Alapon

কাজী নজরুল ইসলাম কি সাম্প্রদায়িক কবি ছিলেন?

আজ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। একটি দেশের জাতীয় কবির জন্মদিন পালন হবার কথা কাজী নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রে সেটি তেমন একটা দেখা যায়। কারণ, কবি সাহিত্যিকদের জন্মদিন পালন করার দায়িত্বে যেসকল ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন তারা আবার এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন। কাজী নজরুল ইসলাম এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মুখোমুখি দাড় করিয়ে দিয়েছেন। তারপর তারা সেখান থেকে নিজেদের পছন্দনুযায়ী একজনকে বাছাই করে নিয়েছেন। আর বরাবরের মত সেই ভাগ্যবান কবি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গ্রহণ করতে গিয়ে আমাদের জাতীয় কবিকেই ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে। যার কারণে, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনে বাংলাদেশের সাহিত্যপাড়ায় যে সাজ সাজ রব এবং উৎসব ধারা বইতে দেখা যায় জাতীয় কবির বেলায় তার ছিটে ফোটাও দেখা যায় না।

সে যাই হোক, আজ কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন যতোটা অনাড়ম্বর পরিবেশে পালিত হচ্ছে, কবি ১২০ আগে যখন এইদিন জন্ম নিয়েছিলেন তখন কিন্তু এই অনাড়ম্বতার ছিটেফোটাও ছিল না। এক গরীব কাজী পরিবারে জন্মগ্রহণ করে কবিকে সারাটা জীবন ধরে ক্ষুধা, দারিদ্র ও অভাব-অনটনের মাঝে জীবন কাটাতে হয়েছে। সেই ইতিহাস আমরা কমবেশি প্রায় সকলেই জানি। 

আমি যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাই তা হল, আসলে জাতীয় কবি কার আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কার? আমরা জাতীয় কবি এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যেভাবে মুখোমুখি দাড় করিয়ে দিয়েছি তার যৌক্তিক অবস্থান কতটুকু?

মূলত কেউ কেউ বলে থাকেন, কাজী নজরুল ইসলাম হলেন সাম্প্রদায়িক কবি। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অসাম্প্রদায়িক কবি। যার কারনে আজকের সেক্যুলার পাড়া কাজী নজরুল ইসলামকে বাদ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গ্রহণ করেছে।

আসুন তার আগে জেনে নেই সাম্প্রদায়িকতা বলতে আমরা কী বুঝি। সাম্প্রদায়িকতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে সলিমুল্লাহ খান বলেছেন, ”যে গোষ্ঠী চেতনা বৃহৎ সমাজকে পাশ কাটিয়ে, ক্ষুদ্র গোষ্টিগত স্বার্থে অন্য ধর্ম, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের কেবল বিরোধিতাই নয় বরং অন্যের অধিকার দিতে অস্বীকার করে এবং ক্ষতি করতে করতে নিযুক্ত থাকে। পাশাপাশি যে চেতনা বা বিশ্বাস অন্য সম্প্রদায় বা ধর্ম বিশেষের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা কিংবা অন্য জাতির ঐতিহাসিক ও সম্মানিত চরিত্রকে হীন বা বিকৃত রূপে উপস্থাপন করতে নানাবিধ প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকে তাকেই সাম্প্রদায়িকতা বলে।অন্যায় কাজে স্বগোত্র-স্বজাতির পক্ষে দাঁড়ানোও সাম্প্রদায়িকতার অন্তর্ভুক্ত। যে বা যারা এই চেতনার লালন, পালন, বাস্তবায়ন ও প্রচার চালায় তারাই সাম্প্রদায়িক।'”

সংজ্ঞা যেহেতু জানা হয়ে গেল এবার আসি মূল কথায়। অসম্প্রদায়িকতার মূর্ত প্রতীক হিসেবে সেক্যুলার গংরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উপস্থাপন করেন। কিন্তু মজার বিষয় হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও সাম্প্রদায়িকতার চেতনা থেকে মুক্ত থাকতে পারেননি। 

১৮৯৮ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কন্ঠরোধ’ একখানি প্রবন্ধ রচনা করেন। সেই প্রবন্ধে তিনি বলেন, ''কিছুদিন হইল একদল ইতরশ্রেণীর অবিবেচক মুসলমান কলিকাতার রাজপথে লোষ্ট্রখণ্ডহস্তে উপদ্রবের চেষ্টা করিয়াছিল। তাহার মধ্যে বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, উপদ্রবের লক্ষটা বিশেষরূপে ইংরাজেরই প্রতি। তাহাদের শাস্তিও যথেষ্ট হইয়াছিল। প্রবাদ আছে, ইঁটটি মারিলেই পাটকেলটি খাইতে হয়; কিন্তু মূঢ়গণ ইঁটটি মারিয়া। পাটকেলের অপেক্ষা অনেক শক্ত শক্ত জিনিস খাইয়াছিল। অপরাধ করিল, দণ্ড পাইল; কিন্তু ব্যাপারটা কী আজ পর্যন্ত স্পষ্ট বুঝা গেল না। এই নিম্নশ্রেণীর মুসলমানগণ সংবাদপত্র পড়েও না, সংবাদপত্রে লেখেও না। একটা ছোটোবড়ো কাণ্ড হইয়া গেল, অথচ এই মূক নির্বাক্‌ প্রজাসম্প্রদায়ের মনের কথা কিছুই বোঝা গেল না।''

আমার বা আমাদের প্রতিপক্ষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নয়। আমাদের প্রতিবাদের বিষয় হল, কাজী নজরুল ইসলামকে বর্জনের কারণ! বলা হয়, কাজী নজরুল ইসলাম সাম্প্রদায়িক কবি। কাজী নজরুল ইসলাম নিজেও কখনো দাবি করেননি, আমি অসাম্প্রদায়িক। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় সবসময় একটি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে তা হল মানুষের অধিকার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন একদিকে ইংরেজ সরকারের স্তুতি গেয়েছে। ভিন্নদিকে কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ শাসনের যাতাতলে পিষ্ঠ হয়ে থাকা ভারতীয় জনগোষ্ঠিকে জাগিয়ে তুলবার জন্য কড়া ভাষায় কবিতা রচনা করেছেন। তিনি শোষণের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। নিজের স্বাধীনতার জন্য কলম চালিয়েছেন। 

একথা অনস্বীকার্য কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় সবসময় সাধারণ মানুষেরর আকাঙ্খা এবং চাওয়া স্পষ্ট ছিল। যার কারণে ব্রিটিশ সরকার কাজী নজরুল  ইসলামের ৫ বই কাব্যগ্রন্থসহ বেশ কিছু কবিতা নিষিদ্ধ করেছিল।

অধিকারের কথা বলা যদি হয় সাম্প্রদায়িকতা। সাধারণ মানুষের স্বাধীনতার দাবিতে কবিতা লিখতে গিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম যদি সাম্প্রদায়িকত চেতনার ফিল্টারে আটকে যান তবে সেটাই কাম্য! আর সেই কাজী নজরুল ইসলামকেই চিনি যিনি কবিতা লিখেছেন, অধিকারের, স্বাধীনতার এবং সাম্যের। আজীবন আমরা কবিকে এভাবেই জানতে চাই। 

পঠিত : ১০৯৬ বার

মন্তব্য: ০