদী আরবের সিংহাসনে
কিং সালমান বসে আছেন, কিন্তু পরোক্ষভাবে তেত্রিশ বছর বয়ষ্ক তার পুত্র
ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান দেশটি শাসন করেছেন৷ বিন সালমানের
পূর্বে আল সৌদ পরিবারের আর কেউ এত কম বয়সে ক্রাউন প্রিন্সের মর্যাদা লাভ
করেনি৷

সৌদী আরবকে একটি আধুনিক এবং উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে
এই তরুণ বেশ কিছু সংস্কারমূলক কাজে হাত দিয়েছেন৷ এর মাঝে ৫% ভ্যাট,
দ্রব্যমূল্য, পানি, বিদ্যুতে, আকামা ফি বৃদ্ধি, কিছু কিছু সরকারী ভাতা
বন্ধ, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৩০% সৌদীকে বাধ্যতামূলক চাকুরী প্রদান,
বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আজনবী নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদি৷ এই সংস্কারের কিছু
প্রভাব সৌদীদের উপর পড়ছে আর শতভাগ প্রভাব পড়ছে আমাদের উপর৷ আমাদের উপর
বলতে শুধু বাংলাদেশী না ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মিশর, তুরষ্ক সহ
বিশ্বের যত দেশের আজনবী (প্রবাসী) সৌদীতে বাস করে সবার উপর৷

এই
সংস্কারের ফলে অনেক আজনবীকে ব্যবসা, চাকুরী ছেড়ে দেশে চলে যেতে হচ্ছে৷
আবার অনেকে কাজ কর্ম না পেয়ে ভিক্ষুকের মত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন, খোলা
আকাশের নিচে ঘুমাচ্ছেন৷ এই বিষয়টাকে যদি আমরা প্রবাসী শ্রমিক এবং মানবিক
দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি তাহলে বিষয়টা অমানবিক৷ কিন্তু সৌদী নাগরিকদের দৃষ্টিতে
যাচাই করার আগে আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি একটু যাচাই করি-

বিভিন্ন
সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে দশ থেকে পঁচিশ লক্ষ ভারতীয় লোক কাজ করে৷
এই ভারতীয়দের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান উভয় ধর্মের লোক আছে৷ এদেরকে তাড়িয়ে
দিয়ে যদি আমাদের দেশের যুবকদের নিয়োগ করা হয়, তাহলে আমাদের প্রতিক্রিয়া
কেমন হবে? অন্যদের বিষয়টা আমার জানা নেই, তবে আমি বিষয়টাকে পুরোপুরি সমর্থন
করবো৷ সৌদী নাগরিকরাও তাই করছে৷ এগুলো ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয় সমস্যা৷


যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য নদীতে যখন সেতু নির্মাণ করা হয়, তখন খেয়া
পাড়ের মাঝিরা বেকার হয়ে যায়৷ বাচ্চাদের উন্নত স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে
আমরা যখন বিডি, প্রাণের মত কোম্পানীগুলার প্যাকেটজাত আচার, ঝালমুড়ি, বাদাম
কিনছি তখন এসব বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করা হকারেরা বেকার হচ্ছে৷
নির্মাণ শিল্পে উন্নতির জন্য আমরা যখন ক্রেনের মত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছি,
তখন অনেক রাজমিস্ত্রী কাজ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে৷ এগুলোর মানবিক
দিক বিবেচনা করে আমরা কিন্তু অনুন্নত থাকছি না৷ বিন সালমানের সংস্কার
কার্যক্রম প্রথম প্রথম সৌদীদের অসুবিধা সৃষ্টি করলেও এখন অনেকেই মেনে
নিচ্ছে৷

যেহেতু সিরিজটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে লেখা, তাই
নিজের ব্যক্তিগত সমস্যার কথা বলি, আমার এই সময় দেশে থাকার কথা৷ আজ এক মাস
আমার ছুটির দরখাস্ত পড়ে আছে, কোম্পানীতে ছাঁটাই চলছে৷ আমি নিজেও জানি না,
আমাকে ছাঁটাই করা হবে না ছুটি দেওয়া হবে৷ এখনো দেশে না আসাতে আমার পরিবার,
আত্মীয়-স্বজন এবং শুভাকাংখীরা উদ্বিগ্ন আছেন৷ এটা হলো আমার ব্যক্তিগত
সমস্যা৷ ব্যক্তিগত সমস্যাকে আমি যদি একটু আবেগ মিশিয়ে প্রকাশ করি, তাহলে
আমার শুভাকাংখী যারা আছেন, তারা শোনে সৌদী সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ব্যক্ত করবেন৷

ব্যক্তিগত সমস্যাকে ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় রূপ দিয়ে
অন্যদের সহানুভূতি আদায় করার প্রবণতা আমার মাঝে খুবই কম৷ আমি জানি, আজ অথবা
কাল আমাকে এখান থেকে যেতেই হবে৷ ধান কাটার মৌসুমে আমাদের এলাকায় বিভিন্ন
জেলা থেকে লোকজন এসে কাজ করে৷ মৌসুম শেষে তারা আবার চলে যায়৷ এখানে আমাদের
মত প্রবাসী কামলারা এর চেয়ে বেশি কিছু না৷ একজন দায়িত্ববান রাষ্ট্রপ্রধানের
দায়িত্ব হলো তার দেশের জনগণের কল্যানের কথা চিন্তা করা৷ বিন সালমান আমার
দেশের রাষ্ট্রপ্রধান না, আর আমিও সৌদীর নাগরিক না যে আমার কল্যানের কথা
চিন্তা করবেন৷

আমার কল্যানের চিন্তা করার দায়িত্ব আমার এবং দেশের
সরকারের৷ খেয়াপারের মাঝি যদি শুধু নৌকা চালানোর চিন্তা নিয়ে বসে থাকে
তাহলেতো তাকে না খেয়েই মরতে হবে৷ জীবন এবং জীবিকার জন্য যে হাতে বৈঠা
ধরেছিলো, সে হাতে তাকে কোদাল, কাস্তে তুলে নিতে হবে৷ অথবা অন্য কোন বিকল্প
চিন্তা করতে হবে৷

বিন সালমানের সংস্কারমূলক কাজগুলোর মাঝে সামাজিক
বনায়ন আছে, মিশর এবং পাকিস্তানের লোকেরা যা দেখাশোনা করে৷ দশটা গাছ লাগালে
মাস শেষে তিনটা টিকে বাকি সাতটা মরে যায়৷ আমরা যদি এগুলো দেখাশোনার সুযোগ
পেতাম তাহলে দশটার মাঝে আটটাই বাঁচত৷

চামড়া শিল্পে এদেশে একটা
সম্ভাবনা আছে৷ প্রতি বছর শুধু মাত্র কোরবানীতে বিশ থেকে ত্রিশ লক্ষ পশু
জবাই করা হয়৷ এদের চামড়াগুলো কি করা হয়, এ ব্যাপারে আমার সঠিক ধারণা নেই৷
আমরা যখন ছাগল জবাই করি, তখন চামড়া ডাস্টবিনে ফেলে দেই৷ এ চামড়া দিয়ে
চামড়াজাত পণ্য তৈরি করা যেতে পারে৷ কোরবানী চামড়ার ক্ষেত্রে জায়েয,
নাজায়েজের প্রশ্ন আসতে পারে, সেক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে ইসলাম অপচয়ও
সমর্থন করে না৷ এ চামড়ার অর্থ তাদের যাকাত-ফিতরাহ ফান্ডে দান করা যেতে
পারে৷ আমাদের রাষ্ট্রীয় উচ্চ পর্যায়ের আলেম এবং শিল্প প্রতিনিধিরা এ
ব্যাপারে যোগাযোগ করতে পারেন৷

আধুনিক সৌদী গঠনের জন্য এখানে আবাসিক
এলাকা, পর্যটন শিল্প, বাণিজ্যকেন্দ্র, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল গড়ে উঠছে৷
সেগুলো পরিচালনার জন্য শিক্ষক, চিকিৎস্যক, প্রকৌশলীর মত গুরুত্বপূর্ণ পদে
লোকের প্রয়োজন হবে৷ এক রিপোর্টে দেখলাম সৌদী যুবকদের প্রায় ১০% বেকার৷ এই
বেকার যুবকসহ শতভাগ সৌদী কাজে যোগ দিলেও ভবিষ্যতে সৌদীতে প্রবাসী শ্রমিক
প্রয়োজন হবে৷ সেই প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য আমাদের দেশে কি পরিমাণ দক্ষ
জনশক্তি আছে, কূটনৈতিকভাবেই বা আমরা কতটুকু প্রস্তুত?

আমিরাতের
জনসংখ্যার সাতাইশ ভাগ ভারতীয়, কাতার এবং মালেশিয়াতেও উচ্চ পর্যায়ের
চাকুরীগুলো ভারতীয়দের দখলে৷ দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে কিভাবে দেশের অর্থনীতিকে
সমৃদ্ধ করা যায়; তারা যখন সেই চিন্তায় ব্যস্ত, আমরা তখন "প্রিয়াংকা চোপড়া
বঙ্গভবনে আইলো না ক্যারে" এই চিন্তায় মগ্ন৷

আমাদের এই অমনোযোগীতার
সুযোগ নিয়ে ভারত, চীন, জাপানের মত দেশগুলো যখন সৌদী আরবের উন্নতির অংশীদার
হবে, আমরা তখনও সমালোচনা করে বলবো, "আমাদের সাথে না মিলে সৌদী আরব
কাফেরদের সাথে মিলছে৷" যেদেশে ব্যবসায়ীরা ধর্ম শেখায়, ষাঁড়েরা শিক্ষা দেয়,
ভাঁড়েরা দেশ চালায়, সেদেশের জনগণের কাছে সবকিছুই হায় হায়

পঠিত : ১৪১৭ বার

মন্তব্য: ০