Alapon

মনের সাথে চোখের সম্পর্ক...

মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে চোখকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। চোখকে ক্যামেরার লেন্সের সাথে তুলনা করলে মনকে ক্যামেরার ফিল্মের সাথে তুলনা করা যায়। ক্যামেরার লেন্স যা দেখে তাই ভেতরের ফিল্মে ছবি হয়ে যায়। তেমনি চোখের লেন্স দিয়ে যা দেখা হয় তাই মনের ফিল্মে ছবি হয়ে ফুটে ওঠে। তাই মনকে পবিত্র রাখতে হলে অপবিত্র দৃশ্য দেখা থেকে চোখকে ফিরিয়ে রাখতে হবে।

কুরআনে মুমিনদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, পরনারীর উপর চোখ পড়ার সাথে সাথে নামিয়ে নিতে হবে এবং আবার দেখা থেকে চোখকে ফেরাতে হবে। যেসব মহিলার সাথে বিয়ে জায়েজ নয় তারা ছাড়া অপর মহিলার দিকে মনোযোগ দিয়ে দেখলে তার ছবি মনে অংকিত হয় এবং সে ছবি মনকে অপবিত্র করতে থাকে। রাস্তা-ঘাটে বা পত্র-পত্রিকায় নৈতিকতার দৃষ্টিতে আপত্তিকর যত রকম দৃশ্য চোখে পড়ে তার প্রতি মনে ঘৃণা জন্মাতে হবে এবং সেসব থেকে সযত্নে চোখকে বাঁচিয়ে চলতে হবে। তাহলে মনের পবিত্রতা রক্ষা করা সহজ হবে।

তসবীহ পড়া বা যিকর করার সময় চোখ বন্ধ রাখলে মনের একাগ্রতা বহাল রাখা সহজে সম্ভব হয়। কারণ চোখ যা দেখে মনকে সে তা দেখায়। নামাযে সব সময় চোখ বুজে থাকা মাকরুহ বলে চোখ বন্ধ রাখার ফাঁকে ফাঁকে চোখ খুলতে হবে। মনকে নামাযে নিবদ্ধ করার প্রয়োজনে চোখ বন্ধ রাখা জায়েয। সব সময় চোখ বুজে নামায আদায় করলে চোখের ট্রেনিং হয় না। নামাযের বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে দেখার বিধান রয়েছে যাতে চোখকেও আল্লাহর হুকুম এবং রাসূলের তরীকা অনুযায়ী ব্যবহার করার ট্রেনিং হয়। এ ট্রেনিং এর উদ্দেশ্য হলো নামাযের বাইরে চোখকে আল্লাহর হুকুম ও রাসুলের তরীকা মেনে চলার যোগ্য বানানো। যাদের নিকট মনের পবিত্রতা রক্ষারও গুরুত্ব রয়েছে তাদেরকে চোখের নিযেন্ত্রণে অবশ্যই সচেষ্ট হতে হবে।

মনের অবসর সময়ের কাজ:

অংগ প্রত্যঙ্গ দিয়ে আপনি যখন কাজ করেন তখন ঐ কাজটি ভালভাবে সমাধা করার জন্য মনোযোগ দিয়েই কাজটি করতে হয়। অবশ্য এটা কাজের ধরনের উপর অনেকটা নির্ভর করে। কৃষক ও শ্রমিকদেরকে শুধু হাত-পা ব্যবহার করে গতানুগতিক ধরনের এমন কাজও করতে হয় যে কাজে মনের তেমন কোন দায়িত্ব থাকে না। রিকশাওয়ালার দেহ রিকশা টেনে নিয়ে যাবার সময় এ কাজে মনের তেমন কোন দায়িত্ব নেই বলে তখন হাজারো ভাব মনে জাগতে পারে।

কিন্তু হাত যখন কলম দিয়ে লেখে তখন মন এ কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, মুখ যখন বক্তৃতা করে অথবা কান যখন বক্তৃতা শুনে তখন মন এ কাজেই শরীক থাকে। তাই আপনাকে হিসাব করতে হবে যে, আপনার দেহ যে কাজ করছে সে কাজে মনের দায়িত্ব কতটুকু আছে। যে কাজের সময় মন বেকার থাকে তখন তাকে কাজ দেয়া প্রয়োজন। তা না হলে আপনার অজান্তেই ইবলিশ তাকে বাজে কাজে বেগার খাটাবে। এটাই মানব জীবনের বিরাট এক সমস্যা। মন অত্যন্ত শক্তিশালী যন্ত্র। এর যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা অসীম। কাজ ছাড়া এক মুহুর্তও সে থাকতে পারে না। তাকে সব সময়ই কাজ দেওয়ার যোগ্যতা অনেকেরই নেই। ফলে আপনার এ মূল্যবান কর্মচারী ইবলিসের বেগার খাটে।

আপনার দেহ কোথাও বসে বা দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বা পায়চারী করে কাটাতে হচ্ছে। একা একা পার্কে বা রাস্তায় ভ্রমণ করছেন। যানবাহনের অপেক্ষায় স্টেশনে বসে বা ডিউটিতে দাঁড়িয়ে আছেন। যানবাহনে চুপচাপ বসে আছেন বা বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। দৈহিক পরিশ্রম করার পর ক্লান্তি দূর করার উদ্দেশ্য বসে বা শুয়ে আছেন,অথবা ঘুমের কামনায় বিছানায় চোখ বুজে পড়ে আছেন। এমন বহু সময় রোজই আমাদের জীবনে কেটে যায় যখন সচেতনভাবে আমরা মনকে কোন বিশেষ চিন্তায়, ভাবনায় বা পরিকল্পনা রচনায় ব্যবহার করি না। মনকে আমরা এভাবে যখনই বেকার রেখে দেই তখন সে ইবলিশের বেগার কর্মচারীতে পরিণত হয়।

এর প্রতিকার হিসাবে রাসূল (সা) একটি ইতিবাচক ও একটি নেতিবাচক উপদেশ দিয়েছেন। নেতিবাচক উপদেশটির সারমর্ম হলো, তোমরা আল্লাহকে লজ্জা কর। মনে এমন ভাব আসতে দিওনা, যা আল্লাহ অপছন্দ করেন। আল্লাহ মনের গোপন ভাবও জাননে। তাই এ কথা খেয়াল রাখবে যে, এমন কথা আমি মনে কী করে স্থান দিতে পারি, যা আমার মনিব অপছন্দ করেন? এভাবে লজ্জাবোধ করলে মনকে বাগে রাখা যায়।

আর ইতিবাচক উপদেশ হলো জিহ্বাকে সব সময় আল্লাহর যিকরে চলমান রাখ। মনে খারাপ ভাব আসতে না দিলে মুখের যিকর মনকে যিকরে মশগুল রাখবে। অর্থাৎ মন ও মুখ কোনটাই খালি রাখা নিরাপদ নয়। মুখের যিকর মনকে যিকর করতে সাহায্য করে। মনকে দেওয়ার মতো কোন কাজ না থাকলে তাকে যিকরে ব্যস্ত করে দিতে হবে এবং এ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য মুখেও যিকর জারী করা দরকার।

যিকরের ব্যাপারে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হাদীসে শুধু ‘আল্লাহ,আল্লাহ’ যিকরের কোথাও শিক্ষা দেয়া হয়নি। আল্লাহ শব্দের সাথে আল্লাহর কোন একটি গুণ থাকা দরকার। যেমন -সুবহানাল্লাহ,আল-হামদুলিল্লাহ,আল্লাহু আকবার, লা- ইলাহা ইল্লাহ ইত্যাদি। বুখারী শরীফের শেষে একটি চমৎকার তসবীহ শেখানো হয়েছে। রাসূল (সা) বলেন, ‘দুটো বাক্য এমন আছে যা মুখে উচ্চারণ করা খুব সহজ, কিন্তু দাঁড়িপাল্লায় বেশ ভারী এবং আল্লাহর নিকট বড় প্রিয়’ তাহলো -‘সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহী সুবাহানাল্লাহিল আযীম।’

কতক বাস্তব পরামর্শ:

খালি মনকে ব্যস্ত রাখার জন্য আমার ব্যাক্তিগত দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে কতক পরামর্শ পেশ করছিঃ

১. সব সময় সব অবস্থায় ইসলামী বই সাথে রাখুন, যখনই মন অবসর হয়ে যায়, ঐ বই পড়ুন। এটা যিকর থেকেও বেশি কার্যকর পন্থা। যিকরে মনোযোগের অভাব হতে পারে। পড়ার সময় তা হয়না। তাছাড়া সকল রকম নফল ইবাদতের মধ্যে দ্বীনের ইলম তালাশ করা শ্রেষ্ঠতম।

২. অনেক সময় বই পড়ার পরিবেশ বা সুযোগ থাকে না। তখন কয়েকটি কাজ করতে পারেনঃ

(ক) কুরআন মাজীদের মুখস্থ করা সূরাগুলো আওড়াতে থাকুন। পরিবেশ অনুকুল থাকলে গুনগুন করেই পড়ুন।

(খ) কালেমা তাইয়্যেবা, তিন তাসবীহ,দরুদ বা যে কোন যিকর মুখে ও মনে জপতে থাকুন।

(গ) আপনার করণীয় কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে করার পরিকল্পনা প্রসঙ্গে চিন্তা করুন। কারো সাথে আলোচনার কথা থাকলে বিষয়টি মনে মনে গুছিয়ে নিন।

(ঘ) নিঃশ্বাস টানার সময় সচেতনভাবে ‘লা-ইলাহা ‘এবং নিঃশ্বাস ছাড়ার সময় ‘ইল্লাল্লাহ’ নিঃশব্দে মনে মনে পড়তে থাকুন।

বই: বই মনটাকে কাজ দিন


পঠিত : ৭২৭ বার

মন্তব্য: ০