Alapon

ছাত্রলীগের শিক্ষক লাঞ্ছনার কলঙ্কিত ইতিহাস


গত ৩০ মার্চ হাটহাজারীর বায়তুশ শরফ আদর্শ মাদ্রাসার সুপার মাওলানা ফরিদকে মাদ্রাসার স্টুডেন্ট কেবিনেটের নির্বাচন শেষে ফলাফল বিবরণীর তালিকা জমা দেয়ার জন্য উপজেলা শিক্ষা অফিসে যাওয়ার সময় উপজেলা সংলগ্ন কলেজ গেইট এলাকায় পরিকল্পিতভাবে শিবিরের প্রচারপত্র বিলি করার অভিযোগ এনে অর্ধশতাধিক ছাত্রলীগ নেতাকর্মী বেধড়ক মারধর করে । যার ভিডিওটি দেখলে যেকোন বিবেক সম্পন্ন মানুষের চোখে পানি আসতে বাধ্য । পরে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়।


ভাবছেন,পরিকল্পিত কেন বলছি? একটি সহজ সমীকরণ করলে  আপনিও আমার সাথে একমত হতে বাধ্য  হবেন।প্রথমত, উনি একজন মাদ্রাসা শিক্ষক এবং তিনি যে একজন ছাত্র নন তা নিশ্চিত । সে কারনে তার শিবির না করাটাও একেবারে নিশ্চিত কেননা শিবির একটি ছাত্রসংগঠন।সুতরাং শিবিরের প্রচারপত্র বিলির অভিযোগ একেবারেই অবান্তর (যদিও এক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকে যায় শিবির কি নিষিদ্ধ সংগঠন যে তার প্রচারপত্র বিলি করা অপরাধ!)। যদি বলা হত যে জামাতের প্রচারপত্র বিলি করছেন তাহলেও হয়তো বিশ্বাস করা যেত।



আপনারা কেউ কেউ হয়ত একে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে স্বাভাবিক ভাবেই নিচ্ছেন কিংবা ভাবছেন এটিও একটি রাজনৈতিক বিষয়,তাদের উদ্যেশে বলছি ছাত্রলীগের এই শিক্ষক লাঞ্ছনার বিষয়টি আজ নতুন কোন বিষয় নয়।ছাত্রলীগের ইতিহাসই হচ্ছে শিক্ষক লাঞ্ছনার ইতিহাস,জাতির বিবেককে পদদলিত করার ইতিহাস।যখনি ছাত্রলীগের অন্যায় আবদারগুলো মেটাতে প্রশাসন ব্যর্থ  হয়েছে তখনি ছাত্রলীগের হাতে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে জাতির বিবেক নামে পরিচিত এই শিক্ষক সমাজকে।আপনাদের উপলব্ধির জন্য তার বর্তমান আওয়ামী ক্ষমতার সময়কালীন অল্প কয়েকটি ধারাবাহিক উদাহরণ দিচ্ছি।


০৭ এপ্রিল ২০১০, হল দখলে বাধাদানকে কেন্দ্র করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হল প্রাধ্যক্ষ প্রফেসর ড. মুর্তুজা খালেদকে মারধর  এবং প্রক্টর প্রফেসর চৌধুরী মোঃ জাকারিয়াকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। (লিংক)


জানুয়ারী ২০১৩, তে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক গোলাম মইনুদ্দিনকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে একই বিভাগের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক মামুন খান। (লিংক )


২৪ মার্চ ২০১৪, ছাত্রলীগ নেতার সাথে বান্ধবীর অন্তরঙ্গ অবস্থানের প্রতিবাদ জানালে রোববার বাকৃবির শিক্ষক বদরুজ্জামান সরকার বিলুকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ এবং শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে বঙ্গবন্ধু হলের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা এস এম রায়হান। (লিংক)


০৭ এপ্রিল ২০১৪, ছাত্রলীগের অন্তঃকোন্দলে ছাত্রলীগের একাংশের কর্মীদের হাতে এক সাবেক ছাত্রলীগনেতা লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনার জেরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বাস সহ যানবাহনে হামলার ঘটনায় অন্তত ৫ জন শিক্ষক আহত হন। (লিংক)


১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪,  সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান শেষ করে আসার সময় ৫-৬ জন ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহকে মারধর করে এবং পরনের শার্ট ছিঁড়ে ফেলে। (লিংক)



১২ জুন ২০১৫, বগুড়া সরকারি শাহসুলতান কলেজে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় নকল করতে বাধা দেওয়ায় এক শিক্ষিকাকে লাঞ্ছিত করে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি বিশ্বজিৎ কুমার দাস। (লিংক)


৩১ আগস্ট ২০১৫, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবি) ভিসিবিরোধী শিক্ষকদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ ক্যাডাররা।তাতে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হাতে জাফর ইকবালের স্ত্রী ড. ইয়াসমিন হকসহ লাঞ্ছিত হন অনেক শিক্ষক। (লিংক)



৩০ অক্টোবর ২০১৫, তে চট্টগ্রাম সিটি কলেজ কেন্দ্রে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা শুরু হলে নগর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি নোমান চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৫/২০ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী জোর করে কেন্দ্রে প্রবেশ করে মোবাইল ফোনে প্রশ্নপত্রের ছবি তুলতে চায়। দায়িত্বরত পরিদর্শক ও ম্যাজিস্ট্রেট তাদের বাধা দিলে তাদের লাঞ্ছিত করে ছাত্রলীগ নেতারা। (লিংক)


১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, বরিশাল সরকারি কলেজে স্নাতক প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় আব্দুর রহিম নামের এক ছাত্রলীগকর্মীকে নকল করতে বাধা দেয়ায় শিক্ষককে প্রকাশ্যে মারধর করে সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি আল মামুন। (লিংক)



২৭ জুন ২০১৬, এইচএসসি’র প্রথম বর্ষে ভর্তির অপেক্ষমাণ তালিকায় নাম না থাকার পরও বহিরাগত ছাত্রলীগ কর্মীরা রোববার সকালে হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক আব্দুল মান্নান দেওয়ানের কাছে কাগজপত্র দাখিল করেন। এ সময় শিক্ষার্থীকে ভর্তি করতে বিলম্ব হওয়ায় ছাত্রলীগ কর্মীরা প্রভাষক আব্দুল মান্নান দেওয়ানকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ লাঞ্ছিত করে। (লিংক)


০৭ জানুয়ারী ২০১৭, আইবিএ ক্যান্টিনে বয়দের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদ করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানজিমউদ্দিন খানকে লাঞ্ছিত করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মনির হোসাইন। (লিংক)


২৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৭, নকলবাজ ছাত্রলীগ কর্মী ফাহিমের পরীক্ষার হলে অসদুপায় অবলম্বন ও শৃংখলাভঙ্গে বাধা দেয়ায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা অধ্যাপক আওয়াল আনসারীকে  লাঞ্ছিত করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা ওই শিক্ষককে ছাত্রলীগ কর্মীর  কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে। (লিংক)


১৯ র্মাচ ২০১৭, অধ্যক্ষকে শাসানো ও লাঞ্ছিত করা বরিশাল সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি রেজাউল ইসলাম ওরফে বাপ্পিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ (লিংক)


কেবল গত ৭-৮ বছরের ছাত্রলীগ কর্তৃক শিক্ষক লাঞ্ছনার প্রকাশিত অপ্রকাশিত এরকম শতাধিক ঘটনা পাওয়া যাবে। যেগুলোকে একত্রিত করলে একটি পূর্ণাঙ্গ বই হয়ে যাবে।


এই অন্যায়গুলোর প্রতিবাদও হয়না অনেক ক্ষেত্রেই,কখনো কখনো হলেও তা একেবারেই সীমিত পরিসরে রাজনৈতিক ক্ষমতা বিবেচনায় রেখেই। মজার বিষয় হচ্ছে এখানেও আজ রাজনীতির প্রভাব স্পষ্ট । সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দ্যেশ্যে শিক্ষকদের অন্যায়কেও সাপোর্ট দিতে দেখা যায় এই ছাত্রলীগকেই। যার ফলে ভালো ও সৎ শিক্ষকদের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর এভাবে শিক্ষকরা লাঞ্ছিত হতে থাকলে শিক্ষার মান ঠিক থাকতে পারে না।


মর্জাদার দিক থেকে মাতা পিতার পরেই শিক্ষকের অবস্থান। কতক ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীর জন্য শিক্ষকদের এই মর্যাদা ভুলুণ্ঠিত হচ্ছে।  আজ সময় এসেছে ছাত্রলীগের এই সন্ত্রাসী আচরনকে শিক্ষক,ছাত্র এবং আমজনতার ঐক্যবদ্ধ মোকাবেলার। যেই জাতি তার শিক্ষকদেরকে তথা জাতি গড়ার কারিগরদের সম্মান দিতে জানেনা, সেই জাতি কখনো সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারে না।

পঠিত : ৯৯৮ বার

মন্তব্য: ০