Alapon

মানুষের দোষ ত্রুটি না খুঁজে সালামের প্রসার ঘটান।


সুরাতুন নিসা কুরআনের মাদানি সূরাগুলোর মাঝে অন্যতম দীর্ঘ একটি সূরা। এটি কুরআনের চতুর্থ সূরা। এই সূরায় আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা অনেক সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন। রাসুলুল্লাহ (স) এর গোটা মাদানি জিন্দেগীর সবচেয়ে জটিলতম সমস্যাগুলোর একটি ছিল মুনাফিকদের সাথে আচরণ করার সমস্যা। এই সূরার ৬০ এর অধিক আয়াতে ক্রমাগতভাবে কীভাবে এই সমস্যা মোকাবেলা করা হবে তার দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এই সূরায় অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলা হয়েছে, কিন্তু এটি অন্যতম জটিল একটি বিষয়।

আর এই সমস্যা মোকাবেলা করার পাশাপাশি আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা এই দলের বিরুদ্ধে কঠিন কঠিন বিধান এবং আয়াত অবতীর্ণ করেন। আমরা দোয়া করছি, আল্লাহ যেন আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত না করেন। উদাহরণস্বরূপ, আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা বলেছেন - "ইন্নাল মুনা-ফিকিনা ফিদ দারকিল আস্ফালি মিনান না-র।" কোন সন্দেহ নেই মুনাফিকরা দোজখের আগুনের সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করবে। (৪ঃ১৪৫)

আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা যেহেতু মুনাফিকদের সম্পর্কে এভাবে বলেছেন এবং তিনি যেহেতু তাদের উপর খুব রাগান্বিত তাই আমরা ধারণা করি, আমাদেরও উচিত তাদের উপর রাগান্বিত হওয়া। আমি সর্বপ্রথম এ ধারণার সংশোধন করতে চাই। আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লার রাগ হওয়া এটি একমাত্র তাঁর অধিকার। তিনি কারো উপর রাগান্বিত হলে এটা বুঝায় না যে, আমারও সেই ব্যক্তির উপর রাগান্বিত হওয়ার অধিকার রয়েছে। আমরা কারো সম্পর্কে কিরূপ মনোভাব পোষণ করবো এবং আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লার কি অধিকার রয়েছে তার মাঝে পার্থক্য রয়েছে।

আমরা যেন ব্যাপারটা সহজে বুঝতে পারি তাই একটি উদাহরণ দিচ্ছিঃ

রাসুলুল্লাহ (স) নাজরানের খ্রিস্টানদের ইসলামের দাওয়াত প্রদান করেন। তখন তাদের একদল প্রতিনিধি নবুয়তের ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখার জন্য মদিনায় আগমন করে। সে সময় তো আর মদিনাতে হোটেল ছিল না। তাই তাদেরকে মসজিদে নববীতে অবস্থান করতে দেয়া হয়। এই খ্রিস্টানরা খুব ধর্মানুরাগী ছিল। তারা খ্রিস্ট ধর্ম সম্বন্ধে ভালো জ্ঞান রাখতো আর তারা ঈসা (আ) এর উপাসনা করতো। মদিনায় অবস্থানকালে উপাসনার জন্য তাদের জন্য বিশেষ কোন জায়গা ছিল না। তাহলে, ধারণা করুন তারা কোথায় যীশু খ্রিস্টের উপাসনা করেছিল? মসজিদে নববীর ভেতর। এটা ঐ সময়টাতে ঘটে যখন তারা মদিনায় অবস্থান করে এবং রাসুলুল্লাহ (স) এর সাথে আলোচনা চালিয়ে যায়।

ঐ সময়টাতে সূরা মারিয়ামের শেষের দিকের কিছু আয়াত আলোচনা করা হয় এবং আলে ইমরানের কিছু আয়াত অবতীর্ণ হয়। বস্তুত, সূরা মারিয়ামের কিছু কিছু আয়াত ইতিমধ্যে অবতীর্ণ হয়ে গিয়েছে যেখানে আল্লাহ বলেন - আর তারা বলে, 'পরম করুণাময় সন্তান গ্রহণ করেছেন।’ অবশ্যই তোমরা এক জঘন্য বিষয়ের অবতারণা করেছ। (১৯:৮৮-৮৯)

কুরআন মাজিদের সবচেয়ে ক্রুদ্ধ আয়াতগুলোর কিছু আয়াত এমন সব মানুষের বিরুদ্ধে নাজিল করা হয়েছে যারা বলে আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন। এটা আল্লাহর নিকট মারাত্মক আপত্তিকর কেউ যখন এমন কথা বলে। কিন্তু তাঁর রাসুলের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, তিনি এই মানুষগুলোর বিরুদ্ধে স্পষ্টত কোন রাগ প্রকাশ করছেন না। তারা মসজিদে নববিতে অবস্থান করছিল এবং সেখানে তাদের উপাসনা করছিল।

তাহলে এটা কীভাবে সম্ভব? আল্লাহ এই মানুষগুলোর উপর রাগান্বিত কিন্তু তাঁর রাসুল তাদের উপর রাগান্বিত নন। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

মুনাফিকদের সম্পর্কে কথা বলার পূর্বে আপনাদের বোঝার জন্য আরেকটি উদাহরণ দিচ্ছি। আমার অনেকগুলো সন্তান রয়েছে। একজন কোন একটা অন্যায় করে বসল। আমি তাকে বকা দিতে লাগলাম। ধরুন, আমার বড় মেয়েকে বকা দিচ্ছিলাম। তো, যখন আমি তাকে বকা দিতে লাগলাম সেসময় আমার ছোট ছেলে এসে বড় মেয়ের দিকে আঙ্গুল তুলে বলল, "হ্যাঁ, আমিও তোমার উপর রাগান্বিত।"

তৎক্ষণাৎ আমি আর আমার মেয়ের উপর রাগ ঝাড়বো না, আমি রাগান্বিত হব আমার ছোট ছেলের উপর। "তুমি এখানে রাগ দেখাচ্ছ কেন? এটা তো তোমার স্থান নয়। আমি আমার অবস্থান থেকে রাগ করতে পারি, আমি এই বাড়ির কর্তা। আমার যখন রাগ করার অধিকার থাকে, সেটা আমার জায়গা থেকে আমি দেখাতে পারি। তোমার তো আমার পদমর্যাদা নেয়ার অধিকার নেই।" তখন সে বলল, "আমি ভেবেছিলাম আপনি যেহেতু রাগান্বিত আমারও রাগ দেখানো উচিত।" সে তার সীমানা অতিক্রম করছে। এটা সীমা অতিক্রম করা আচরণ।

আমাদের বুঝতে হবে, আল্লাহর রাগ হওয়া আল্লাহর অধিকারে। এটা তাঁর অধিকারে। তিনি যেভাবে ইচ্ছা তাঁর বান্দার সাথে আচরণ করবেন। এটা আমাদের কাজ নয়। অন্য মানুষদের বিরুদ্ধে আল্লাহর রাগ ঝাড়া আমাদের কাজ নয়।

তাই আপনি যখন মুনাফিকদের সম্বন্ধে নাজিল কৃত কোন আয়াত শুনেন, তখন হয়তো ভাবেন আমাদেরও তাদের প্রতি রাগ দেখানো উচিত। যেহেতু আল্লাহ তাদের উপর রাগান্বিত আমাদেরও উচিত তাদের প্রতি রাগান্বিত হওয়া।

এই পার্থক্যটা আল্লাহ তাঁর রাসুলকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। মুনাফিকদের নেতা আব্দুল্লাহ ইবেন উবাই - যে রাসুলুল্লাহ (স) এর জন্য বহু সমস্যা তৈরি করেছিল, যে ছিল মন্দদের মাঝে সবচেয়ে মন্দ ব্যক্তি - সে মারা গেল। তার মৃত্যুর পর রাসূলুল্লাহ (স) নিজে তাঁর জানাজার নামাজ পড়ান। তিনি জানাজার নামাজের ইমামতি করেন। এরপর কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হয় - وَلَا تُصَلِّ عَلَىٰ أَحَدٍ مِّنْهُم مَّاتَ أَبَدًا وَلَا تَقُمْ عَلَىٰ قَبْرِهِ - "আর তাদের মধ্য থেকে কারো মৃত্যু হলে তার উপর কখনও নামায পড়বেন না এবং তার কবরে দাঁড়াবেন না।" (৯:৮৪)

কিন্তু তিনি নামাজ পড়ানোর পূর্বে আয়াত অবতীর্ণ হয়নি। তিনি নামাজ পড়ানোর পর আয়াত অবতীর্ণ হয়। আল্লাহ যদি চাইতেন রাসুলূল্লাহ (স) মুনাফিক নেতার জানাজার নামাজ পড়াবেন না, তাহলে তিনি আগেই আয়াত নাজিল করতে পারতেন। কোন সমস্যা হত না। কিন্তু আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা নামাজ পড়ানো পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। কেন? কারণ একমাত্র আল্লাহ জানেন কারা মুনাফিক। এমনকি স্পষ্ট কারণ বর্তমান থাকেলও আমি আপনি কারো প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলতে পারি না এই হল একজন মুনাফিক বা স্পষ্টত এই লোকের ঈমান নেই।

বিশেষ করে নিফাক তথা কপটতার অবস্থান হল অন্তরের গহীনে। "ফি- কুলুওবিহিম মারাদুন" তাদের অন্তরে রোগ রয়েছে। হার্ট এমন এক জায়গা যেখানে আমার আপনার প্রবেশাধিকার নেই। আমরা নিজেদের অন্তরের খবরও পুরোপুরি জানি না। নিজেদের অবস্থান নিয়েও আমরা নিশ্চিত নই। কীভাবে আমি আপনি অন্য একজনের অন্তরের বিচার করবো? আমি আপনি যা দেখি তা হল, মানুষের আচরণ। আমরা কেবল বাহ্যিক ব্যাপারগুলো দেখতে পারি। আমাদের পক্ষে ভেতরের অবস্থা জানার কোন উপায় নেই। আর বাহির এবং ভেতর সবসময় পরস্পর সংযুক্ত থাকে না। কখনো কখনো অবস্থা দৃষ্টে যা মনে হয় আসল ব্যাপার তা নয় বা আসল ব্যাপার বাহ্যিক অবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

- উস্তাদ নোমান আলী খান

পঠিত : ২০৩৭ বার

মন্তব্য: ০