Alapon

নাস্তিকতা ও আস্তিকতার সারকথা...


হুমায়ূন আহমেদ তাঁর আত্মজীবনীতে এক লোকের ইউটার্নের একটি ঘটনা উল্লেখ করেন।

“আমি একজন ঘোরতর নাস্তিককে চিনতাম, তার ঠোঁটে একবার একটা গ্রোথের মতো হলো। ডাক্তাররা সন্দেহ করলেন ক্যানসার। সঙ্গে সঙ্গে সেই নাস্তিক পুরোপুরি আস্তিক হয়ে গেলেন। তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে যান। বায়োপসির পর ধরা পড়ল গ্রোথের ধরন খারাপ নয়। লোকালাইজড গ্রোথ। ভয়ের কিছু নেই। অপারেশন করে ফেলে দিলেই হবে। সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক আবার নাস্তিক হয়ে পড়লেন। ভয়াবহ ধরনের নাস্তিক।” (হুমায়ূন আহমেদ, ছায়াসঙ্গী; পৃষ্ঠা ২১)

বিপদে পড়লে নাস্তিকরা আস্তিক হয়ে যাবার এমন অজস্র ঘটনা আছে। ড. মোহিত কামালের সাথে বাংলার নাস্তিকদের ‘ঠাকুরমা’ তসলিমা নাসরিন একবার সেন্টমার্টিন ঘুরতে যান। ফিরে আসার সময় যখন সমুদ্র অস্থির আচরণ শুরু করলো, সমুদ্রের ঢেউ এলোমেলোভাবে বিক্ষিপ্ত হতে থাকলো, তখন তসলিমা নাসরিন চিৎকার করে ‘আল্লাহ-আল্লাহ’ করতে থাকেন! (ড. মোহিত কামাল, মানব মনের গতিপ্রকৃতি; পৃষ্ঠা ৭১-৭২)

পবিত্র কুর’আনেও ইউটার্নের এমন কিছু ঘটনা দেখা যায়। সারাজীবন নিজেকে ‘খোদা’ বলে দাবী করা ফির’আউন যখন লোহিত সাগরে ডুবে যাচ্ছিলো, তখন আল্লাহর উপর ঈমান এনে বললো- আমি আল্লাহর উপর ঈমান আনলাম! এমন একটা দলের কথা আল্লাহ কুর’আনে উল্লেখ করেন যারা জলপথ পাড়ি দেবার সময় যখন বিপদে ছিলো তখন আল্লাহর উপর ঈমান এনেছিলো, আবার যখন তীরে ফিরলো তখন আল্লাহর সাথে শিরক করা শুরু করলো।

মানুষের এমন দ্বিমুখী স্বভাবের কথা উল্লেখ করে জসীমউদ্দীন লিখেনঃ
বিপদ কালেতে মোরা হাত জোড়া করি
বিপদ কাটিলে পুনঃ নিজ মুর্তি ধরি
অসময়তে চিকিৎসককে বন্ধু বটে কই
সুসময়ে দেখা হলে মুখ ফিরে লই ।

প্রত্যেকের মনের কোণে যদি একজন সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস থাকে, তাহলে তারা কেন তাঁকে অস্বীকার করে নাস্তিকতার পক্ষে প্রচারণা চালায়? এই প্রশ্নের উত্তর ‘অবিশ্বাসী কাঠগড়ায়’ বইয়ের লেখক রাফান আহমেদ দেন এভাবে- যারা নিজেদের নাস্তিকতা নিয়ে সংশয়ে ভোগেন, তারাই কেবল দিন-রাত ধর্মকে আক্রমণ করে বেড়ান; নিজের অবস্থান যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সেজন্য, যাতে তার বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয় সেজন্য।

‘অবিশ্বাসী কাঠগড়ায়’ বইটিতে লেখক নাস্তিকদের ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নগুলোর জবাব না দিয়ে প্রশ্নের উৎসমূলের দিকে নজর দিয়েছেন। যেমনঃ নাস্তিকরা বলে ধার্মিকরা অন্ধবিশ্বাসী, তারা প্রমাণ ছাড়াই কোনো কিছু বিশ্বাস করে। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে লেখক ডিফেন্সিভ এপ্রোচে উত্তর না দিয়ে প্রশ্নকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। অর্থাৎ, লেখক এটা প্রমাণ করতে যাননি যে, ‘না, ধার্মিকরা অন্ধবিশ্বাসী না’; বরং লেখক দেখিয়েছেন, নাস্তিকরা যে বলছে তারা বিজ্ঞান মানে, আচ্ছা বিজ্ঞান কি কোনো ক্ষেত্রে ‘অন্ধবিশ্বাস’ করে?

বইটিতে মূলত হুমায়ূন আজাদের ‘আমার অবিশ্বাস’ গ্রন্থের অপনোদন হলেও কেবল আমার অবিশ্বাসের পয়েন্ট ধরে ধরে উত্তর দেওয়া হয়নি; বরং লেখকের ব্যাপারে যেসব ‘মিথ’ প্রচলিত আছে সেগুলোর দিকেও আঙ্গুল তোলা হয়েছে। হুমায়ূন আজাদকে বলা হয় প্রথাবিরোধী লেখক। প্রথাবিরোধী বলতে আসলে কী বোঝানো হয়, আর হুমায়ূন আজাদের নিজস্ব সংজ্ঞানুযায়ী তিনি কতটুকু প্রথাবিরোধী হতে পেরেছিলেন? নাকি নিজের প্রথায় চক্রাকারে ঘুরছেন? সেটি লেখক তুলে ধরেছেন।

হুমায়ূন আজাদ ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু তার ধর্মীয় শিক্ষা কতটুকু? এই ধর্মীয় শিক্ষা তিনি কোথায় লাভ করলেন? কোনো শিক্ষকের কাছ থেকে নাকি কোনো বইপত্র পড়ে? বইপত্র পড়ে থাকলে বইগুলো কী মানের ছিলো? (হুমায়ূন আজাদের মতে উনি ধর্ম শিক্ষা লাভ করেছিলেন ‘নিম্নমানের’ বই পড়ে)
একটা বই রিফিউট করতে গেলে এটা জেনে নেওয়া আবশ্যক যে, যে বিষয়ে উনি লিখেছেন সেই বিষয়ে উনার জ্ঞানের পরিধি কতটুকু। যেমনঃ বাংলা ডিপার্টমেন্টে পড়া একজন যদি মেডিক্যালের গাইড বই লিখেন তাহলে তো তার বই কেউ পড়বে না, সে যদি এই তথ্যটি জানতে পারে। ঠিক তেমনি হুমায়ূন আজাদ যে ধর্ম নিয়ে এতো কথবার্তা বলেছিলেন, ‘তার ধর্মীয় জ্ঞান কতটুকু ছিলো’ এই প্রশ্নটি নিয়ে অনুসন্ধান চালান ‘অবিশ্বাসী কাঠগড়ায়’ বইয়ের লেখক।

হুমায়ূন আজাদ বিজ্ঞান নিয়ে আস্ফালন করলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় তিনি বিজ্ঞানীদেরকে তুলোধুনো করেন। সেইসব লিজেন্ডারি সাইন্টিস্টদের (যেমনঃ নিউটন, আইনস্টাইন) কেবল একটাই অপরাধ ছিলো, তারা ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। নিজের কথা যার সাথে মিলে যায় তাদের সাথে হুমায়ূন আজাদ করেছেন গলাগলি, যার সাথে নিজের কথা মিলে না তাকে করেছেন গালাগালি। হুমায়ূন আজাদের এমন অসংখ্য ডাবল স্ট্যান্ডার্ড এই বইটিতে আলোচনায় এসেছে।

‘অবিশ্বাসী কাঠগড়ায়’ বইটিতে লেখক রাফান আহমেদ হুমায়ূন আজাদকে বারবার বিভিন্ন কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। কখনো তাকে দাঁড় করিয়েছেন ইতিহাসের কাঠগড়ায়, কখনো দাঁড় করিয়েছেন বিজ্ঞানের কাঠগড়ায়, কখনো নৈতিকতার কাঠগড়ায় আবার কখনো হুমায়ূন আজাদের নিজের গড়া কাঠগড়ায়। আদালতে যেমন কোনো কিছু প্রমাণ করতে যুক্তি-প্রমাণ হাজির করতে হয়, এই বইয়েও লেখক রাফান আহমেদ হুমায়ূন আজাদের যুক্তির অসারতা প্রমাণ করতে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেছেন। হুমায়ূন আজাদকে জেরা (Cross-examination) করেছেন। আর রায় দেবার দায়ভার তুলে দিয়েছেন পাঠকের উপর। পাঠক তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে শাস্তি ঘোষণা করুক।

হুমায়ূন আজাদ ‘আমার অবিশ্বাস’ বইটি সাজান অনেক মিথ্যার ফুলঝুরি দিয়ে। লেখক রাফান আহমেদ হুমায়ূন আজাদকে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সেখানে ছড়ান সত্যের পুষ্পবৃষ্টি। যার ভারে নুইয়ে পড়ে মিথ্যে বালির বাঁধ। লেখক অজস্র সায়েন্টিফিক রিসার্চ আর হুমায়ূন আজাদের গুরুজনদের রেফারেন্স টেনে প্রমাণ করেছেন হুমায়ূন আজাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অসারতা। গতানুগতিক জবাব না দিয়ে লেখক এগিয়েছেন অ্যাকাডেমিক ওয়ে-তে। এতো এতো তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করে রাফান আহমেদ হুমায়ূন আজাদকে যেভাবে রিফিউট করেছেন, সেখানে একবারও দেখতে পাইনি রাফান আহমেদ ড. আজাদকে ইমোশনালি আঘাত (গালিগালাজ) করতে। এই বিষয়টা আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছে। রিফিউটেশনের বইগুলোতে যাকে রিফিউট করা হয় তাকে গালিগালাজ করতে হরহামেশা দেখা যায়। কিন্তু রাফান আহমেদ ছিলেন বেশ ব্যতিক্রম। যার কাছে এতো তথ্য-প্রমাণ আছে তাঁর গালিগালাজ করার কোনো দরকার আছে! ৩০০ পৃষ্ঠার একটা বইতে প্রায় হাজারখানেক রেফারেন্স! নিজের কথা না বলে লেখক কেবল সেইসব ব্যক্তিদের কথা এনেছেন যাদেরকে স্বয়ং হুমায়ূন আজাদ ‘আইডল’ মেনেছেন, যাদেরকে নিজের (ড. আজাদ) বই উৎসর্গ করেছেন।

সংগৃহিত...

পঠিত : ১৫৪৮ বার

মন্তব্য: ০