Alapon

ইংরেজদের বিদায়ের ৭২ বছর পরও নিজেকে ঔপনিবেশিক দাস-ই মনে হয়!

১৯৪৭ সাল! সমস্ত আয়োজন শেষে ইংরেজরা উপমহাদেশ ছাড়তে যাচ্ছে। উপমহাদেশ ছাড়ার আগে ইংরেজদের মধ্যে একজন মন্তব্য করেছিল, ‘আমরা ভারত ছাড়ছি ঠিকই! কিন্তু আমরা এমন ব্যবস্থা করেছি, জন্ম উপমহাদেশে হলেও চাল-চলন হবে ইংরেজদের মত।’

পরাজিতরা সবসময় বিজয়ী দ্বারা প্রভাবিত হয়। বিজয়ীর চোখে পৃথিবীকে দেখে। ইংরেজদের ২০০ বছরের শাসন আমাদের এতোটাই হীণমন্যতায় পর্যবুসিত করেছে যে, এখন আমাদের নিজস্বতা বলতে কিছুই নেই। থাকলেও আমাদের চোখে সেগুলো পুরনো! এমনকি মুখের ভাষাটাও! এখন মাতৃভাষার সাথে যে যতো বেশি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতে পারবে, সে ততো বেশি শিক্ষিত! বাস্তবিক অর্থে সমাজ তাকে সম্মানও করে। আর এটি হয়েছে হীনমন্যতা থেকেই।

আজকের ইংরেজি মিডিয়ামের একজন শিক্ষার্থী এবং বাংলা মিডিয়ামের কোনো শিক্ষার্থীর মধ্যে যদি তুলনা করা হয়, কবে জাতি এবং সমাজ ইংরেজি মিডিয়ামের শিক্ষার্থীকেই অধিক প্রাধান্য দিবে। এর কারণ শুধু এটাই নয় যে, সে ইংরেজিতে পারদর্শী; বরং হীনমন্যতার দরুন আমরা এভাবে চিন্তা করি।

আজকের সমাজে লুঙ্গি পরা লোক দেখলে নাক ছিটকাই! প্রচলিত পোষাক পাঞ্জাবী, পায়জামা পরে আজকাল নাকি কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়া যায় না। সেখানে যেতে হলে স্যুট, টাই পরে যেতে হবে। স্যুট, টাই যে ভদ্রতার মানদন্ড, এই চিন্তা এসেছে দাসত্বের মনোভাব থেকে। দাসত্বের মনোভাব নিজস্বতা বলতে সবকিছু ধ্বংস করে দেয়। সেই দাসত্ত থেকে আজ অবধি আমরা ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। ইংরেজি মিডিয়ামের জন্য আজও ব্রিটিশ কাউন্সিল প্রবর্তিত সিলেবাস অনুসরণ করা হয়। ব্রিটিশ কাউন্সিল প্রবর্তিত এ-লেভেল., ও-লেভেল মেনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। অথচ, স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের নিজস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার কথা ছিল। কিন্তু আমরা দাসত্বে এমনভাবে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছি যে, সাবেক প্রভুদের রেখে যাওয়া শিক্ষা ব্যবস্থাকেই সবচেয়ে উত্তম বলে স্বীকার করছি। অথচ এই শিক্ষা ব্যবস্থাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঔপনিবেশিক দাসে পরিণত করছে।

শুধু কি শিক্ষাখাতে! আমাদের দাসত্ব বিরাজ করছে, সৌন্দর্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও। আজ আমাদের চোখে সুন্দর বলা হয় তাকেই যে, ফর্সা! আমাদের সমাজে ফর্সা মানেই সুন্দর। আপনার মনে হতে পারে এটি খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। কিন্তু এটি কোনো স্বাভাবিক বা সাধারণ কোনো বিষয় নয়। এটিও ঔপনিবেশিক দাসত্বের বহিঃপ্রকাশ। দাসত্বের বহিঃপ্রকাশ। আমাদের সাবেক প্রভুরা শিখিয়ে গেছে, শ্বেতাঙ্গ মানেই সুন্দর। আর কৃষ্ণ বর্ণ মানেই অসুন্দর এবং অকল্যাণ!

প্রভুদের রেখে যাওয়া সেই ধ্যান ধারণা আজও আমরা লালন করে যাচ্ছি। কেউ বিবাহ-শাদি করতে গেলে প্রথমে জিজ্ঞেস করে, মেয়ে ‘সুন্দর’ কিনা! এই সুন্দর অর্থ মেয়ে ফর্সা কিনা। এর অর্থ ফর্সা মানেই সুন্দর।

ইংরেজ প্রভুরা বিদায় নিয়েছে আজ প্রায় ৭২ বছর আগে। কিন্তু আজও আমরা চিন্তা এবং বিশ্বাসের দিক থেকে স্বাধীন হতে পারিনি। আজও আমরা চিন্তার দিক থেকে ঔপনিবেশিক দাসত্ব করে যাচ্ছি। ইংরেজদের শেখানো ভালোকে ভালো বলছি, আর তাদের দেখানো খারাপকে খারাপ বলছি! তাই আমার নিজেকে স্বাধীন মনে হয় না। নিজেকে এখনও ঔপনিবেশিক দাসই মনে হয়।

পঠিত : ২৭৪৭ বার

মন্তব্য: ০