Alapon

ঢাকা শহরে রিক্সা বন্ধের সিদ্ধান্ত এবং আমার কিছু কথা...

গাজীপুর যেতে হবে। একদিকে জ্যামের ভয়, অন্যদিকে রিক্সাওয়ালাদের অবরোধ। দুই ভয় একত্রিত হয়ে মহা ভয়ে রূপ নিল। সেই ভয় নিয়ে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু সেই কাকডাকা ভোরে বেরিয়েও শেষ রক্ষা হল না। রিক্সাওয়ালাদের চলমান আন্দোলনের কারণে বাস যোগে গাজীপুর যাওয়া সম্ভব হল না।

আজকের এই ব্লগ পোস্টে রিক্সাওয়ালাদের চলমান আন্দোলন নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।

প্রথমত, ঢাকার প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে রিক্সা বন্ধ করার এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। পত্রিকা মারফত জেনেছিলাম, এমন একটি সিদ্ধান্ত বছর দুয়েক আগেও নাকি নেওয়া হয়েছিল। তৎকালীণ ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হকের উদ্যোগে এই সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের কার্যকারিতা খুব একটা দেখা যায়নি। তাই দিন যাওয়ার সাথে সাথে এই সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়ন করার তাড়ানা হাওয়ার সাথে মিলিয়ে যায়।

বর্তমানে ঢাকা শহর জুড়ে মেট্টো রেলের কাজ চলায় জ্যামের মাত্রাটি অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছে গেছে। আমার ধারণা, এ কারণেই দুই বছর আগের রিক্সা বন্ধের সিদ্ধান্তটি কার্যকর করার চেষ্টা করা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, রিক্সা ঢাকা শহরে জ্যামের অন্যতম কারণ হলেও একমাত্র কারণ নয়। রিক্সাওয়ালারা সুযোগ পেলেই রাস্তার মাঝখান দিয়ে রিক্সা চালিয়ে যায়। নিজেদের মধ্যে ওভারটেকিং করে, যার কারণে বড় যানবাহনগুলো নির্বিগ্নে চলতে পারে না, এটাও সত্যি। সেজন্য রিক্সা পুরোপুরি বন্ধ করে না দিয়ে, সংখ্যা নিয়ন্ত্রন করা প্রয়োজন।

সরকারি এক হিসাবনুসারে দেখা যায়, ঢাকা শহরে সরকার অনুমোদিত রিক্সার সংখ্যা ৬০ থেকে ৮০ হাজার মাত্র। আর ঢাকা শহরে রিক্সা চলাচল করে ৬-৭ লাখ। এতো বিশাল সংখ্যক রিক্সা ঢাকা শহরে অবৈধভাবে চলাচল করে, এটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সরকার কারোরই অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশ যেভাবে মটর সাইকেলের কাগজ এবং লাইসেন্সের ব্যাপারে তৎপর, ততোটা তৎপর রিক্সার ব্যাপারে নয়। তাই অবৈধ রিক্সা বন্ধ করার ব্যাপারে ট্রাফিক পুলিশকে কখনোই আন্তরিক দেখা যায়নি। অবৈধ রিক্সার দৌরাত্য এতোটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, এখন মটর লাগানো রিক্সা ঢাকা শহরে দিব্যি চলাচল করছে। পুলিশের ভাবসা দেখে মনে হচ্ছে, সে যেন কিছুই দেখে না। আর এসবই রিক্সা, ভ্যান ও শ্রমিকদের সমিতির পাওয়ার।
যাইহোক, অবৈধ রিক্সা নিয়ন্ত্রন করার জন্য সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। না হলে সরকারের এই উদ্যোগ ভেস্তে যেতে সময় লাগবে না।

তৃতীয়ত, ঢাকা শহরের জ্যামের অন্যতম কারণ অবৈধ পার্কিং। অবৈধ পার্কিংয়ের বহর সকালবেলা থেকে দুপুর বেলা দেখা যায়, ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি স্কুল কেন্দ্র করে। প্রতিটি স্কুলের সামনে বাবা-মায়েরা প্রাইভেট কার নিয়ে তাদের সন্তানের জন্য অপেক্ষা করে। আর তাদের এই অপেক্ষার দরুন বলির পাঠা হচ্ছে সাধারণ জনতা। তাদের ঘন্টার পর ঘন্টা জ্যামে বসে থাকতে হচ্ছে।

তাই এই অবৈধ পার্কিং বন্ধে সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কোনো স্কুলের সামনে কোনো অভিভাবক প্রাইভেট কার নিয়ে অপেক্ষা করতে পারবে না। যদি, করতেই হয় তবে স্কুলের নিজস্ব পার্কিং প্লেস রাখতে হবে। নগরীর চলমান এই অবস্থায় যেকোনো অভিভাবকই চিন্তায় থাকবে। সেই চিন্তা থেকে তারা সন্তানদের স্কুলে নিয়ে আসে, অপেক্ষা করে, তারপর স্কুল থেকে বাসায় নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে স্কুলগুলোকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রতিটি স্কুলের বাধ্যতামূলক স্কুল বাস থাকতে হবে। বাচ্চাদের বাড়ি থেকে স্কুল এবং স্কুল থেকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত সমস্ত দায়দায়িত্ব স্কুলকে বহন করতে হবে। তাহলে হয়ত, বাবা মায়েরা স্কুলের সামনে এভাবে প্রাইভেট কার নিয়ে অপেক্ষা করবে না।

চতুর্থত, এক শ্রেণীর মানুষ বলছেন যে, রিক্সা বন্ধ করলে রিক্সাওয়ালারা না খেয়ে মরে যাবে। আমি এই কথার সাথে সচেতনভাবে দ্বিমত করছি। না খেয়ে মরার কথা তখনই আসবে যখন আয় ইনকাম করার কোনো সুযোগ থাকবে না।

একটা ছোট্ট ঘটনা বলে শেষ করছি। মাস ছয়েক আগে, বিকেল বেলা আব্বাকে নিয়ে হাটতে বের হয়েছি। কমলাপুর স্টেডিয়াম পার হচ্ছি, এমন সময় এক রিক্সাওয়ালা এসে আব্বার হাত চেপে ধরলেন। আমি চিনতে না পারলেও আব্বা ঠিকই চিনলেন। এই লোকটি একসময় আমাদের রাইস মিলে কাজ করতো। তখন দৈনিক মজুরি পেত ৫০০ টাকা। এখন ঢাকায় এসে দৈনিক ইনকাম করে ৭০০-৮০০ টাকা।

এই ২০০-৩০০ টাকা ইনকাম বেশি করার জন্য মফস্বল এবং গ্রামগুলো থেকে শতশত মানুষ প্রতিদিন ঢাকা শহরে প্রবেশ করছে। অন্যদিকে গ্রামে ধানের মৌসুমে ধান মাড়াই করবার শ্রমিক নেই। দৈনিক ৭০০ টাকা মজুরি দিয়েও ধান কাটার জন্য শ্রমিক পাওয়া যায় না। তখন বাধ্য হয়ে কেউ কেউ নিজের ছেলেদের নিয়ে ধান কাটতে নেমে পড়েছিলেন।

এখন আশা করি বুঝতে পারবেন, কেন আমি দ্বিমত পোষণ করছি। জ্যাম নিয়ন্ত্রনে সরকারের এই সিদ্ধান্ত সত্যিই প্রশংসা করার মত। কিন্তু রিক্সা মালিক এবং চালকদের চলমান এই আন্দোলন নিয়ন্ত্রনে প্রশাসন ও সরকারকে খুব একটা আন্তরিক দেখা যাচ্ছে না। হতে পারে, কতক মানুষের স্বার্থের কারণে এই উদ্যোগটিও ভেস্তে যাবে! মন থেকে আশা করছি, এমন যেন না হয়। বাকিটা সময়ই বেলে দেবে...

পঠিত : ১০০১ বার

মন্তব্য: ০