Alapon

যুবকদের দুনিয়া এবং ইসলাম

প্রফেসর ডঃ মেহমেদ গরমেজ
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন, ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আ’লা আশরাফিল আম্বিয়ায়ী ওয়া আসহাবিহি আজমাইন।
সম্মানিত শিক্ষকমণ্ডলী, সম্মানিত ডীন, প্রিয় যুবক বন্ধুগণ, সম্মানিত উপস্থিতি আসসালামু আলাইকুম।
আমি আমার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের এবং আমাদের দেশের যুবকদের আহবানে সাড়া দিয়ে তাদের আয়োজিত বিভিন্ন সেমিনার সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণ করার চেষ্টা করি। মালেশিয়া, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, বসনিয়া সহ আরও অনেক দেশে যুবক ভাইদের সাথে মেশার চেষ্টা করেছি। তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করেছি এবং তাদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছি। তবে তাদের কিছু কিছু প্রশ্ন আমার কাছে কঠিন মনে হয়েছে।
আমরা আমাদের মসজিদ, মাদ্রাসায়, বিশ্ববিদ্যালয়, সেমিনার ও কনফারেন্সে ইসলামকে বুঝানোর জন্য যে ভাষা ব্যবহার করি তার সাথে যুবকদের এবং শিক্ষার্থীদের সম্পর্কহীনতাকে বুঝতে চেষ্টা করেছি। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, একই বাড়িতে বসবাস কারী ২ ভাইয়ের মধ্যে যদি বয়সের ক্ষেত্রে ১ বছরেরও পার্থক্য থাকে কিন্তু তাদের দেখে মনে হয় তাদের মধ্যে যেন প্রজন্মের পার্থক্য আছে। এর কারণ হল দুনিয়ার দ্রুত পরিবর্তনশীলতা। আজ দুনিয়া খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। দুনিয়া আজ এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, যে কোন ধরণের তথ্য আজ খুব সহজেই এবং দ্রুত পাওয়া যায়। এমন একটি দুনিয়ায় যুবকদের দুনিয়ার সাথে আমার দুনিয়ার মধ্যে কিংবা পূর্বের প্রজন্মের সাথে পরবর্তী প্রজন্মের দুনিয়ার মধ্যে সম্পর্ককে বুঝতে চেষ্টা করেছি।
এই জন্য আমি আজকের এই কনফারেন্সের বিষয় নির্ধারণ করেছি, ‘যুবকদের দুনিয়া এবং ইসলাম’। তাই আমাদের ভবিষ্যৎকে বিনির্মাণ করার জন্য ‘যুবকদের দুনিয়া এবং এই দুনিয়ায় ইসলামের অবস্থান নির্ধারণ করা’ আজ আমাদের সবচেয়ে গুরত্ত্বপূর্ণ দায়িত্ত্ব।
প্রিয় যুবক ভাইয়েরা,
এই জন্য আজ আমি তোমাদের দুনিয়া নিয়ে কথা বলার জন্য এখানে এসেছি। আমি তোমাদেরকে উপদেশ কিংবা নসিহত করার জন্য আসিনি। আজ আমি তোমাদের সাথে আমার অন্তরকে মিলিয়ে একত্রে তোমাদের দুনিয়া নিয়ে কথা বলতে চাই।
প্রথমত যুবকদের দুনিয়াকে বুঝার জন্য মানুষকে বুঝা জরুরী। মানুষ সৃষ্টির কারণ, এই পৃথিবীতে তার দায়িত্ত্ব এবং কর্তব্য কি এটা সঠিক ভাবে জানতে হবে। যে সকল মূল্যবোধ সমূহ মানুষকে মানুষ বানিয়েছে এবং সে সকল মূল্যবোধ সমূহ থেকে দূরে সরে গেলে কোন ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে এই সকল বিষয় সমূহকে খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে।
যুবকদের দুনিয়াকে বুঝার জন্য, এই পৃথিবীতে মানুষের দায়িত্ত্ব, মহান আল্লাহ কতৃক তাদেরকে খলিফা হিসেবে নির্বাচিত করণ, বিশ্ব জাহান এবং সমগ্র সৃষ্টিকুলকে তার কাছে আমানত রাখা, মানুষ এবং আল্লাহর মধ্যকার সম্পর্ক (মিসাক), মানুষ এবং আল্লাহর মধ্যেকার চুক্তি আমাদেরকে ভালোভাবে বুঝতে হবে। এই সকল বিষয় নিয়ে চিন্তা গবেষণা করে বুঝা ব্যতিত যুবকদের দুনিয়াকে বুঝা সম্ভব নয়।
আজ আমরা যে দুনিয়ার বসবাস করছি এই দুনিয়া যুবকদের প্রতিষ্ঠিত কোন দুনিয়া নয়। প্রিয় যুবক ভাইয়েরা, আজ তোমরা আমাদের প্রতিষ্ঠিত দুনিয়ায় বসবাস করছ। তোমাদের পূর্বের প্রজন্মের প্রতিষ্ঠিত দুনিয়ায় বসবাস করছ।
আজকের দুনিয়ার যে অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার ও যুলুম নির্যাতন বিরাজ করছে এটা তোমাদের কর্মের ফলাফল নয়।কারণ এই দুনিয়াকে তোমরা প্রতিষ্ঠিত করনি। এই দুনিয়াকে তোমরা তোমাদের সামনে প্রস্তুত অবস্থায় পেয়েছ। তোমাদের জন্য এই দুনিয়াকে আমরা প্রতিষ্ঠিত করেছি। আজকের দুনিয়ায় যে যুদ্ধ-বিগ্রহ, শোষণ যে শোষণ চলছে এটা তোমাদের অপরাধ নয়। আজ ক্ষুধার কারণে মৃত্যুবরণকারী মানুষের চেয়ে মেদবহুলতার (Obesity) কারণে মৃত্যুবরণকারীর সংখ্যা বেশী। এর জন্য তোমাদের কোন জবাবদিহিতা নেই। কারণে এই দুনিয়াকে তোমরা প্রতিষ্ঠিত করনি। এই দুনিয়াকে তোমরা তোমাদের মীরাস (উত্তরাধিকার) স্বরূপ পেয়েছ।
আজকের এই দুনিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে কামনা, বাসনা এবং স্বার্থপরতা ও স্বার্থন্ধতা। আজকের এই দুনিয়ায় যুলুম ও নির্যাতনকারীরা কতৃত্বশালী। এটা তোমাদের অপরাধ নয় কারণ এই দুনিয়াকে তোমরা প্রতিষ্ঠা করনি।
তবে একটি বিষয় গুরত্ত্বপূর্ণ, এটা তোমাদেরকে ভালোভাবে বুঝতে হবে। তোমাদের পরবর্তী বংশধরদের জন্য এই দুনিয়াকে তোমাদের প্রস্তুত করতে হবে। আজকে যেমন আমরা তোমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মকে নিয়ে পক্ষে কিংবা বিপক্ষে কথা বলছি, তোমাদের পরবর্তী বংশধরেরাও তোমাদেরকে নিয়ে আলোচনা করবে। তোমাদের পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলবে। তোমরা কি তাদের জন্য ভালো একটি দুনিয়া মিরাস হিসেবে রেখে যাচ্ছ নাকি খারাপ একটি দুনিয়া রেখে যাচ্ছ? এটা নিয়ে তারা আলাপ আলোচনা করবে। এই জন্য আজ তোমাদের সবচেয়ে গুরত্ত্বপূর্ণ দায়িত্ত্ব হল, তোমাদের কাছে যে দুনিয়া আছে সেটাকে খুব ভালোভেব মূল্যায়ন করা এবং আমাদের কাজের সমালোচনা করা। তবে তোমাদের পরবর্তী বংশধরদের জন্য সুন্দর একটি দুনিয়া রেখে যাওয়ার জন্য প্রানান্তকর প্রচেষ্টা চালানো। আমরা যে ভুল করেছি, যে ভুলের কারণে আমরা আজ যে তোমাদের সামনে সমালোচিত হচ্ছি, তোমারাও যদি আমাদের মত ভুক্তভোগী না হতে চাও তাহলে তোমাদের সুন্দর একটি দুনিয়া প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
প্রিয় যুবক ভাইয়েরা,
প্রত্যেক মানুষই দুনিয়াতে একবার আসে। আল্লাহ কতৃক নির্ধারিত সময়সীমাকে আমরা বয়স বলে থাকি। মহান আল্লাহ কতৃক প্রদত্ত্ব সময়কে যদি আমরা এই পৃথিবীকে বিনির্মাণ করার জন্য কাজে লাগাতে পারি তাহলে সেই জীবনই হবে কেবলমাত্র অর্থবহ একটি জীবন। অন্যথায় আল্লাহ প্রদত্ত্ব সময়কে আমরা অপচয়কারী বলে গণ্য হব। বয়সের আরবী হল عمر এই عمر এবং اعمار একই উৎস (মাসদার) থেকে উৎসারিত। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
هُوَ أَنشَأَكُم مِّنَ الْأَرْضِ وَاسْتَعْمَرَكُمْ فِيهَا
অর্থাৎঃ তিনি তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি চান তোমরা যেন পৃথিবীকে বিনির্মাণ (اعمار ) কর।
একজন মানুষ পৃথিবীকে বিনির্মাণ করার জন্য যতটুকু বয়স (عمر) ব্যয় করে, সে মূলত ততটুকু সময়ই সঠিক ভাবে ব্যয় করে। তাছাড়া সে কেবলমাত্র বয়স (عمر) অপব্যয়কারী হিসেবে পরিগণিত হবে। একজন মানুষ পৃথিবীকে সভ্যতাকে বিনির্মাণ করার জন্য যতটুকু অবদান রাখে সে মূলত তার জীবনের ততটুকু সময়ই বেঁচে থাকে।
বয়স (عمر) বা জীবনের তিনটি পর্যায় রয়েছেঃ
১। শিশুকাল,
২। যৌবনকাল,
৩। বার্ধক্য।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার মহাগ্রন্থে প্রথম দুর্বল সময়, শক্তিশালী সময় এবং দ্বিতীয় দুর্বল সময় বলে আখ্যায়িত করেছেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন,
اللَّهُ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن ضَعْفٍ
অর্থঃ আল্লাহই দুর্বল অবস্থা থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেন। (রুম-৫৪)
মানুষের সন্তান যে পরিমাণে দুর্বল হয়ে জন্ম গ্রহণ করে অন্য কোন কিছুর বাচ্চা এত দুর্বল হয়ে জন্ম নেয় না। অন্য যে কোন পশু কিংবা পাখির বাচ্চাকে একা একা রেখে দিলে সে বেঁচে থাকতে পারে কিন্তু মানুষের নবজাতক সন্তানকে অল্প সময়ের জন্যও একা রেখে দিলে সে ক্ষুধা এবং পিপাসায় মৃত্যুবরণ করবে। এই জন্য শিশুকাল হল দুর্বল সময়কাল।
ثُمَّ جَعَلَ مِن بَعْدِ ضَعْفٍ قُوَّةً
তাঁরপর এ দুর্বলতাঁর পরে তোমাদের শক্তি দান করেন।
আয়াতে বর্ণিত এই শক্তি, আজ তোমরা যুবক হিসেবে যে শক্তির অধিকারী এই শক্তি।
ثُمَّ جَعَلَ مِن بَعْدِ قُوَّةٍ ضَعْفًا وَشَيْبَةً ۚ
এ শক্তির পরে তোমাদেরকে আবার দুর্বল ও বৃদ্ধ করে দেন।
প্রিয় যুবক ভাইয়েরা,
শিশুকাল হল ‘ তাকলিদের সময়’ বা অনুকরণের সময়। যৌবনকাল হল ‘তাহকীকের সময়’ বা কোন কিছুকে জেনে বুঝে চিন্তা করে শেখা। আর বৃদ্ধকাল হল ভোগ করার বা ব্যয় করার সময়। তোমরা যৌবনকালে যা অর্জন করবে বৃদ্ধ বয়সে এসে তা ব্যয় করবে। তোমরা যৌবনকালে যা শিখবে বৃদ্ধ বয়সে এসে তা শিক্ষা দিবে। এই জন্য জীবন নামক পূঁজি গুরুত্ত্বপূর্ণ। আর এই জীবন নামক পূঁজির মধ্যে যৌবনকাল হল সবচেয়ে বেশী গুরুত্ত্বপূর্ণ। এই জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সকল নবীগণকে যুবকদের মধ্য থেকে নির্বাচিত করেছেন।
এমন কোন নবী নেই যাকে বৃদ্ধ বয়সে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নবী বলে ঘোষণা করেছেন। সকল নবীগণই যুবক ছিলেন। আল্লাহ তাদেরকে যুবক বয়সে এই জন্য নির্বাচিত করেছিলেন যে, যেন তারা সুন্দর একটি দুনিয়া বিনির্মাণ করতে পারে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন,
ما بعث الله عز وجل نبيا إلا وهو شاب
আল্লাহ তার সকল নবীকে যুবকদের মধ্য থেকে নির্বাচিত করেছেন।
এই কথা বলে যুবকদেরকে তিনি বার্তা দিয়েছেন।
ولا أوتي عالم علما إلا وهو شاب
এবং এমন কোন আলেম নাই যাকে যুবক বয়সে জ্ঞান দান করা হয়নি।
এখানে একটি বিষয় আমি তুলে ধরতে চাই, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ইসলামের ইতিহাস বিষয়ক বিভিন্ন ধরণের ছবি ও ডকুমেন্টারী দেখানো হয়ে থাকে। সেই সকল চ্যানেলে যে সকল আলেমকে দেখানো হয় তাদের সকলের বয়সই ষাট কিংবা তার ঊর্ধ্বে। এর মাধ্যমে তারা আমাদেরকে একটি বার্তা দেয়, সেই বার্তাটি কি? সেই বার্তাটি হল, ইসলাম হল ষাট ঊর্ধ্ব বৃদ্ধদের জন্য আর বৃদ্ধ হওয়া ছাড়া আলেম হওয়া যায় না! এই দ্বীন যুবকদের জন্য নয়। এই দ্বীন যুবকদেরকে উদ্দেশ্য করে কথা বলে না। কিন্তু বাস্তবতা আসলে কি? আমি এটা নিয়ে আপনাদের সামনে কয়েকটি উপমা তুলে ধরতে চাই।
আমাদের সকলের পরিচিত একটি হাদিস গ্রন্থের নাম হল রিয়াদুস সালিহীন। পৃথিবীর সকল প্রান্তের মুসলমানগনই এই গ্রন্থটি পাঠ করে থাকে। এই কিতাবের লেখক ইমাম নববী মাত্র ২২ বছর বয়সে এই গ্রন্থটি রচনা করেছেন। এবং তিনি মাত্র ৩৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। যুবক বয়সেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ইমাম গাজালী, মানতিক ও উসূলের গ্রন্থ ২১ বছর বয়সে রচনা করেন। যা আজ ইসলামী জ্ঞানের অন্যতম গুরুত্ত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ রূপে আমাদের সামনে রয়েছে। তিনি ৫১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। অথচ তোমাদের মনমস্তিষ্কে ও কল্পনায় ইমাম গাজালীকে ১০০ বছর বয়সী বৃদ্ধ একজন মানুষ বলে অঙ্কিত করা হয়েছে। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইহইয়াহু উলুমুদ্দীন’ যখন তিনি লেখা শুরু করেছেন তখন তার বয়স ছিল তিরিশের কোটায়। গাজালীর সমগ্র গ্রন্থ সমূহকে যদি হিসাব করা হয় তাহলে দেখা যায় যে, তিনি দিনে গড়ে ৮০ পৃষ্ঠা করে লিখতেন। ‘মুয়াল্লাফাতুল গাজালী’ বা গাজালীর রচিত গ্রন্থ সমূহ নিয়ে আমাদের কাছে একটি গ্রন্থ রয়েছে। এটি মূলত একটি পিএইচডি থিসিস। গবেষক এখানে গবেষণা করে বের করেছেন যে, ইমাম গাজালীর লিখিত বইয়ের সংখ্যা ৫০৭ টি। শুধুমাত্র তার লিখিত বই সমূহ দিয়েই একটি লাইব্রেরী ভর্তি করা সম্ভব। তার লিখিত গ্রন্থ সমূহ সাধারণ মানের কোন গ্রন্থ নয়। ফিলোসফি বা দর্শন শাস্রের সর্বোচ্চ মান সম্পন্ন গ্রন্থ সমূহও লিখেছেন আবার উসূলে ফিকহের উপরেও সর্বোচ্চ মানের গ্রন্থ রচনা করেছেন। কেবলমাত্র ইমাম গাজালীর বই সমূহের নামের উপর ভিত্তি করেই একটি সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
তাকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, এত কম সময়ের জীবনে এত বেশী কাজ কিভাবে করেছেন?
তিনি তাদেরকে জবাবে বলেন যে, ‘আমি আল্লাহর কাছে সময়ের মধ্যে সময় চেয়েছিলাম’। আমি আমার প্রত্যেকটি দোয়াতেই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে বলেছি যে, হে আল্লাহ আমাদের জীবন খুবই অল্প সময়ের জন্য, কিন্তু কাজ অনেক বেশী। তুমি আমার প্রতি অনুগ্রহ করে আমাকে সময়ের মধ্যে সময় দান কর। আমি যেন কম সময়ের মধ্যে অনেক ভালো কাজ করতে পারি’। এইভাবে ইমাম গাজালী, গাজালীতে পরিণত হন।
আজ আমাদের তুরস্কে ১০০ র বেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামীক থিওলজি ডিপার্টমেন্ট রয়েছে। গাজালী একাই ইসলামী সভ্যতা বিনির্মাণে যে অবদান রেখেছেন, আমাদের এই সকল ডিপার্টমেন্ট সমূহ কি সেই ভূমিকা পালন করতে পারবে? ১০০ বছর বা ২০০ বছর পরে মুসলিম উম্মাহ আমাদেরকে কিভাবে মূল্যায়ন করবে? আজ আমাদের নিজেদেরকে এই প্রশ্ন করা উচিত।
প্রিয় যুবক ভাইয়েরা,
মুসলিম উম্মাহ আজ ইমাম গাজ্জালীদের অপেক্ষায়। মুসলিম উম্মাহ আজ ইবনে সিনাদের অপেক্ষায়। মুসলিম উম্মাহ আজ ফখরুদ্দীন রাজীদের অপেক্ষায়। আমাদের নিকট অতীতের আলেম ও দার্শনিক হলেন আল্লামা ইকবাল, আলিয়া ইজ্জেত বেগভিচ। আজ তোমাদেরকে তাদের শুন্যস্থানকে পূরণ করতে হবে।
সকল নবীগণই ছিলেন যুবকদের মধ্য থেকে। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) যখন নমরুদের প্রতিষ্ঠিত মেসোপটেমিয়ায় ‘তাওহীদের সংগ্রাম’ পরিচালনা করেন তখন তিনি একজন যুবক ছিলেন। কোরআনের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে কোরআন বলেছে,
قَالُوا سَمِعْنَا فَتًى يَذْكُرُهُمْ يُقَالُ لَهُ إِبْرَاهِيمُ
(কেউ কেউ) বললো, “আমরা এক যুবককে এদের কথা বলতে শুনেছিলাম, তার নাম ইবরাহীম৷” (আম্বিয়া – ৬০)
এই যুবক ইব্রাহীম পৃথিবীকে শিরকের নাগপাশ থেকে মুক্ত করার জন্য একাই তাওহীদের এক মহাসংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। হাজার হাজার বছর পরে এসে মুহাম্মাদ রাসূলূল্লাহ (সঃ) বলেছিলেন, আমি আমার পিতা ইব্রাহীমের দোয়ার ফল।
হযরত ইসমাইল যখন তার পিতার সাথে এই সংগ্রামে শামিল হোন, তিনিও তখন একজন যুবক ছিলেন।
হযরত ইউসুফ পূর্বে কূপে নিক্ষিপ্ত হোন এবং যুবক বয়সে এসে মিশরের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হোন।
হযরত ঈসা, হযরত মূসা সহ সকল নবীগণ যুবক বয়সে নবুয়ত প্রাপ্ত হয়ে আল্লাহ প্রদত্ত্ব দায়িত্ত্বকে বাস্তবায়ন করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
যুবকগণ যখন আমাদেরকে প্রশ্ন করেন যে, উস্তাজ আমরা কাকে দেখব? আমাদের সামনে তো কোন রোল মডেল নাই। আমি মনে করি এই প্রশ্ন করার অধিকার তাদের রয়েছে।
আমি তাদেরকে এই প্রশ্নের জবাবে বলি, কোরআন খুলে দেখ, সেখানে উল্লেখিত নবীগনের সকলেই যুবকদের জন্য রাহবার (অনুকরনীয় ব্যক্তিত্ত্ব)। আল্লাহর নবীদের চেয়ে কী আর কোন বড় রোল মডেল বা অনুকরনীয় আদর্শ হতে পারে?
মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে বলা হয়েছে,
فَبِهُدَاهُمُ اقْتَدِهْ
তুমিও তাদের পথে চল, তাদের অনুসরণ কর। (সূরা আনআম-৯০)
নবীগণই শুধুমাত্র যুবক ছিলেন না, তারা তাদের সংগ্রামের জন্য, তাদের সঙ্গীদেরকেও যুবকদেরকে মধ্য থেকে নির্বাচিত করেছিলেন। সকল নবীদের প্রথম সারির সঙ্গী সাথী গণ ছিলেন যুবকদের মধ্য থেকে।
প্রিয় যুবক ভাইয়েরা,
বড় বড় সাহাবীদেরও সকলেই ছিলেন যুবকদের মধ্য থেকে। কিন্তু আজ বই-পুস্তক, উপন্যাস, গল্প এবং সিনেমার মাধ্যমে তাদেরকে বৃদ্ধ বলে আমাদের সামনে উপস্থাপণ করা হয়েছে। মক্কায় রাসূলে আকরাম (সঃ) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হল দারুল আরকাম। আপনারা কি জানেন কে এই আরকাম? যে তার ঘরকে আল্লাহর রাসূলের সাহাবীদের জন্য উম্মুক্ত করে দিয়েছিলেন? যেখানে বসে রাসূল (সঃ) তার সংগ্রামকে পরিচালনা করতেন। এই আরকাম তখন ছিলেন মাত্র ১৯ বছর বয়সী একজন যুবক।
রাসূলে আকরাম (সঃ) এর প্রথম প্রজন্মের সাহাবীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী বয়স্ক কে ছিলেন? হযরত আবু বকর (রাঃ)। হযরত আবু বকর (রাঃ) যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তিনি কত বছর বয়স্ক ছিলেন? তখন তার বয়স ছিল ৩৭ বছর! হযরত উমর (রাঃ) যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তার বয়স ছিল ৩০ বছর। হযরত উসমান (রাঃ) ৩৩ বছর বয়সী ছিলেন। হযরত আলী (রাঃ) মাত্র ৯ বছর বয়সী ছিলেন এবং তিনি যখন ইসলামের পতাকা হাতে নিয়ে জিহাদের ময়দানে এগিয়ে যান তখন তিনি ছিলেন ২০ বছর বয়সী।
হিজরতও সর্বপ্রথম শুরু করেন যুবকরা। হাবেশিস্তান এবং মদিনায় সর্বপ্রথম হিজরত করেন যুবকগণ। রাসূলে আকরাম (সঃ) বিভিন্ন অঞ্চলে গভর্নর প্রেরণ করেন, এই সকল গভর্নরদের সকলেই ছিলেন যুবক। ইসলামী সভ্যতার মৌলিক বিষয়সমূহকে শিক্ষাদানকারী হাদীস সমূহের রাবী হযরত মুয়াজ ইবনে জাবালকে যখন ইয়েমেনের গভর্নর হিসেবে পাঠানো হয় তখন তার বয়স ছিল ২১ বছর।
প্রিয় যুবক ভাইয়েরা,
এই জন্য তোমাদের জন্য সবচেয়ে বড় আদর্শ (রোল মডেল) হলেন নবীগণ, তাদের সাহাবীগণ এবং ইসলামী সভ্যতার মহান আলেমগণ।
যুবকদেরকে জীবনকে ধ্বংসকারী ৩ বিষয় রয়েছে,
১। অবসর সময়,
২। অবসর মস্তিষ্ক
৩। অবসর অন্তর।
তোমরা যদি এই ৩ টি জিনিসকে ভালোভাবে পরিপূর্ণ করতে পার তাহলে তোমরা আজকে যে অভিযোগে আমাদেরকে অভিযুক্ত করছ, তোমাদের পরবর্তীগণ তোমাদেরকে এই সকল অভিযোগে অভিযুক্ত করতে পারবে না। এই তিনটি বিষয়কে যদি ভালোভাবে পূর্ণ করতে পার, তাহলে তোমরা তোমাদের পরবর্তী বংশধরদের জন্য অনেক সুন্দর একটি দুনিয়া রেখে যেতে পারবে।
যুবক ভাইয়েরা আমাদের জীবনে যেন অবসর সময় বলতে কোন বিষয় যেন না থাকে। কেননা কিয়ামতের দিন যে সকল প্রশ্ন করা হবে তার মধ্যে গুরত্ত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, عَنْ عُمْرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ , وَعَنْ شَبَابِهِ فِيمَا أَبْلاهُ অর্থাৎ তার জীবন সম্পর্কে সে কোথায় তা ব্যয় করেছে, এবং তার যৌবনকাল সম্পর্কে সে কোথায় তা ব্যয় করেছে।
এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সমগ্র জীবনকালের মধ্যে যৌবনকালের ব্যাপারে আলাদা ভাবে হিসাব নেওয়া হবে। তোমরা এমন যুব সমাজ যারা হক্বের পথে চলছ। হক্বের পথের পথিক যুবকরা তাদের জীবনকে ভার্চুয়াল জগতের অধিনস্ত করে রাখতে পারে না। জীবনকে ভার্চুয়াল জগতের কাছে সমর্পণ করে দিয়ে হাকীকত থেকে দূরে সরে যাওয়া এবং সময় ব্যয় করা একটি জাতির বিকাশের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। এই জন্য আমাদের জীবন পরিকল্পিত হওয়া উচিত। যদিও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং অন্যান্য ইবাদতের মাধ্যমে পরিকল্পনা মাফিক করে দিয়েছেন। কিন্তু তোমাদের উচিত হবে নিজের জীবনকে সাজিয়ে নেওয়া যেন এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট না হয়।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি যুবকদের জন্য বিপদজনক তা হল, ফাঁকা (অলস) মস্তিষ্ক। এই ফাঁকা মস্তিষ্ককে যে মূল্যবান জিনিস দিয়ে পূর্ণ করতে হবে তা হল, ইলিম, হিকমাহ এবং মারিফাত। এই বিষয় সমূহই কেবলমাত্র আমাদের মস্তিষ্ককে পরিপূর্ণভাবে পূর্ণ করতে পারবে। অন্য কোন কিছু নয়। তোমাদের উচিত হবে সর্বদায় উপকারী জ্ঞানের পেছনে দৌড়ানো। তোমরা তোমাদের মস্তিস্ককে ভর্তি করবে এবং পূর্ণ করবে।
তবে এই বিষয়টির প্রতি খেয়াল রাখতে হবে, মস্তিষ্ককে কেবলমাত্র তথ্য দ্বারা ভর্তি করে রাখার নাম মস্তিষ্ককে পূর্ণ করা নয়। আজ আমাদের এই যুগে হান্দাসাতুল জাহলিয়া বা মূর্খতার ইঞ্জিনিয়ারিং সব জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই পদ্ধতি মানুষকে শিক্ষা দিয়ে মূর্খ বানায়। হান্দাসাতুল জাহলিয়া বা মূর্খতার ইঞ্জিনিয়ারিং যুবকদের হাতে সার্টিফিকেট তুলে দিয়ে তাদেরকে মূর্খ বানিয়ে রাখে। সবচেয়ে খারাপ মূর্খতা হল, শিক্ষিত জাহিল বা মূর্খ। সবচেয়ে বিপজনক মূর্খতা (জাহেলিয়াত) হল শিক্ষা দানের মাধ্যমে যে মূর্খতা (জাহেলিয়াত) শিক্ষা দেওয়া হয়। এই জন্য তোমাদের নির্বাচক হতে হবে। তোমাদের মস্তিষ্ক ও মেধা অপ্রয়োজনীয় তথ্যভাণ্ডারের ডাস্টবিনে যেন পরিণত না হয়।
তোমাদের মস্তিষ্ক সমূহ যেন কেবলমাত্র হাকীকত, সুন্দর, সঠিক এবং উপকারী জ্ঞানের ভাণ্ডারে পরিণত হয়।
প্রিয় যুবক ভাইয়েরাঃ
আজকে আমরা এমন এক দুনিয়ায় বসবাস করছি যে দুনিয়ায় সবচেয়ে সহজ বিষয় হল তথ্য আহরণ করা। যে কোন মুহূর্তে যে কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া আজ অনেক সহজ সাধ্য হয়েছে। দীর্ঘ ২০ বছর বিরতীর পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় ক্লাস নেওয়া শুরু করেছি। ২০ বছর আগে যখন ক্লাস নিতাম তখন আগে ক্লাসে প্রবেশ করে চক দিয়ে প্রথম ১৫ মিনিটে হাদীস সমূহ এক এক করে লিখতাম। এর পর লাইন ধরে ধরে ওই সকল হাদীস শিক্ষার্থীদেরকে বুঝাতাম।

পঠিত : ৪২২০ বার

মন্তব্য: ০